• 23 Chamelibagh, Dhaka-1217
  • +88-02-9333543
  • bfdrms@gmail.com
In Publication

কী হবে যদি আঁধার নেমে আসে?

কী হবে যদি আঁধার নেমে আসে?

মোনায়েম সরকার
পৃথিবীর মানচিত্রে এক দুর্ভাগ্য পীড়িত জাতির নামÑ বাঙালি জাতি। এ জাতির মতো আর কোনো জাতি এত নির্যাতন আর নিপীড়ন ভোগ করেনি। বাঙালি জাতির ভাগ্যে সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয় না। যারা এই নিরন্ন জাতির জন্য অন্নের ব্যবস্থা করেছে, পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেÑ তাদেরকেই বাঙালিরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। বাঙালি গরিব বলেই এদের লোভ বেশি। লোভের ফাঁদে এরা খুব দ্রুতই ধরা দেয়। তাই বিদেশি শাসক-শোষকেরা লোভের ফাঁদে ফেলে বার বার বাঙালিকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ পেয়েছে। এখনো বাঙালিকে লোভ ও লাভ দেখিয়ে যেকোনো কাজ করানো দুঃসাধ্য নয়।
লোভী বাঙালির সামনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই প্রথম পুরুষÑ যিনি প্রধানমন্ত্রিত্বের লোভ দু’পায়ে মাড়িয়ে বাঙালির স্বাধিকারের জন্য দুর্বার সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন এবং সেই মরণপথ সংগ্রামে তিনি সফল হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আপসহীন নেতা, তিনি যা বলতেন সরাসরি বলতেন। কারো রক্ত চক্ষুকে তিনি কখনো ভয় পান নাই। শ্মশান বাংলাকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু সেই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করার সময় তিনি পাননি, তার আগেই লোভী ঘাতকের দল সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধুর মতো জনপ্রিয় নেতা বাংলার ইতিহাসে আর কখনো আসেনি বললে বেশি বলা হয় না। অথচ তিনি যখন নিহত হলেন তখন বাংলাদেশ নির্জীব হয়ে গিয়েছিল। রাস্তায় কোনো মিছিল হলো না, কেউ কোনো প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করল না, বরং অনেকেই সেদিন ঘাতক দলের অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য ঘাতকদের সঙ্গে অন্ধকারে হাত মিলিয়ে ছিল।
আজ আমার বলতে দ্বিধা নেই, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকা- শুধু একটি হত্যাকা-ই নয়Ñ একটি স্বাধীন অসাম্প্রদায়িক জাতিকে পরাধীন ও সাম্প্রদায়িক করার পাশবিক চক্রান্তও বটে। আমরা যদি যৌক্তিক বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখবো একটি জাতিকে পরাধীন করা এবং সেই জাতিকে সাম্প্রদায়িক করে তোলা বর্তমান সা¤্রাজ্যবাদের নতুন কৌশল। সুতরাং যারা সা¤্রাজ্যবাদী এবং সা¤্রাজ্যবাদের ক্রীড়নক তারাই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী।
বঙ্গবন্ধু আমলে বাংলাদেশ ছিল একটি ধ্বংসস্তূপ। সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে বঙ্গবন্ধু তাঁর নেতৃত্বের দূরদর্শিতায় বাংলাদেশকে টেনে তোলেন। জিডিপি নিয়ে যান ৭.৫ শতাংশে। যা আমরা এখনও কল্পনা করে শিউরে উঠি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পরে বাংলাদেশ থমকে গিয়েছিল। বজ্রাহত মানুষের মতো হয়ে গিয়েছিল বাংলার শোকাহত মানুষ। সেদিন শোকে-দুঃখে পুরো জাতি পাথর হয়ে গিয়েছিল। সেই মৃত পাথরে ধীরে ধীরে আজ প্রাণ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে।
আজ বঙ্গবন্ধুর নামে ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়েছে। এখন মুখে মুখে উচ্চারিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর নাম। এটা এক অর্থে ইতিবাচক হলেও মুজিব প্রেমের গভীরতা যাচাই করা দরকার আছে বলেই আমি মনে করি। যারা সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার লোভে ‘জয় বাংলা’ ও ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে তাদের লোক দেখানো মুজিবপ্রেম বস্তুত কোনো কাজের কথা নয়, কেননা দলের দুঃসময় এলেই তারা দল ত্যাগ করে কেটে পড়বে। মুখে তখন অন্য স্লোগান ধরবে। বলতে দ্বিধা নেই আজ আওয়ামী লীগের স্লোগান দেওয়ার অনেক মানুষ থাকলেও এরা কয়জন সত্যিকারের আওয়ামী লীগার ও মুজিব আদর্শে বিশ্বাসী, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার অনেক কারণ আছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর ৪৪ বছর অতিবাহিত হচ্ছে। এই ৪৪ বছরে আওয়ামী লীগ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে সে বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রত্যেকটি নেতাকর্মীকে আত্মসমালোচনা করা দরকার। বঙ্গবন্ধু বার বার তার ভাষণে নেতাকর্মীদের আত্মশুদ্ধি ও আত্মসমালোচনা করার কথা বলতেন। সে সময়ের অনেক লড়াকু নেতাই পরে ভোল পাল্টিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন। অনেকেই বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর উল্টাপাল্টা কথা বলেছিলেন অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর সামনে যারা বিড়াল হয়ে বসে থাকতেন তার অবর্তমানে তারাই বাঘ হয়ে আবির্ভূত হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর বাংলার রাজনৈতিক আকাশে অপরাজনীতির কালো মেঘ জমেছিল। ’৭৫-পরবর্তীকালে এদেশের বুকে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা নিষিদ্ধ ছিল। তবু বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী কিছু মানুষ মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে গোপনে গোপনে চালিয়েছে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রচার-প্রচারণা। লড়াই করেছে মুজিববিরোধী শিবিরের সঙ্গে। আজ যারা বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে অতি উৎসাহী সেদিন তারা কোথায় ছিলেন? তাদের অনেককেই সেদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি। আজ সেই স্মৃতি হয়তো ইতিহাসের মলিন কাহিনীমাত্র। কিন্তু একদিন এই মলিন স্মৃতিগুলোই ছিল বাস্তব সত্য। আজ যারা নব্য আওয়ামী লীগার, তাদের হয়তো অনেকেরই জানা নেইÑ সেই দুঃসহ দিনের সঠিক ইতিহাস। আজ আওয়ামী লীগের আকাশ থেকে কালো মেঘ কেটে গেছে, দিন বদলে গেছে আওয়ামী লীগের। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এখন স্বর্ণযুগ পার করছে। চতুর্দিক থেকে দলছুট নেতাকর্মীরা এসে আওয়ামী লীগে ভিড় জমাচ্ছে। কেউ দলের পদ-পদবি পাচ্ছে, কেউ কেউ এই সুযোগে সীমাহীন দুর্নীতি করে দলের মুখে চুনকালি মাখাচ্ছে। এ বিষয়ে এখনি আওয়ামী লীগের প্রধানকে সাবধান হওয়া দরকার। আমি মনে করি তিনিও এ বিষয়ে সজাগ আছেন। দলীয় ভাবমূর্তি নষ্ট করে যারা ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতে চায়Ñ তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে।
পূর্বেই বলেছি আজ বঙ্গবন্ধুর নামে ইতিহাসে নতুন অধ্যায় সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রমাণ হিসেবে অনেক তথ্যই উপস্থাপন করা যায়। যেমনÑ প্রতিদিনই বিভিন্ন গণমাধ্যম কর্মী আমাদের বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনে এসে তথ্য সন্ধান করছেন। পিএইচ.ডি. ডিগ্রি প্রত্যাশী কয়েকজন গবেষকও ইতোমধ্যে আমাদের ফাউন্ডেশনে এসে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে গেছেন। অনেকে ফোন, ইমেইল ও অন্যান্য মাধ্যমে যোগাযোগ করছেন। এই যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা এটা এক অর্থে ভালো দিক। আবার অতি উৎসাহী মূর্খরা এমনভাবে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন করছেন দেখে লজ্জায় মরে যাই, আমার মনে আছেÑ নেতাজি সুভাষ বসুর নামে একটি বিড়ি বের হয়েছিল, যারা ওই কাজ করেছিল তারা বুঝেনি নেতাজি সুভাষ বসু বিড়ির মডেল হতে পারেন না। তার মূল্য নির্ধারণ করা অত সহজ ব্যাপার নয়, আজ বঙ্গবন্ধুর বিষয়েও আমাদের ভাবগাম্ভীর্য বজায় রাখা দরকার।
আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছেন। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে দলীয় নেতাকর্মীরা কিছুটা বেপরোয়া ও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে উঠেন এটাই স্বাভাবিক। দলীয় নেতাকর্মীদের বেপরোয়াভাব দমন করতে না পারলে ভবিষ্যতে দলকে কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে তাকালেই এটা পরিষ্কার বোঝা যায়। দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্ধত আচরণ দল ও দেশের জন্য কোনোক্রমেই কাম্য নয়। দলীয় যেসব নেতা-কর্মী ও মন্ত্রী-এমপির গায়ে দুর্নীতির দুর্গন্ধ আছে, সেসব নেতাকর্মীকে দ্রুত দল থেকে বিদায় করতে হবে এবং ত্যাগী ও আদর্শবান নেতাকর্মী নিয়ে দল ও সরকার পুনর্গঠন করতে হবে। যে আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে বাংলার মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে সেই আকাক্সক্ষায় কিছুতেই চিড় ধরানো ঠিক হবে না। গণমানুষের প্রত্যাশা আওয়ামী লীগকেই বাস্তবায়ন করতে হবে। আজ সারাদেশেই ব্যাপক উন্নতি হচ্ছে, এরপরেও কেন সরকারের প্রতি মানুষের বিরূপ ধারণা তৈরি হচ্ছে সেটা পুনর্মূল্যায়ন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। ত্যাগী ও আদর্শবান নেতাকর্মীরাই দলের সম্পদ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, এটা নিঃসন্দেহে আশা জাগানিয়া ব্যাপার। সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ দরকার। লোভী মানুষ দিয়ে সোনার বাংলা গড়া যাবে না। আজ যারা আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণ করছেন তাদের অনেকেই বলছেন আগস্টের ষড়যন্ত্র শেষ হয়নি, এখন ‘প্রাইম টার্গেট’ শেখ হাসিনা। তাই যদি হয়, তাহলে এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের কি করা উচিত সেটা ভেবে দেখতে হবে। আবার যদি ১৫ আগস্ট নেমে আসে, আবার যদি অন্ধকারে ছেয়ে যায় পুরো বাংলাদেশÑ সেদিনের অবস্থাও কি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মতোই হবে? নাকি সেদিন আদর্শকর্মী ও জনতা মিছিল নিয়ে রাস্তায় নেমে আসবে, ঘাতকের বিচার দাবি করবে? আদর্শ ছাড়া দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা করা যায় না। আজ আওয়ামী লীগের অনেকের নামেই অনেক কুকথা শোনা যাচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষ বিরক্ত হচ্ছে। মানুষের বিরক্তি উৎপাদন করে দল টিকিয়ে রাখা যায় না। আমরা প্রত্যাশা করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও সাংস্কৃতিক শুদ্ধতা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে এগিয়ে যাবেন।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
১৯ আগস্ট, ২০১৯

Leave a Reply

Send Us Message

*

You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>