২৫ মার্চ, ১৯৭১ : অপারেশন সার্চ লাইটের অতর্কিত গণহত্যা
মোনায়েম সরকার
২৪ মার্চ একটা গুজব ছড়িয়ে পড়ে ঢাকায়। সবাই বলাবলি করতে লাগল, ইয়াহিয়া খান আর্মিকে মুভ করার নির্দেশ দিয়েছেন। রাতেই ক্র্যাক ডাউন হবে। শহরময় উত্তেজনা। কী জানি কী ঘটে। রাত সাড়ে আটটার মধ্যে আমরা পার্টি অফিস থেকে বের হয়ে গেলাম। সারারাত উত্তেজনা আর আশঙ্কার মধ্য দিয়ে কাটল।
২৫ মার্চ একই অবস্থা। থমথমে ভাব বিরাজ করছিল ঢাকায়। রাত ন’টার দিকে বের হলাম। গন্তব্য ধানমন্ডির ৩২ নম্বর। উদ্দেশ্য, বঙ্গবন্ধুর বাড়ির অবস্থা দেখা। উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের যে বৈঠকগুলো হয়েছিলÑ মোটামুটি সব খবরই রাখতাম। ওয়ালী খান বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক থাকতে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, পাক আর্মি খেপে আছে তাঁর ওপর। আগরতলা মামলায় গ্রেফতারের পর বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করে ওরা নাকি ভুল করেছে বলে মনে করছে। মেরে ফেললেই নাকি তারা ভালো করত। তাহলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আর কোনো ভাবনা চিন্তা করতে হতো না। ওয়ালী খানের পরামর্শ শুনে হেসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বলেছিলেন, ‘মোজাফফরের (ন্যাপ) অভ্যাস আছে আন্ডারগ্রাউন্ডে যাওয়ার। আমার সে অভ্যাস নেই। তবু বাসার পেছনে সিঁড়ি লাগিয়ে রেখেছি, দেখা যাক কী হয়।’
ওয়ালী খানের সেই সতর্কবাণী আমাদেরও অজানা ছিল না। বঙ্গবন্ধু তাঁর সহকর্মীদের সাবধানে থাকতে বললেন। কিন্তু তিনি নিজে আত্মগোপন করছেন কিনা, তা জানার ইচ্ছা দমিয়ে রাখতে পারলাম না। শহরে থমথমে পরিস্থিতি। তা সত্ত্বেও পার্টি অফিস থেকে রওনা হলাম ধানমন্ডির উদ্দেশে। ৩২ নম্বর সড়কে ঢুকে প্রথম গেলাম শোভা আপার বাড়িতে। এ সড়কের দ্বিতীয় বাড়ি সেটা। পরবর্তীকালে শেখ হাসিনা ভাড়া ছিলেন ওই বাড়িতে। শোভা আপা ও অন্যরা আমাকে দেখে ভয় পেলেন মনে হলো। বললেন, ‘কী ব্যাপার? এ পরিস্থিতিতে এত রাতে এ এলাকায় কেন?’ বুঝলাম তারা নিজেরাও আতঙ্কে আছেন। কখন কী ঘটে বোঝা মুশকিল। শোভা আপার বাসায় কিছুক্ষণ কাটিয়ে বের হলাম। আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগলাম বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে। দূর থেকেই দেখলাম একটা লাল গাড়ি দাঁড়ানো। বুকটা ধক করে উঠল। তাহলে বঙ্গবন্ধু সত্যি সত্যিই আন্ডারগ্রাউন্ডে যাচ্ছেন? এ গাড়িতে চড়েই কি তিনি বের হবেন? আমি দূর থেকে দেখছি। দেখলাম গাড়ি থেকে নেমে এলেন আবদুর রাজ্জাক আর শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান। নেমে আবার উঠে পড়লেন। আবার নামলেন। তারপর চট করে ঢুকে পড়লেন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে।
আমি কৌতূহল নিয়ে সেখানেই রাস্তার ওপর রয়ে গেলাম। কেমন অস্বস্তিকর মনে হচ্ছিল পরিবেশটা। এভাবে দাঁড়ানো নিরাপদ হবে না, বুঝতে পারছিলাম। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি, খুবই স্পর্শকাতর স্থান। কে আবার কী সন্দেহ করে বসে কে জানে! ওদিকে আবদুর রাজ্জাক আর আবদুল মান্নানও বের হচ্ছেন না। রাস্তার পাশে একটা পানের দোকান ছিল। দোকানদারের কাছে পান চাইলাম। সিগারেট দিতে বললাম। সে গা করল না। দেখি সে দ্রুত হাতে সবকিছু গোছগাছ করছে। জানাল তার ভালো লাগছে না। সবকিছু অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। তাই বাসায় চলে যাচ্ছে। বাক্স-পেটরা গুছিয়ে বলল, ‘ভাই, একটু মাথায় তুইলা দিবেন?’ তাকে সাহায্য করলাম। সে রওনা হলো ব্রিজের দিকের পথ ধরে। আমারও আর দাঁড়িয়ে থাকা সমীচীন মনে হলো না। তার পিছু পিছু হাঁটতে লাগলাম। তখন রাত প্রায় ১০টা।
ধানমন্ডির ২৪ নম্বর সড়কে স্থপতি মাজহারুল ইসলামের বাসায় গেলাম। তিনি আমাকে দেখে খুব উৎফুল্ল হলেন। বুঝলাম কিছু একটা ঘটছে এখানে। তিনি বললেন, ‘আপনি এসেছেন। ভালোই হয়েছে। আমাদের শুটিং ক্লাবের কিছু আর্মস আছে বাসায়। এগুলো কর্নেল জামানের বাসায় দিয়ে আসব (কর্নেল জামান স্থপতি মাজহারুল ইসলামের স্ত্রীর বড়ো ভাই। তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন)। অস্ত্রগুলো পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে কাজে লাগবে।’ আমরা একটা গাড়ি করে অস্ত্রগুলো নিয়ে গেলাম কর্নেল জামানের বাসায়। কর্নেল জামানের ওখানে অস্ত্রগুলো রাখা হলো। কর্নেল জামানের বাসা থেকে বের হলাম। স্থপতি মাজহারুল ইসলামের গাড়ি থেকে নেমে গেলাম তিন নম্বর রোডের মাথায়। তখন রাত এগারোটা। রিকশা পেলাম না। হাঁটতে হাঁটতে গেলাম ন্যাপ নেতা ডা. এম এ ওয়াদুদের বাসায়। সেখানে পেলাম ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদকে। কিছুক্ষণ কথা বললাম তাঁর সঙ্গে।
তারপর পার্টি মেস ২৩ চামেলীবাগের দিকে রওনা দিলাম রিকশায় চড়ে। সে সময় এখনকার শাহবাগের পাশের রাস্তা ছিল না। হাতিরপুল হয়ে যাতায়াত করতে হতো। রিকশা হাতিরপুল আসতেই দেখি রাস্তায় ব্যারিকেড। কাছে গিয়ে দেখি, ওঁরা আমাদের দলেরই কর্মী। সঙ্গে ছাত্রলীগের কজন। ওঁরা রাস্তা খুঁড়ছে। আমাকে দেখেই ছুটে এল। বললো, মোনায়েম ভাই আমরা রাস্তা খুঁড়ে ব্যারিকেড দিচ্ছি। পাকিস্তানিদের হামলা ঠেকাতে হবে না? আপনিও থাকেন। রিকশা ছাড়লাম না। ওদের কিছুক্ষণ সঙ্গ দিয়ে রিকশাঅলাকে বললাম এলিফেন্ট রোডে অবস্থিত সায়েন্স ল্যাবরেটরির দিকে যেতে। রাত তখন সাড়ে এগারোটা।
সায়েন্স ল্যাবরেটরির কাছে আমার এক বোন মাহমুদা আপা থাকতেন। তার বাসায় গেলাম। সেখানেই রাত কাটাব। রাতে ঘুম ভেঙে গেল প্রচ- আওয়াজে। ভাগ্নি নাফিস তখন ছোট্ট। আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙেছে তারও। আতঙ্কে মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেছে। আমাকে জাপটে ধরে বলল, ‘মামা! কিসের শব্দ?’ তাকে অভয় দেয়ার জন্যে বললাম, ‘বিয়ের অনুষ্ঠানে বাজি ফুটছে।’ নাফিসকে সান্ত¡না দিতে দিতে আমার মনে পড়ল ওয়ালী খানের একটি কথা। আহমেদুল কবীরের বাসায় বসে একদিন তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘তোমরা পুলিশের সঙ্গে লড়াই করেছো। আর্মির সঙ্গে করোনি। আর পাঞ্জাবি আর্মি কী জিনিস, তোমরা তা কল্পনাও করতে পারবে না।’ ওয়ালী খানের সে কথা উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম ২৫ মার্চ কালরাতে। পাকিস্তানি সেনারা যে নরপিশাচ, মানুষকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করতে ওদের হাত কাঁপে না… বুঝলাম সেদিন। বুঝলাম প্রজ্বলিত ঢাকা শহরে অসহায় নিরস্ত্র মানুষের আর্তনাদ শুনে।
মাহমুদা আপার বাড়ির পাশেই লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেমের বাড়ি। পাকিস্তানি আর্মি তাঁকে হত্যা করে টেনে-হিঁচড়ে লাশ বের করে নিয়ে যায়। হানাদাররা তাঁকে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলার নির্দেশ দিয়েছিল। তিনি বীরের মতো বলেছেন, জয় বাংলা। তাঁকে দিয়ে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলাতে ব্যর্থ হয়ে ক্ষিপ্ত পাক হানাদাররা গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয় তাঁর শরীর। লাশ নিয়ে যায় পা ধরে টেনে-হিঁচড়ে।
২৬ মার্চ অবরুদ্ধ দিন কাটালাম। রাস্তায় বেরুব তার উপায় নেই। কারফিউর মধ্যে বের হওয়া সম্ভব ছিল না। ২৭ মার্চ শুক্রবার। জুমার নামাজের জন্যে কারফিউ শিথিল করা হলো। বের হলাম মাহমুদা আপার বাসা থেকে। সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড়ে গিয়ে পেলাম আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে। গাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। আমাকে দেখে থামলেন। জানালেন বঙ্গবন্ধু অ্যারেস্ট হয়েছেন। চট্টগ্রাম বেতার শুনতে বললেন। গাড়িতে বসে আমরা কিছুটা সময় কথা বললাম। এ সময় দেখি, বায়তুল মামুর মসজিদের সামনে একজনের লাশ। জানলাম, ওই মসজিদের মুয়াজ্জিনের লাশ। ফজরের আজান দিতে উঠেছিলেন। বেচারা কারফিউর কথা জানতেন না। পাকিস্তানি আর্মি তাঁকে দেখেই গুলি করে। ভয়ে কেউ লাশ নিতে আসেনি। দুদিন ধরে পড়ে আছে লাশটা।
সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে কিছুক্ষণ থাকলাম আমরা দুজন। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে বললাম আমাকে ৩২ নম্বরের কাছাকাছি নামিয়ে দিতে। যেতে যেতে আরো কিছু কথা বললাম আমরা দু বন্ধু। কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলাম না বঙ্গবন্ধু অ্যারেস্ট হলেন কীভাবে? তাঁর তো আত্মগোপন করার কথা! মঞ্জুকে বললাম সে কথা। তিনি বললেন, ‘আমি অতশত জানি না, তবে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হয়েছেন, এ কথা সত্য।’
ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের কাছে নামলাম গাড়ি থেকে। মঞ্জু চলে গেলেন। সতর্ক পায়ে ৩২ নম্বর রোডের উত্তর দিকের দেয়াল টপকে শোভা আপার বাড়িতে ঢুকে যাই। শোভা আপা বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতারের ঘটনা বর্ণনা করলেন। আর্মিরা এসে প্রথমে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু দোতলার ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন। ধমকের সুরে বলেন, ‘এই, কারা তোমরা? কী হয়েছে?’ বঙ্গবন্ধুর এ কথা শুনে আর্মিরা গোলাগুলি বন্ধ করে। অফিসার গোছের একজন বঙ্গবন্ধুকে বলে, ‘আপনাকে যেতে হবে আমাদের সঙ্গে।’ কিছুক্ষণ পর আর্মিদের গাড়িগুলো চলে যায়। শোভা আপারা পুরো ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন।
ক্ষুব্ধতা ভর করল মনে। তাজউদ্দিন আহমদসহ অন্যরা বার বার অনুরোধ জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকে। অনুরোধ করেছিলেন আত্মগোপনে যেতে। বঙ্গবন্ধু কারো পরামর্শ শোনেননি। বলেছেন, ‘ওরা যদি সত্যিই আমাকে অ্যারেস্ট বা হত্যা করতে আসে, তাহলে আমাকে না পেলে পুরো ঢাকা শহর তছনছ করে ফেলবে। মানুষজনের ওপর নির্যাতন চালাবে।’
বঙ্গবন্ধুকে বোঝাতে না পেরে নেতারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো যে যেখানে যাওয়ার চলে গেলেন। বঙ্গবন্ধুই সব ঠিকঠাক করে রেখেছিলেন। কলকাতায় গিয়ে কোথায় উঠতে হবে, কী করতে হবে সব বলে দিয়েছিলেন। শুধু নিজে রয়ে গেলেন। বঙ্গবন্ধু হয়তো ভেবেছিলেন, তিনি সারা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার রায় পেয়েছেন ১৯৭০-এর নির্বাচনে। সুতরাং তাঁর পালিয়ে যাওয়া সাজে না। আর এমনিতেও অসীম সাহসের অধিকারী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। পালিয়ে যাওয়ার মানসিকতা তাঁর ছিল না। তা সত্ত্বেও আমার মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধল। কেন বঙ্গবন্ধু আন্ডারগ্রাউন্ডে গেলেন না?
এসব ভাবতে ভাবতে ডা. ওয়াদুদের বাসায় গেলাম। অধ্যাপক মোজাফফরকে জানালাম সবকিছু। তিনি বললেন, ‘আমার এখন শেলটার বদলানো দরকার।’ হাতে সময় নেই। অধ্যাপক সাহেবকে কোথায় নেব, তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করার সুযোগ নেই। ডা. ওয়াদুদ ন্যাপের নেতা। তার বাসা নিরাপদ নয়। যেকোনো সময় পাকহানাদাররা হানা দিতে পারে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলাম, মাহমুদা আপার বাসায় রাখব অধ্যাপক সাহেবকে, তাঁকে নিয়ে গাড়িতে বের হলাম।
মাহমুদা আপার বাসার সামনে আরেক ঘটনা। গাড়ি থেকে নেমে আমি দ্রুত ঢুকে গেলাম ওনার বাড়িতে। কারো চোখে পড়ে গেলে অধ্যাপক সাহেবের বিপদ হবে। ওদিকে, তিনি আমাকে ফলো করতে না পেরে ঢুকে গেলেন উল্টো দিকের আরেক বাড়িতে। ওনার জন্যে ঘর ঠিকঠাক করতে বললাম মাহমুদা আপাকে। কিন্তু অধ্যাপক সাহেবকেই খুঁজে পাচ্ছি না। বেশ কিছুক্ষণ পর দেখি, তিনি ওই বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন। জানালেন, আমাকে খুঁজে না পেয়ে তাঁর এ অবস্থা। নেতাকে নতুন শেলটারে রেখে বাইরে গেলাম। ফিরে এসে ঝাল মেটালাম তাঁর ওপর। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললাম, ‘মুক্তিযুদ্ধ কেমন করে হবে? কাকে নিয়ে হবে? বঙ্গবন্ধু নেই। কীভাবে কী হবে? বঙ্গবন্ধু কেন আত্মগোপন করলেন না।’ জবাবে অধ্যাপক মোজাফফর শুধু বললেন, ‘এমন তো কথা ছিল না!’
আমি মোজাফফর সাহেবের সঙ্গে মাহমুদা আপার বাসাতেই থাকতে লাগলাম। কারফিউ চলছে। মাঝে মাঝে বিরতি থাকে বাজার-টাজার করার জন্যে। বিরতির সুযোগে আমি বের হতাম। বিভিন্ন দিকে গিয়ে খোঁজখবর নেয়ার চেষ্টা করতাম। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকেও যেতাম। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়ার আগে পাকিস্তানি আর্মি গুলি করে বাড়ির গেটের ছয়টি তারা ভেঙে ফেলেছিল। ৬-দফার স্মারকচিহ্ন হিসেবে বসানো হয়েছিল ছয়টি তারা। কারফিউর বিরতির ফাঁকে একদিন দেখে এলাম, তারাগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে।
২৫ মার্চের পর নিজের আস্তানায় যাওয়া হয়নি। আস্তানা মানে ২৩ চামেলীবাগের মেস। কদিন থাকলাম মাহমুদা আপার বাসায়। ২৭ মার্চ অধ্যাপক গৌরাঙ্গ এলেন। তার মোটরসাইকেলটি আমার সার্বক্ষণিক বাহন ছিল ’৬৯-এর উত্তাল দিনগুলোতে। পার্টির জরুরি কাজে এখানে-ওখানে যেতাম তার গাড়ির পেছনে চড়ে। বের হলাম গৌরাঙ্গের সঙ্গে। ইউনিভার্সিটি এলাকায় গেলাম। বুয়েটের দিক দিয়ে ঢুকলাম। মোটরসাইকেল চলছে ধীরগতিতে। কেউ নেই কোথাও। মাঠের মধ্যে মাটি ওলট-পালট হয়ে আছে। মাটি খুঁড়ে লাশ চাপা দিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদাররা। বুয়েটের শিক্ষক ড. নূরুল সেগুলো মুভি ক্যামেরায় ধরে রেখেছিলেন জগন্নাথ হলে হানাদারদের জঘন্য তা-বলীলা। হানাদাররা জগন্নাথ হলের ছাত্রদের লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে।
সুরেশ নামের একজন গলায় গুলিবিদ্ধ হয়েও অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। জগন্নাথ হল অ্যাটাক হওয়ার পর ছাদে পানির ট্যাংকির নিচে লুকিয়েছিলেন সুরেশ এবং আরো কজন। আর্মিরা সেখানেই সাত-আটজনকে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে। আরেকজন ছাত্র বেঁচে যান, তাঁর নাম কালীরঞ্জন শীল। সুরেশ এবং কালীরঞ্জন শীল পরবর্তীকালে সে রাতের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। কালীরঞ্জনের একটা লেখা আছে এ নিয়ে, কীভাবে হল থেকে ছাত্রদের বের করে আনা হয়, তাদের দিয়ে মাটি খোঁড়ানো হয়, সতীর্থদের লাশ টানতে বাধ্য করা হয়Ñ এসব ঘটনার বর্ণনা দেয়া আছে তার লেখায়। ছাত্রদের খোঁড়া গর্তেই ছাত্রদের লাশ চাপা দেয়া হয়। ব্রাশ ফায়ারের সময় কালীরঞ্জনের গায়ে গুলি লাগেনি। তিনি শুয়ে মরার মতো পড়ে ছিলেন অন্যদের লাশের মধ্যে। সুরেশের মুখে সে ভয়াল রাতের বর্ণনা শুনলাম।
২৭ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটি লাশ দেখতে পাই। জগন্নাথ হল ও রোকেয়া হলের মাঝামাঝি জায়গায় লাশটা পড়ে ছিল। পচন ধরে ফুলে গেছে। উপুড় হয়ে থাকা শরীরের গড়ন দেখে মনে হলো মধুদার লাশ, আমরা উত্তর দিকে যেতে লাগলাম। এখানে কিছু লোকজন পেলাম। এমন সময় পেছন দিক থেকে আর্মির একটা জিপ এল। আমি বা গৌরাঙ্গ কেউই টের পাইনি পেছনে আর্মির জিপ। কিন্তু সামনে দাঁড়ানো কজন লোক দ্রুত পালিয়ে যেতে যেতে আমাদের ইঙ্গিত দিয়ে সতর্ক করল। পেছনে তাকিয়ে দেখি জলপাই রঙের গাড়িটা এগিয়ে আসছে ধীরগতিতে। তিলমাত্র দেরি না করে গৌরাঙ্গ মোটরসাইকেল ছোটালো, সময়মতো টের না পেলে নির্ঘাত ধরা পড়তাম।
শহীদ মিনারের বিপরীত দিকে ৩৪ নম্বর ফ্ল্যাটের নিচতলায় থাকতেন জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি আর্মি অফিসার তাঁর বাসার সিঁড়ির নিচে তাঁকে গুলি করে। তাঁর ডান কাঁধ গুলিবিদ্ধ হয়। আমরা গেলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালের সাত নম্বর ওয়ার্ডে গুলিবিদ্ধ ড. গুহঠাকুরতাকে পেলাম। স্যার আমাদের হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন। মাসিমা অর্থাৎ বাসন্তী গুহঠাকুরতা বললেন, ‘ঘাড়ে গুলি লেগেছে। শুধু মাথাটাই কাজ করছে। শরীরের বাকি অংশ পুরোপুরি অবশ।’ তাদের কন্যা মেঘনা গুহঠাকুরতাকে দেখলাম মনে হলো স্কুলে পড়ে।
২৫ মার্চের ক্র্যাক ডাউনের দু-একদিন আগে লায়লা কবীর বলেছিলেন, ‘মোনায়েম, পরিস্থিতি সুবিধের মনে হচ্ছে না। ন্যাপ এবং কমিউনিস্ট পার্টির হিন্দু কমরেডদের সবাইকে ভারতে চলে যেতে বলো। আমি যতটুকু বুঝতে পারছি, পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে হিন্দুদের ওপর প্রথম আঘাতটা আসবে।’ লায়লা কবীর বললেন রণেশদা, সত্যেনদা, জিতেনদা এবং অন্যদের পর্যায়ক্রমে পাঠিয়ে দিতে। আমি তাকে জানালাম সত্যেনদা ঢাকায় নেই। মুন্সীগঞ্জ গেছেন। আর ওঁদের পাঠাতে হলে তো টাকা লাগবে। লায়লা কবীরের কাছে ৫০০ টাকা ছিল। আমার হাতে সাড়ে তিনশ টাকা তুলে দিলেন। এ টাকা তখন অনেক টাকা। সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে আমি ন্যাপ থেকে মাসিক ভাতাই পেতাম পঞ্চাশ টাকা। এমনকি পীর হাবিবুর রহমানও মাসিক ভাতা পেতেন পঞ্চাশ টাকা। আত্মগোপনে থাকা কমিউনিস্ট নেতারা ২৫ মার্চের পর ঢাকায় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতেন। কারণ তাঁদের কেউ চিনত না। আর বাঙালি গোয়েন্দারা দখলদার পাকিস্তানি সেনাদের এ ব্যাপারে সহযোগিতাও করতেন না। আমাদের যোগাযোগের পর কমিউনিস্ট নেতা খোকা রায়, আবদুস সালাম (বারীণ দত্ত), জ্ঞান চক্রবর্তী ও মোহাম্মদ ফরহাদ এবং ন্যাপনেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, পঙ্কজ ভট্টাচার্য, মতিয়া চৌধুরী, সরদার আবদুল হালিমসহ অনেকে আগরতলা চলে যান। মণি সিংহ রাজশাহী জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সীমান্ত অতিক্রম করেন কিন্তু জেলখানায় আমার দেয়া পার্কার-৫১ কোটের পকেটে রেখে চলে আসেন।
ক’দিন বাদে গৌরাঙ্গ খবর নিয়ে এলেন, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা মারা গেছেন। তাঁকে দাহ করার টাকা লাগবে। লাকড়ির জন্যে চল্লিশ টাকা দিলাম। জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার স্ত্রী বাসন্তী গুহঠাকুরতা তাঁর ‘স্মৃতি ৭১’ বইতে লিখেছেন, ‘মোনায়েম বলছেন জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে দাহ করা হয়েছে। আর ড্রাইভার চিকমালী বলছে তাঁকে কবর দেয়া হয়েছে। এখন কোনটা সঠিক?’ আমি বাসন্তী গুহঠাকুরতার প্রশ্নের জবাব দিতে পারিনি। যেহেতু আমরা কেউ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার শেষকৃত্যে উপস্থিত থাকতে পারিনি, আমরা জানি না কোনটা সঠিক।
একটি কথা আমি বহুবার শুনেছি সেটা হলো পাক বাহিনী রাত সাড়ে দশটা বা এগারোটায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে মধ্যরাতে কেন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে পৌঁছালো? এত সময় লাগল কেন তেজগাঁও থেকে ধানমন্ডি আসতে? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে ড. এবিএম আবদুল্লাহ’র লেখা নিবন্ধে ‘২৫ মার্চ, ১৯৭১ : কালরাত্রে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রথম ছোবল ও প্রতিরোধ’। পাক বাহিনী ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়েই ফার্মগেটে বাঙালির ব্যারিকেডের মুখে পড়ে, সেই ব্যারিকেড ভাঙতে তাদের অনেক সময় লাগে। ফার্মগেটের ব্যারিকেড ভেঙে তারা ছড়িয়ে পড়ল অপারেশন সার্চলাইট অনুযায়ী ঢাকা শহরের বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য এলাকায়। জগন্নাথ হল, ইকবাল হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল এবং রোকেয়া হল, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, ইপিআরÑ তাদের লক্ষ্য। শুরু হলো গণহত্যা। ঘুমন্ত নগরীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। বিশ্ববিদ্যালয়ে শত শত ছাত্র নিহত হলো। ড. গোবিন্দ দেব, ড. মনিরুজ্জামানসহ বহু শিক্ষককে হত্যা করা হলো।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা, নির্যাতন, নিপীড়ন, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ ইত্যাদির মাধ্যমে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে বাংলাদেশে গণহত্যা অভিযানের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের সেনানিবাসগুলোতে অবস্থানরত বাঙালি সামরিক অফিসার ও সৈন্যদের হত্যা করা; এখানকার পুলিশ, ইপিআর, আনসার বাহিনীর সব বাঙালি অফিসার ও সদস্যদের হত্যা; ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনাসম্পন্ন সব শিক্ষক ও ছাত্র হত্যা; আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলো এবং ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়ন প্রভৃতি রাজনৈতিক সংস্থার অঙ্গসংগঠনের সব নেতা ও কর্মীকে হত্যা; বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নির্মূল করা এবং বাঙালি মুসলমানদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করা। ২৫ মার্চের গণহত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে এক কলঙ্কময় অধ্যায়ের নাম। এই কলঙ্কময় ইতিহাস বাঙালি জাতি কোনোদিন ভুলবে না।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
০৪ জুন, ২০১৮