১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্টে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃত দিয়ে তিনি যে ঔদার্য প্রদর্শন করেছেন, এ জন্য বাংলার মানুষ চিরদিন তাঁকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির রক্ত আর ভারতবাসীর রক্ত মিশে এক পবিত্র বন্ধন রচনা করেছে। আমরা দুই দেশ রক্তের বাঁধনে বাঁধা। শুধু তাই নয়Ñ মুক্তিযুদ্ধকালীন আটানব্বই লক্ষ নিরানব্বই হাজার তিনশত পাঁচজন শরণার্থীকে আশ্রয় ও খাদ্য দিয়ে যেভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাঙালি জাতির জীবনে তা অমলিন হয়ে থাকবে। আমি বাংলাদেশের ষোলো কোটি মানুষের পক্ষ থেকে আজ জন্মশতবর্ষে ইন্দিরা গান্ধিকে শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। বাঙালির প্রতি তার যে অসীম ভালোবাসাÑ সেই অসীম ভালোবাসার প্রতি ঋণ স্বীকার করছি। ১৯৭৫ সালের পরে আমি তিনবার ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ তাদের ১৬৯ জন প্রতিনিধির মধ্যে ১৬৭ জন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীকে নির্বাচিত করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক আমলাতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠী জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বানের পরিবর্তে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) লক্ষ লক্ষ মানুষের বিশাল সমাবেশে বলেনÑ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ইউনোস্কর বিশ্ব ঐতিহ্যে তালিকায়, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে পরিণত হয়েছে। এই দুই অর্জনই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বকালেই অর্জিত।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়ার নির্দেশে ঢাকাসহ সাবেক পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান মিলিটারি নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে। তারা অগ্নিসংযোগ লুণ্ঠন ও মানুষের ক্ষতি সাধন করে। সে-রাতেই বঙ্গবন্ধু ইপিআর-এর ওয়্যারলেসের ডিকোডেড মেসেজের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। তার আহ্বানে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে পশ্চিম পাকিস্তানি কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও বাঙালি সেনারা ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়াসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করে সশস্ত্র লড়াই শুরু করে। ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে শেখ মুজিবুর রহমান প্রেরিত নির্দেশকে ভিত্তি করে ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথমে আওয়ামী লীগের আবদুল হান্নান কালুরঘাটে স্থাপিত বেতার কেন্দ্রের বেলাল মোহাম্মদ, আবুল কাশেম সন্দীপ এবং ২৭ মার্চ তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে সাক্ষাতের পর ১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ গণপরিষদের নির্বাচিত সদস্যগণের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি (ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি), তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমদ, এম. মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানকে মন্ত্রী করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করা হয়। অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এমএজি ওসমানী এমএনএ-কে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। ঘোষণার এক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী মুজিবনগরে (তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার পরিবর্তিত নাম) ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ শেষে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে মন্ত্রিসভার সদস্যদেরকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।
১৯৭১-এর মে মাসে কলকাতার ৮নম্বর থিয়েটার রোডে প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান দপ্তর স্থাপন করা হয় এবং ৫৭/৮ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে এমএনএ আবদুল মান্নানের পরিচালনায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয়।
১৯৭১-এর ৭-১২ জুলাই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের অধিনায়কত্বে যুদ্ধ পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ১৯৭১-এর ১০ আগস্ট সামরিক শাসক ইয়াহিয়া (ঈগখঅ) কর্তৃক বিশেষ সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রহসনমূলক বিচারের ঘোষণা দেওয়া হয়।
১০ আগস্ট সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিচারের প্রহসনের বিরুদ্ধে ভারত ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিশ্বের অন্যান্য স্থানে প্রতিবাদ ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবি উত্থাপিত হয়। ১৫ আগস্ট চট্টগ্রাম, মংলা ও চাঁদপুর বন্দরে বাংলাদেশের নৌ-কমান্ডোদের গেরিলা আক্রমণে ৯টি পাকিস্তানি জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ১৯৭১-এর ২৩ নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর সাফল্যে ভীত হয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা জারি করে। বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে যেমন : কমলপুর, নকশী, ধলই, জয়মনিরহাট, পটিয়া বাজার, সালদা নদী, বিলোনিয়া, রৌমারী ইত্যাদি এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান বাহিনীকে ক্রমাগত আক্রমণ ও পর্যুদস্ত করতে থাকে।
পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নৃশংস অত্যাচারে অবরুদ্ধ বাংলাদেশ থেকে নভেম্বরের শেষে ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় এক কোটি। মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গণহত্যা, নারী নির্যাতনসহ অন্যান্য ধ্বংসাত্মক কর্মকা- বেড়ে যায়।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সারা পৃথিবীর অনেক দেশ এবং মানুষ সক্রিয় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। সর্বোচ্চ সহায়তা প্রদান করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির নেতৃত্বে ভারত এবং পদগর্নির নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন।
১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর (বৈদ্যনাথতলায়) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ করে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (Proclamation of Independence) পাঠ করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী এমএনএ (মেম্বার অব ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি)। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ, অর্থ-বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী ক্যাপটেন (অব.) এম. মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্র, কৃষি-ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামান-কে নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। এছাড়া সংবাদপত্র, তথ্য ও বেতার চলচ্চিত্র বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয় এমএনএ আবদুল মান্নানকে।
১৯৭১-এর মে মাসে কলকাতার ৮নং থিয়েটার রোডে মুজিবনগর সরকারের প্রধান দপ্তর স্থাপন করা হয়। ৫৭/৮, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে এমএনএ আবদুল মান্নানের পরিচালনায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয়। ১২ জুলাই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জনসংযোগ ও দেশের প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ১১ জন নির্বাচিত সংসদ সদস্যকে আঞ্চলিক প্রশাসক নিযুক্ত করে।
১৯৭১-এর ২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সারাদেশে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচারে নিরাপরাধ মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে, গ্রাম ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে সীমানা পেরিয়ে ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিতে শুরু করে।
৩১ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান ও প্রতিরোধ তথা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন ও সহমর্মিতা ঘোষণা করেন।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দুর্গত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আবেদন জানান। ১৫-১৬ মে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধি পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামরাজ্যে আশ্রয়প্রার্থী লক্ষ লক্ষ বাঙালি শরণার্থীর দুঃখ-দুর্দশা সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। ভারতে ও বিশ্ববাসীর কাছে নিরাপরাধ মানুষের উপর পাকিস্তানি সামরিক জান্তার হত্যাযজ্ঞের চিত্র তুলে ধরেন।
১৩ আগস্ট মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সফর করেন এবং শরণার্থী-জনগণের দুর্দশা দেখে বলেন,
ÒIt is the greatest human tragedy of our time.Ó
পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নৃশংস অত্যাচারে অবরুদ্ধ বাংলাদেশ থেকে নভেম্বর মাসের শেষে ভারতে আশ্রিত শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১ কোটি। ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়। শরণার্থীরাও স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ফিরতে শুরু করেন।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ও জেলাভিত্তিক শরণার্থী পরিসংখ্যান
১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত
–
–
ক্রমিক রাজ্যের শিবির ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত শরণার্থী
নম্বর নাম সংখ্যা শিবিরের মধ্যে শিবিরের বাইরে মোট
১. পশ্চিমবঙ্গ ৪৯২ ৪৮,৪৯,৭৮৬ ২৩,৮৬,১৩০ ৭২,৩৫,৯১৬
২. ত্রিপুরা ২৭৬ ৮,৩৪,০৯৮ ৫,৪৭,০৯৮ ১৩,৮১,৬৪৯
৩. মেঘালয় ১৭ ৫,৯১,৫২০ ৭৬,৪৬৬ ৬,৬৭,৯৮৬
৪. আসাম ২৮ ২,৫৫,৬৪২ ৯১,৯১৩ ৩,৪৭,৫৫৫
৫. বিহার ৮ ৩৬,৭৩২ – ৩৬,৭৩২
৬. মধ্যপ্রদেশ ৩ ২,১৯,২৯৮ – ২,১৯,২৯৮
৭. উত্তরপ্রদেশ ১ ১০,১৬৯ – ১০,১৬৯
মোট : ৮২৫ ৬৭,৯৭,২৪৫ ৩১,০২,০৬০ ৯৮,৯৯,৩০৫
কেন ইন্দিরা গান্ধি আপামর বাঙালির ব্যথায় সাড়া দিলেন, কেন তিনি ঝুঁকি নিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সেই বিষযে কথা বলার আগে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে ইন্দিরা গান্ধির মানসগঠনের দিকে। তার পিতা প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ জওয়াহেরলাল নেহেরু, তিনি সাহচার্য পেয়েছেন কবি-দার্শনিক রবীন্দ্রনাথের, তাঁর রুচিবোধ তৈরি করেছিল ইউরোপীয় মানবিক উদারতা। প্রাচীন ভারতবর্ষের আরণ্যক ঋষিরা যেমন তার কাছে প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় ছিলেন, তেমনি তার মুগ্ধতা জাগিয়ে ছিল ইউরোপ। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের এই মেলবন্ধন ইন্দিরা গান্ধির মধ্যে এক অতুলনীয় সেতুবন্ধন তৈরি করেছিল বলেই তিনি মানুষের ব্যথায় ব্যথা অনুভব করতেন। ক্ষমাপ্রার্থীকে ক্ষমা করতে পারতেন এবং পীড়নকারীকে দিতে পারতেন কঠিন শাস্তি।
পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশ যখন যুদ্ধের মাঠে লড়ছে তখন নতুন করে হিসাব-নিকাশ কষতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও পাকিস্তান। এই ত্রিদেশীয় বিরোধিতা মোকাবিলা করতে ইন্দিরা গান্ধি হাত বাড়ান সোভিয়েট রাশিয়ার দিকে। কিভাবে সেদিন ইন্দো-সোভিয়েট চুক্তি করে ইন্দিরা বাংলাদেশকে স্বাধীনার পথে এগিয়ে দিয়েছিলেন এবং ভারতকেও ভয়ঙ্কর যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচিয়ে ছিলেন তার বিবরণ দিয়েছেন পুপুল জয়কর।
আসন্ন চীন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক কাতারে শামিল হওয়া এবং দু’জাতির মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে পাকিস্তানের ভূমিকা সম্বন্ধে ঝা’র প্রতিবেদনে ভারতের জন্য বিপদের ঝুঁকিগুলো তীব্রতর হয়ে ওঠে। যুধ্যমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, চীন ত্রয়ী ভারতের অখ-তার জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে দেখা দেয়। ত্বরিতগতিতে ইন্দিরা গান্ধি প্রয়োজন সিদ্ধ করেন। সোভিয়েতদের কাছে দূত পাঠানো হয় এবং শান্তি, বন্ধুত্ব আর সহযোগিতার ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তি যা আলোচনাধীন তবে স্থগিতাবস্থায় রাখা হয়েছে তা, আগস্ট মাসের মাঝামাঝি নাগাদ স্বাক্ষরিত হয়।
ইতিহাস যেমন নেতৃত্বের সৃষ্টি করে, নেতৃত্বও তেমনি ইতিহাস সৃষ্টি করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারা যেমন শেখ মুজিবুর রহমানকে ইতিহাসের মূলস্রোতে নিয়ে তাঁকে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা করেছে, ঠিক তেমনিভাবে শেখ মুজিবও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে তাঁর রাজনৈতিক সাধনা-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিয়ে গেছেন একটা পরিণতরূপে স্বাধীন বাঙালি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা পূরণ করে। তাই বাংলাদেশ ও বাঙালির অপর নামÑ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধুর মহিমা এখন বাংলাদেশ ছেড়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। সমগ্র পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে তার নাম।
একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো যেখানে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে যখন মহান ভারতের ঔদার্যে দেশের বির্ধ্বস্ত সেতু, সড়কপথ পুনরায় ব্যবহারের উপযোগী করা হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় কোষাগার যখন আক্ষরিক অর্থেই কপর্দকশূন্য, সেই সর্বশূন্য অবস্থা থেকে সংক্ষিপ্ততম সময়ের মধ্যে তিনি জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে উন্নীত করেছিলেন। এটি সম্ভব হয়েছিল তার প্রজ্ঞা, কঠোর পরিশ্রম এবং অকৃত্রিম ভালোবাসার জন্য। এই প্রবৃদ্ধির হার আজও বাংলাদেশের জন্য একটি ইপ্সিত লক্ষ্য।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন :
‘‘‘‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’
মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে বাংলার মাটি ও মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই সংশপ্তক, শত্রুর নিশ্চিত ফাঁসির মঞ্চ থেকেও বেরিয়ে এসেছিলেন, দেশ ও বিশ্ববাসীর দাবির মুখে বীরের বেশে। কিন্তু এই ভালোবাসার কাঙ্গাল মানুষটিকে, শেষ পর্যন্ত বুকের রক্ত দিতে হলো, বাংলার মাটিতে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায়, কতিপয় অবিমৃষ্যকারী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রের ষড়যন্ত্রে।
বঙ্গবন্ধুর ভাষায় :
‘সাত কোটি বাঙালির ভালোবাসার কাঙ্গাল আমি। আমি সব হারাতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারবো না। বাঙালির ভালোবাসার ঋণ বুকের রক্ত দিয়ে শোধ করবো ইন্শাল্লাহ।’
বঙ্গবন্ধু তার কথা রেখেছেন। এখন আমাদের ঋণ পরিশোধ করার পালা। বাঙালিশ্রেষ্ঠ বঙ্গবন্ধুর নামে ইতিহাসের নতুন অধ্যায় সৃষ্টি হয়েছে। আবহমান কালের প্রবহমান মানুষ তার নামে উদ্দীপ্ত হবে, অনুপ্রাণিত হবে, অনুরণিত হবে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে।
তদ্রƒপ ইন্দিরা গান্ধির নামও উচ্চারিত হবে সসম্মানে। তিনি শুধু দুনিয়ার বৃহদাকার গণতান্ত্রিক দেশের পার্লামেন্ট সরকার প্রধান ছিলেন না, মতিলাল নেহেরু ও জওয়াহেরলাল নেহেরুর মতো দুজন মহান নেতার গুণাবলির উত্তরাধিকারিণীও ছিলেন। আর এ জন্যই তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল দ্রুততম সময়ের মধ্যে যুদ্ধজয়ী ভারতীয় সেনাবাহিনীর বাংলাদেশ ত্যাগ। বঙ্গবন্ধু যেমন বাংলাদেশ ও বাঙালিকে বুকের রক্ত দিয়ে ভালোবেসে ছিলেন, ইন্দিরা গান্ধিও সেই একই কথা ব্যক্ত করছিলেন তার জীবনের শেষ ভাষণে।
আমি বেঁচে থাকব কি নাÑ পরোয়া করি না। আমি দীর্ঘজীবন লাভ করেছি এবং যদি আমি কোনোকিছু নিয়ে গর্বিত হই, তবে সেটা হল এই যে, আমি আমার জীবনের সবটুকু সেবাকর্মে কাটিয়েছি। আমি শুধু এটা নিয়েই গৌরব বোধ করি এবং অন্য কিছুতেই নয়। অধিকন্তু যতদিন পর্যন্ত আমার দম আছে ততদিন পর্যন্ত আমি সেবাকর্ম চালিয়ে যাব এবং যখন আমার জীবন চলে যাবে তখন আমি বলতে পারব যে, আমার প্রতিটি রক্তবিন্দু ভারতকে প্রাণসঞ্চার করবে, আর তাকে আরও শক্তিশালী করে তুলবে।
বাংলাদেশ এখন স্বাধীন দেশ। স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশকে ত্বরান্বিত করে ৬৭ বছর বয়সী ইন্দিরা গান্ধি বাঙালি জাতিকে চিরঋণে আবদ্ধ করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশ চিরজীবী হোক। চিরজীবী হোক আধুনিক ভারতের রূপকার প্রিয়দর্শিনী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধি।
১৯ নভেম্বর, ২০১৭