বর্তমান বিশ্ব দারুণ অস্থিতিশীল প্রকৃতি, প্রতিবেশ ও পরিবেশের ভেতর দিয়ে এগোচ্ছে। সারা পৃথিবীতে কোথাও কোনো শান্তি নেই। প্রত্যেকেই আজ বেপরোয়া ও উদ্ধত। আজকের দুনিয়ায় হয় কোনো রাষ্ট্র যুদ্ধাক্রান্ত, নয়তো দুর্বল বা শত্রু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিকল্পনায় রত। কোনো কোনো দেশ আবার প্রতিবেশী রাষ্ট্রের শরণার্থী সামাল দিতে গলদঘর্ম। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে অত্যন্ত দূরদর্শিতার সঙ্গে সবকিছু সামাল দিয়ে দেশকে ও দেশের মানুষের জীবনমান এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন আধুনিক সুখী-সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক জননেত্রী শেখ হাসিনা।
রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই শেখ হাসিনা ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ছুটে চলছেন। তাঁর পিতার মতো তিনিও নিরন্তর লড়াই-সংগ্রাম করছেন, বাংলার শোষিত-বঞ্চিত নিরন্ন মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য। একটা মানুষ যে কী পরিমাণ ত্যাগী আর দেশপ্রেমিক হতে পারেন যারা কাছ থেকে শেখ হাসিনাকে না দেখেছেন তাদের পক্ষে তা অনুধাবন করা পুরোপুরি সম্ভব নয়।
কে ভেবেছিল বাংলার রাজনীতি শেখ হাসিনার হাতে নবপ্রাণ লাভ করবে? তিনি নিজেও কোনোদিন স্বদেশ গড়ার এই স্বপ্ন দেখেছেন কিনা সে বিষয়ে সংশয় আছে। অথচ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন হওয়া বাংলা যখন দুঃসময়ের মুখোমুখি, সামরিক স্বৈরশাসক যখন কালো বুটের তলায় পিষ্ট করে চলেছে ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ, তখন সহায়-স্বজনহীন শেখ হাসিনা রাজনীতির মঞ্চে পা রাখেন। তাঁরই বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু হত্যার ২১ বছর পরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। শুরু হয় আওয়ামী লীগের নব উত্থান। ২০০১ সালে আবার আওয়ামী লীগ দিকভ্রান্ত হয়। ২০০৪ সালে শেখ হাসিনা গ্রেনেড হামলার শিকার হলে অনেক নেতাকর্মী নিহত ও আহত হন। ২০০৫ সালে শাহ এ এম এস কিবরিয়া গ্রেনেড হামলায় নিহত হন। ২০০৮ সালে পুনরায় বাংলার মানুষের নিরঙ্কুশ ভোটে ক্ষমতা পায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন দল। এখনও তারা ক্ষমতায় আছে।
আজ থেকে ৪৬ বছর আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ও আপামর জনতার স্বতঃ¯ফূর্ত ও সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা যাদের পরাজিত করেছি তারা অনুকূল পরিবেশ পেয়ে এই ৪৬ বছরে অসামান্য শক্তি সঞ্চয় করেছে। বিশেষ করে ’৭৫ পরবর্তী কালপর্বে সামরিক শাসন এবং তাদের মদদপুষ্ট রাজনৈতিক দলের সাহায্য-সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা এম.পি, মন্ত্রী হয়েছে। এমনকি রাষ্ট্রপতি পদেও আসীন হয়েছে। তারা বিচ্ছিন্ন হয়নি, বরং প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নিজেদের অবস্থান সংহত করার জন্য তারা সুদূরপ্রসারী ও সুচতুর পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়েছে। অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসনÑ সবক্ষেত্রেই তারা মারাত্মক শক্তি অর্জন করেছে। ভোটের রাজনীতিতেও তারা আজ ‘ফ্যাক্টর’ হিসেবে বিবেচিত। সাধারণ মানুষের সমর্থন তাদের প্রতি ততটা জোরালো না হলেও তাদের মূল উৎপাটন মোটেই সহজ কাজ নয়। দেশের মধ্যে যেমন, তেমনি দেশের বাইরেও তাদের মিত্র ও মুরুব্বি আছে। যেমনটি ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে।
শেখ হাসিনা ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। অনেকেরই এই বিষয়টি ভালো লাগছে না। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যারা বিশ্বাসী নয় তাদের চোখে এটা মোটেই সহ্য হচ্ছে না। ইদানীং বাংলাদেশে কিছু সুজন জন্মেছে, এদের কাজ শুধু কূজন করা। এদের লোকসংখ্যার চেয়ে কণ্ঠের আওয়াজ বেশি। পত্র-পত্রিকায় এদের ছবি দেখা যায়, জোরালো কণ্ঠ শোনা যায়। দুর্ভাগ্য আমাদের! এই কণ্ঠগুলো দেশপ্রেমের চর্চা করে যদি দুঃখ ও অপমান সহ্য করতো তাহলে সান্ত¦না থাকতো। তারা শুধু উপদেশ ও জ্ঞান দিয়ে বেড়ান। কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেনÑ ‘গুরুদেব (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) আমাকে একবার বলেছিলেন, ‘বাইরের ল্যাজ কাটা সহজ কিন্তু মনের ল্যাজ কাটবে কে?’
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো পার্টির পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের ধারা অব্যাহত রাখা আপাতত সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে শুরু থেকে ষড়যন্ত্র চলেছে এখনও চলছে। অনেকেই আওয়ামী লীগ ছেড়ে গেছে, আবার অনেকে এসেই ভিড়েছে আওয়ামী লীগের ছায়াতলে। যারা আওয়ামী লীগ থেকে চলে গেছে তারা নিজেদের কপাল নিজেরাই পুড়িয়েছে। এদেশে ছোট ছোট পার্টির কিছু বড় বড় নেতা আছেন, যারা সুযোগ বুঝে দল ও ভোল পাল্টান। এদেরকে দেশ-জাতি সনাক্ত করেছে। এদের কথায় এখন এদেশের মানুষ ভুলে না। আগামী দিনে এরা জাতীয় শত্রু বলেই বিবেচিত হবে।
বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে কিছুতেই সেক্যুলার ধারার বাইরে যেতে দেওয়া ঠিক হবে না। আজ সেক্যুলার ভারতে বিজেপি ক্ষমতায়। এর প্রধান কারণ কংগ্রেসের দুর্বলতা। কংগ্রেসের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার জন্যই আজ আরএসএসের প্রতিনিধি কট্টর বিজেপি ভারতের রাষ্ট্র ক্ষমতায়। যদি জিন্নাহর চামড়ার নিচে পরীক্ষা করা যেতো তাহলে দেখা যেতো তার চামড়ার নিচে মুসলমানিত্ব ছিল। তদ্রƒপ নেহেরুর চামড়ার নিচেও ছিল হিন্দুত্ব। আসলে দু’জনেরই সাম্প্রদায়িক মন ও ধর্মনিরপেক্ষ মুখ ছিল, ভারত বর্ষের এই রাজনৈতিক মহাপুরুষেরা যদি সত্যিকার সেক্যুলার হতেন তাহলে ভারত ভাগ হতো না। ভারত ও বাংলাদেশে এত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও জাতিগত বিদ্বেষও মাথা চাড়া দিয়ে উঠত না। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে আজ ‘ট্রু সেক্যুলার’ হতে হবে। তা না হলে মৌলবাদী গোষ্ঠীর থাবা থেকে বাংলাদেশকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। এ জন্য যত কৌশল প্রয়োগ করা দরকার শেখ হাসিনার সরকারকে তা-ই করা উচিত। একটি কথা মনে রাখতে হবেÑ সাধারণ মানুষ ধর্ম পালন করে, হজ্জ্ব ও বিশ্ব ইজতেমা তাঁর প্রকৃষ্ট প্রমাণ কিন্তু তারা মৌলবাদী নয়।
বিএনপি আজ বাংলাদেশে মৌলবাদীদের তোষণ, সীমাহীন দুর্নীতি আর মানুষ হত্যার রাজনীতির কারণে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। দেশের মানুষ ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করছে বিএনপির জামায়াত ঘেঁষা পলিসি। বেগম জিয়ার দুই পুত্রের সীমাহীন অর্থলিপ্সা ও স্বেচ্ছাচারী আচরণ, হাওয়া ভবন কেন্দ্রিক দুর্নীতি বিএনপির মুখে চুনকালি লেপে দিয়েছে। সেই সঙ্গে জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া বাধা তাদেরকে রসাতলের শেষ স্তরে নিয়ে গেছে। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থেকে গণভবনে নয়, ক্যান্টনমেন্টে থাকতে পছন্দ করতেন। রাজাকারদের মন্ত্রী বানাতে গর্ববোধ করতেন। বাংলাদেশবিরোধী শক্তির সঙ্গে আঁতাত করতে তার জুড়ি মেলা ভার। এগুলো বাংলার মানুষ ভুলে যায়নি। কোনোদিন ভুলে যাবে বলেও মনে হয় না। মুক্তিযুদ্ধের কালপর্বে তিনি কোথায় ছিলেন? কেন ছিলেন?
জেনারেল জিয়া রাজাকারদের পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে নাগরিকত্ব প্রদান করেছিলেন, স্বামীর ফিরিয়ে আনা রাজাকারদের মন্ত্রীর পদ দিয়ে তাদেরকে আঁচলতলে পুষে রেখেছেন খালেদা জিয়া। জিয়া ও খালেদা জিয়া শুধু মুক্তিযুদ্ধকেই অস্বীকার করেছেন এমন নয়, তারা তলে তলে পাকিস্তানি ভাবধারাকেই উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছেন। তবে এটাও ঠিক শুধু মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের সমালোচনা করলেই হবে না আওয়ামী লীগের ভেতরেও শুদ্ধতার চর্চা করতে হবে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে আওয়ামী লীগের মধ্যেও কম আবর্জনা জমেনি। এগুলো এখন পরিষ্কার করার সময় এসেছে। দলের মধ্যে যেসব দুর্বৃত্ত, ধান্ধাবাজ, টেন্ডারবাজ ও সুযোগসন্ধানীরা রয়েছে তাদেরকে এখনি বিতাড়ন করা দরকার। এদের কোনোক্রমেই ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না। বঙ্গবন্ধু তাঁর শাসনামলে দল থেকে দুর্বৃত্ত ও দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গকারীদের বিতাড়িত করে দলকে অনেকটাই সংহত করেছিলেন। শেখ হাসিনাকেও দলীয় স্বার্থে কঠোর হওয়া জরুরি। তবে এটাও ঠিক শেখ হাসিনাই সেই সাহসী নেতা যিনি দলীয় এম.পি. ও মন্ত্রীকে অন্যায়ের জন্য বহিষ্কার করতে পারেন। সাম্প্রতিক কিছু বহিষ্কারের ঘটনা সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে, ভবিষ্যতে জনগণ অনুরূপ শুদ্ধি অভিযান আশা করে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নির্বাচনমুখী দল। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হলে মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করতে হবে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যেভাবে বাংলার মানুষ আওয়ামী লীগকে ভালোবেসে ভোট দিয়েছিল সেভাবে আবার গণজোয়ার সৃষ্টি করতে হবে। নৌকায় যেসব পালকাটা ইঁদুর আছে সেগুলো নৌকা থেকে বাছাই করতে হবে। ঘরে ও বাইরে শত্রু রেখে সামনের দিকে এগিয়ে চলা সম্ভব নয়। ভাবমূর্তি নষ্ট করে এমন কাউকে দলে প্রশ্রয় দেওয়া হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। অন্যায়কারী ও অপরাধী যেই হোক আওয়ামী লীগে তাকে ঠাঁই দেওয়া মোটেই ঠিক হবে না। মানুষ স্বভাবতই লোভী। লোভের কারণে যারা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে তাদের চিহ্নিত করতে হবে এবং দল থেকে বহিষ্কার করতে হবে। যারা হত্যাকারী ও সন্ত্রাসী বলে পরিচিত, যারা মাদকব্যবসায়ী ও মানবপাচারকারী তাদেরকেও শাস্তি দিতে হবে। মাঠ পর্যায়ের ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করে হাইব্রিডদের পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পত্র-পত্রিকায় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের নামে যেসব অভিযোগ উঠছে তাদের বিরুদ্ধে এখনি কঠোর না হলে পরিণাম ভালো হবে না। বিপদ আসার আগেই সাবধান হওয়া ভালো। পরাজিত হয়ে আত্মসমালোচনা না করে, পরাজয়ের আগেই ত্রুটি বিচ্যুতি-সংশোধন করা বুদ্ধিমানের কাজ। অন্য কোনো দলের সাহায্য নিয়ে নয়, আওয়ামী লীগকে একা-একাই ৫১ শতাংশ ভোট ও ৫১ শতাংশ আসন পেয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার কৌশল নিতে হবে। আওয়ামী লীগ এখন সাবালক রাজনৈতিক দল। একে এখন নিজের দু’পায়ে দাঁড়ানো শেখা দরকার। পোলিও আক্রান্ত আওয়ামী লীগ নয়, বাংলাদেশকে গড়তে হলে সবল আওয়ামী লীগ তৈরি করতে হবে।
শেখ হাসিনা শক্ত হাতেই আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের হাল ধরেছেন। বর্তমান সরকার ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ হাতে নিয়েছে। দেশ তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উন্নীত হয়েছে নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশে। অচিরেই পরিণত হবে মাধ্যম আয়ের দেশে। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন শুধু আর স্লোগান নয়Ñ বাস্তব বিষয়। মৌলবাদ রুখে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও অগ্রগতির সঙ্গে একাকার হয়ে আছে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাÑ এটা যতদিন না বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পারবে ততদিন বাংলাদেশের কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না। সেই জায়গাটাতেই অতন্ত বুদ্ধিমত্তা ও সাহসের সঙ্গে হাত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের ভাগ্য একই সূত্রে গাঁথা। উন্নয়নশীল বাংলাদেশের ভার শেখ হাসিনার হাতেই থাকুক, সুখে-শান্তিতে-নিশ্চিন্তে থাকুক বাংলার মানুষ। আজকের শেখ হাসিনা শুধু বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়কই নন, তিনি একজন রাজনীতিপ্রাজ্ঞ বিশ্বনেতাও।
২২ জানুয়ারি, ২০১৭