১১ নভেম্বর, ২০১৬ তারিখে ‘দৈনিক আমাদের সময়’-এ কবি ও সম্পাদক অমিত গোস্বামী ‘ভারতীয় ভিসা প্রাপ্তি নিয়ে টালবাহানা’ শিরোনামে একটি কলাম লেখেন। তার লেখা পড়ে এবং বাংলাদেশের মানুষের ভোগান্তির কথা স্মরণ করে আজকের এই লেখা লিখতে চাই। যারা ভারতের ভিসা পাওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ করেছেন বা আগামীতে দৌড়ঝাঁপ করবেন বলে মনে করেছেন এই লেখা তাদের জন্য একটু হলেও সাবধান হতে সাহায্য করবে। কয়েক মাস পূর্বে ‘ভারতীয় ভিসা সোনার হরিণ’ শিরোনামে আমি একটা কলাম লিখেছিলাম। এখন কতটা সহজ হয়েছে জানি না! তবে বিভিন্ন জায়গায় ভিসা সেন্টার খোলা হয়েছে।
ভারত বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ। বাংলাদেশ ভারতের কাছে জন্মসূত্রে ঋণী। বাংলাদেশের মাটিতে বাঙালির রক্ত আর ভারতবাসীর রক্ত মিশে একাকার হয়ে গেছে। দুটি দেশ মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে যেভাবে এক সাথে কাজ করেছে এবং এখনো ভারত যেভাবে বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বপূর্ণ মানসিকতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তা ভাবতে গেলে বিস্মিত হতে হয়। আমরা বাংলাদেশের পক্ষে থেকে চাই আমাদের এই দুই দেশের বন্ধন অটুট থাকুক।
২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মান্যবর নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে এসে বলেছিলেন, ‘জল, বায়ু ও পাখির কোনো ভিসা লাগে না।’ তাহলে মানুষের ভিসা লাগবে কেন? মোদি মহোদয়ের কথার সঙ্গে আমিও সম্পূর্ণ একমত। বর্তমানে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য ভারতের ভিসা পাওয়া ভোগান্তির চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক ভারতে যায়। এদের বেশির ভাগই যায় চিকিৎসা, তীর্থস্থান দর্শন, পড়াশুনা, কেনা-কাটা, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মিলিত হতে ও সভা-সেমিনারে যোগদান করতে। এ ছাড়া ভারত ভ্রমণ ও ব্যবসার উদ্দেশ্যেও অনেকে ভারত গমন করেন। যারা ভিসা নিয়ে ভারত যান তাদের প্রথমেই ই-টোকেন সংগ্রহ করতে হয়। এই কাজটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভিসা প্রার্থী নিজে নিজে করতে পারেন না। তাকে অবশ্যই দালাল বা অন্যকোনো মাধ্যমের সাহায্য নিতে হয়। ই-টোকেন সংগ্রহ করতে একজন ভিসাপ্রার্থীকে আড়াই থেকে পাঁচ হাজার টাকা গুণতে হয়।
ই-টোকেন পাওয়ার পর ভারতীয় ভিসা সেন্টারে গিয়ে লাইন ধরে একদিন পাসপোর্ট জমা দিতে হয়। জমাকৃত পাসপোর্ট আরেক দিন গিয়ে ফেরত আনতে হয়। যারা ভিসার জন্য পাসপোর্ট জমা দেয় তাদের সবার ভাগ্যেই ভিসা মেলে না। ভিসা পাওয়ার সকল শর্ত পূরণ করার পরেও ভিসা পায় না বেশিরভাগ মানুষ। নামের বানান ভুল, ঠিকানায় দাড়ি-কমার ভুল, ইত্যাকার টুকিটাকি ভুলের কারণে বেশিরভাগ ভিসা প্রত্যাশীকেই ভিসা দেওয়া হয় না। যা খুবই দুঃখজনক এবং ভোগান্তির বিষয়। একটি বিষয় লক্ষণীয় বাংলাদেশ থেকে যারা ভারতে যায়, তারা কেউই খালি হাতে যায় না। একেক জন বাংলাদেশি নাগরিক কমপক্ষে দুই হাজার ডলার নিতে পারে, এক থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা নিয়ে ভারতে যায় তাদের প্রয়োজনীয় কাজে। এই টাকাটা পুরোটাই ভারতে খরচ করে, অথচ ভিসা পাওয়ার বিষয়টি যদি আরো একটু সহজ হতো তাহলে ভারত আরো বেশি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতো, বাংলাদেশের মানুষও উপকৃত হতো।
বাংলাদেশ জনসংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র। ধর্মীয় কারণে কোরবানিসহ মুসলমানদের খাদ্য তালিকায় গরুর মাংস অগ্রগণ্য। শুধু খাদ্য হিসেবেই নয়Ñ কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে কৃষিতেও গরুর চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। ভারত ও নেপাল থেকে গরু আসে বলেই বাংলাদেশে গরুর চাহিদায় ভারসাম্য বজায় থাকে। কিন্তু ইদানীং উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। ভারত ও নেপাল থেকে পর্যাপ্ত গরু না পাওয়ায় বাংলাদেশ গো-সংকটে পড়েছে। ভারত যদি গরুর চোরাচালান বন্ধ করতে চায়, সেটাকে আমরা অবশ্যই সাধুবাদ জানাবো। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো যখন ভারত থেকে ফেনসিডিলের চোরাচালান ঢোকে, ইয়াবা-কোকেনের মতো ভয়ংকর মাদকের চোরাচালান ঢোকে তখন ভারত তা থামাতে পারে না। তাহলে গরুর বেলায় এত আপত্তি কেন? বছরের প্রায় প্রতিদিনই দেখা যায়, বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি গরু ব্যবসায়ী নিহত হচ্ছে কিন্তু কোনোদিন কোনো ফেনসিডিল ব্যবসায়ী বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছে এমন খবর শোনা যায়নি। বাংলাদেশের জঙ্গিরা যে সকল অস্ত্র ব্যবহার করে তাও ভারত থেকেই আসে। কই কোনোদিন তো বিএসএফের গুলিতে কোনো অস্ত্রব্যবসায়ী মারা গেল না। গরিব গরু ব্যবসায়ী গুলিতে প্রাণ হারাবে আর মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের টিকিটিও কেউ ধরতে পারবে না এটা কোনো ভালো কথা নয়। অবশ্যই এই বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জোরালো ভূমিকা পালন করা দরকার।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস আমি ভারতে ছিলাম। ’৭৫-পরবর্তী সময়ে আরো সাড়ে তিন বছর ভারতে স্বেচ্ছায় নির্বাসনে ছিলাম, ভারতের অনেক কিছুই আমি জানি। ভারতের অনেক কবি-সাহিত্যিক-রাজনীতিকের সঙ্গেই আমার সখ্য আছে। মাঝে মাঝে বিভিন্ন প্রয়োজনে আগে ভারতে যেতাম। এখন যাই কালেভদ্রে। সম্প্রতি ভারতের ভিসা নিতে গিয়ে আমার যে অভিজ্ঞতা হলো তা অত্যন্ত তিক্ত ও বিরক্তিকর। ভিসা নিতে গিয়ে এত ঝামেলা পোহাতে হলো যা অকল্পনীয়। ভারত কি ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে শত্রু-রাষ্ট্রে পরিণত করছে?
মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার বিমান বন্দরে অন অ্যারাইভাল ভিসা পাওয়া যায়। আমি মনে করি ভারতসহ সার্কভুক্ত সকল দেশে রেল, নৌ, সড়ক ও আকাশ পথে অন অ্যারাইভাল ভিসা (on arrival visa) চালু হওয়া উচিত। বাংলাদেশ ও ভারতের খুনি, সন্ত্রাসী, দুর্বৃত্তরা যদি ভিসা ছাড়াই একদেশ থেকে আরেক দেশে যেতে পারে, তাহলে সাধারণ নিরীহ মানুষগুলো কেন এত ঝামেলা পোহাবে? আজ দুই দেশের মাঝে যে কাঁটাতারের বেড়া তা যেন শুধু বেড়া-ই নয়Ñ রূপ নিয়েছে দুর্ভেদ্য বার্লিন ওয়ালে। কিন্তু আমরা এটাও তো জানি, আজ আর বার্লিন ওয়াল নেই। তাহলে আমরা কেন আটকে আছি কাঁটাতারের বেড়ায়? এই কাঁটাতারের বেড়া ডিঙাতে ভিসা জটিলতা দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিরসন করা দরকার। তা নাহলে বাংলাদেশের মানুষ খুব শিগগিরই ভারত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে।
ভারত আমাদের যে উপকার করেছে তার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। আবার ভারত আমাদের যে ক্ষতি করেছে তারও কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল মার্কিন গোষ্ঠীর মদদেই জাসদ সৃষ্টি হয়েছিল। এই জাসদ আওয়ামী লীগের একটি বিশাল মিলিট্যান্ট অংশকে বিভ্রান্ত করে তথাকথিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে বঙ্গবন্ধুকে পলিটিক্যালি হত্যা করেছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের অনেক আগেই। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শারীরিকভাবে শহিদ হয়েছেন মাত্র। শুধু তাই নয় বঙ্গবন্ধুর খুনি রিসালদার মুসলেহ উদ্দীনও বহুদিন ভারতে বহাল তবিয়তে পলাতক ছিল। ভারত যদি আজ নিজেকে ‘বিগ ব্রাদার’ মনে করে তাহলে ভারত মস্ত বড় ভুল করবে। কেননা বাংলাদেশ আজ আর আগের জায়গায় নেই। বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। ভারতের সাহায্য আমাদের প্রয়োজন আছে বটে, তবে বাংলাদেশের সহযোগিতাও ভারতের আজ অনেক বেশি দরকার। বিশেষ করে ভারতের পূর্বাঞ্চলের প্রদেশগুলোকে দিল্লির সঙ্গে যুক্ত করার জন্য ট্রানজিটের কথা ভুলে যাওয়া মোটেই উচিত হবে না।
কবি বলেছেন, ‘সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি।’ এ কথা আজ বাংলাদেশের মানুষকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করা দরকার। আমাদের মাঝে দেশপ্রেম জাগত করা দরকার। বিদেশী মোহ আমাদের মাঝে ব্যাধির রূপ নিয়েছে। এই মোহ থেকে আমাদের মুক্ত হওয়া প্রয়োজন। অকারণে ভারত ভ্রমণ বাদ দিন। লেখাপড়া, চিকিৎসা কিংবা ঘোরাঘুরিরর জন্য বিনা কারণে ভারত যাওয়ার প্রবণতা পরিহার করুন। আমাদের এখন উচিত হবে নিজের দেশে চিকিৎসা নেওয়া। নিজের দেশে শিক্ষা নিন এবং নিজের দেশেই শিক্ষা দিন। বাংলাদেশের সুন্দর নিসর্গ না দেখে ভারতের প্রকৃতি দেখার কোনো মানে নেই। ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশি হাই কমিশনে ভারতীয়দের ভিসা পেতে কোনো ভিসা ফি লাগে নাÑ যদিও এ ব্যাপারে আমাদের ৬০০ টাকা সার্ভিস চার্জ দিতে হয়। আমি মনে করি, বাংলাদেশি হাইকমিশনেও সার্ভিস চার্জ নির্ধারণ করা উচিত, তারা যদি আমাদের কোনো ছাড় না দেয়, তাহলে তাদেরকেও ছাড় দেওয়া আমাদের ঠিক হবে না। যারা একাধিকবার এমনকি ৫০-৬০ বার ভারতে গিয়েছেন তাদের on arrival visa দিতে বাঁধা কোথায়?
আসুন দুই দেশের ভিসা সংক্রান্ত একটি পরিসংখ্যান দেখিÑ প্রতিদিন ভারতীয় হাইকমিশন (ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন, রাজশাহীর সহকারী হাইকমিশন এবং চট্টগ্রামের সহকারী হাইকমিশন) অফিস হতে প্রায় তিন হাজার ভিসা প্রদান করা হয়। এই হিসেবে বছরে সাত লক্ষ আশি হাজার ভিসা প্রদান করা হয়। ভিসার আবেদন অনলাইনে পূরণের ক্ষেত্রে প্রায়ই সার্ভার ডাউন পাওয়া যায়। অনলাইনে আবেদন পূরণ করা গেলেও তা সাবমিট করা যায় না। শুধুমাত্র কতিপয় দালালের মাধ্যমে অনলাইন আবেদন সাবমিট করা যায় এবং সাক্ষাৎকারের তারিখও পাওয়া যায়। যে সকল দালালের মাধ্যমে ভিসা আবেদন অনলাইনে সাবমিট করা যায়, তাদের ভিসার প্রকারভেদে তিন হাজার টাকা থেকে দশ হাজার, পনেরো হাজার টাকার লেনদেন হয়। যদিও ভারতীয় ভিসার জন্য কোনো ধরনের ভিসা ফি প্রদান করতে হয় না। ভারতীয় ভিসার জন্য প্রতি আবেদনকারীকে ছয়শত টাকা সার্ভিস চার্জ জমা দিতে হয়। সেই হিসেবে এক বছরে ভারতীয় ভিসা প্রার্থীকে কমপক্ষে ছিয়াশি কোটি আশি লক্ষ টাকা ভারতীয় ভিসার সার্ভিস চার্জ প্রদান করা হয়।
পক্ষান্তরে ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন (দিল্লীর বাংলাদেশ হাইকমিশন, কলকাতা ও মুম্বাই উপ-হাইকমিশন এবং আগরতলা সহকারী হাইকমিশন) অফিসসমূহ হতে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার ভিসা প্রদান করা হয়। এই হিসাবে বছরে দুই লক্ষ ষাট হাজার ভিসা প্রদান করা হয়। ভিসা প্রার্থীরা নিজেরা বা তাদের যথোপযুক্ত প্রতিনিধির মাধ্যমে Over the counter ভিসার আবেদনপত্র জমা দিতে পারেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জমা দেওয়ার পরদিন ভিসা প্রদান করা হয়। বাংলাদেশি ভিসার জন্য কোন ধরনের সার্ভিস চার্জ জমা দিতে হয় না।
এই লেখাটা শুরু করেছিলাম অমিত গোস্বামীর কথার সূত্র ধরে। তিনি বলেছেন, ‘মাত্র ১৫ বছর আগেও ভারতীয় ভিসা পাওয়া যেত কোনোরকম ভোগান্তি ছাড়াই। অতীতে দিনে দিনে ভিসা হয়ে যেত, এখন প্রায় সাত থেকে পনেরো দিন সময় লাগে। এমতাবস্থায় ভারতীয় দূতাবাস অবিলম্বে যদি কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ না করে কিছুদিনের মধ্যেই এটা উচ্চ পর্যায়ের আন্তর্জাতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে এবং ভারতের ভাবমূর্তির পক্ষে চূড়ান্ত কলঙ্কজনক হবে সেটা তাদের বোঝার সময় এসেছে।’ সদিচ্ছা থাকলে কোনো সমস্যাই সমাধানের ঊর্ধ্বে নয়। এখন ভারত ভিসা জটিলতার সহজ সমাধান খুঁজবে নাকি এভাবেই বাংলাদেশি নাগরিকদের ভোগাবেÑ এটাই দেখার বিষয়। আগামী ডিসেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সম্ভাবনা রয়েছে। ওই সফরে দুই দেশের নিরাপত্তা-সহযোগিতা বিষয়ক রূপরেখা প্রাধান্য পেলেও বাংলাদেশের অনেক সমস্যার কথা ভারতের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করার কথা রয়েছে। সেই সফরে ভিসা ব্যবস্থা সহজীকরণ নিয়েও আলোচনা করা হবে বলে জানা যাচ্ছে। বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করব অবশ্যই আপনি এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উত্থাপন করবেন এবং ভারতীয় ভিসা জটিলতা থেকে আমাদের মুক্ত করবেন। আপনার দৃঢ় পদক্ষেপে ভারতীয় ভিসা ব্যবস্থা সহজ হবে এমনটিই আশা করে বাংলাদেশের অসহায় মানুষ।
২৪ নভেম্বর, ২০১৬