মুজিবনগর সরকারের সংকট ও সাফল্য
মোনায়েম সরকার:
ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তে স্নাত পুণ্যভ‚মির নাম বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। দীর্ঘ নয় মাসে রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যে নবজাত রাষ্ট্র পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়ায় তাঁর অতীত ইতিহাস বড়ই করুণ ও অশ্রæসিক্ত। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের এই গৌরবদীপ্ত মুহূর্তে যখন অতীত দিনের কথা মনে করছিলাম তখন চোখের সামনে ভেসে উঠছিল মুজিবনগর সরকারের নানামুখি সংকট ও অবিশ্বাস্য সাফল্যগাথা। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধার মতো আমিও বিনিদ্ররাত্রিযাপন করেছি বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য। ক্ষুধামুক্ত, ধর্মনিরপেক্ষ, সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গঠন করার লক্ষ্যে সেদিন কোটি কোটি বাঙালি জীবন বাজি রেখে শত্রæর মুখোমুখি যুদ্ধ করেছিল। সেই ভয়ঙ্কর যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল ‘মুজিবনগর সরকার’। কিভাবে দ্রæততম সময়ের মধ্যে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়ে স্বল্পলোকবল নিয়েই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সংক্ষেপে সেই ইতিহাস তুলে ধরতে চাই।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় বাঙালি জাতির মনে রাষ্ট্রশাসনের অভিপ্রায় জাগ্রত করে। কিন্তু ক্ষমতালোভী পাকিস্তানি শাসকবর্গ বাঙালিদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে একের পর এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ৭ তারিখে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তাঁর এই ভাষণে তিনি সুকৌশলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং দশ লক্ষ লোকের ওই গণসমাবেশে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার দিক-নির্দেশনা প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু সেদিন সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করলে পাকিস্তানি সরকার সমাবেশে গুলিবর্ষণ করে অসংখ্য মানুষ হত্যা করতো। এমনই পরিকল্পনা ছিল পাকিস্তানিদের। বঙ্গবন্ধু নিজেও সে-সম্পর্কে অবগত ছিলেন। এ কারণেই অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তিনি উচ্চারণ করেছিলেনÑ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ আমি নিজেকে এ কারণে সৌভাগ্যবান মনে করছি যে, সেদিনের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ স্থপতি মজহারুল ইসলাম ও আমি দূর থেকে মাইকের কাছে টেপরেকর্ডার ধরে রেকর্ড করেছিলাম।
বস্তুতপক্ষে, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পরেই বাংলাদেশ পুরোপুরি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলতে শুরু করে। বাংলার মানুষ বুঝে ফেলে পাকিস্তানি সামরিক সরকার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তাই তারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্বাধীনতা-সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে বঙ্গবন্ধু চুপ করে বসে থাকেননি। তিনি ভবিষ্যতের ভয়াবহ যুদ্ধের কথা নানা মাধ্যম থেকে আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত চার সহযোগী, পরবর্তীতে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে নিয়ে আওয়ামী লীগের হাইকমাণ্ড গঠন করেন।
এদের উপর নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার। জীবনবাজি রেখে জাতীয় চারনেতা বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাঁর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। ২৫ মার্চ সকাল থেকেই বাংলাদেশের থমথমে পরিস্থিতি টের পাওয়া যায়। এইদিন সকাল থেকে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাসভবনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের জরুরি পরামর্শ দিয়ে আত্মগোপনের নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু। নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পেয়ে যে-যার মতো নিরাপদ স্থানে সরে পড়েন। ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরু হলে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার কিছুক্ষণ পরেই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের হাতে নিজ বাড়িতে বন্দি হন।
বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি তখন তাঁর সহচরগণ ভারতের মাটিতে অবস্থান করে স্বাধীন বাংলা সরকার গঠনের ব্যাপারে নিরলস পরিশ্রম করেন। ২৫ মার্চ যখন আক্রমণ হয় বাংলার নিরীহ মানুষের উপর, তার কিছুদিন পূবেই বঙ্গবন্ধু কলকাতার ৩ নম্বর রাজেন্দ্রপ্রসাদ রোডের চিত্ত সুতারের বাড়ি নির্বাসিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের থাকার জন্য ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু কোনো ঠিকানাই তাজউদ্দীন আহমদের কাছে লেখা ছিল না। তিনি চিত্ত সুতারকে পেলেন না। তাকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে কয়েকজন বিএসএফের জোয়ান সীমান্তের ওপারে নিয়ে যান। সেখানে তাজউদ্দীন আহমদকে অভ্যর্থনা জানান বিএসএফের আঞ্চলিক প্রধান গোলক মজুমদার। গোলক মজুমদার তাজউদ্দীন আহমদকে পেয়ে হাতে যেন আকাশের চাঁদ পেয়ে যান। গোলক মজুমদার পরবর্তীতে ইন্দিরা গান্ধী সরকারের উর্ধ্বতন ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি রাশিয়ান কার্গো বিমানে অতীব গোপনে কলকাতা থেকে তাজউদ্দীন আহমদকে দিল্লি নিয়ে যান। এরপর একের পর এক মিটিং চলতে থাকে। মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় সুশৃঙ্খলভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে হলে সরকার গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। এ প্রসঙ্গে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পিএন হাকসারের ভ‚মিকা উল্লেখযোগ্য।
বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে কিভাবে এই ‘প্রবাসী সরকার’ গঠিত হবে তা নিয়ে তাজউদ্দীন সাহেব খুবই চিন্তায় পড়েন। মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে এর প্রতিক্রিয়া কি হবে তা তাজউদ্দীন আহমদ অনুমান করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে প্রথম প্রথম কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিলেন। সেদিন যদি সমস্ত অভিযোগ, অপমান সহ্য করে অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ মুজিবনগর সরকারের দপ্তর আগলে না রাখতেন, তাহলে বাংলাদেশ আজো স্বাধীন হতো কিনা সন্দেহ। ঢাকাস্থ তদানীন্তন ভারতীয় হাই কমিশনার সুবিমল দত্তকে তাজউদ্দীন আহমদ একবার একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎকারে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, কিভাবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি সুবিমল বাবুকে বলেছিলেন, ‘আমি অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যে ধরনের নিঃসঙ্গতায় সেই ৯ মাস কাটিয়েছিলাম, বঙ্গবন্ধুও সরকার পচিালনা করতে গিয়ে খুবই একাকীত্ববোধে ভুগছেন। এক সময় যারা তার খুব কাছের লোক ছিল, আজ তারা তাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে। অনেকে গেছে তাদের রাজনৈতিক উচ্ছাকাক্সক্ষার জন্য। কয়েকজন গেছে মতের অমিলের জন্য, যদিও তারা মন-প্রাণ দিয়ে তাকে ভালোবাসেন এবং তার জন্য তারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতেও রাজি।’ মুজিবনগর সরকার গঠনের শুরু থেকেই খন্দকার মোশতাক ও শেখ ফজলুল হক মনি তাজউদ্দীন আহমদকে কোণঠাসা করে রাখার চেষ্টা করেন। তাজউদ্দীন আহমদ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এসব সমস্যা মোকাবিলা করেন। এ জন্য মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তিনি যে পরিশ্রম করেন তা অবর্ণনীয়।
একদিন আমি ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের অফিসে যাই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করতে। সেদিন কথায় কথায় তাজউদ্দীন ভাইকে বলিÑ আচ্ছা তাজউদ্দীন ভাই, আপনি হাফশার্ট পরেন কেন, মুজিবকোর্ট পরতে হবে সেই কারণে? তাজউদ্দীন ভাই আমাকে বললেন, ‘ওঠো’। আমি উঠলাম। এরপর তিনি আমাকে তার বাথরুমে নিয়ে গেলেন। সেখানে গিয়ে দেখলাম আরেকটা হাফশার্ট ধুয়ে তিনি হ্যাঙ্গারে টাঙিয়ে রেখেছেন। এই দুটো শার্ট পরেই তিনি দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন দেশ স্বাধীন না করে কেউ পরিবারের সঙ্গে থাকবেন না। সেদিন এ শপথ অনেকেই রক্ষা করেননি, কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ এই অঙ্গীকার রক্ষা করেছিলেন।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল। বেলা ১১টা। এই দিন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার মুক্তাঞ্চল ভবের পাড়ার বৈদ্যনাথ তলায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করে। অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কর্ণেল ওসমানী ও অন্যান্যদের নিয়ে বৈদ্যনাথ তলায় মঞ্চে এলেন। আশেপাশের গ্রাম থেকে চেয়ার আনা হয়েছে। সংগৃহীত চেয়ারগুলোর একটাও পূর্ণাঙ্গ নয়। কোনটার হাতল নেই, কোনটার বা পা নেই। ক্যাপ্টেন মাহবুব আর জনাব তওফিক এলাহী চৌধুরী তখন অনুষ্ঠানসূচি প্রণয়নে ব্যস্ত। গার্ড অব অনার দেয়ার জন্য আনসার বাহিনী প্রস্তুত। ক্যাপ্টেন মাহবুব তাদের নিয়ে গার্ড অব অনার দিলেন অস্থায়ী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে। প্রায় হাজার দুই লোক এসেছিল অনুষ্ঠানে দর্শক হিসেবে। শতাধিক বিদেশি সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার ও টিভি ক্যামেরাম্যান এসেছেন। গার্ড অব অনার ও জাতীয় সঙ্গীতের পর নেতৃবৃন্দ মঞ্চে বসলেন।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ স্বাধীনতা সনদের স্বপক্ষে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপস্থিত জনতা ও সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁর মন্ত্রিসভা-সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর ভাষণে বলেন, ‘পৃথিবীর মানচিত্রে আজ যে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হলো তা চিরদিন থাকবে। পৃথিবীর কোন শক্তি তা মুছে দিতে পারবে না। পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় পাকিস্তানের কবর রচিত হয়েছে। শত সহস্রর মানুষের মৃত্যু বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর হয়ে থাকবে। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ একটা বাস্তব সত্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি তাদের অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে যাচ্ছে। কেউই নতুন জাতিকে ধ্বংস করতে পারবে না। আজ হোক, কাল হোক, দুনিয়ার ছোট বড় প্রতিটি রাষ্ট্রই এই নতুন জাতিকে গ্রহণ করবে। স্থান দিতে হবে বিশ্ব রাষ্ট্রপুঞ্জে। আমাদের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সোভিয়েট ইউনিয়ন, ভারত এবং বিশ্বের অন্যান্য বহু দেশের স্বাধীনতা প্রিয় মানুষ যে সমর্থন দিয়েছেন, তা আমরা চিরকৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি। গণচীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, গ্রেটবৃটেন ও অন্যান্য দেশের কাছে অনুরূপ সমর্থন আশা করি। তা পেলে তাঁদের অভিনন্দন জানাবো।
এই সভায়ই কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীকে মুক্তি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী খোন্দকার মুশতাক আহমদ, মন্ত্রী পরিষদের সদস্য জনাব এম. মনসুর আলী ও জনাব এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান। কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমাধীন ভবেরপাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথতলার যে ছায়াঘেরা আম্রকাননে অনুষ্ঠিত সেই ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ এই স্থানের নতুন নামকরণ করেনÑ মুজিবনগর। সমগ্র অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আব্দুল মান্নান এমএনএ (টাঙ্গাইল)। মুজিব নগরে শপথ অনুষ্ঠানে দেশী, ভারতীয় ও বিদেশি একশ’ সাতাশ জন সাংবাদিক, শ্রী ফণিভূষণ মজুমদার, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও সোহরাব হোসেন সহ যশোর খুলনার বহু গণপ্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
গগনবিদারী স্লোগান বিপুল করতালির মাঝে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বাধীনতা সনদটি পাঠ করেন আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির চিফ হুইপ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউসুফ আলী। এই আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠের মধ্যে দিয়ে ২৬ মার্চ জাতির জনক রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন তা সাংগঠনিক রূপ নেয় এবং বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। বাংলাদেশ পঞ্চাশ বছরে পা দিয়েছে। মুজিবনগর সরকারেরও (১০ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত) আজ পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হচ্ছে। যে ‘মুজিবনগর সরকার’ অসংখ্য প্রতিক‚লতার মধ্যেও বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলÑ সেই সংগ্রামী মুজিবনগর সরকারকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। আমরা যেন কোনোদিনই সেই সরকারের অবদানের কথা ভুলে না যাই। সেই সঙ্গে যেন বিস্মৃত না হইÑ ত্রিশ লক্ষ শহিদের জীবনদান ও আড়াই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম বিসর্জনের নির্মম কাহিনী। জয় বাংলা।
০৭ এপ্রিল, ২০২১
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।
পৃথিবীর মানুষ মানবিক বিশ্বব্যবস্থা কামনা করছে
মোনায়েম সরকারঃ আজ আমি ছিয়াত্তরে পা দিলাম। আমার জন্মের পর ছিয়াত্তর বার সূর্যকে পরিভ্রমণ করেছে পৃথিবী। মহাকালকে যদি প্রশ্ন করা হয় সে হয়তো বলবে এ তেমন কোনো দীর্ঘ সময় নয়, কিন্তু আমি জানি আজ আমার জীবনসূর্য এগিয়ে চলছে পূর্ণতার দিকে। আমার জন্ম হয়েছিল বিশ শতকের প্রথমার্ধে। সাল তারিখের হিসেবে ১৯৪৫ সালের ৩০ মার্চ। দু’ দুটি বিশ্বযুদ্ধের অমানবিক হত্যাযজ্ঞ ও ভয়াবহতা আমি প্রত্যক্ষ না করলেও আমার শৈশব ও কৈশোরে এর প্রভাব ছিল ভয়াবহ। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী দুর্ভিক্ষ, ক্ষমতার দ্বদ্ব, শোষণ-তোষণ, অবিশ্বাস ও বিশ্বাসঘাতকতা, অনেক কিছুই আমি প্রত্যক্ষ করেছি, কিছু উপলব্ধি করেছি পরোক্ষভাবে। ছোট্ট এই জীবনে আমি অনেক বাধা পেরিয়েছি। অপরূপ বাংলার সোনাডাঙ্গা মাঠ ছাড়িয়ে, গোমতি পার হয়ে, ময়নামতি সেনানিবাসের পাশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত শত শত সৈনিকের সমাধির পাশ দিয়ে পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে আমার জন্ম, বেড়ে উঠেছিলাম পরাধীন পাকিস্তানি শাসনে। তাই যুগের দাবি মেনে নির্ভীক যৌবনে আমি নিজেকে সমর্পণ করেছিলাম বাম-প্রগতিশীল রাজনীতির ধারায়। আমার বিশ্বাস ছিল শোষণ ও বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থা ভেঙ্গে একমাত্র সমাজতন্ত্রই মানুষকে দিতে পারে সুন্দর ও সুখী জীবনের নিশ্চয়তা। দেশে দেশে তখন ত্বরান্বিত হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, দারুণ এক স্বপ্নময় সময়। বিশেষ করে ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্ল¬ব স্বাপ্নিক মানুষের মধ্যে যে আশাবাদের সূচনা করে, তার মোহনীয় আবেদন ছিল আকর্ষণীয় ও অপরিহার্য। কিন্তু সমাজতন্ত্র কায়েমের যাত্রাপথে নানা অঘটন অনেকের মতো আমাকেও উদ্বিগ্ন করে তোলে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কালে রাশিয়ায় দুই কোটি মানুষের জীবন বলিদান। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি চীনে, সেখানেও মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল তিন কোটি মানুষকে। যে সমাজতন্ত্র মানুষের জন্য সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের মহামন্ত্র নিয়ে বিশ্ববাসীর সামনে অবতীর্ণ হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে তার রক্তাক্ত মুখশ্রী দেখে অনেকেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছিল। আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থানে যেমন রুশ বিপ্লবের ভূমিকা ছিল, তেমনি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের জন্যও দায়ী ছিল তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও পার্টি।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন প্রসঙ্গে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পিএন হাকসার একটি পত্রে আমাকে লিখেছিলেন, The Soviet Union built no institutions except the Communist Party, Central Committee, Polit Bureau and General Secretary. পার্টিই যদি জীবনের সবকিছুকে নির্ধারণ করে দেয়, তাহলে মানুষের জীবন যান্ত্রিক হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। সোভিয়েত ইউনিয়নে সেই ঘটনাই ঘটেছিল।
১৯৩০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠিতে আমরা তার আভাস পাই,
রাশিয়ায় অবশেষে আসা গেল। যা দেখছি আশ্চর্য ঠেকছে। অন্য কোনো দেশের মতোই নয়। একেবারে মূলে প্রভেদ। আগাগোড়া সকল মানুষকেই এরা সমান করে জাগিয়ে তুলছে। …
এর মধ্যে যে গলদ কিছুই নেই তা বলি নে; গুরুতর গলদ আছে। সেজন্যে একদিন এদের বিপদ ঘটবে। সংক্ষেপে সে গলদ হচ্ছে, শিক্ষাবিধি দিয়ে এরা ছাঁচ বানিয়েছে, কিন্তু ছাঁচে-ঢালা মনুষ্যত্ব কখনো টেকে না, সজীব মনের তত্তে¡র সঙ্গে বিদ্যার তত্ত¡ যদি না মেলে তা হলে হয় একদিন ছাঁচ হবে ফেটে চুরমার, নয় মানুষের মন যাবে মরে আড়ষ্ট হয়ে, কিংবা কলের পুতুল হয়ে দাঁড়াবে।
আদিমকাল থেকেই দেখা যাচ্ছে, সমাজে একদল মানুষ থাকে যারা কোনো দিনই মানুষের অধিকার নিয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতে পারে না। এরা কম খায়, কম পরে, কম শিখে; কিন্তু কাজ করে সবার চেয়ে বেশি। এই অল্পে তুষ্ট মানুষগুলো নিজের গায়ে ধূলি লাগিয়ে, কাদা-জলে জীবন কাটিয়ে সমাজের উঁচুতলার মানুষগুলোকে সেবা দিয়ে যায়, কিন্তু তাদের ভাগ্যে এতটুকু সম্মান বা সমাদর জোটে না। এই ধুলোমাখা মানুষগুলোই সভ্যতার নির্মাতা, এদের বুকে পা ফেলেই পৃথিবীতে আসে নব উত্থান। এই মানুষগুলোর মঙ্গল কামনাই আমার জীবনের ব্রত।
কীভাবে বঞ্চিত মানুষগুলোর এতটুকু কল্যাণ করা যায়, আমার মনের গহিনে কেবল সেই চিন্তাই সারাক্ষণ বিরাজমান। আজ জীবনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমার মনে হচ্ছে দিনে দিনে মানুষ সামনের দিকে যতটা না এগোচ্ছে, পিছিয়ে যাচ্ছে তার কয়েকগুণ বেশি। আমার দৃষ্টি দুই শতাব্দীতে প্রসারিত। বিংশ এবং একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে অগ্রগতি আমি প্রত্যক্ষ করেছি, পৃথিবীর ইতিহাসে নিঃসন্দেহে তা চমকপ্রদ, যা বিগত বহু শতাব্দীতে সম্ভব হয়নি এবং অনাগত কালের জন্যও বিস্ময়কর। কিন্তু এটা কি অস্বীকার করার কোনো উপায় আছে, যে বিজ্ঞান মানুষের কল্যাণের জন্য শ্রম-মেধা ব্যয় করছে, মানুষকে বিভিন্নভাবে মারার জন্যও তার প্রচেষ্টার কোনো কমতি নেই। অ্যাটম বোমা, হাইড্রোজেন বোমা, পারমানবিক ক্ষেপণাস্ত্র ও মারণাস্ত্র তৈরিতেও মানুষের বিপথগামিতার ধারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আজ মানুষের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে, সে কি তার সর্বশক্তি মানবকল্যাণেই ব্যয় করবে, নাকি মারণাস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টাও অব্যাহত রাখবে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ ও বাঙালির জীবনে সবচেয়ে আলোচিত দুঃখ-বেদনা এবং গৌরবদীপ্ত অধ্যায়। দীর্ঘ তেইশ বছর পশ্চিম পাকিস্তানিরা শুধু আমাদের অর্থনৈতিকভাবেই পঙ্গু করেনি, তারা আমাদের মানসিকতারও অবক্ষয় ঘটিয়েছিল। বাংলা ভাষা ও বাঙালির সংস্কৃতির বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের কথা আজ আর কারো অজানা নেই। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, সেই মানসিকতার কিছু মানুষ এখনো বাংলাদেশে আছে, তারা যেন কিছুতেই বাংলা ও বাঙালির সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে কোনো বিষদাঁত না বসাতে পারে সে বিষয়ে সজাগ থাকা আমাদের কর্তব্য। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পেছনে ছিল একরাশ সোনালি স্বপ্ন। সেই স্বপ্নগুলো দাঁড়িয়েছিল চারটি মূলনীতির উপর। যথা: জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। আজ আমি গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার সমর্থক। কেন আমি সমাজতন্ত্রের বৃত্ত থেকে বাইরে গিয়ে গণতন্ত্রের কাছে প্রণত হলাম তার একটি ঐতিহাসিক কারণ আছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে রাজনীতি খুব দুঃখজনক রূপ ধারণ করে। প্রচÐ সরকারবিরোধী ভূমিকা নিয়ে আওয়ামী লীগের বিভ্রান্ত মিলিট্যান্ট অংশ তথাকথিত ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও প্রকারান্তরে তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীশক্তির উত্থানের পথ প্রস্তুত করে। যে-আদর্শ বুকে নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, সে-আদর্শ আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে পেয়েছি। কালের চিরন্তন ভেলায় তার আদর্শ ও নীতি তাঁকে দিয়েছে অমরত্বের গৌরব। তাই বঙ্গবন্ধুর নামে আজ ইতিহাসে নতুন অধ্যায় সৃষ্টি হয়েছে। বঙ্গবন্ধু আজ বিশ্ববন্ধুতে রূপান্তরিত হয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে আজ বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে যে নারকীয় হত্যাকাÐ সংঘটিত হয়, তা শুধু মুজিব পরিবারকেই শেষ করার চক্রান্ত নয়, তা ছিল পুরো বাংলাদেশকে পিছিয়ে দেওয়ার, ধ্বংস করে দেওয়ার চক্রান্ত। ’৭৫-পরবর্তী কালপর্বে বাংলাদেশের রাজনীতির ধারা পরিচালিত হয় সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক কায়দায়। বন্দুকের নল আর সামরিক আমলাতন্ত্রের পদতলে নত হয়ে পড়ে বাংলাদেশের রাজনীতি। দেশ চলে পাকিস্তানি সামরিক আমলাতান্ত্রিক ধারায়। সেই সময়কার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ভূমিকা আজও আমার কাছে রহস্যজনক আর অবোধ্যই রয়ে গেছে। ওই ভয়ঙ্কর মুহূর্তে যখন মুজিবের নাম উচ্চারণ করা পর্যন্ত অসম্ভব ছিল, তখন ভারতে স্বেচ্ছানির্বাসনে থাকাকালে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রচার-প্রচারণা চালাতে গিয়ে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, পিএন হাকসার, কমরেড আবদুল রাজ্জাক খা, ভুপেশ গুপ্ত, গণেশ ঘোষ, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, রমেন মিত্র, ইলা মিত্র, প্রফেসর শান্তিময় রায়সহ পৃথিবীর বহু দেশের বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে মত-বিনিময় করে বুঝতে পারি গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া বাংলাদেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা অসম্ভব।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশ পাকিস্তানি ধারায় চলে যায়। দেশশাসন করতে থাকে চিহ্নিত দেশদ্রোহী ও দেশবিরোধীরা। তাই বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ও গণতন্ত্রের ধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য আপসকামী বামপন্থীদের সংশ্রব ছিন্ন করে ১৯৭৯ সালে যুক্ত হই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে, যুক্ত হই অসা¤প্রদায়িক গণতন্ত্রের ধারায়। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই বাংলাদেশকে যদি এগিয়ে নিতে হয় তাহলে গণতান্ত্রিক পথেই এগিয়ে নিতে হবে। আমি আমার জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছি এদেশের মানুষ যতটা না বিপ্লবী তারচেয়ে অনেক বেশি গণতন্ত্রমনা। সুতরাং গণতন্ত্র ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করা অবান্তর।
ইতিহাসে মধ্যযুগে আমরা দুই শতাব্দীব্যাপী ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের কথা জানি। ক্রুসেডাররা পবিত্র জেরুজালেম নগরী লুণ্ঠন করেছিল, অসংখ্য মসজিদ ও সিনেগগ ধ্বংস করেছিল এবং নির্বিচারে অগণিত মুসলমান এবং ইহুদিকে হত্যা করেছিল। কিন্তু তাদের আদর্শ ও উদ্দেশ্যের মধ্যে কোনো ধর্মীয় পবিত্রতা ছিল না। ১০৯৯ সালে ক্রসেডারা জেরুজালেমে খ্রিস্টান রাজত্ব কায়েম করেছিল।
ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ আজও চলছে, তবে অন্যরূপে। আমাদের উপমহাদেশের রাজনীতিতে ধর্ম আর ধর্ম নিয়ে সংঘাত অনেক সময়ই প্রধান রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। এক অর্থে এটা হয়তো স্বাভাবিক, কেননা এশিয়া থেকেই বেশিরভাগ ধর্মের উৎপত্তি। ইহুদি ধর্ম, খ্রিস্টান ধর্ম, ইসলাম ধর্ম, হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, কনফুসিয়ানবাদ, তাওবাদ, সিন্তোবাদ, এসব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলেই সৃষ্টি হয়েছে। এখানে ধর্মের নামে যে কি ভয়াবহ রক্তপাত হয়েছে তা আমরা ইতিহাসে দেখেছি। দেখেছি হিন্দু-মুসলমানের সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা। পরে ১৯৭১ সালে দেখেছি মুসলমান-মুসলমানের নির্মম হত্যাযজ্ঞ। ধর্মের নামে, সা¤প্রদায়িকতার নামে বর্তমান শতাব্দীতেও কী পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ হচ্ছে তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মানুষের লোভ আর স্বার্থপরতা। সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য ব্যক্তিমানুষকে যে পরিমাণ নির্লোভ আর পরার্থপর হওয়া উচিত তা কি একবিংশ শতাব্দীর অতৃপ্ত, লোভী ও স্বার্থপর মানুষের পক্ষে আদৌ সম্ভব? আজ বরং আমার মনে হচ্ছে, যা হয়েছে সমাজপ্রগতির ধারাতেই হয়েছে। যা হবে তাও সমাজপ্রগতির স্বাভাবিক ধারাতেই হবে। সমাজপ্রগতির ধারার বিরুদ্ধে দাঁড়ালে মানুষ শুধু নির্বুদ্ধিতারই পরিচয় দেবে না, সঙ্গে সঙ্গে মানবসভ্যতার পতনও ডেকে আনবে। বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা তারই লক্ষণ। আমি আমার জীবনে কত ঘটনা-ই না দেখেছি। আমি দেখেছি জমিদারের জমিদারি গেছে, রাজার রাজত্ব গেছে, সাম্রাজ্যবাদীর সাম্রাজ্য গেছে। সামরিক স্বৈরশাসকদের পতন হয়েছে পৃথিবীর দেশে দেশে। শীতল (Cold War) বা স্নায়ুযুদ্ধের মুহূর্তগুলোও প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। এগুলো থেকে আমার এই প্রতীতিই জন্মেছে যে, ক্ষমতা কখনো স্থায়ী হয় না; ফাঁকি দিয়ে, চালাকি করে বৃহৎ ও মহৎ কাজ করা যায় না। জোর করে ইতিহাসে স্থান পাওয়া যায় না। ইতিহাস তার অমোঘ নিয়মে চলে। বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিতে চাকরি ও খাদ্যের অভাবে সংগ্রাম চলছে।
নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন তিনটি কারণকে ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্কট বলে উল্লে¬খ করেছেন, (১) সা¤প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ, (২) সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ এবং (৩) জঙ্গি রক্ষণশীলতা। বাংলাদেশে মূলত প্রথম এবং শেষ সংকটটি ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য হুমকির কারণ। যদি আমরা ধর্মনিরপেক্ষ আচরণে অভ্যস্ত না হই, তাহলে এখানে মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে ধর্মীয় উগ্রপন্থী ও জঙ্গিবাদ, যা আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য কখনোই কাম্য নয়। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে ধর্মের নামে কি নির্মম হত্যাযজ্ঞ ও হানাহানি চলছে তা বিশ্ববাসী অবলোকন করছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর দেশে দেশে ধর্মীয় মৌলবাদীদের উত্থান দেখে মনে হচ্ছে মানুষ যেন আবার মধ্যযুগের মতো ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
বর্তমান বিশ্ব হিংসা আর স্বার্থপরতায় উন্মত্ত হয়ে ওঠেছে। তাই দেশে দেশে ও মানুষে মানুষে মারামারি, কাটাকাটি, রক্তপাত লেগেই আছে। মানুষের জন্য যা ক্ষতিকর সেসব করা মানুষের উচিত নয়। তবু মানুষ মোহে অন্ধ হয়ে বা ক্ষমতার অপব্যবহার করতে এমন কিছু আবেগী সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে, যা সভ্যতার জন্য কলঙ্কতিলক হয়ে থাকে। যুদ্ধ পৃথিবীতে কেউ চায় না, তবু আজ পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আছে। এই ভয়াবহ যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে মানুষ আজ মুক্তি চায়। কিন্তু মুক্তির পথে না হেঁটে মানুষ যদি যুদ্ধের পথে হাঁটে ও অস্ত্রের ভাষায় কথা বলে, তাহলে রক্তস্রোত বন্ধ হবে না। বন্ধ হবে না ঘরে ঘরে অসহায় মানুষের কান্না। দেশে দেশে আজ মারণাস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা চলছে। পৃথিবীর স্বার্থেই আজ মারণাস্ত্র তৈরির কারখানা বন্ধ করতে হবে।
এক সময় মানুষ বনে জঙ্গলে, পাহাড়ে-পর্বতে বসবাস করত। সেই বনচর মানুষেরা স্বাধীনভাবেই জীবনযাপন করত। তাদের মধ্যে কোনো কলহ ছিল না। শোষণ ছিল না। উদ্বৃত্ত সম্পদ সঞ্চয়ের কোনো মানসিকতাও ছিল না। বনচারী মানুষের সেই জীবনকে সমাজতাত্তি¡কেরা নাম দিয়েছেন আদিম সাম্যবাদী সমাজ। সমাজ বিবর্তনের ধারায় আদিম সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়লে তৈরি হয় দাসপ্রথা। দাসযুগে ব্যক্তি মানুষের কোনো স্বাধীনতা ছিল না। দাসদের ছিল না স্বাধীন জীবনযাপন করার অধিকার। দাসবিদ্রোহের পরে আসে সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় দাসরা কিছুটা মানবিক অধিকার ফিরে পেলেও তাদের ভাগ্যোন্নয়ন পুরোপুরি হয় না। আবার শুরু হয় শোষিত মানুষের লড়াই। এ লড়াই চলতে থাকে যুগের পর যুগ। এক সময় ভেঙে পড়ে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ। জন্ম নেয় পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা। এই নব্য পুঁজিবাদী যুগে এসেও মানুষ শোষিত হতে থাকে। যার ফলে রাশিয়া-চীনসহ বেশ কিছু দেশে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা কায়েমের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। অর্থাৎ সংক্ষেপে বলতে হয়, আদিম সাম্যবাদী সমাজ ভেঙে যাওয়ার পর এখনো মানুষ পরিপূর্ণভাবে সুখী হতে পারেনি। অর্থ ও ক্ষমতালোভী কিছু মানুষ অধিকাংশ মানুষকে সুখী হতে দেয়নি।
১৯৬০-এর দশক বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল সময়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে দেখি চারদিকে প্রগতিশীল ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসীদের জয়জয়কার। মানুষ দলে দলে দীক্ষিত হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ চর্চিত হচ্ছে সর্বত্র। আমরা তখন ধরে নিয়েছিলাম গোটা পৃথিবী বিংশ শতাব্দীর মধ্যেই সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে পরিণত হবে। আমাদের চোখে অন্তত সেই স্বপ্নই খেলা করত। কিন্তু সত্তরের দশক যেতে না যেতেই আমাদের মোহভঙ্গ হয়। এর মধ্যে রাশিয়া ও চীন দেশের ইতিহাস পাঠ করে হয় আরো তিক্ত অভিজ্ঞতা। রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের নামে চলেছে একনায়কত্ব ও সীমাহীন ভোগবিলাস। সমাজতান্ত্রিক দুই পরাশক্তি চীন-রাশিয়ার কর্ম মানুষের মনের মধ্যে সন্দেহ বাসা বাঁধে। মানুষ মনে করতে থাকে জোর করে প্রতিষ্ঠিত সমাজতন্ত্র বেশি দিন টিকবে না। নব্বইয়ের দশকে এসে আমরা তা-ই প্রত্যক্ষ করলাম। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। সারাবিশ্বে মুখ থুবড়ে পড়ল সমাজতন্ত্র। আজ আমরা চীনকেও সমাজতান্ত্রিক দেশ বলতে পারি না, চীনও এখন পুঁজিবাদের পথেই হাঁটছে।
কার্ল মার্কস বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাস মূলত শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস।’ বাস্তবে পৃথিবীর ইতিহাস কখনোই শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস নয়। পৃথিবীর ইতিহাস মূলত ক্ষমতা দখল ও বদলের ইতিহাস। ক্ষমতাই পৃথিবী পরিবর্তনের কারণ। কেননা মানুষ দেখেছে ক্ষমতা থাকলে অর্থ-বিত্ত-আরাম-ভোগ-বিলাসিতা সবকিছু করতলে থাকে। তাই ক্ষমতার কাছে যাওয়ার জন্য মানুষ চিরদিনই তৎপর থেকেছে। এই তৎপরতা আজও অব্যাহত আছে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মানুষ নানারকম লড়াই-সংগ্রাম করেছে। আদিম সাম্যবাদী সমাজ থেকে আজ পর্যন্ত যত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে তা মূলত ক্ষমতা কুক্ষিগত করারই সংগ্রাম। একদল সুবিধা বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষ ভেবেছে তাদের ক্ষুধা ও মৃত্যুর কারণ ক্ষমতাশালীদের সীমাহীন দৌরাত্ম্য। তাই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার জন্যই সুবিধাবঞ্চিতরা নানারকম ফন্দি-ফিকির করেছে এবং সেসব ফন্দি-ফিকিরের কেতাবি নামও প্রয়োগ করেছে। কিন্তু দেখা গেছে, যারাই ক্ষমতার কাছে গিয়েছে তারাই দস্যু, ডাকাত ও দুর্বৃত্ত হয়ে ওঠেছে। তাই তাদের হটানোর জন্য আবার শুরু হয়েছে নতুন লড়াই, ভিন্ন পরিস্থিতিতে, ভিন্ন নামে।
পৃথিবী নিজের নিয়মেই পরিবর্তনশীল। মানুষ সেই পরিবর্তন কিছুতেই রোধ করতে পারে না। বিংশ শতাব্দীতে মানুষ চাঁদ-মঙ্গলসহ অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রের পাশাপাশি মহাবিশ্বের অনেক কিছুই জয় করেছে। কিন্তু প্রকৃতিকে জয় করতে পারেনি। মানুষ ভ‚মিকম্প, সুনামি ও দাবানলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখনও নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়নি। মানুষ চেষ্টা করছে এসব নিয়ন্ত্রণ করতে। কবে এসব তার করতলগত হবে, তা ভবিষ্যতই জানে।
আজ পৃথিবীর দিকে তাকালে মনে হয় বিশ্ব একটি মানবিক আর্থসামাজিক ব্যবস্থা প্রত্যাশা করছে। পৃথিবীতে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে, ঘরে ঘরে, দেশে দেশে মানুষের কান্না থামাতে গেলে অবশ্যই মানুষকে মানবিক হতে হবে। মানুষ যদি মানবিক না হয়, তাহলে মানুষের পৃথিবী কখনোই সুন্দর শান্তিময় হবে না। এই পৃথিবী আমাদের, আমাদের পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখার দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদসহ সকল উগ্রপন্থীদের নিশ্চিহ্ন করে পৃথিবীতে শান্তি বজায় রাখতে হবে। আজ আমরা পৃথিবীর দেশে দেশে কিছু উপদ্রব দেখতে পাচ্ছি। আমরা দেখছি একটি সম্প্রদায় আরেকটি সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠছে, সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীকে দমন-পীড়ন ও হত্যা করছে সংখ্যাগুরুরা। ধর্মীয় উগ্রবাদীদের কর্ম দেখে আজ সঙ্গত কারণেই মনে প্রশ্ন জাগছে আমরা কি তাহলে আবার পেছনে ফিরে যাচ্ছি?
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও মাস্টার দা সূর্যসেনের সহযোদ্ধা কল্পনা যোশীর (১৯১৩-১৯৯৫) একটি কথা এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে। ১৯৯৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কল্পনা যোশী কলকাতার পিজি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর কয়েকদিন পূর্বে আমি আর নাচোলবিদ্রোহের নেত্রী ইলা মিত্র কল্পনা যোশীকে হাসপাতালে দেখতে যাই। হাসপাতালে যাওয়ার পূর্বে ইলাদি বলেন, “কল্পনাদিকে দেখতে গিয়ে কি হবে, তিনি তো কাউকে চিনতে পারেন না।” তবু আমি কল্পনাদির স্নেহের কথা মনে করে তাকে শেষ দেখা দেখতে যাই। হাসপাতালে গিয়ে দেখি তিনি তার বেডে চুপচাপ শুয়ে আছেন। তাকে সেবারত নার্সের অনুমতি নিয়ে আমি আর ইলাদি ভেতরে যাই এবং ডেকে তুলি। আমার পরিচয় দিতেই তিনি চোখ মেলে তাকান এবং বাংলাদেশের কথা জিজ্ঞাসা করেন। আমি তাকে বলি বাংলাদেশ ভালো নেই। এরপর তিনি বললেন, “একদিন আমরা একটি সুন্দর পৃথিবীর জন্য লড়াই করেছি। তখন মনে হতো পৃথিবী একদিন সুন্দর হবে। কিন্তু আজ দেখছি পৃথিবীটা যেন কেমন হয়ে গেল।” তিনি আর কোনো কথা বললেন না। চুপচাপ শুয়ে পড়লেন। আমরা দুজন বিদায় নিয়ে চলে এলাম। আমার মাথায় তখনও কল্পনাদির কথাটি ঘুরপাক খাচ্ছিল। একদিন তো আমরাও আমাদের যৌবনে সুন্দর পৃথিবীর জন্যই লড়াই-সংগ্রাম করেছি। আজ পৃথিবীর এই রক্তাক্ত দুরবস্থা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।
আজ আমরা প্রাচ্য-প্রতীচ্য যেদিকেই তাকাই না কেন সবখানেই মানুষের হাহাকার দেখছি। দিশেহারা মানুষের মিছিল দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। ক্ষমতাশালীদের প্রতাপে ভেঙে পড়ছে প্রাচীন ঐতিহ্য ও সভ্যতা। মানুষ তার স্বভ‚মি থেকে হচ্ছে বাস্তুচ্যুত। প্রতিদিনই কোনো না কোনো দেশে আগুন জ্বলে ওঠছে। শান্তির পরিবর্তে মানুষ ভোগ করছে মনুষ্যসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক শাস্তি। এটা তো হওয়ার কথা ছিল না। তবু হচ্ছে। আমরা কি পারি না সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সুন্দর দিন আনতে? মানুষের প্রয়োজনেই মানুষকে সুন্দর ও শান্তির পথ বেছে নিতে হবে। কল্যাণের দায়িত্ব নিতে হবে মানুষকেই। বিগত শতাব্দীতে আমরা দুটি বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি। সেই দুটি বিশ্বযুদ্ধে মানবসম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির কথা নিশ্চয়ই আমাদের স্মরণে আছে। আজ যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং পারমাণবিক অস্ত্রসমৃদ্ধ দেশ সেই যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাহলে পৃথিবী মুহূর্তের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যাবে। কিছুতেই আমরা আমাদের পৃথিবীকে ধ্বংস হতে দিতে পারি না। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উৎকর্ষের পাশাপাশি মানবিক বোধ জাগ্রত করতে মানুষকে আরো সচেষ্ট হতে হবে। অশুভ-শক্তির পতন ঘটিয়ে পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে যাওয়ার অঙ্গীকারে আজ আমাদের সকলকেই আবদ্ধ হতে হবে। তাহলেই মুক্তি মিলবে মানুষের।
বর্তমান পৃথিবী এখন একটা নতুন আর্থসামাজিক ব্যবস্থার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এককেন্দ্রিক (Unipolar) বিশ্বব্যবস্থা কখনো সফল হবে না। সি.আই.এ, পেন্টাগন, ন্যাটোর সব প্রচেষ্টা আফগানিস্তান, ইরাক, ইরান, সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের সকল দেশে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের সৃষ্ট তালেবান, আল-কায়দা, আই এস-এর সঙ্গে আবার তাদেরই যুদ্ধ করতে হচ্ছে। সারা বিশ্বের মানুষ আজ মানবিক বিশ্বব্যবস্থা (Humane World Order) কামনা করছে। বাংলাদেশও এখন তাই আকাঙ্ক্ষা করে। বর্তমানে বাংলাদেশ সবদিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাওয়ার এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা আমাদের সকলেরই দায়িত্ব। কোনো ব্যক্তিবিশেষের পক্ষে একটি দেশ বা জাতিকে টেনে তোলা সম্ভব নয়, যদি না গোটা জাতি উত্তরণের পথ খোঁজে। আমরা অনেক দূরে যেতে চাই, আমাদের সেই যাত্রার অনুপ্রেরণা হোক গণতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতা। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন-
‘বাংলার মাটি নিত্য উর্বর। এই মাটিতে নিত্য সোনা ফলে। এত ধান আর কোনো দেশে ফলে না। এত ফুল, এত পাখি, এত গান, এত সুর, এত কুঞ্জ, এত ছায়া, এত মায়া আর কোথাও নেই। এত আনন্দ, এত হুল্লোড়, আত্মীয়তা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এত ধর্মবোধ, আল্লাহ, ভগবানের উপাসনা, উপবাস-উৎসব পৃথিবীর আর কোথাও নেই।’
জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশ দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার। বঙ্গবন্ধুর আমলে যেমন বাংলাদেশ অনেক শক্তিশালী রাষ্ট্রের ও প্রতিষ্ঠানের বিষ দৃষ্টিতে ছিল এখনও তাই আছে। তবে আশার কথা এই যে, জনবান্ধবনেত্রী শেখ হাসিনার কটনৈতিক দূরদর্শিতার কারণে বিরুদ্ধবাদী সেই শক্তিমান রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন, আমেরিকা, চীন, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ওআইসি, এখন বাংলাদেশের সঙ্গে সখ্য গড়তে তৎপর হয়ে উঠছে। এটা বর্তমানের বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় সুখবর।
নিন্দুকের দৃষ্টি কখনোই ভালো কিছু দেখে না। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সকল দুঃসাধ্য কাজ সাধন করেছেন তা কারো পক্ষে সম্ভব হতো কিনা জানি না। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছেন, বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন (যেমন হিজবুত তাহরীর, জেএমবি, আনসারউল্লাহ বাংলা টিম, হরকাতুল জিহাদ)-এর মূলোৎপাটন করেছেন, এগুলোকে যারা ছোট করে দেখতে চায়, তারা প্রকারান্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই অস্বীকার করতে চায়। বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও অগ্রগতির সঙ্গে একাকার হয়ে আছে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, এটা যতদিন বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে না পারবে ততদিন বাংলাদেশের কোনো উন্নয়নই, কোনো পরিকল্পনাই টেকসই হবে না, আর সেইখানেই অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে হাত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যার ফল এখন আমরা হাতে-নাতে পাচ্ছি।
শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আজ বঙ্গবন্ধুর নাম আকাশে-বাতাসে সসম্মানে উচ্চারিত হচ্ছে। ২০২০-’২১ সালে (মুজিব বর্ষে) নানামুখী মাধ্যমে উদ্যাপিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। বঙ্গবন্ধুর নামে ইতিহাসের নতুন অধ্যায় সূচিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে সমুন্নত রাখতে শেখ হাসিনাকেই ভমিকা নিতে হবে। বাংলাদেশ বিশ্বসভায় সুনাম অর্জন করছে। অর্থনীতি ও সামাজিক জীবন কাক্সিক্ষত স্তরে উপনীত হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ হয় এমন কোনো সিদ্ধান্ত ও কার্যকলাপ পরিহার করতে হবে। দুর্বৃত্ত ও দুর্নীতিবাজ নেতাকর্মীদের দল থেকে বহিষ্কার করতে হবে এবং জনমনে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের সাংগঠনিক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে হবে। সজাগ থাকতে হবে দলের প্রত্যেকটি নেতাকর্মীকে। আওয়ামী লীগের কাছেই বাংলাদেশ আশা করে, কেননা আশার স্বপ্ন আওয়ামী লীগই বাস্তবায়ন করার সামর্থ্য রাখে, বহতা নদীর মতো আওয়ামী লীগ চলমান।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে উচ্চতম স্থানে নিয়ে গেছে। এখন মানুষের মনে অনেক আশা জন্ম নিচ্ছে। মানুষ বুঝতে পারছে আসলেই দেশের উন্নতি হচ্ছে। এখন সবদিক সামাল দিয়ে ঠাÐা মাথায় সরকার ও দল পরিচালনা করতে হবে। বাংলাদেশের এখন বড় বাধা দুর্নীতি। সব সেক্টরে দুর্নীতি যতটা সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। আগামী দিনের উন্নত বাংলাদেশ গড়তে হলে রাষ্ট্রের প্রতিটি জায়গায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এখন শেখ হাসিনার চোখের দিকে তাকিয়েই স্বপ্ন দেখছে। শেখ হাসিনার স্বপ্ন আর সাধারণ মানুষের স্বপ্ন মিশে একাকার হয়ে গেছে। যে অনন্য উচ্চতায় শেখ হাসিনা নিজেকে এবং বাংলাদেশকে স্থাপন করেছেন সঙ্গত কারণেই তার কাছে মানুষের প্রত্যাশা সীমাহীন। বাংলার নিরন্ন-দুঃখী মানুষের প্রত্যাশা তিনি পূরণ করবেন এমনটাই আশা করে এদেশের জনগণ। সূর্য নিজে জ্বলে যেমন করে পৃথিবীকে আলোকিত করে রাখে, শেখ হাসিনাও তেমনি করে আলোকিত করছেন বাংলাদেশ।
পরিশেষে বলতে চাই- স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্য, বৈচিত্র্য, সম্পদ ও সম্ভ্রম রক্ষা করার ব্রত আমরা যেন ভুলে না যাই। আমরা যেন কখনো ভুলে না যাই, মায়ের অশ্রু, ভাইয়ের রক্ত, বিধবা বোনের দীর্ঘশ্বাসের আরেক নাম বাংলাদেশ। আসুন গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ছায়াতলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে এগিয়ে নিয়ে যাই। জয় বাংলা।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।
জন্মশতবর্ষে শেখ মুজিব : আমাদের করণীয়
মোনায়েম সরকার
১৭ মার্চ, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ। বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হলো আজ। বাংলার মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতার জন্মশতবর্ষ ঘিরে দেশে-বিদেশে নানামুখী কর্মকাণ্ড গৃহীত হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন যেমন গুরুত্ব পেয়েছে, তেমনিভাবে সম্মানিত হচ্ছে উদীয়মান বাংলাদেশের গণমুখী কার্যক্রম। যে মহামানবের জন্ম না হলে বাংলাদেশ পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে পারত না, তাঁকে ঘিরে একটু অন্যরকম আনন্দ-উৎসব হবে এটাই স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধুর মর্যাদা বৃদ্ধি পেলে বাঙালি জাতিও সম্মানিত হন। কেননা বঙ্গবন্ধুর লড়াই-সংগ্রামের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বাঙালির জীবনমান উন্নতকরণ। নিপীড়িত বাঙালির ত্রাতা হিসেবেÑ জননায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের আপসহীন নেতৃত্ব চিরদিন বাঙালি জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। বঙ্গবন্ধুই বাঙালি সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচয়। এই পরিচয় চিহ্ন কোনোদিনই মুছে যাওয়ার নয়।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপন সমগ্র বাঙালি জাতির জন্যই আনন্দঘন উৎসবে পরিণত হচ্ছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে মৌখিকভাবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন করার প্রস্তাব উত্থাপন করি। আমার প্রস্তাব ছিল ২০১৯ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত বছর ব্যাপী জন্মদিন পালন। কিছুদিন পরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই প্রস্তাবের সঙ্গে তাঁর নিজের কিছু পরিকল্পনা যুক্ত করে তিনি এটাকে ২০২০-২০২১ সাল পর্যন্ত সম্প্রসারিত করেন। এর ফলে দুটো সুবিধা হয়েছে, একটি হলোÑ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন, অন্যটি হলো স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন। এই দুটি বিষয়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। সুতরাং আমি বিবেচনা করে দেখলামÑ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে চিন্তা থেকে ‘মুজিববর্ষ’ ঘোষণা করেছেন এবং যে সময় তিনি নির্ধারণ করেছেন (২০২০-২০২১) তা যথার্যই হয়েছে। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পনাই মেনে নিলাম। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ কে-কিভাবে গ্রহণ করেছেন জানি না, তবে বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ ২০১৮ সাল থেকেই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। আমরা একটু আগে থেকেই এই চিন্তা করেছিলাম বলে বেশকিছু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা ও সম্পাদনা করতে পেরেছি। বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন একটি ছোট্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠান হলেও এর কর্মকাণ্ড আজ আর ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। মুজিববর্ষ ঘিরে আমরা বিশটির মতো বই প্রকাশ করেছি, মৌলিক দুটি কালজয়ী গান নির্মাণ করেছি এবং দেশব্যাপী বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে পোস্টার, লিফলেট প্রকাশ করেছি। শুধু বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনই নয়, এরকম আরো অসংখ্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এখন মহাসমারোহে মুজিববর্ষ উদ্যাপন করছে। আমরা চেয়েছিলাম, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে শিশু-কিশোরদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুরে চিন্তা-চেতনা গেঁথে দিতে, বর্তমান সরকার সে বিষয়ে যথেষ্ট আন্তরিক বলেই মনে হচ্ছে।
বিশ্ব এখনও করোনা মহামারীর ভয়ংকর থাবা থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি। করোনার কারণে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের উৎসব কিছুটা ধীর গতিতে হয়েছে বটে, তবে এবার যদি তেমন কোনো বিপর্যয় না ঘটে আশাকরি ১৭ মার্চের কর্মসূচি নিঃসন্দেহে বর্ণাঢ্য ও সফল হবে। বঙ্গবন্ধু আজ শুধু আর বঙ্গবন্ধু নন, তিনি এখন বিশ্ববিন্ধু। তার চিন্তা-চেতনা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা পৃথিবীর মানুষকে চমকিত করেছে, তাঁর মতো সাহসী ও আপসহীন নেতা শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এ কারণেই বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা UNO, UNESCO বঙ্গবন্ধুকে সম্মানিত করার জন্য অবিরাম চেষ্টা করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে এসব আন্তর্জাতিক সংস্থা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের এতিহাসিক ভাষণ ১২টি ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেছে। UNESCO বঙ্গবন্ধুর নামে শান্তিপদকও ঘোষণা করেছে। UNESCO বিশ্বের শোষিত মানুষের মুক্তির দূত বঙ্গবন্ধুর নামে শান্তিপদক ঘোষণা করে একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিলেন বলেই আমি বিশ্বাস করি।
বঙ্গবন্ধু জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন ‘বিশ্ব দুই শিবিরে বিভক্ত, শোষক আর শোষিত আমি শোষিতের পক্ষে।’ আমৃত্যু বঙ্গবন্ধু শোষিত মানুষের পক্ষেই লড়াই করে গেছেন। এ কারণেই তিনি বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিককে যুক্ত করে ‘বাকশাল’ গঠন করে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। আজকের বিশ্বব্যবস্থায় ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ই নিরন্ন মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারে, বঙ্গবন্ধু অনেক আগেই এ কথা ভেবেছিলেন। এ জন্যই তিনি ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারলে বাংলা সত্যিকার অর্থেই সোনার বাংলা হয়ে উঠত। ঘাতকের দল বঙ্গবন্ধুকে সেই সুযোগ না-দিয়ে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে পা-দিয়ে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। এর ফলে পিছিয়ে পড়ে বাংলাদেশ, মুখ থুবড়ে পড়ে বঙ্গবন্ধুর আজন্মলালিত স্বপ্ন।
বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতার প্রদর্শিত পথেই নিরলসভাবে হেঁটে চলেছেন। তিনি একক নেতৃত্বে বাংলাদেশকে সম্মানের সঙ্গে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তার উন্নয়নমূলক গণমুখী কর্মকাÐ বাংলাদেশের মানুষের মনে আশার সঞ্চার করেছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে বাংলাদেশ সর্বদিক থেকেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নয় লক্ষ গৃহহীন পরিবারকে গৃহ প্রদান করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটি ঐতিহাসিক কাজ করেছেন। বাংলার মানুষ না খেয়ে থাকবে না, গৃহহীন থাকবে না, তারা ভাত-কাপড়-বাসস্থান সবকিছুই পাবে তাদের মুখে একদিন হাসি ফুটবে এমন স্বপ্নই খেলা করত বঙ্গবন্ধুর চোখে। বঙ্গবন্ধু তার স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তবায়ন না করতে পারলেও তার কন্যা বঙ্গবন্ধুর অসম্পূর্ণ কাজগুলো নানান প্রতিক‚লতার মধ্যেও ধীরে ধীরে সম্পন্ন করছেন, লড়াকু বাঙালি জাতিকে আর দাবাযে রাখা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।
বঙ্গবন্ধুই আমাদের একমাত্র দিশারী, বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করেই আমরা সৎ হতে পারি, সচেতন হতে পারি, দক্ষ কর্মী হতে পারি, দেশপ্রেমিক হয়ে দেশকে গড়ে তুলতে পারি। এ কথা এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, বঙ্গবন্ধুই আমাদের ঐতিহ্য, বঙ্গবন্ধুই আমাদের ভবিষ্যৎ। বঙ্গবন্ধু আমাদের মঙ্গলের জন্যই, দেশের কল্যাণের জন্যই জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হয়ে যদি আমরা এ দেশে শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারি, যদি এ দেশের নিপীড়িত জনগণের জন্য অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারি তবেই শুধু বঙ্গবন্ধুর আত্মদান সার্থক হবে। আর এ কার্যসাধনে বঙ্গবন্ধুর অমলিন স্মৃতিই হবে আমাদের পথপ্রদর্শক। আজ যদি আমরা বঙ্গবন্ধুকে ভুলে যাই, তাঁর আদর্শকে বিস্মৃত হই তবে যে জাতি হিসেবে আমাদের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হয়ে পড়বে শুধু তাই নয়, পৃথিবীর জন্যও তা এক মহাক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের শোষিত ও নিপীড়িত জনগণের জন্য প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে সকল বাস্তব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তা সারা পৃথিবীর মানুষের পক্ষে শিক্ষণীয় ও অনুকরণীয় বিষয়।
এতদিন মুজিবপ্রেম ছিল বাঙালির বাইরে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে তা মননে ঢুকতে শুরু করেছে। এটা শুভ লক্ষণ। আগে বঙ্গবন্ধুর জন্ম ও শাহাদাৎ দিবসে নেতাকর্মীরা মাইক বাজাত, তোরণ বানাত আর খিচুড়ি খেত, এখন এই প্রবণতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রচনা প্রতিযোগিতা, কুইজ ও নানামুখী সাংস্কৃতিক কর্ম। আজ বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর হয়েছে, প্রকাশিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘আমার দেখা নয়া চীন’। তার এবং স্বাধীনতার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন জায়গায় তৈরি হচ্ছে নানারকম ভাস্কর্য ও স্মৃতিসৌধ, যেমন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গ্লাসটাওয়ার, শিখা চিরন্তন, শেখ মুজিবের জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ার অবকাঠামোগত উন্নয়ন ইত্যাদি। ’৭৫-এর মুজিব সমাধির যে চেহারা ছিল আজ তা নেই। তার বাড়ির ভাঙা দরজাও আজ বদলে গেছে। এই ছবিগুলো আছে ‘হু কিলড মুজিব’ আর ‘বাংলাদেশের সমাজবিপ্লবে বঙ্গবন্ধুর দর্শন’ গ্রন্থে। ছবিগুলো সে সময় দিল্লিতে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার হাত দিয়েই ‘হু কিলড মুজিব’ গ্রন্থের লেখক এ এল খতিব (আবদুল লতিফ খতিব)-এর হাতে পৌঁছেছিল। ছবিগুলো সংগ্রহের ক্ষেত্রে আমারও কিছু ভ‚মিকা ছিল। কিন্তু আমাদের শুধু এখানেই তৃপ্তির ঢেঁকুর গিললে হবে না, আরও ব্যাপকভাবে কাজ করতে হবে। মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর শেখ মুজিবের বিশ্বস্ত কর্মীরা কেউ মাথায় পাগড়ি বেঁধে ফেরিওয়ালা হয়ে পালিয়েছিল, কেউ স্বেচ্ছায় গ্রেফতার হয়েছিল ঘরের মধ্যে বসে থেকে। আমার ভয় হয় আবার যদি ১৫ আগস্টের মতো কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের অবস্থা কী হবে? আমরা আশা করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের আদর্শ, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও সাংস্কৃতিক শুদ্ধতা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে এগিয়ে যাবেন।
আজকের সভ্য মানুষ সমঅধিকারে আর বিশ্বাস রাখে না, তারা চাচ্ছে শান্তিপূর্ণ সুখী জীবন। একটি শান্তিপূর্ণ জীবন পেলে, সার্বিক নিরাপত্তা পেলে ব্যক্তিমানুষের আর কোনো আকাক্সক্ষা থাকে না। মাথা গণনায় সব মানুষ সমান থিওরির চেয়ে যোগ্যতার প্রশ্নে সব মানুষ সমান হলে তবেই সমাজের মঙ্গল হতো। কিন্তু সমাজতন্ত্র সে পথে হাঁটেনি। জোর করে কোনোকিছু করে প্রগতিকে রোধ করা যায় না। বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে, বিশ্ব এগিয়ে যাবে, তবে নতুন বিশ্ব কোন্ পথে চলবে, নতুন দিনের সমাজতাত্তি¡কদের সেই কথাটাই ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে আবেগকে প্রাধান্য না দিয়ে যুক্তিকেই মূল্য দিতে হবে। পৃথিবী অতীতে দুটি বিশ্বযুদ্ধ, সমাজতন্ত্র, ধনতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের রক্তাক্ত ইতিহাস প্রত্যক্ষ করেছে, ভবিষ্যতে সমাজতন্ত্রের কাল্পনিক কাব্যকথা শুনতে মানুষ রাজি নয়। পৃথিবীব্যাপী মানুষ আজ একটি (Humane world order)মানবিক বিশ্বব্যবস্থা ও আইনের শাসন কামনা করছে।
আমি আমার জীবনের অর্ধশতাব্দী অতিবাহিত করেছি সমাজতন্ত্রের সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে। পৃথিবীর বহু দেশের অসংখ্য যুবকও তাদের লড়াকু যৌবন উৎসর্গ করেছিল সমাজতন্ত্রের স্বপ্লীল মন্ত্রে। আজ আমি উপলব্ধি করছি, যে সমাজতন্ত্রের জন্য আমার মতো অসংখ্য মানুষ তাদের জীবন-যৌবন বিলিয়ে দিয়েছিল তাদের মোহভঙ্গ ও স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে বা হচ্ছে। তারাও আজ কামনা করছেন নতুন মানবিক ও আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেই গড়ে তোলা সম্ভব হবে আগামী দিনের সুখী, সমৃদ্ধিশালী, সুন্দর বাংলাদেশ তথা পৃথিবী।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।
‘সোনার বাংলা’ গড়তে হলে ‘দুর্নীতি’ দূর করতেই হবে?
মোনায়েম সরকার
বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে তার দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন এবং একের পর এক নেতাকে ধরে জেলে ভরছেন তাতে তার ভাবমূর্তি ও জনপ্রিয়তা দারুণভাবে বেড়ে গেছে। এই শুদ্ধ অভিযান দুর্নীতির শেকড় উপড়ে না ফেলা পর্যন্ত চলুকÑ এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।
বাংলাদেশ একটি গরিব রাষ্ট্র বলেই বিশ্বে পরিচিত। এই রাষ্ট্রের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার জীবদ্দশায় তিনিও সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ছিলেন এবং তার ২৭ জন এম.পি-কে পার্টি থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শক্ত হাতে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরেছিলেন বলেই তখনকার যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিল এবং জিডিপি সাড়ে সাত শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। দেশি-বিদেশি ঘাতক চক্রের চক্রান্তে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নির্মমভাবে নিহত হলে এদেশে আবির্ভূত হয় পুতুল সরকার এবং এই পুতুল সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা নেয় সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। তিনি বাংলাদেশে অবাধে দুর্নীতি করার সুযোগ তৈরি করে দেন।
জিয়াউর রহমান দেশবিরোধীদের রাষ্ট্রের মন্ত্রী বানিয়ে মুজিব কিলারদের মর্যাদাপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করে দুর্নীতিবাজদের পুনর্বাসন করেন বাংলাদেশে। এরপরেই আসেন আরেক দুর্নীতিবাজ সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদ। তিনি দুর্নীতিতে এতটাই পারঙ্গম ছিলেন যে অল্পদিনেই তার প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে যান। জিয়াউর রহমান দুর্নীতির সঙ্গে সঙ্গে অবৈধ অস্ত্রের বিস্তারও ঘটান। এরশাদ সাহেব দুর্নীতির সঙ্গে ঢুকিয়ে দেন মাদক ও সন্ত্রাস। এরপরে ’৯০ সালে এরশাদের পতন হলে খালেদা জিয়া বাংলাদেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। তিনি এবং তার পুত্রদ্বয় বাংলাদেশে দুর্নীতির এক মহোৎসব শুরু করেন। খালেদা পুত্র তারেক রহমান ও কোকোÑ দুর্নীতির জন্য বাংলাদেশে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তারেক রহমানের আশেপাশে যারা ছিলেন তারাও একেক জন দুর্নীতির রাঘব বোয়াল হয়ে উঠেছিলেন। এক্ষেত্রে গিয়াসউদ্দীন আল মামুনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। খালেদা জিয়ার আমলে ‘হাওয়া ভবন’ ছিল দুর্নীতির হেড কোয়ার্টার আর ‘খোয়াব ভবন’ ছিল মদ-মাস্তির বিনোদন কেন্দ্র। আজ বাংলাদেশের মানুষ দুর্নীতির যেসব চিত্র দেখতে পাচ্ছে সেগুলো মূলত জিয়া-এরশাদ-খালেদার শাসনামলেরই সৃষ্টি।
বন কেটে বসতি গড়া যেমন কষ্টকর, শেখ হাসিনা এখন সেই কষ্টটাই করছেন। তিনি একই সাথে বাংলাদেশকে বিশ্বের মধ্যে সম্মানজনক স্থানে দাঁড় করাবার চেষ্টা করছেন, অন্যদিকে পূর্বের দুর্নীতির শেকড় উপড়ে ফেলার মিশন হাতে নিয়েছেন। এই দুটো কাজই শ্রমসাধ্য এবং ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকি নিতে শেখ হাসিনা পছন্দ করেনÑ এমন প্রমাণ আমরা বহুবার তার কাছ থেকে পেয়েছি। ঝুঁকি নিতেই হবে। ঝুঁকি নিয়েই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি বর্বরদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন এবং বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন।
মুজিব কন্যা শেখ হাসিনাও একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়তে জীবন বাজি রেখে লড়াই করে যাচ্ছেন। এতদিন তিনি লড়েছেন প্রতিপক্ষ শত্রুর বিরুদ্ধে, আজ তিনি লড়াই করছেন নিজ দলীয়, ছদ্মবেশী, অর্থগৃধ্রু দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে। এই লড়াই নিঃসন্দেহে কঠিন লড়াই, কিন্তু এই লড়াইয়ে শেখ হাসিনা জয়ী হবেনÑ এমনটাই আশা করেন বাংলাদেশের ষোলো কোটি মানুষ।
একটি বেদনার কথা না বললেই নয়, সারা দেশে যখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান পরিচালিত হচ্ছে, তখন একদল জ্ঞানপাপী ভ-ের উল্টাপাল্টা কথা শুনে আশ্চর্য হতে হয়। একদিন আমিও রাজনীতি করেছি। আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণের কিছুটা ক্ষমতা আমারও ছিল। আমার স্পষ্ট মনে আছে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার কিছু কায়দা-কৌশল আছে, অথচ আজকাল সরকারবিরোধীরা কি বলেন-না বলেন স্পষ্ট করে কিছুই বোঝা যায় না। এদের দেখে মনে হচ্ছে, এদের তত্ত্বজ্ঞানও নেই, এদের তথ্য জ্ঞানও নেই। এরা একজনেই একটি দল। এরা রাস্তায় দাঁড়ায় কিন্তু কোনো কর্মী থাকে না। এরা ছোট্ট ঘরে, নিজস্ব চেম্বারে প্রেস কনফারেন্স করে। সেই প্রেস কনফারেন্সে তাদের দুই একজন ছাড়া আর কাউকে দেখা যায় না। অথচ এই জনভিত্তিহীন পার্টির প্রধানগণ যখন পত্রিকায় বলেন দুর্নীতিবাজদের ধরা হচ্ছে, ধরে জেলে নেওয়া হচ্ছে কিন্তু রিমান্ড হচ্ছে না। আবার ওই পত্রিকায়ই যখন দেখি অমুক দুর্নীতিবাজের ২০ দিন রিমান্ড মঞ্জুর, তখন জনগণ ওই জ্ঞানহীন নেতার কা-জ্ঞান দেখে বিস্মিত হয়। বাংলাদেশে দুর্নীতি, খুন, বোমা, গ্রেনেড, মৌলবাদÑ এসবই এনেছে সামরিক সরকার ও তাদের উত্তরাধিকারীগণ। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার রক্তে কোনো দুর্নীতি নেই। শেখ হাসিনার চিন্তায় দুর্নীতির স্থান নেই, তিনি খুন, বোমা, গ্রেনেড, মৌলবাদ দিয়ে রাজনীতি করার পক্ষে নন। তিনি দেশ গড়তে চান, উন্নয়নের ম্যাজিক দেখিয়ে জনতার মনে সম্মানের আসন পেতে চান।
কথায় আছেÑ ক্ষমতা মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলে, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা মানুষকে নিরঙ্কুশভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলে। আজ সারা বিশ্বেই দুর্নীতি ব্যাধির আকারে রূপ নিয়েছে। অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানই দুর্নীতির দায়ে জেলে আছেন। সেই হিসাবে শেখ হাসিনার সরকার যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি নিয়ে দেশ শাসন করছেন। যাদেরকে বিশ্বাস করে তিনি দলীয় ক্ষমতায় বসিয়েছেন তিনিই আজ তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটা শুধু বাংলাদেশের জন্যই দৃষ্টান্ত নয়, সারা পৃথিবীর জন্যই অনন্য দৃষ্টান্ত। ক্ষমতাসীন সরকার কখনো কোনো দেশে এতটা কঠোরভাবে দুর্নীতি দমনে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন কিনা তা আমাদের অজানা। শেখ হাসিনা সরকারের এই প্রশংসাযোগ্য পদক্ষেপে বাংলাদেশের মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। এ জন্য শেখ হাসিনা সরকারকে আমাদের ধন্যবাদ দিতেই হবে।
শেখ হাসিনা সরকারকে এখন ত্রিমুখী লড়াই করতে হচ্ছে। সরকারবিরোধী পক্ষের সঙ্গে লড়াই করার পাশাপাশি দুর্নীতিবাজ দলীয় নেতৃবৃন্দ এবং ক্ষুধামুক্ত উন্নত বাংলাদেশ গড়ার লড়াই করতে হচ্ছে। এতটা চাপ নিয়ে দেশশাসন করা আসলেই অনেক কঠিন কাজ। আজ পৃথিবীর অনেক দেশের প-িত-গবেষকগণই বলছেনÑ বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ অল্প সময়ের মধ্যেই উন্নত দেশে পরিণত হবেÑ এমন সব আশার বাণী আমাদের মনে প্রেরণার সঞ্চার করে। বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবেও আমরা এ জন্য গর্ববোধ করি।
যেভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হয়েছে, এ মনোভাব কিছুতেই পরিবর্তন করা যাবে না। কোনো চাপের মুখে বা কারো প্রতি প্রীতি দেখিয়ে ন্যায়-বিচার থেকে সরে আসা যাবে না। যারা ব্যাংকের টাকা ক্যাসিনো ভল্টে রেখেছে, যারা বিদেশে টাকা পাচার করেছে, সীমাহীন দুর্নীতি করে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করেছে, তাদের ব্যাপারে করুণা প্রদর্শন করা ঠিক হবে না। সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ দরকার। দুর্নীতিবাজদের, টেন্ডারবাজদের, জুয়াড়িদের দল থেকে বহিষ্কার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এমনকি দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ, কোনো মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী দুর্নীতিগ্রস্ত হলে তাদেরও শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিপরিষদের কেউ দুর্নীতিবাজ ছিলেন না, আমরা চাইÑ শেখ হাসিনার মন্ত্রিপরিষদও দুর্নীতিমুক্ত থাকুক।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার আগমন আশীর্বাদস্বরূপ। এক সময় বাংলাদেশ দুর্নীতিতে ক্রমাগত চ্যাম্পিয়ন হতো। আজ বাংলাদেশ সেই কলঙ্ক মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। কোনোভাবেই বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে নাÑ তাহলে ত্রিশ লক্ষ শহিদ আমাদের ক্ষমা করবেন না। নিন্দুকেরা যত কথাই বলুকÑ অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গেই দুর্নীতির এই অভিযানের সফল সমাপ্তি ঘটাতে হবে। দুর্নীতির কারণে শুধু আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে তাই নয়, সমাজে অস্থিরতাও তৈরি হচ্ছে। বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকা- দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতিরই কুফল। আমরা এমন নৃশংস হত্যাকা- কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না। অতীতে এমন নৃশংস হত্যাকা- অনেক ঘটেছে। সেগুলোর সুষ্ঠু বিচার হলে আজ হয়তো আবরার হত্যাকা- আমাদের দেখতে হতো না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে আবরার হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও বিচারের মুখোমুখি করা এটাও শুদ্ধি অভিযানের দৃষ্টান্ত বলে আমি মনে করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপর বাংলাদেশের সকলের আস্থা আছে। অপশক্তি যতই তার এগিয়ে চলার গতি রোধ করার চেষ্টা করুক না কেনÑ কিছুতেই তার অপ্রতিরোধ্য গতি থামানো যাবে না। দলে শুদ্ধ অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি প্রশাসনেও এ অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে এবং সৎ, যোগ্য, দেশপ্রেমিক মানুষদের দেশ সেবায় সম্পৃক্ত করতে হবে। তাহলেই আওয়ামী লীগ নিরাপদে থাকবে, তাহলেই বাংলা হবে সত্যিকারের সোনার বাংলা।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
১০ অক্টোবর, ২০১৯
যে দুটি মর্মস্পর্শী ছবি আমাকে কাঁদায়
মোনায়েম সরকার
আগস্ট এলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী অন্যান্য বাঙালির মতো আমিও শোকবিহ্বল হয়ে পড়ি। আমার শোককে যে দুটি ছবি আরো উসকে দেয়, তার একটি হলোÑ ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে সিঁড়ির উপর পড়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর রক্তাক্ত লাশের ছবি। আরেকটি হলো ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ভয়াবহ ও নৃশংস গ্রেনেড হামলার পরে ওষ্ঠে আঙুল ছোঁয়ানো ভয়ার্ত শেখ হাসিনার ছবি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র সফল হয়েছিল এবং ঘাতকরা ২১ বছর বাংলাদেশকে ছিন্ন-ভিন্ন করছিল। শেখ হাসিনার হত্যার ষড়যন্ত্র সফল হলে বাংলাদেশের পরিণতি হতো তা ভাবাই যায় না। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধি পাকিস্তানের ৯৩ হাজার বন্দি সৈন্য মুক্তি দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর জীবনের জন্য। ওই ৯৩ হাজার বন্দি সৈন্যের বিনিময়ে শ্রীমতি গান্ধি হয়তো কাশ্মীরকেও দাবি করতে পারতেন, তিনি তা করেননি। তিনি চেয়েছিলেন মুজিবের প্রাণ। কিন্তু দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে বাংলার ঘাতকদের হাতেই সপরিবারে প্রাণ হারান বঙ্গবন্ধু। আমরা যারা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছি, তার আগে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনে অংশ নিয়েছি তারা জানি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কত বড় মাপের নেতা ছিলেন। তিনি নাহলে স্বাধীন বাংলাদেশের কথা আমরা চিন্তাই করতে পারতাম না। তাঁর দূরদর্শী ও ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বে একটি পরাধীন জাতি পায় স্বাধীনতার স্বাদ। বহু বছরের শোষণ-দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে তিনি গড়ে তোলেন সমৃদ্ধিশালী, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। একটি অবহেলিত ভূখণ্ডের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে স্বাধীনতা অর্জন করার মতো নেতা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই বিরল নেতা। শেখ মুজিব আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন, প্রজাপ্রেমী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন। যে মানুষটি কখনোই বাঙালিকে অবিশ্বাস করেননি, শত্রু ভাবেননি, সেই শুদ্ধ চিত্তের মানুষটিকেই কয়েকজন স্বার্থপর-ঘাতক সপরিবারে হত্যা করলÑ যা শুধু বাঙালির ইতিহাসেরই নয়, পৃথিবীর ইতিহাসেও একটি কলঙ্কজনক ঘটনা বলে বিবেচিত।
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ ২১ আগস্ট, ২০০৪
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকা- শুধু একটি হত্যাকাণ্ডই নয়, একটি স্বাধীন, অসাম্প্রদায়িক জাতিকে পরাধীন ও সাম্প্রদায়িক করার পাশবিক চক্রান্তও বটে। আমি যখন বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সিঁড়িতে তাঁর রক্তাক্ত লাশের ছবিটি দেখি তখন আবেগআপ্লুত হই। আমার চোখ কান্নায় ভিজে যায়।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে আজ প্রায় অর্ধ শতাব্দী হতে চলল। এই অর্ধ শতাব্দীতে আমি অনেক পরিবর্তন লক্ষ করছি যা আগে কখনো করিনি। জাতীয় শোক দিবস এখন যেভাবে উৎসবের মতো করে পালন করা হচ্ছে আগের দিনের শোক দিবস এভাবে পালিত হতো না। অতীত দিনের সেসব শোক দিবসের জৌলুস ছিল না, কিন্তু গাম্ভীর্য ছিল। সেখানে সৃষ্টিশীলতার-মননশীলতার চর্চা থাকতো। আজকাল ‘কাঙালি ভোজন’ আর নেতাকর্মীদের হৈ-হুল্লোড়ই প্রধান আকর্ষণ থাকে জাতীয় শোক দিবসে। ব্যানার-ফেস্টুনে নেতাকর্মীরা নিজের ছবি ছাপায় বঙ্গবন্ধুর চেয়েও বড় করে, ভুল বানানে লেখা থাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে হয় নিয়ম রক্ষার অনুষ্ঠান। এগুলোকে আমি ছোট করে দেখছি না, তবে জাতীয় শোক দিবসের মর্যাদা আরো ব্যাপক ও হৃদয়স্পর্শী হওয়া দরকার বলে আমি মনে করি। ১৯৭৫-এর পরে দীর্ঘ একুশ বছর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর দর্শন ভুলানো হয়েছে, তার নাম মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। তার কন্যা শেখ হাসিনা লড়াই-সংগ্রাম করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এলে পরিস্থিতি কিছুটা বদলাতে থাকে, এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণই আওয়ামী লীগের অনুকূলে। সারাদেশে এখন আমি শুধু আওয়ামী লীগারই দেখি, এদের দেখে আমার খুব বলতে ইচ্ছে করে ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ ’৭৫-এর পরে এদের কাউকেই দেখিনি এমন কিÑ আওয়ামী রাজনীতিতে যুক্ত থাকাকালীনও নয়। আমার মনে মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে এরা কারা? এরা কি সত্যিকার অর্থেই মুজিব আদর্শে বিশ্বাসী শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত সিপাহসালার- নাকি সুবিধাবাদী, ছদ্মবেশী গুপ্তচর? ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা মুজিব আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম করেছেনÑ আজ তারা অনেকেই আওয়ামী লীগে নেই, অনেকেই মারা গেছেন, অনেকেই বার্ধক্যজনিত কারণে গৃহবন্দি হয়ে পড়েছেন।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর যারা শেখ মুজিবের পক্ষে দেশে-বিদেশে প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছে, প্রকাশনা বের করেছে, সভা-সেমিনার, বক্তৃতার আয়োজন করেছে তাদের কথা আজ খুব মনে পড়ছে। ১৯৭৫-এর ২০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর নূরুল আমীন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. ম. আখতারুজ্জামান ও আমি একটি লিফলেট তৈরি করি। সেই লিফলেটটির হেডলাইন ছিলÑ ‘মীরজাফররা হুঁশিয়ার’। আর লিফলেটের বক্তব্য ছিলÑ ‘তোমরা যারা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সহযোগিতা করবে, তাদের সবংশে নির্বংশ করা হবে।’ লিফলেটের হাতের লেখা ছিল নূরুল আমীনের। পরে ওটা হাত মেশিনে ফটোকপি করা হয়। এই লিফলেটটি আমরা মন্ত্রী, এমপি, সচিব, ডিসি ও এসপিদের কাছে ডাকযোগে পাঠাই এবং তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। এটা হলো বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। সে সময়ের শোক-সভাগুলো কেমন হতো এবার তার কিছু নমুনা দেই।
১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে ছাত্র-শিক্ষক-জনতার শোক মিছিল যায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে শ্রদ্ধা জানাতে। একই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং ওই হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার পরে ১৯৭৬ সালে সর্বপ্রথম শোকসভা হয় লন্ডনের কনওয়ে হলে। কিন্তু সেদিনের শোকসভা প- করার জন্য জিয়ার অনুগত পেটোয়া বাহিনী হামলা করেÑ তখন লন্ডন আওয়ামী লীগের সভাপতি গাউস খানসহ অন্যরা (রুহুল কুদ্দুস, স্থপতি মাজহারুল ইসলাম, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম) সাহসের সঙ্গে সেই হামলা মোকাবেলা করেন। জিয়ার অনুগতদের পিটিয়ে হল ছাড়া করেন। এরপর ১৯৭৭ সালে আমরা দিল্লির গান্ধী মেমোরিয়াল হলে শোকসভার আয়োজন করি। এই শোকসভায় ভারতের প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতাই কমবেশি অংশ নেন। সেদিনের সেই শোকসভায় যারা বক্তৃতা দিয়েছিলেন তাদের বেশ কয়েকজনের নাম আমার স্মৃতিতে এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে। এরা হলেনÑ ইন্দিরা গান্ধীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পি এন হাকসার, বিশ্বশান্তি পরিষদের রমেশ চন্দ্র, কংগ্রেসের জেনারেল সেক্রেটারি ভি ভি রাজু, জনতা পার্টির নেতা কৃষ্ণ কান্ত। সেদিনের শোকসভার সভাপতি ছিলেন বিপ্লবী ও লেখক মন্মথনাথ গুপ্ত।
আমি মনে করি জাতীয় শোক দিবসের তাৎপর্য তখনই ফলপ্রসূ হবে যখন আমরা এটি সদ্ব্যবহার করব। শোক দিবসে কান্না-হাহাকার নয়, বঙ্গবন্ধুকে সঠিকভাবে বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করাই হওয়া উচিত শোক দিবসের মূললক্ষ্য। এ জন্য দেশে-বিদেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বেশি বেশি করে সভা-সেমিনার-প্রকাশনা ও গবেষণামনস্ক হওয়া দরকার। ২০২০-২০২১ সালকে মুজিব বর্ষ বলে সরকার ঘোষণা করেছে। এবারের ১৫ আগস্ট যেভাবে উদ্যাপিত হয়েছে তাতে সারা বাংলায় কিছুটা হলেও সাড়া পড়েছে। ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ এমনভাবে উদ্যাপন করতে হবে, যেন আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবার মনে জ্বলজ্বল করেন বঙ্গবন্ধু। আমি মনে করি মুজিববর্ষে ব্যাপক কাজ হওয়া দরকার। দেশি-বিদেশি খ্যাতনামা গবেষক দিয়ে বঙ্গবন্ধুর জীবনের নানা দিক নিয়ে গ্রন্থ মুদ্রণ করা দরকার। এগুলোই বঙ্গবন্ধুকে বাঁচিয়ে রাখবে। শুধু শেখ হাসিনার দিকে তাকিয়ে না থেকে ব্যক্তিগত পর্যায়েও আমাদের কিছু করণীয় আছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। ব্যক্তি মানুষের মনে যখন বঙ্গবন্ধু থাকবেন তখন আওয়ামী লীগ এমনিতেই যুগ-যুগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকবে। জাতীয় শোক দিবস এলে দেখি বঙ্গবন্ধুর ঘাতকরাও আজ ছদ্মবেশ ধারণ করে মুজিবপ্রেমী হওয়ার চেষ্টা করে। দেখে খুব কষ্ট পাই। যারা পলিটিক্যালি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের তো আপস করার কথা ছিল না, তবু আজ আমরা সেটাই দেখছি। কেন দেখছি? দেখছি এই জন্য যে, আওয়ামী লীগাররা সংখ্যায় বৃহৎ দেখায় বটেÑ আসন সংখ্যায় এখনো অনেক পিছিয়ে থাকে নানা ষড়যন্ত্রে। এসব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করতে হবে।
যারা বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস করে তাদের একমাত্র ভরসা তো আওয়ামী লীগই। বাংলাদেশের ইতিহাস মানে আওয়ামী লীগেরই ইতিহাস। দারুণ এক ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশের হাল ধরেছিলেন শেখ হাসিনা। সেই ভগ্নদশা থেকে দল ও দেশকে টেনে তুলেছেন তিনি। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে মডেল। বিগত এগারো বছরে বাংলাদেশে যে অসম্ভব উন্নয়ন হয়েছে আগামী দিনের ইতিহাসে তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে থাকবে।
বর্তমান বাংলাদেশকে শেখ হাসিনা তার দূরদর্শী নেতৃত্বের মাধ্যমে যেই জায়গায় নিয়ে গেছেন তা কল্পনারও বাইরে। এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কোনো রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশে নেই। তাছাড়া দলটি বেশ কিছু দৃশ্যমান উন্নয়ন কর্মকা- করেছে। দারিদ্র্য বিমোচনের আপেক্ষিক হার হ্রাস, এগারো বছর ধরে অব্যাহতভাবে ছয় ভাগের বেশি প্রবৃদ্ধির হার ধরে রাখা (বর্তমানে যা ৭.১১ শতাংশ), বিশ্বব্যাংকের বিরোধিতার মুখেও নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি প্রতিপালন তথা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যকর প্রভৃতি সাফল্য আওয়ামী লীগকে দিয়েছে ব্যাপক গণভিত্তি। এর পাশাপাশি কূটনৈতিকভাবেও বর্তমান সরকারের সাফল্য শুধু বাংলাদেশের মানুষের নয়, বিশ্ববাসীরও দৃষ্টি কেড়েছে। ভারত-চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র হলেও এই চারটি শক্তিধর রাষ্ট্রের সঙ্গেই আওয়ামী লীগ সরকারের সুসম্পর্ক রয়েছে। এই সরকারের আমলে দেশে-বিদেশে প্রায় দেড় কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। বাংলা নববর্ষে উৎসব ভাতা, আশ্রয়ন, একটি বাড়ি একটি খামার, দুস্থ ভাতা, বিধবা ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ অসংখ্য সেবা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। দেশে বর্তমানে শিক্ষার হার ৭১ শতাংশ, উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার মেগাওয়াট। সড়ক, নৌ, রেল ও বিমানসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন বাংলাদেশে এখন দৃশ্যমান সত্য।
পূর্ববর্তী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বাংলাদেশকে বানিয়েছিল মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের কারখানা। সে সময় যেখানে সেখানে বোমা হামলা হতো, এমন কি ৬৩টি জেলায়ও এক সঙ্গে বোমা হামলার নজির রয়েছে। সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হয়েছে। মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ দমনে সরকারের অনমনীয় দৃঢ়তা জনগণের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে। যারা বাংলাদেশকে বিশ্বাস করে না, যারা মৌলবাদের বীজ বুনতে চায় বাংলার মাটিতে, শেখ হাসিনা তাদের টার্গেটে বহুদিন ধরেই আছে। কিন্তু শেখ হাসিনার মৃত্যু শুধু ব্যক্তির মৃত্যুই হবে না, সেটি হবে একটি উদীয়মান দেশের উন্নয়নের মৃত্যু, সীমাহীন সম্ভাবনার মৃত্যু। এসব আমাদের উপলব্ধি করতে হবে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এবং আওয়ামী লীগের ভাগ্য একসূত্রে গাঁথা। যখনই বাংলাদেশের মাটিতে ঘাতকচক্র ও বিরোধী শিবিরের ষড়যন্ত্রে আওয়ামী লীগ বিপর্যস্ত হয়েছে তখনই বাংলাদেশের ভাগ্যে নেমে এসেছে চরম অশান্তি কিংবা সামরিক থাবা। বাংলাদেশের জন্য লড়েছে আওয়ামী লীগ, বর্তমানে দেশও গড়ছে আওয়ামী লীগ। উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত রাখতে হলে অবশ্যই আওয়ামী লীগকে স্বচ্ছ, সুন্দর ও আত্মসমীক্ষার মুখোমুখি হওয়া দরকার। দল এখন ক্ষমতায় আছে। ক্ষমতায় থাকলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে কিন্তু পর্যবেক্ষণ শক্তি কমে। আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনা বর্তমান বিশ্বে অতুলনীয় নেত্রী। তিনি একাই আওয়ামী লীগের ভার বহন করতে সক্ষম। কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, শেখ হাসিনা যতই ক্লিন ইমেজ তৈরি করুন না কেন যদি তার দলীয় লোকজন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, দলীয় নীতি বিসর্জন দিয়ে অবৈধভাবে মানুষকে হয়রানি করে, তাহলে সামনে ভরাডুবি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। ভুলে গেলে চলবে নাÑ একদল লোক বাংলাদেশে বসে এখনো পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখছে। মৌলবাদী ও পাকিস্তানি ভাবধারা থেকে তাদের ‘মাইন্ডসেট’ পরিবর্তন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক ভাবধারায় বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে হবে। দেশের উন্নয়নের পাশাপাশি এটাও অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগের জন্য।
বাংলাদেশকে শেখ হাসিনা উচ্চতম স্থানে নিয়ে গেছেন। শেখ হাসিনাকে ঘিরে এখন মানুষের মাঝে অনেক আশা তৈরি হচ্ছে। মানুষ বুঝতে পারছে আসলেই দেশের উন্নতি হচ্ছে। এই জন্যই রাজপথে বিরোধী দলের মিছিল-মিটিং জনশূন্য। এটা আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত শুভ লক্ষণ। সব দিক সামাল দিয়ে এখন ঠাণ্ডা মাথায় সরকার ও দল পরিচালনা করতে হবে। মন্ত্রিপরিষদকেও স্বচ্ছতা ও দুর্নীতিমুক্ত করার প্রয়োজনে পরিবর্তন করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেখানে বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে চান সেখানে নিতে গেলে অবশ্যই শেখ হাসিনা ও তার সরকারের ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতি সঠিক ও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে, কেননা শেখ হাসিনার সুস্থ-সুন্দর-নিরাপদ ভবিষ্যৎ আর বাংলাদেশের ভাগ্য একসূত্রে গাঁথা। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যত ষড়যন্ত্রই হোক বাংলাদেশের স্বার্থে তা বাংলার মানুষকেই মোকাবিলা করতে হবে। এই সত্য আমরা যত দ্রুত উপলব্ধি করবোÑ আমাদের সার্বিক মুক্তি তত দ্রুতই বাস্তবতায় রূপ নেবে।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
৩০ আগস্ট, ২০১৯
কী হবে যদি আঁধার নেমে আসে?
মোনায়েম সরকার
পৃথিবীর মানচিত্রে এক দুর্ভাগ্য পীড়িত জাতির নামÑ বাঙালি জাতি। এ জাতির মতো আর কোনো জাতি এত নির্যাতন আর নিপীড়ন ভোগ করেনি। বাঙালি জাতির ভাগ্যে সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয় না। যারা এই নিরন্ন জাতির জন্য অন্নের ব্যবস্থা করেছে, পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেÑ তাদেরকেই বাঙালিরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। বাঙালি গরিব বলেই এদের লোভ বেশি। লোভের ফাঁদে এরা খুব দ্রুতই ধরা দেয়। তাই বিদেশি শাসক-শোষকেরা লোভের ফাঁদে ফেলে বার বার বাঙালিকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ পেয়েছে। এখনো বাঙালিকে লোভ ও লাভ দেখিয়ে যেকোনো কাজ করানো দুঃসাধ্য নয়।
লোভী বাঙালির সামনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই প্রথম পুরুষÑ যিনি প্রধানমন্ত্রিত্বের লোভ দু’পায়ে মাড়িয়ে বাঙালির স্বাধিকারের জন্য দুর্বার সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন এবং সেই মরণপথ সংগ্রামে তিনি সফল হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আপসহীন নেতা, তিনি যা বলতেন সরাসরি বলতেন। কারো রক্ত চক্ষুকে তিনি কখনো ভয় পান নাই। শ্মশান বাংলাকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু সেই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করার সময় তিনি পাননি, তার আগেই লোভী ঘাতকের দল সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধুর মতো জনপ্রিয় নেতা বাংলার ইতিহাসে আর কখনো আসেনি বললে বেশি বলা হয় না। অথচ তিনি যখন নিহত হলেন তখন বাংলাদেশ নির্জীব হয়ে গিয়েছিল। রাস্তায় কোনো মিছিল হলো না, কেউ কোনো প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করল না, বরং অনেকেই সেদিন ঘাতক দলের অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য ঘাতকদের সঙ্গে অন্ধকারে হাত মিলিয়ে ছিল।
আজ আমার বলতে দ্বিধা নেই, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকা- শুধু একটি হত্যাকা-ই নয়Ñ একটি স্বাধীন অসাম্প্রদায়িক জাতিকে পরাধীন ও সাম্প্রদায়িক করার পাশবিক চক্রান্তও বটে। আমরা যদি যৌক্তিক বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখবো একটি জাতিকে পরাধীন করা এবং সেই জাতিকে সাম্প্রদায়িক করে তোলা বর্তমান সা¤্রাজ্যবাদের নতুন কৌশল। সুতরাং যারা সা¤্রাজ্যবাদী এবং সা¤্রাজ্যবাদের ক্রীড়নক তারাই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী।
বঙ্গবন্ধু আমলে বাংলাদেশ ছিল একটি ধ্বংসস্তূপ। সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে বঙ্গবন্ধু তাঁর নেতৃত্বের দূরদর্শিতায় বাংলাদেশকে টেনে তোলেন। জিডিপি নিয়ে যান ৭.৫ শতাংশে। যা আমরা এখনও কল্পনা করে শিউরে উঠি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পরে বাংলাদেশ থমকে গিয়েছিল। বজ্রাহত মানুষের মতো হয়ে গিয়েছিল বাংলার শোকাহত মানুষ। সেদিন শোকে-দুঃখে পুরো জাতি পাথর হয়ে গিয়েছিল। সেই মৃত পাথরে ধীরে ধীরে আজ প্রাণ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে।
আজ বঙ্গবন্ধুর নামে ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়েছে। এখন মুখে মুখে উচ্চারিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর নাম। এটা এক অর্থে ইতিবাচক হলেও মুজিব প্রেমের গভীরতা যাচাই করা দরকার আছে বলেই আমি মনে করি। যারা সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার লোভে ‘জয় বাংলা’ ও ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে তাদের লোক দেখানো মুজিবপ্রেম বস্তুত কোনো কাজের কথা নয়, কেননা দলের দুঃসময় এলেই তারা দল ত্যাগ করে কেটে পড়বে। মুখে তখন অন্য স্লোগান ধরবে। বলতে দ্বিধা নেই আজ আওয়ামী লীগের স্লোগান দেওয়ার অনেক মানুষ থাকলেও এরা কয়জন সত্যিকারের আওয়ামী লীগার ও মুজিব আদর্শে বিশ্বাসী, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার অনেক কারণ আছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর ৪৪ বছর অতিবাহিত হচ্ছে। এই ৪৪ বছরে আওয়ামী লীগ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে সে বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রত্যেকটি নেতাকর্মীকে আত্মসমালোচনা করা দরকার। বঙ্গবন্ধু বার বার তার ভাষণে নেতাকর্মীদের আত্মশুদ্ধি ও আত্মসমালোচনা করার কথা বলতেন। সে সময়ের অনেক লড়াকু নেতাই পরে ভোল পাল্টিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন। অনেকেই বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর উল্টাপাল্টা কথা বলেছিলেন অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর সামনে যারা বিড়াল হয়ে বসে থাকতেন তার অবর্তমানে তারাই বাঘ হয়ে আবির্ভূত হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর বাংলার রাজনৈতিক আকাশে অপরাজনীতির কালো মেঘ জমেছিল। ’৭৫-পরবর্তীকালে এদেশের বুকে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা নিষিদ্ধ ছিল। তবু বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী কিছু মানুষ মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে গোপনে গোপনে চালিয়েছে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রচার-প্রচারণা। লড়াই করেছে মুজিববিরোধী শিবিরের সঙ্গে। আজ যারা বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে অতি উৎসাহী সেদিন তারা কোথায় ছিলেন? তাদের অনেককেই সেদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি। আজ সেই স্মৃতি হয়তো ইতিহাসের মলিন কাহিনীমাত্র। কিন্তু একদিন এই মলিন স্মৃতিগুলোই ছিল বাস্তব সত্য। আজ যারা নব্য আওয়ামী লীগার, তাদের হয়তো অনেকেরই জানা নেইÑ সেই দুঃসহ দিনের সঠিক ইতিহাস। আজ আওয়ামী লীগের আকাশ থেকে কালো মেঘ কেটে গেছে, দিন বদলে গেছে আওয়ামী লীগের। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এখন স্বর্ণযুগ পার করছে। চতুর্দিক থেকে দলছুট নেতাকর্মীরা এসে আওয়ামী লীগে ভিড় জমাচ্ছে। কেউ দলের পদ-পদবি পাচ্ছে, কেউ কেউ এই সুযোগে সীমাহীন দুর্নীতি করে দলের মুখে চুনকালি মাখাচ্ছে। এ বিষয়ে এখনি আওয়ামী লীগের প্রধানকে সাবধান হওয়া দরকার। আমি মনে করি তিনিও এ বিষয়ে সজাগ আছেন। দলীয় ভাবমূর্তি নষ্ট করে যারা ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতে চায়Ñ তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে।
পূর্বেই বলেছি আজ বঙ্গবন্ধুর নামে ইতিহাসে নতুন অধ্যায় সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রমাণ হিসেবে অনেক তথ্যই উপস্থাপন করা যায়। যেমনÑ প্রতিদিনই বিভিন্ন গণমাধ্যম কর্মী আমাদের বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনে এসে তথ্য সন্ধান করছেন। পিএইচ.ডি. ডিগ্রি প্রত্যাশী কয়েকজন গবেষকও ইতোমধ্যে আমাদের ফাউন্ডেশনে এসে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে গেছেন। অনেকে ফোন, ইমেইল ও অন্যান্য মাধ্যমে যোগাযোগ করছেন। এই যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা এটা এক অর্থে ভালো দিক। আবার অতি উৎসাহী মূর্খরা এমনভাবে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন করছেন দেখে লজ্জায় মরে যাই, আমার মনে আছেÑ নেতাজি সুভাষ বসুর নামে একটি বিড়ি বের হয়েছিল, যারা ওই কাজ করেছিল তারা বুঝেনি নেতাজি সুভাষ বসু বিড়ির মডেল হতে পারেন না। তার মূল্য নির্ধারণ করা অত সহজ ব্যাপার নয়, আজ বঙ্গবন্ধুর বিষয়েও আমাদের ভাবগাম্ভীর্য বজায় রাখা দরকার।
আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছেন। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে দলীয় নেতাকর্মীরা কিছুটা বেপরোয়া ও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে উঠেন এটাই স্বাভাবিক। দলীয় নেতাকর্মীদের বেপরোয়াভাব দমন করতে না পারলে ভবিষ্যতে দলকে কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে তাকালেই এটা পরিষ্কার বোঝা যায়। দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্ধত আচরণ দল ও দেশের জন্য কোনোক্রমেই কাম্য নয়। দলীয় যেসব নেতা-কর্মী ও মন্ত্রী-এমপির গায়ে দুর্নীতির দুর্গন্ধ আছে, সেসব নেতাকর্মীকে দ্রুত দল থেকে বিদায় করতে হবে এবং ত্যাগী ও আদর্শবান নেতাকর্মী নিয়ে দল ও সরকার পুনর্গঠন করতে হবে। যে আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে বাংলার মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে সেই আকাক্সক্ষায় কিছুতেই চিড় ধরানো ঠিক হবে না। গণমানুষের প্রত্যাশা আওয়ামী লীগকেই বাস্তবায়ন করতে হবে। আজ সারাদেশেই ব্যাপক উন্নতি হচ্ছে, এরপরেও কেন সরকারের প্রতি মানুষের বিরূপ ধারণা তৈরি হচ্ছে সেটা পুনর্মূল্যায়ন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। ত্যাগী ও আদর্শবান নেতাকর্মীরাই দলের সম্পদ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, এটা নিঃসন্দেহে আশা জাগানিয়া ব্যাপার। সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ দরকার। লোভী মানুষ দিয়ে সোনার বাংলা গড়া যাবে না। আজ যারা আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণ করছেন তাদের অনেকেই বলছেন আগস্টের ষড়যন্ত্র শেষ হয়নি, এখন ‘প্রাইম টার্গেট’ শেখ হাসিনা। তাই যদি হয়, তাহলে এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের কি করা উচিত সেটা ভেবে দেখতে হবে। আবার যদি ১৫ আগস্ট নেমে আসে, আবার যদি অন্ধকারে ছেয়ে যায় পুরো বাংলাদেশÑ সেদিনের অবস্থাও কি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মতোই হবে? নাকি সেদিন আদর্শকর্মী ও জনতা মিছিল নিয়ে রাস্তায় নেমে আসবে, ঘাতকের বিচার দাবি করবে? আদর্শ ছাড়া দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা করা যায় না। আজ আওয়ামী লীগের অনেকের নামেই অনেক কুকথা শোনা যাচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষ বিরক্ত হচ্ছে। মানুষের বিরক্তি উৎপাদন করে দল টিকিয়ে রাখা যায় না। আমরা প্রত্যাশা করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও সাংস্কৃতিক শুদ্ধতা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে এগিয়ে যাবেন।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
১৯ আগস্ট, ২০১৯