বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন পুতুল (খালেদা জিয়া) ও একজন মওদুদ (মৌ-দুধ) আহমদ বর্তমানে বেশ আলোচিত। এই আলোচনার কারণ অবৈধভাবে দখলে থাকা তাদের দুটি বাড়ি ও সেই বাড়ি থেকে উচ্ছেদের ঘটনা। আজ আমি পুতুলের পুতুল খেলা ও মওদুদ আহমদের মৌ-দুধ খাওয়ার ব্যাপারে দুই একটি কথা লিখতে চাই। মনে হচ্ছে বর্তমান প্রেক্ষাপটে কথাগুলো বলা আজ সময়ের দাবি পূরণের জন্য অত্যান্ত প্রাসঙ্গিক।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আইন অমান্য শুরু হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে। যতদিন বঙ্গবন্ধু জীবিত ছিলেন ততদিন বাংলাদেশে কেউ আইন অমান্য করার ধৃষ্টতা দেখায়নি। বঙ্গবন্ধু চিরদিনই সরকারের বিধি-নিষেধ মেনেই রাজনীতি করেছেন। তার দলকে তিনি সেভাবেই গড়ে তুলেছেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর বাংলাদেশে শুরু হয় আইন অমান্যের সংস্কৃতি। আইন অমান্য করেই জিয়া ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। শত শত সামরিক অফিসারকে হত্যা করে। অবৈধভাবে রাজাকার-আলবদর, যুদ্ধাপরাধী ও দেশবিরোধীদের সাহায্যে গঠন করে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’। কলুষিত করে বাংলাদেশের রাজনীতি ও পবিত্র সংবিধান। জিয়া মূলত আইয়ুব ও ইয়াহিয়ার পথ অনুসরণ করে। তিনি মার্শাল ল’, কার্ফ্যু জারির পাশাপাশি পাকিস্তানি ভাবধারায় বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে থাকেন। ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটান। এরপরে এরশাদ সাহেব জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাংলাদেশের দ-মু-ের অধিকারী হন। তিনিও আইন অমান্য করে, ৪৮ ঘণ্টা মিডিয়া ক্যু করে নির্বাচনের ফলাফল উল্টে দেন। এরশাদের দুঃশাসন যে কত নিষ্ঠুর আর ভয়াবহ ছিল সেই ইতিহাস যাদের জানা আছে তারা নিশ্চয়ই সেসব আজ মনে করতে পারেন। একটি বৈধ ও জনগণের দল কখনো অন্যায়ভাবে কিছু করার সাহস দেখাতে পারে না। কেননা জনগণের কাছে তাদের জবাবদিহিতা করতে হয়। জনগণের প্রশ্নের জবাব তাদের দিতে হয়। নইলে নির্বাচনের মুহূর্তে জনগণ ঠিকই তাদের বিরুদ্ধে রায় দিয়ে দেয়। গণতন্ত্রে জনগণই জয়ী হয়। তারা পাঁচ বছরের জন্য তাদের কাঙ্খিত রাজনৈতিক দল ও নেতাকে ক্ষমতায় বসায় ঠিকই কিন্তু তাদের মর্জি মতো কাজ না করলে জনগণ নির্বাচনে ফলাফল উল্টে দেয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এক রকম চিত্রই দেখা যায়।
পরিসংখ্যান যাই থাকুক, বাংলাদেশের মানুষ অর্ধেকের বেশি অশিক্ষিত বলে এখানে গুজব বেশ গুরুত্ব পায়। মানুষের আবেগকে কাজে লাগানো যায়, সত্য-মিথ্যা দিয়ে খিঁচুড়ি পাকিয়ে মানুষকে খুব সহজেই গেলানো যায়। তাছাড়া দলীয় অনুগতরা যদি একটু সুবিধা পায়, তাহলে দিনকে রাত করাও এখানে কোনো ব্যাপার নয়। এ দেশে একটুখানি অবৈধ সুবিধা দিলে অনেকখানি অবৈধ সুযোগ পাওয়া যায়। বারবার এদেশে আইন অমান্যের এমন দৃষ্টান্ত ঘটেছে। দেশের মানুষ সজাগ না হলে ভবিষ্যতেও এমন ঘটনা ঘটতে থাকবে।
ক্যান্টনমেন্ট সেনাবাহিনীর জন্য বরাদ্দ। ওখানে সেনাবাহিনীর লোকজন থাকবেন এটাই বিধান। সিভিলিয়ানরা সেনানিবাসে থাকবে এটা সেনা আইনের বহির্ভূত। কেন সিভিলিয়ানরা সেনানিবাসে থাকতে পারবে না এর অনেকগুলো কারণ আছে। সেনানিবাস একটি স্পর্শকাতর এলাকা। সর্বসাধারণের জন্য নিষিদ্ধ এলাকাও বটে। কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান বা চেয়াপারসনের বাড়ি ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে থাকলে ক্যান্টনমেন্টের নিজস্ব নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়ে। প্রতিদিন হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় সেনাবাহিনীর সদস্যদের। তাছাড়া ক্যান্টনমেন্টে যেহেতু সেনাবাহিনীর লোক ছাড়া অন্যদের বসবাস অবৈধ, সুতরাং তাদের সেখানে থাকাটাও অন্যায়।
খালেদা জিয়া তার ক্যান্টনমেন্টের বাড়িতে ৪০ বছর বসবাস করেছেন বলে নিজে দাবি করেছেন। ওই বাড়িতে বসেই তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছড়ি ঘুরিয়েছেন, ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করেছেন। ক্যান্টনমেন্ট একটি নিরাপদ জায়গা। ওখানে বসে ঢিল ছুঁড়লে বাইরের মানুষের গায়ে লাগানো যায় কিন্তু ক্যান্টনমেন্টের দিকে ঢিল ছোঁড়া মানেই আইনত দ-নীয় অপরাধ। খালেদা জিয়া এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন বলেই ক্যান্টনমেন্ট ছাড়তে চাননি। আঁকড়ে থাকতে চেয়েছেন তার ষড়যন্ত্রশালা। আইন কারো আবেগ মানে না, কারো চোখের পানি দেখে না। আইন তার নিজস্ব গতিতেই চলমান। আদালতের নির্দেশে খালেদা জিয়াকে তার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি ছাড়তে হয়। আদালতই খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদ করেন তার বাড়ি থেকে। এটা অবশ্য খালেদা জিয়ার জন্য এক অর্থে পজেটিভ খবর হওয়ারই কথা ছিল। জনগণের নেতা জনগণের কাতারে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। জনগণ যেহেতু ক্যান্টনমেন্টে থাকে নাÑ জনগণের দলের চেয়ারপারসন কেন ক্যান্টনমেন্টে থাকবেন? তাকেও জনতার সুখে-দুঃখ তাদের পাশে থাকা দরকার। আদালতের রায় খালেদা জিয়া মানতে চাননি। যদিও পরে তিনি মানতে বাধ্য হয়েছেন। সেই উচ্ছেদ ঘটনা নিয়ে তিনি অনেক নাটকও করেছেন। কয়েকদিন হরতালও করেছেন। একটি অবৈধ ইস্যুকে নিয়ে হরতাল করা যে কত বড় জঘন্য অন্যায় সেটা দেশবাসী নিশ্চয়ই বুঝতে পারেন। তবু খালেদা জিয়ার জ্বালাও-পোড়াও-মানুষ মারোÑ হরতালে কিছু অনুগত অংশ নিয়েছে। এটা করে ওই হরতালের সমর্থকরাও আইন অমান্য করার ধৃষ্ঠতা দেখিয়েছে।
খালেদা জিয়া আপনি ছিলেন একজন সাধারণ গৃহবধূ। হয়তো ওই পরিচয়টুকুই আপনার নিয়তি ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁর ¯েœহের স্পর্শ দিয়ে আপনাকে ধন্য করেছিলেন। জিয়া আপনাকে একদা ঘরে তুলতে চায়নি, কেন চায়নি তা আপনার ভালো করেই জানার কথা। বঙ্গবন্ধু জিয়াকে বলেছিলেন, ‘পুতুল আমার কন্যার মতো,’ শুধু তাই নয় তিনি আপনার পিতার ভূমিকাই পালন করেছিলেন। আপনি আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা আপনার পক্ষে কোনোদিনই সম্ভব হতো না, যদি না জেনারেল জিয়ার হাতে আপনাকে মুক্তিযুদ্ধের পরে বঙ্গবন্ধু কন্যাজ্ঞানে তুলে না দিতেন। বঙ্গবন্ধু শুধু জাতির পিতাই নন, এক অর্থে আপনারও পিতৃসম। আপনি অকৃতজ্ঞের মতো আজ ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে মিথ্যা জন্মদিনের কেক কেটে যে উল্লাস করেন তা বড়ই বেমানান। এসব বন্ধ করুন। এসব আপনাকে মোটেই মানায় না।
খালেদা জিয়া যে বাড়িতে তার এতিম দুই সন্তান নিয়ে থাকতেন এখন সেখানে ৪৫টি শহিদ সেনা সদস্যের পরিবার বাস করে। ভেবে দেখুন আপনি কতখানি জায়গা অকারণে দখলে রেখেছিলেন। আপনার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি প্রথমে ছিল আর্মি ডেপুটি চিফের বাড়ি। জিয়া অবৈধভাবে প্রেসিডেন্ট হয়ে ওটাকে প্রেসিডেন্টের বাসভবন বানায়। জিয়ার মৃত্যুর পরেও অবৈধভাবে আপনি সেই বাড়ি আঁকড়ে পড়ে থাকেন। আপনি বা আপনার পরিবার শুধু আকড়াতে চান কেন? দেশের জায়গা-জমি, টাকা-পয়সা, জাহাজ-ফ্যাক্টরি, এতিমের অর্থ-সম্পদ সবকিছুই কি আপনার বা আপনাদের লাগে?
কেন খালেদা জিয়া সেনানিবাসের বাড়ি ছাড়তে চাননি? কি ছিল তার নৈপথ্যের কারণ? এগুলো খতিয়ে দেখলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসবে। খালেদা জিয়া আর আপনি শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে পারবেন না। আপনার মিথ্যাচারে আর দেশবাসী ভুলবে না। আপনি জানেন এখন দেশের মানুষ আপনার ডাকে রাস্তায় নামে না, হরতাল পালন করে না, গাড়ি পোড়ায় না, জনগণ এখন আপনার চেহারা বুঝে ফেলেছে। খালেদা জিয়ার বাড়ি দখল যেমন অবৈধ ছিল না, তেমনি বাংলাদেশের মাল্টিকালার পলিটিশিয়ান ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের গুলশানের বাড়ি দখলও অবৈধ বলে সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছেন। আদালতের রায় ঘোষণা হওয়ার পরে এবং রাজউক মওদুদ আহমদের ১ একর ১৩ কাঠার বাড়ি থেকে বৈধভাবে উচ্ছেদের পরে শহিদ সুরকার আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন দেশবাসী তা জেনে মওদুদ আহমদকে ধিক্কার জানিয়েছেন।
মওদুদ সাহেব রাউন্ড টেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর ব্যাগ টেনেছেন। জিয়াউর রহমানের পিঠে চড়ে ফায়দা লুটেছেন, এরশাদ সাহেবের কোলে চড়ে প্রধানমন্ত্রী ও উপরাষ্ট্রপতি হয়েছেন, খালেদা জিয়ার বগলে থেকেও মন্ত্রী হয়ে আকন্ঠ মধু-দুধ খেয়েছেন। একদিন আমি ড. কামাল হোসেনকে জিজ্ঞাসা করেছিলামÑ মওদুদ আহমদ নাকি বঙ্গবন্ধুর প্যারোলে মুক্তির বিপক্ষে ছিলেন। ড. কামাল বলেছিলেন, ‘আমার জীবনে মওদুদের মতো মিথ্যাবাদী বন্ধু আর একটিও পাইনি। মওদুদ সাহেব আপনার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত বেশ কিছু স্মৃতি আছে, সেই স্মৃতির ঝাঁপি খুললে যা কিছু বের হবে তার সবই আঁধারে ঢাকা। আপনার জীবনটাও এক অর্থে আঁধারে ঢাকাই। আর কত এবার পুতুল ম্যাডাম ও আপনি দুজনেই ‘ক্ষ্যামা ’ দেন। অনেক খেলা দেখিয়েছেন, অনেক পাতে বসে অনেক মৌ-দুধ খেয়েছেন। এখন সেসব বদ হজম হতে শুরু করেছে। আপনার চিকিৎসা দরকার। বিবেকের চিকিৎসা নিন।
মওদুদ আহমদ একজন আইনজ্ঞ। তিনি আইন মানবেন এটাই স্বাভাবিক। আদালত যে রায় দেয় সেই রায় যদি একজন আইনজীবী না মানেন, তাহলে সাধারণ মানুষ আদালতের প্রতি আস্থা হারাতে থাকে। যখন যুদ্ধাপরাধীদের রায় হচ্ছিল তখনও বিএনপির আইনজীবীরা রায় মানতে চায়নি, রায় মানে নি। এখনও তারা আদালতের কোনো রায় মানতে চায় নাÑ কেন? তারা কি আইন অমান্য করেই বাংলাদেশে রাজনীতি করতে চান? খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে সব মামলা এখনও আদালতে সচল আছে তার বেশিরভাগই কেয়ারটেকার সরকারের আমলে করা। তাদের কাক্সিক্ষত কেয়ার টেকার সরকারই তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা ঠুকেছে। এমনকি তারেক জিয়া মুচলেকা দিয়ে যে লন্ডনে পালিয়ে গেলেন সেই মুচলেকাও নিয়েছিল কেয়ারটেকার সরকার। অথচ মিথ্যাচার করে সব দোষ চাপানো হয়েছে আওয়ামী লীগের ঘাড়ে।
শুধু বিএনপি বা অন্যান্য দলই আইন অমান্য করে এমন নয়Ñ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও সুযোগ পেলে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়। পত্র-পত্রিকায় আওয়ামী লীগের সাংসদদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যেসব চিত্র প্রকাশিত হচ্ছে সেটাও কাক্সিক্ষত নয়। আওয়ামী লীগের অনেক সাংসদই আইনের চোখে ধুলো দিয়ে অবৈধ সম্পদ করেছে। নির্বাচনের আগে তারা সম্পদের যে হিসাব দিয়েছেÑ নির্বাচিত হওয়ার পরে তাদের সম্পদ কয়েক গুণ বেশি হয়েছে বলে দুর্নীতি দমন কমিশন জানাচ্ছে। এসব অবৈধ সম্পদ যাদের ঘরে আছে তাদেরও আমরা আইনের মুখোমুখি হতে দেখতে চাই। আওয়ামী লীগের কারো দখলে যদি কোনো বাড়ি বা স্থাপনা অবৈধভাবে থাকে সেসব বাড়ি বা স্থাপনাও আমরা দখল মুক্ত হতে দেখতে চাই। অন্যায় কর্ম যেই করুক না কেন তাকে ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না। বিসমিল্লাহ গ্রুপ, হলমার্কের হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতিতে সরকারের যারা জড়িত তাদেরও শাস্তি হওয়া দরকার। জনগণ এমনটিই প্রত্যাশা করে, জনগণের ভ্যাটের টাকা ব্যাংকে থাকবে, আর সেখান থেকে টাকা চলে যাবে চোরের পেটেÑ এমনটা আমরা কেউ-ই আশা করি না। চোর-বাটপাড়-দুর্নীতিবাজরা শাস্তি পাক, সুস্থ-সুন্দর-স্বাভাবিক ধারায় এগিয়ে যাক বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিÑ এমনটাই আমরা সাধারণ মানুষ আকাক্সক্ষা করি।
১৪ জুন, ২০১৭