মানুষ সমাজবদ্ধ রাজনীতিসচেতন জীব। জীবন-যাপনের জন্য মানুষকে সমাজে বসবাস করতে হয়। তৈরি করতে হয় নানারকম প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র মানবরচিত সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য রাজনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটি রাষ্ট্র কীরকম হবে, কেমন হবে তার শাসন ব্যবস্থা ও জনজীবন তা রাজনীতির আলোচ্য বিষয়। যুগে যুগে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ রাজনীতির নানারকম তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন। গ্রীক দার্শনিক প্লেটো-আরিস্টটল থেকে শুরু করে নতুন যুগের নতুন মানুষেরাও রাজনীতি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছেন। যতদিন রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠান থাকবে ততদিন মানুষ রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাবে এটাই স্বাভাবিক।
আদিম সমাজ থেকে আধুনিক যুগে আসতে মানুষকে হাজার হাজার বছরের পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। এই পথ পরিক্রমায় মানুষ অর্জন করেছে নানা রকম অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতায় ভর করে সামনে আসা সমস্যাকে সমাধানের চেষ্টা করেছে ভবিষ্যৎমুখী মানবসমাজ। মানুষ চায় সুন্দরভাবে বাঁচতে। কিন্তু চাইলেই মানুষ সুন্দর জীবন পায় না। এই জন্য তাকে লড়াই করতে হয়, অবিরাম সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে হয়।
এক সময় পৃথিবীতে সাম্য ছিল, বনচারী মানুষ সাম্যের পতাকাতলে নিজেকে নিয়ে সুখেই ছিল। পুঁজির চিন্তা মাথায় এলে মানুষ সাম্যাবস্থার শর্ত ভেঙে দাসপ্রথা কায়েম করে। দাসদের জীবন ছিল অত্যন্ত যন্ত্রণাকর। শুরু হয় দাসবিদ্রোহ। সেই মহাবিদ্রোহে দাসপ্রথা ভেঙে সামন্তসমাজ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। সামন্ত সমাজ ব্যবস্থাও তার অস্বাভাবিক লোভ ও শোষণের কারণে মুখ থুবড়ে পড়ে। সামন্ত সমাজের পতনের পরে পৃথিবীতে জেঁকে বসে সর্বগ্রাসী পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। পুঁজিবাদের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে আবার সাম্যবাদে ফিরে যাওয়ার জন্য তাগিদ অনুভব করেন কিছু মানববাদী মানুষ। এদের মধ্যে কার্লমার্কস, এঙ্গেলস, লেলিনের নাম অগ্রগণ্য। তবে এখানে বলে রাখা ভালো যে, প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থেও সাম্যবাদের কথা উল্লেখ আছে। প্লেটোকে আমরা হয়তো সাম্যবাদের প্রবক্তা বলে মানি না, কিন্তু সাম্যবাদের কথা প্লেটোর দার্শনিক মনেও উঁকি দিয়েছিল এ কথা ভুলে গেলে চলবে না।
প্রতি মুহূর্তে বৈশ্বিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। সেই সাথে বদলে যাচ্ছে দৈশিক অবস্থা, প্রকৃতি ও জলবায়ু। আগে এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের যে সম্পর্ক ছিল সেই সম্পর্ক এখন আরো বেশি ঘনিষ্ঠ বা শত্রুতাপূর্ণ। পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। যিনি সভ্যতার জটিলতাকে যত বেশি চিনতে পারবেন, বুঝতে পারবেনÑ তার পক্ষেই সম্ভব হবে সভ্যতাবিনাশী সূত্রগুলো দ্রুততার সঙ্গে আবিষ্কার করা। আজ এক দেশে পরিবর্তন এলে সেই পরিবর্তনের ছোঁয়া অন্য দেশেও লাগে। বিশেষ করে মিত্রদেশগুলোতে পরিবর্তন অনুভব না করে উপায় থাকে না।
একবিংশ শতাব্দী নানা কারণেই পৃথিবীর মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এই শতাব্দীতে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যে উৎকর্ষ লাভ করেছে তাতে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত না হয়ে পারে না। আজকের দুনিয়ায় কোনো কিছু গোপন করার সুযোগ নেই। সবকিছুই মানুষ দেখতে পারে, নিজের বিচার-বুদ্ধি দিয়ে যাচাই-বাছাই করতে পারে। ফলে কয়েক দশক আগেও রাজনীতির যে চেহারা বা ব্যাকরণ ছিল এখনকার রাজনীতির চিত্র তার চেয়ে ভিন্ন। শুধু ভিন্ন নয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিপরীতধর্মী।
মার্কসবাদ এক সময় ভীষণ জনপ্রিয় রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে গণ্য ছিল। এখনও মার্কসবাদ গুরুত্ব হারায়নি তবে মার্কসবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে মানুষ আজ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই আস্থা রাখতে প্রয়াসী। পৃথিবীতে কিছুদিন আগেও সামরিক শাসকের দৌরাত্ম্য ছিল। ৭০টির মতো দেশে এই সেদিনও কায়েম ছিল সামরিক শাসন ব্যবস্থা। গণমানুষের সম্মিলিত আন্দোলনে সামরিক শাসন ব্যবস্থা আজ বিকল হয়ে পড়েছে। সামরিক শাসক হতে আজ আর কেউ আগ্রহ দেখায় না, কেননা মানুষের রুচি বদলে গেছে, পরিবর্তন হয়ে গেছে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির।
মানুষ চিন্তাশীল প্রাণী। সে শুধু একা একাই বাঁচতে চায় না, অন্যকেও বাঁচার সুযোগ দিতে চায়। যূথবদ্ধতা আদিম মানুষের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলেও আধুনিক মানুষ এই যৌথ জীবন থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়নি। যদিও আধুনিক জীবন ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদে চরমভাবে বিশ্বাসী, তাই বলে সামগ্রিক জীবনাকাক্সক্ষ তার কাছে অবজ্ঞা অবহেলার নয় বরং প্রার্থিত। নিজের প্রয়োজনে যেমন, তেমনি অন্যের প্রয়োজনেও মানুষ যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত। এই যে অন্যের জন্য প্রাণ বিসর্জনের প্রচেষ্টা এর পেছনেও আছে রাজনৈতিক চেতনা।
আজ এক দেশে সংঘাত হলে অন্য দেশ হাত গুটিয়ে বসে থাকে না, একটি দেশ নিপীড়নের শিকার হলে অন্য দেশ হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়। হয়তো এর পেছনে পুঁজিবাদী মানসিকতাও থাকে। তবে সবকিছুর পরে এ কথা বলতেই হবে এটাও প্রাক্তন ধ্যান-ধারণা পরিবর্তনেরই সংকেত।
এক সময় পৃথিবীর দেশে দেশে অসংখ্য মহান নেতা জন্ম নিয়েছিলেন। ভারতের মহাত্মা গান্ধী, আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, আমেরিকার আব্রাহাম লিংকন, রাশিয়ার লেনিন, ভিয়েতনামের হো চে মিন, চীনের মাও সে তুঙ, বাংলাদেশের শেখ মুজিব প্রমুখ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কখনো কখনো পরাধীন জাতিকে লড়াই-সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে স্বাধীনতা এনে দিয়ে গেছেন, কখনো নির্মাণ করেছেন সম্প্রীতির সেতু। এই মানবপ্রেমী নেতৃবর্গ নিজেদের জীবনবাজি রেখে বুক ঠেকিয়ে দিয়ে শত্রু পক্ষের বন্দুকের নলের সামনে একটি মহান আদর্শকে বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন। এখনকার দিনে এমন কোনো মহান নেতার খবর অন্তত আমার জানা নেই, যিনি নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও জনগণের কথা ভাবেন বা ভেবেছেন। আজকের দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্র্যাম্পকে নিয়ে সারা পৃথিবীর মানুষ উদ্বিগ্ন। খামখেয়ালি এই মানুষটা যখন নির্বাচনে দাঁড়ান তখন থেকেই তার পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরেও আলোচনার ঝড় থামেনি। কেন তিনি এত সমালোচিত? এর কারণ তিনি প্রকৃত রাজনীতিক নন। তিনি একজন ব্যবসায়ী, বিশ্বের অন্যতম ধনী মানুষ। আগের দিনে ধনী মানুষেরা জনসেবা করতে, সুনাম অর্জনের জন্য এখনকার দিনে ধনী মানুষেরা রাজনীতি করেন ধন-সম্পদ রক্ষা করার জন্য, নিজের আধিপত্য বিস্তার করার জন্য। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণই নয়Ñ পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশের দেশপ্রধানই এখন কোনো না কোনোভাবে ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
বিশ্ব রাজনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতেও লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া। আমাদের রাজনীতিতে বর্তমানে ব্যবসায়ী অনুপ্রবেশ প্রবণতা সাংঘাতিক আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যবসায়ীরা যেভাবে রাজনীতিতে বেনোজলের মতো ঢুকে পড়ছে তাতে দেশের সৎ,যোগ্য ও মেধাবী রাজনীতিবিদরা তো কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছেই, সঙ্গে সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষও বঞ্চিত হচ্ছে যথাযত রাজনৈতিক সেবা থেকে। অতীত দিনের রাজনীতির অঙ্গনে আমরা সেই মানুষগুলোকেই দেখছে যারা দেশের জন্য ও দেশের মানুষের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। আজ যারা ব্যবসায়ী নেতাÑ যারা টাকার জোরে রাজনীতির মঞ্চ দখল করেছেন, তাদের কাছে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা সবকিছুই ভূ-লুণ্ঠিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যখন বাংলাদেশের হাল ধরেছিলেন তখনও এদেশের রাজনীতি সঠিক পথেই ছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরে জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিকে একেবারে নষ্ট করেছেন। তিনি বলেন I shall make politics dificult for politicians. তিনি শুধু পলিটিশিয়ানদের জন্যই পলিটিক্স জটিল করেননি, তিনিই বাংলাদেশের রাজনীতিতে অবৈধ টাকার ছড়াছড়ি করেন। তার বহুল উচ্চারিত উক্তির আরেকটি হলো ÔMoney is no problemÕ। জোড়াতালি দেওয়া পার্টি বিএনপি গঠন করার জন্য জিয়া দেশরক্ষার মহান কাজে নিয়োজিত সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেন। তিনি এমন এমন ব্যক্তিকে রাজনীতির মাঠে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন যারা দেশের চিহ্নিত অপরাধী ও অবৈধ টাকার মালিক। শুধু তাই নয়Ñ ’৭১ সালের দেশদ্রোহী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী রাজাকারদের জিয়াই রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেন।
এরপরে আসেন আরেক জেনারেল এইচ.এম. এরশাদ। তিনিও জিয়ার মতো জাতীয় পার্টি গঠন করেন সেনাসদস্য, অস্ত্র ও টাকার উপর ভিত্তি করে। এরশাদের জাতীয় পার্টিতে একে একে এসে যোগ দেয় সুযোগ সন্ধানী আমলা, সেনা কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীগণ। এরশাদের পরে ১৯৯১ সালে নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হলে সেই নতুন সরকারের মধ্যেও দেখা যায় ব্যবসায়ী, সামরিক ও আমলাতান্ত্রিক আধিপত্য। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের শুধু অরাজনৈতিক ব্যক্তিরাই রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছে এমন নয়Ñ সেখানে জঙ্গিরাও ব্যাপক হারে অনুপ্রবেশ করেছে। খালেদা জিয়া জঙ্গিদের যেভাবে মদদ দিয়ে বাংলার মাটিতে প্রতিষ্ঠিত করার ষড়যন্ত্র করতে থাকেন সেই ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে আজ হয়তো বাংলাদেশে রাজনীতিবিদ বলতে সাধারণ মানুষ জঙ্গি ও রাজাকারদেরই বুঝতো।
এক সময় পৃথিবীব্যাপী কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন বেগবান ছিল। আমাদের দেশেও এসব আন্দোলনের পাশাপাশি ছাত্র আন্দোলন গতিশীল ছিল। পত্রিকার পাতা খুললেই ছাত্র রাজনীতির ঘৃণ্য ও চাঞ্চল্যকর খবর দেখা যায়। যা মোটেই কাক্সিক্ষত নয়। আজ আমাদের নতুন করে ভেবে দেখা দরকার আসলেই ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজন আছে কিনা। আজ বাংলাদেশের জনগণ রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠছে। এ কারণে নেতার নির্দেশে মাঠে মিছিলে যাবার আগে ভেবে নেয়Ñ মিছিলে যাওয়া ঠিক হবে কিনা। যার ফলে আগে নেতারা ডাক দিলেই যেভাবে সাধারণ মানুষ এসে জড়ো হতো এখন তা হয় না। এখন পেট্রোল বোমা মারতে গেলে মানুষ ভাড়া করতে হয়, হরতাল দিয়ে গাড়ি ভাঙতে গেলেও মানুষ ভাড়া করতে হয়। এমনকি ইস্যুহীন সভা-সেমিনারের জন্যও তৈরি রাখতে হয় প্যাকেট বিরিয়ানি। রাজনীতিতে গণসম্পৃক্ততা কমার কারণ হলো গণমানুষের জীবনমান ও দৃষ্টিভঙ্গির বদল। বাংলাদেশের রাজনীতি এখন বিশ্বের রাজনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়েই চলছে। আমরা হয়তো উন্নত বিশ্বের মতো অত আপডেট নইÑ কিন্তু এ কথা বলা মোটেই বাহুল্য নয় যেÑ আমরা উন্নত বিশ্বের মতো হওয়ার জন্যই এখন চোখ মেলে তাকিয়ে আছি। আধুনিক রাজনীতি ও রাষ্ট্র দুটোই এখন আমজনতার সেবা দিতে বাধ্য। কেননা জনতা যদি রাষ্ট্র ও রাজনীতি সম্পর্কে অনাস্থা প্রকাশ করে, তাহলে সবকিছুই মুখ থুবড়ে পড়বে। রাজনীতির কাজই হলো সামনের দিকে এগিয়ে চলা। পেছনে পড়ে থাকা নয়।
১৩ জুলাই, ২০১৭