আওয়ামী লীগকে কেন ভোট দিতে হবে
মোনায়েম সরকার
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এ বছরের শেষে অনুষ্ঠিত হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে নানান রকম হিসাব-নিকাশ। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে জোট করে ভোট করার প্রবণতা বাংলাদেশেও চালু হয়েছে। সমমনা দলের সঙ্গে জোট গঠন খারাপ কিছু নয়, নির্বাচনী কৌশল হিসেবে এটাকে বাঁকা চোখেও দেখার কিছু নেই। গণতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন মেনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা এটা ব্যক্তি বা দলের নাগরিক অধিকার।
সরকার গঠন ও সরকার পরিবর্তনে ভোটের গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা যদি সবাই নিজেদের বুদ্ধি-বিবেচনা খাটিয়ে সৎ-যোগ্য ও দেশপ্রেমিক জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করি, উন্নয়নমুখী রাজনৈতিক দলকে দেশ-পরিচালনার দায়িত্ব দিই, তাহলে দেশ সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যায়। এর অন্যথা হলেই দেশে দেখা দেয়া রাজনৈতিক সংকট জনজীবনে নেমে আসে দুর্ভোগ ও দুর্দশা। এ কথার প্রমাণ বিগত দিনের সামরিক সরকার (জিয়া-এরশাদ সরকার) প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদ শাসন (বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার) ও সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনকাল উল্লেখ করা যেতে পারে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে আমরা দেশের স্বাধীনতা পেয়েছি। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর দেশে যে অগণতান্ত্রিক শাসনের ধারা সূচিত হয়, তার অবসান ঘটানোর জন্য, জনগণের ভোটের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশের গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল শক্তিকে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম করতে হয়েছে। বাঙালিশ্রেষ্ঠ বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হলেও আওয়ামী লীগ শাসনক্ষমতায় থাকার সুযোগ পেয়েছে খুব কম সময়ই। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মাত্র সাড়ে তিন বছর ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। ওই সময় যুদ্ধ-বিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশ পুনর্গঠনের জটিল কাজটি অত্যন্ত সফলভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিল। সে অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে রাজনীতির গতিমুখ পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছিল। তারপর দীর্ঘ ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সুযোগ পায়। সেবার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও সাহসী কাজ করেছিল। বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচার কাজ শুরু করে বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছিল। এ ছাড়াও পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর, গঙ্গার পানিবন্টন চুক্তিসহ দীর্ঘদিনের জিইয়ে থাকা বেশ কিছু সমস্যা সমাধানের যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তারপরও ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পুনরায় নির্বাচিত হতে পারেনি। তুলনামূলকভাবে ভালো শাসন উপহার দিয়েও সেবার নির্বাচনে জয়ী না হওয়া অপ্রত্যাশিতই ছিল। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের অপশাসন-কুশাসনে অতিষ্ট দেশবাসী পরের নির্বাচনে আবার সঠিক রায় দিতে ভুল করেনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ার সুযোগ পায়। দেশ গড়ার কাজে মন দেয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। ধীরে ধীরে দেশ এগিয়ে যেতে থাকে। এক দশকেই উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে সারা বিশ্বে স্বীকৃতি পায় বাংলাদেশ।
২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোটের সেই বিভীষিকাময় শাসনামলের কথা চিন্তা করলে সত্যিই শরীরে শিউরে ওঠে! বিএনপি-জামায়াতকে সঙ্গে নিয়েই ‘সোনার বাংলা’ ধ্বংসের মিশনে নেমেছিল। ক্ষমতা হারানোর পরও জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধই আছে বিএনপি। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষ নেতার দ- হওয়ায় দেশের ভেতর জামায়াত-শিবির যে তা-ব চালায়, সেই নারকীয় তা-বের সঙ্গে কেবল একাত্তরের দুঃসময়েরই তুলনা করা চলে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির কাছ থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পাওয়া যায়নি। বরং জামায়াতের রাজনীতি ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার অবস্থান অত্যন্ত পীড়াদায়ক।
রাজাকার-আল-বদর ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে অনেকের মুখে অনেক রকম সমালোচনা শোনা যায়। বলা হয়, এটা নাকি মতলবের বিচার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে ব্যবসা ইত্যাদি। এসব কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলা কথা এটাই যে, গত ৪৭ বছরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দল কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কি? ৪৭ বছরের অধিকাংশ সময় যারা বাংলাদেশের ক্ষমতায় থেকেছে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কোনো উদ্যোগ নেয়নি কেন? কারণ একটাই। আওয়ামী লীগই একমাত্র দল যে কিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে। সেই জন্যই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নানা প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে এতদিন পর ক্ষমতায় এসে একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে এবং তাদের শাস্তি কার্যকর করে ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি রয়েছি, যারা মনে করি বাংলাদেশের জন্ম না হলে আমরা আজকের এই অবস্থায় পৌঁছাতে পারতাম না। তারা নৌকা ছাড়া আর কোন প্রতীকে ভোট দেব? আওয়ামী লীগ ছাড়া কাকে দেব দেশ শাসনের ভার? যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলাদেশের মানুষের জীবনে নিঃসন্দেহে একটি শ্রেষ্ঠ ঘটনা। শ্রেষ্ঠ পাওয়া।
’৭৫-পরবর্তী প্রজন্মকে ভুল ইতিহাস শিক্ষা দিয়ে পাকিস্তানি ভাবধারায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। নতুন প্রজন্মকে বোঝানো হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যা ঘটেছিল তা সব সত্য নয়। এমনকি আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে মনগড়া ইতিহাস রচনা করে এ যুগের নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার হীন প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। আর এটা সম্ভব হয়েছে দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে ছিল বলে। নির্বাচনকে সামনে রেখে এখনই কেউ কেউ আমাদের অতীত ভুলে সামনে তাকাতে বলছেন। বলছেন, নতুন ধারার রাজনীতির কথা ভাবতে। কিন্তু আমরা কি করে ভুলব মুক্তিযুদ্ধের কথা, কীভাবে ভুলব ত্রিশ লক্ষ শহীদের কথা? কি করে ভুলব রাজাকার-আলবদরদের নৃশংসার কথা, জাতির শ্রেষ্ঠসম্পদ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা। আমাদের পক্ষে বিএনপি-জামায়াতের অপশাসন ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর পাকিস্তানি স্টাইলে সংখ্যালঘুদের উপর জুলুম-নির্যাতন, তাদেরকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইউনুস, আওয়ামী লীগ নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টার, মঞ্জুরুল ইমাম, সাবেক অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শাহ এ এম এস কিবরিয়া, চট্টগ্রামের গোপাল কৃষ্ণ মুহুরিকে নির্মমভাবে হত্যা এবং প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদের উপর হামলা ঘটনা কি ভুলে যাওয়া যায়? বানিয়ার চর গির্জায় হামলা, যশোরের উদীচীর অনুষ্ঠান, ময়মনসিংহের সিনেমা হল, সিপিবির জনসভা, পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলের অনুষ্ঠানসহ ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বোমা-গ্রেনেড হামলা করে আমাদের প্রিয় স্বদেশকে এক অন্ধকার মৃত্যু-উপত্যকা বানানোর স্মৃতি কী এত সহজেই ভোলা যায়?
২০০১-এ ক্ষমতায় এসেই বিএনপি-জামায়াত তিন মাসে পাঁচশ’র কাছাকাছি মন্দির ধ্বংস করে। শ’য়ে শ’য়ে নারীকে ধর্ষণ করে, জেএমবি, হরকাতুল জিহাদের মতো জঙ্গি দলের উত্থান ঘটায়, এক যোগে বোমা হামলা চালায় ৬৩টি জেলায়। বাংলার মানুষ ইচ্ছে করলেও সেই ভয়াবহ দুঃসময়ের স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলতে পারবে না। ভুলে যেতে পারবে না হাওয়া ভবন, খোয়াব ভবনের লুটেরা তথা তারেক-কোকো-মামুনের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের ঘটনা। এদেশের মানুষ বিএনপির শাসনামলে জঙ্গি সংগঠন জেএমবি’র পৃষ্ঠপোষক এসপি মাসুদ মিয়া ও বাংলা ভাইয়ের তা-ব বিস্মৃত হয়নি। ভুলে যায়নি এসপি কোহিনূরের আইনবহির্ভূত আচরণের কথাÑ যে কিনা রাজপথে জাতীয় নেতাদের পিটিয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল।
বাংলাদেশ এক সময় ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে বিশ্বে পরিচিত ছিল। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে পাঁচ-পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে ব্যর্থ রাষ্ট্রের খ্যাতি পেয়েছিল। জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে দুর্বার বেগে এগিয়ে যাচ্ছে। কৃষিতে, যোগাযোগ ব্যবস্থাপনায়, শিল্পে, শিক্ষায়, তথ্য-প্রযুক্তিতে, নারীর ক্ষমতায়নে, রক্তাক্ত সবুজ পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায়, আইনের শাসন বাস্তবায়নে, মানবতা-বিরোধী অপরাধীদের বিচার ও জঙ্গি দমনে বিশ্বের দরবারে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। বিগত এক দশকে সারাদেশে নজিরবিহীন যে উন্নয়নমূলক কর্মকা- হয়েছে তা কেবল খাতা-কলমের উন্নয়ন নয়, বাস্তবেও তা দৃশ্যমান।
ষোলো কোটি মানুষের এই ছোট্ট দেশে উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা দিতে যে জাদুর কাঠির প্রয়োজন তা কেবল আওয়ামী লীগের হাতেই আছে। তাই চলমান উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে আওয়ামী
লীগকেই আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনা দ্বিধায় বিজয়ী করতে হবে। তাই আসুন, সকল রকম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, মান-অভিমান পরিহার করে ’৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনের মতো জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান তুলে আগামী নির্বাচনে নিজে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ তথা নৌকা মার্কায় ভোট দিই এবং অন্যকেও একই সিদ্ধান্ত নিতে অনুপ্রাণিত করি।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
০১ নভেম্বর, ২০১৮