বর্তমান পৃথিবী হিংসা, দ্বন্দ্ব, যুদ্ধ ও স্বার্থপরতায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। তাই দেশে-দেশে ও মানুষে-মানুষে মারামারি, কাটাকাটি, রক্তপাত লেগেই আছে। মানুষের জন্য যা ক্ষতিকর সেসব করা মানুষের উচিত নয়। তবু মানুষ অর্থের মোহে অন্ধ হয়ে বা ক্ষমতার অপব্যবহার করতে এমন কিছু আবেগী সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে, যা সভ্যতার জন্য কলঙ্ক তিলক হয়ে থাকে। যুদ্ধ পৃথিবীতে কেউ চায় না, তবু আজ পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আছে। এই ভয়াবহ যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে আজ মানুষ মুক্তি চায়, চায় সার্বিক শান্তি। কিন্তু শান্তির পথে না হেঁটে মানুষ যদি অস্ত্রের পথে হাটে ও অস্ত্রের ভাষায় কথা বলে, তাহলে রক্ত¯্রােত বন্ধ হবে না, বন্ধ হবে না ঘরে ঘরে নর-নারী ও শিশুর ক্রন্দন।
পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যত রকমের শোষণ দেখা গেছে তার মূলে ছিল অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তার। অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করতে না পারলে পৃথিবীতে মোড়লগিরি করা যায় না, দাপটের সঙ্গে চলাফেরা করা যায় না, তাই নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর বারবার জোর দিয়েছে মানুষ। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য যা কিছু করার দরকার, কোনো কোনো রাষ্ট্র এখন সেসব কিছুই করছে।
বলতে দ্বিধা নেইÑ পুঁজিবাদ পৃথিবীকে এখন মরণ কামড় বসিয়ে চলছে। যারা বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছেন বা বিশ্ব রাজনীতি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করছেন, তারা নিশ্চয়ই টের পাচ্ছেন পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে এখন ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে। এই ক্যান্সার পরিস্থিতি চিকিৎসার বাইরে চলে গেছে। এখন যত দিন যাবে ততই পুঁজিবাদ দুর্বল হয়ে পড়বে, শক্তি কমে আসবে তার অসুর শরীরে। এক তরফা দাপট দেখিয়ে পৃথিবীকে বহুদিন শাসন করেছে পুঁজিবাদী প্রভুরা। পুঁজিবাদ যেভাবে পৃথিবীতে অনাচার-অত্যাচার ও মানবিকতার পতন ঘটিয়ে যাচ্ছে তাতে তার মৃত্যু ঘণ্টা বাজতে আর বেশি দেরি নেই।
দুর্নীতি সারা বিশ্বে এখন মহামারীর আকার ধারণ করেছে। এমন কোনো দেশ নেই, এমন কোনো সমাজ নেই সেই দেশে যেই সমাজে দুর্নীতি নেই। দুর্নীতির পেছনে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি ক্রিয়াশীল থাকে তার নাম ‘অর্থ’। অর্থ বানানোর জন্যই মানুষ দুর্নীতির খাতায় নাম লেখায়। আজ সুযোগ পেলেই মানুষ দুর্নীতি করার জন্য তৎপর হয়ে উঠছে। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে সবাই দু’হাতে টাকা কামানোর ফিকিরে ব্যস্ত। নির্বিচারে টাকা কামানোর বা সম্পদের পাহাড় গড়ার প্রবণতা সামাজিক সাম্য রক্ষার জন্য হুমকি স্বরূপ। পুঁজিবাদী বিশ্বে দুর্নীতি যত সীমাহীন হবে, পুঁজিবাদের মৃত্যু ততই নিকটে আসবে, এটাই পুঁজিবাদের নিয়তি।
গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বায়ন থিউরি পুঁজি বিকাশের জন্য উন্নত দেশের এক বিরাট ধাপ্পা। বিশ্বায়নের নামে এখন চলছে ছদ্ম-উপনিবেশবাদ। বলতে গেলে বিশ্বে এখন দুই রকম উপনিবেশবাদ কার্যকর আছেÑ এক. জোরপূর্বক ভূমি দখল, দুই. ভূমি দখল না করেও বাজার দখল। বিশ্বায়ন হলো সেই তত্ত্ব যেই তত্ত্বের বলে ভূমি দখল না করেও বাজার দখল করতে সক্ষম হয়েছে ধনী ও শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো। বিশ্বায়নকে পজেটিভ অর্থেই প্রথম সারাবিশ্বে প্রচার করা হয়। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই মোহভঙ্গ হয় সাধারণ মানুষের। তারা বুঝতে পারে বিশ্বায়ন মূলত গরিব দেশগুলোকে শোষণ করারই একটি অভিনব পদ্ধতি। এখন বিশ্বায়ন তত্ত্বের কুফল মানুষ বুঝতে পারছে, কিন্তু ততদিনে অনেক বেশি ফুলে-ফেঁপে উঠেছে সর্বনাশী পুঁজিবাদ।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো এখনও পৃথিবীতে অনেক কোম্পানি আছে, যারা ভিন্ন নামে ভিন্নভাবে দেশে দেশে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এদের নতুন নাম হয়েছে ‘মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি’। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির প্রধান কাজ কমিশন দিয়ে কাজ নেওয়া। এই কমিশনকে সহজ ভাষায় ‘ঘুষ’ও বলা যেতে পারে। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো এক টাকার পণ্য একশ টাকায় বেঁচতে চায়। এই জন্য যা যা করার দরকার পড়ে তারা তাই করে।
এই কোম্পানিগুলো এত পরিমাণ অবৈধ অর্থের মালিক যে ছোটোখাটো দেশের রাজনীতিতেও এরা প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা রাখে। এদের দৌরাত্ম্য দিনে দিনে বেড়েই চলছে। এভাবে যদি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির আধিপত্য বৃদ্ধি পায়Ñ তাহলে আবার ফিরে আসবে উপনিবেশের কাল। যেটা এখন আফ্রিকায় সূচনা হয়েছে। খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ আফ্রিকার উপরে পৃথিবীর শক্তিশালী দেশগুলো তাদের বিষদাঁত ফুটিয়ে কামড়ে ধরেছে। সম্প্রতি চীনও সেখানে ভাগ বসানোর জন্য সদলবলে ছুটে গেছে। আফ্রিকা যে নব্য উপনিবেশ হতে যাচ্ছে এটা মোটামুটি পরিষ্কার।
বিশ্ব আজ একটি মারাত্মক সংকটের ভিতর দিয়ে অতিক্রম করছে। এই সংকটের নাম আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদ। জঙ্গিবাদ জনজীবনে হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। গভীরভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে, জঙ্গিবাদের পেছনে রয়েছে পুঁজিবাদের গোপন অভিপ্রায়। কি সেই অভিপ্রায়? জঙ্গিবাদ সৃষ্টির পেছনে আছে রমরমা অস্ত্র ব্যবসা। মারণাস্ত্র ব্যবসা এখন সবচেয়ে লাভজনক খাত। এই খাতে ধনী দেশগুলো কোটি কোটি বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। দেশে দেশে সৃষ্টি করছে জঙ্গিগোষ্ঠী। আমরা যদি পেছনের ইতিহাস খেয়াল করি, তাহলে দেখবো পৃথিবীর বৃহৎ জঙ্গি সংগঠন ‘আল-কায়েদা’কে সৃষ্টি করেছিলো মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি।
আল-কায়েদার কাঁধে বন্দুক রেখে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদীরা আফগানিস্থানকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আফগানিস্থানের সমস্ত সম্পদ লুট করে নেয় মার্কিনিরা। এমন কি ইরাকে যে মার্কিন হামলা হলো টুইন টাওয়ার ধ্বংসের অজুহাত্ েসেই হামলার সঙ্গে আল-কয়েদার সংযোগ স্থাপন করে ইরাক দখল করে পুঁজিবাদী গোষ্ঠী। ‘আল-কায়েদার’ পতন হতে না হতেই পুঁজিবাদী মার্কিন গোষ্ঠী সৃষ্টি করে আরেক নতুন জঙ্গি গোষ্ঠী যারা ‘আইএস’ নামে খ্যাত। বিভিন্ন অনুসন্ধানে বের হয়ে আসছে ‘আইএস’ সৃষ্টির পেছনে মার্কিনিদের হাত রয়েছে। আইএস বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনেছে আমেরিকার নিকট থেকে, ইরাক-সিরিয়া-মিশরসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আইএস একটি শক্তিশালী জঙ্গি সংগঠন। আইএস এখন কিছুটা দুর্বল হয়ে গেছে। তাদেরকে দুর্বল করার ক্ষেত্রে আমেরিকার ভূমিকার পাশাপাশি রাশিয়ারও হাত রয়েছে।
সা¤্রাজ্যবাদী আমেরিকা বুঝে ফেলেছে আইএস দিয়ে তারা যা করতে চেয়েছিল তাদের সেই উদ্দেশ্য সফল হয়ে গেছে। এখন আর আইএস দরকার নেই। তাই যেই আইএস দানব তারা নিজের হাতে সৃষ্টি করেছিল সেই আইএসকে এখন তারা নিজেরাই ধ্বংস করে ফেলছে। আইএস’র পতন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আইএস’র পর এখন আবার কোন্ জঙ্গিগোষ্ঠী তৈরি হয় সেটাই দেখার বিষয়। অনেকেই আশঙ্কা করছেনÑ পৃথিবীতে খুব শীঘ্রই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধবে। এমনটি ভাবার কোনো কারণ আপাতত আছে বলে মনে হয় না। তবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয় দেখিয়ে ছোট ছোট দেশগুলোকে অস্ত্র-শস্ত্র কিনতে বাধ্য করবে অস্ত্র উৎপাদনকারী দেশগুলো। ইতোমধ্যে বেশকিছু দেশে অস্ত্র বিক্রি করার জন্য তোড়জোর শুরু করেছে আমেরিকা। আমেরিকার অর্থনীতি এখন ধুকতে শুরু করেছে, অস্ত্র ব্যবসা ও যুদ্ধ ব্যয় সামলাতে গিয়েই তাদের অর্থনীতি সংকটের মুখে পড়েছে। আমেরিকা এখন অর্থের জন্য পাগল হয়ে গেছে। তাদের এই পাগলামি পৃথিবীকে কোথায় নিয়ে যায় তা বলা মুশকিল।
মানুষের মধ্যে একটা প্রবণতা আছে যেটা হলো কেউই ঠকতে চায় না। সবাই জিততে চায়, নিজেকে অন্য মানুষের চেয়ে শক্তিশালী দেখতে চায়। আজ যদি আমরা উত্তর কোরিয়ার দিকে তাকাই, তাহলেই এই কথাটার সত্যতা বুঝতে পারি। গরিব দেশ উত্তর কোরিয়া বুঝে ফেলেছে পুঁজিপতি হতে হলে শক্তি প্রদর্শনের বিকল্প আর কিছু নেইÑ তারা এখন আমেরিকাকে হুমকি দিচ্ছে। উত্তর কোরিয়ার হুমকিতে আমেরিকা যে মোটেই ভয় পাচ্ছে না এ কথা বলার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।
আমার এক বন্ধু একটা কথা বলতোÑ ‘জব্বারের মাথায় বল দুইদিকে গোলকিপার সাবধান।’ পৃথিবীর দেশে দেশে এখন পাগল ধনীপতিরা রাষ্ট্রনায়ক হয়ে বসে আছে। এরা কখন কোন অঘটন ঘটায় তা কেউ বলতে পারে না। উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জন থেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্র্যাম্প প্রত্যেকেই শক্তি প্রদর্শনে ব্যস্ত। এই শক্তি প্রদর্শন পুঁজিবাদের কবর খুড়ছে বলেই আপাতত মনে হচ্ছে।
বিশ্ববাসী বিগত দিনে অনেক যুদ্ধ দেখেছে। মানুষ আর যুদ্ধ দেখতে চায় না। মানুষকে যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য পৃথিবীর সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, এই জন্য গণবিধ্বংসী মরণাস্ত্র উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। যেসব দেশের হাতে মারণাস্ত্র আছে সেসব দেশকেও বাধ্য করতে হবে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র ধ্বংস করার জন্য। পৃথিবীতে অস্ত্র ব্যবসা ও মাদক ব্যবসা সবচেয়ে লাভজনক হলেও এ দুটোকে বন্ধ করতে হবে। কেননা অস্ত্র ও মাদক বিক্রির জন্য দেশে দেশে ইচ্ছাকৃত সংকট সৃষ্টি করা হয়Ñ বাঁধিয়ে দেওয়া হয় যুদ্ধের মতো জীবন বিপন্ন পরিস্থিতি।
পুঁজিবাদীর সব ফন্দিই মানুষ এখন বুঝে ফেলেছে। মানুষকে বোকা বানিয়ে আর তাদের শোষণ করা যাবে না। পুঁজিবাদ এখন যদি সাবধান ও সংযমের পরিচয় না দেয়, তাহলে তার ধ্বংস অনিবার্য। মানুষের জীবন নিয়ে রক্তের হোলি খেলা বন্ধ না হলে মানুষই পুঁজিবাদের কবর রচনা করবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে যেই অস্ত্র বিক্রির জন্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো উন্মাদ হয়ে উঠেছে, সেই অস্ত্র আর কিছুদিন পরে তাদের দিকেই তাক করে ধরা হবে।
৩১ জুলাই, ২০১৭