বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর পালে জোরেশোরে হাওয়া লেগেছে বলেই মনে হয়। ইতোমধ্যেই বেগম খালেদা জিয়া তার দলের ভিশন-২০৩০ ঘোষণা করে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলেছেন। এইচ এম এরশাদ ও তাঁর দল জাতীয় পার্টিও জোট গঠনের জন্য বেশ দৌঁড় ঝাঁপ শুরু করেছেন। একটি বৃহৎ জোট গঠন করে ক্ষমতায় যাওয়াই এরশাদের লক্ষ্য বলে মনে হচ্ছে। অন্যদিকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এখন থেকেই নৌকা মার্কার পক্ষে ভোট চাওয়া শুরু করেছেন। অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতি ২০১৮ সালের নির্বাচনকে ঘিরে বেশ জমে উঠছে বলেই মনে হয়।
১০ মে, ২০১৭ সালে ৩৭টি বিষয়ে ২৫৬-দফা সংবলিত ‘ভিশন-২০৩০’ ঘোষণা করেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন। এই ভিশন উপস্থাপনকালে তিনি রাজনীতিতে নতুন ধারা ও অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেন।
বিএনপির ঘোষিত ভিশন-২০৩০ আমি খুব মনোযোগ দিয়েই পড়েছি। তাতে এমন কোনো চমক নেই যা ‘ভিশন-২০২১’ এ নেই। যা কিছু চমক তাহলো সেই জায়গাগুলো যে জায়গাগুলোর জন্য জামায়াত বর্তমানে বেকায়দায় আছে, সংবিধানের এবং প্রচলিত আইনের কয়েকটি ধারায় বিএনপি সংশোধনীর প্রস্তাব পেশ করেছেন ভিশনে। ওই ধারাগুলো পরিবর্তন করাটা এই মুহূর্তে জরুরি নয় দেশ ও দেশের মানুষের জন্য। তবে বিএনপি ও জামায়াতের জন্য খুব দরকার, তাই সেগুলো পরিবর্তন করতে বিএনপি আগ্রহী হবে এটাই স্বাভাবিক। ভবিষ্যতে হাওয়া ভবন, খোয়াব ভবন বা তারেক জিয়ার ভিশনের কোন কথা নেই।
আগামী নির্বাচন এমন একটা সময়ে অনুষ্ঠিত হবে যে সময়টা বিএনপির জন্য হবে অগ্নিপরীক্ষাতুল্য। বিএনপি-জামায়াত ছাড়া নির্বাচনে যাওয়া মানে নিশ্চিত ভরাডুবি। বিগত দিনের নির্বাচন পরিসংখ্যান অন্তত তাই বলে। আগামী নির্বাচনে জামায়াত অংশ নিতে পারবে না, সে ক্ষেত্রে জামায়াতের ভোট বিএনপির বাক্সে গেলেও বিএনপিকে একা একাই মাঠে থাকতে হবে। অবশ্য এই মুহূর্তে একা একা মাঠে টিকে থাকার সামর্থ্য বিএনপির আছে কিনা সেই বিষয়েও সন্দেহ রয়েছে। বিএনপি যা লুটপাট করেছিল এতদিনে সেই পুঁজি প্রায় শেষ হয়ে গেছে। হাওয়া ভবনে এখন আর কমিশন ব্যবসা নেই, সিন্ডিকেট নেই, কোকো ১, ২, ৩, ৪ ইত্যাদির ব্যবসা মন্দা, ড্যান্ডি ডাইংও খারাপ অবস্থায়, দলীয় নেতাকর্মীরা সকলেই প্রায় সীমাহীন দুর্নীতির দায়ে পলাতক বা দলত্যাগী। জামায়াতের কোনো কাজেও বিএনপি আসতে পারছে না যে জামায়াত তাদের অর্থ যোগান দিবে। সুতরাং কোমর ভাঙ্গা দল নিয়ে বিএনপি কতটুকু লড়াই করতে পারবে বা আদৌ পারবে কিনা সেটাই বিবেচ্য।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বর্তমানে বিএনপি বা জাতীয় পার্টি ফ্যাক্টর নয়, ফ্যাক্টর আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের বিকল্প এখন আওয়ামী লীগই। যদি বড় কোনো দুর্যোগ না ঘটে তাহলে এ মুহূর্তে উন্নয়নে, পরিকল্পনায়, রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় আওয়ামী লীগের ধারে কাছে কেউ নয়। কৃত্রিম জিনিস আর আসল জিনিস কখনোই এক নয়। কৃত্রিম কখনোই আসলের বিকল্প হতে পারে না। হয়তো আসলের অভাব দেখা দিলে মানুষ নকল দিয়ে কাজ চালায় কিন্তু আসল পেলে কে নকল জিনিস চায়?
স্বাধীন বাংলাদেশে পঁচাত্তরের পরে যে দুটি রাজনৈতিক দল দীর্ঘদিন ক্ষমতা দখল করে রেখেছিল সেগুলো ছিল কৃত্রিমভাবে প্রতিষ্ঠিত দল। ক্ষমতায় আসীন থাকাকালে জেনারেল জিয়া তথাকথিত ১৯-দফার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিএনপি আর পরবর্তীকালে জেনারেল এরশাদ ১৮-দফার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জাতীয় পার্টি। বিএনপি মূলত রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, ন্যাপ, সুবিধাবাদীদের নিয়ে গঠিত ওরস্যালাইন পার্টি। ক্যান্টনমেন্টের অন্ধকার কুঠুরিতে জন্ম নেয়া এই দলটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পায়ে কুড়ালের প্রথম কোপটি মারে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস যারা জানেন, তারা নিশ্চয়ই মনে করতে পারেন পঁচাত্তর পরবর্তী জিয়া সরকার ছিল অবৈধ। জিয়া আইয়ুব খানের মতো হ্যাঁÑনা ভোটের আয়োজন করেছিলেন দেশকে পাকিস্তানি ধারায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। এই অবৈধ জিয়া সরকার সারাদেশে সৃষ্টি করেন এক দুর্বিষহ আতঙ্ক। তার সীমাহীন নির্যাতনে জেলখানা ভরে যায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী দ্বারা। কেউ কেউ চলে যান আন্ডার গ্রাউন্ডে। আন্ডার গ্রাউন্ডেও যখন সাঁড়াশি অভিযান চালানো হয়, তখন তারা বাধ্য হয় হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে দেশ ত্যাগ করতে। জিয়ার শাসনামলে প্রতি রাতে দেশে ‘মার্শাল ল’ থাকতো। জনজীবন ছিল চরম অনিরাপত্তার ভেতর। সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়া বাংলাদেশে যে কালো আইন তৈরি এবং মুজিব হত্যাকা-ের বৈধতা দান করে ঘাতকদের পুরস্কৃত করে তাতেই কি জিয়ার নির্দয় একনায়কের পরিচয় বহন করে না?
জিয়ার পরে আসে আরেক গণতন্ত্রহত্যাকারী জেনারেল এরশাদ। এরশাদও আওয়ামী লীগের নেতৃকর্মীদের ওপর ভয়ঙ্কর নির্যাতন চালায়। কেননা এরশাদ তো প্রকারান্তরে জিয়ারই ভাবশিষ্য। গুরু প্রদর্শিত পথই তো শিষ্যের জন্য অনুসরণীয়। তাই আওয়ামী লীগকে নির্যাতন করতে জিয়া ও বিএনপি যা যা করেছেÑ এরশাদ আর জাতীয় পার্টিও তা-ই করেছে। বরং এরশাদের নির্যাতন কোথাও কোথাও জিয়াকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। চোখ বেঁধে শেখ হাসিনাসহ ৩৩ জন নেতাকর্মীকে সেনানিবাসের কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছিল।
১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে জনগণের প্রিয় পার্টি আওয়ামী লীগ ২৮৮টি আসন, ভোট পায় ৮৯ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগ পায় ২৯৩টি আসন, ভোট পায় ৭৩ দশমিক ২০ শতাংশ। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে জেনারেল জিয়া প্রতিষ্ঠিত বিএনপি পায় ২০৭টি আসন, ৪১ দশশিক ১৬ শতাংশ ভোট আর আওয়ামী লীগ পায় ৩৯টি আসন এবং ২৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ ভোট। এখানে লক্ষ্য করার মতো একটি ব্যাপার হলোÑ ঘাতকের হাতে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পূর্বেও যে আওয়ামী লীগের ভোট ছিল ৭৩ দশমিক ২০ শতাংশ। তার মৃত্যুর পরে তার ভোটার সংখ্যা কিভাবে ২৪ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে যায় আর হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা সেনাশাসক জেনারেল জিয়ার ভূঁইফোড় বিএনপি পায় ৪১ দশমিক ১৬ শতাংশ ভোট।
১৯৮৬ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের শাসনামলে যে নির্বাচন হয় সেই নির্বাচন বিএনপি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সরে দাঁড়ায় এবং খালেদা জিয়া তথাকথিত আপসহীন নেত্রীতে পরিণত হন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়কে ঠেকাতে ৪৮ ঘন্টা মিডিয়া ক্যু করে জাতীয় পার্টি নির্বাচনের ফলাফল উল্টে দেয়। এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি পায় ১৫৩টি আসন, ভোট পায় ৪২ দশমিক ১৫ শতাংশ। মিডিয়া ক্যু না হলে নির্বাচনের ফলাফল আওয়ামী লীগের পক্ষেই যেতো। ১৯৮৮ সালে আবার এরশাদের অধীনে নীল নকশার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেউই অংশ নেয়নি। এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ২৫১টি আসন, ভোট পায় ৬৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ, ফ্রিডম পার্টি তথা কিলার পার্টি পায় ২টি আসন আর ৭২ দলীয় জোটের নেতা আ স ম আবদুর রব ১৯টি আসন পেয়ে হয় বিরোধী দলীয় নেতা হন।
এরপর ১৯৯১ সালে সর্বদলীয় রাজনৈতিক পার্টির অংশগ্রহণের মাধ্যমে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে বিএনপি পায় ১৪০টি আসন, আওয়ামী লীগ জোট পায় ১০০টি আসন এবং জাতীয় পার্টি পায় ৩৫টি আসন। এই নির্বাচনের ভোটের সংখ্যা বিশ্লে¬ষণ করে দেখা যায় বিএনপির বাক্সে পড়ে ৩০ দশমিক ৮১ শতাংশ ভোট আর আওয়ামী লীগ পায় ৩৩ শতাংশ ভোট, জাতীয় পার্টি পায় ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ ভাট। জামায়াত পায় ১৮টি আসন। জামায়াত-বিএনপির সিট এলাইন্সের ফলে বিএনপি ১৯৯১ সালে অপ্রত্যাশিতভাবে সরকার গঠন করে।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আবার এসে গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়ে। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নিজের অধীনে আয়োজন করে ষড়যন্ত্রের নির্বাচন। এই নির্বাচনে বিএনপি পায় ২৭৮টি আসন, ফ্রিডম পার্টি পায় ২টি এবং স্বতন্ত্র পার্টি পায় ১০টি আসন। কিন্তু খালেদা জিয়া গণ-আন্দোলনের মুখে শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। প্রচ- গণ-আন্দোলন ও জনতার মঞ্চ গঠন করার ফলে ১৯৯৬ সালের জুন মাসে তিনি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। যদিও তিনি বলেছিলেন পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ নির্দলীয় নয়।
এই নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ ১৪৬টি আসন এবং ৩৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ ভোট পেয়ে একুশ বছর পরে অর্থাৎ পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পরে ক্ষমতায় আসীন হয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি পায় ১৯৩টি আসন এবং ৪০ দশমিক ৮৬ শতাংশ ভোট, আওয়ামী লীগ পায় ৬২টি আসন এবং ৪০ দশমিক ২১ শতাংশ ভোট। অর্থাৎ এই নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ প্রায় সমসংখ্যক ভোট পেলেও আসন সংখ্যায় বিএনপি এগিয়ে থাকে। এবারও জামায়াতকে সাথে নিয়ে জামায়াতের ৪ দশমিক ২৯ শতাংশ ভোট নিয়ে এবং ১৭টি আসন নিয়ে বিএনপি এগিয়ে যায়। ২০০১ সালের নির্বাচনে জয় লাভ করে বিএনপি আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার নানামুখী ষড়যন্ত্র করে, রাজাকারদের মন্ত্রী বানায়, বাংলা ভাই সৃষ্টি করে এবং দেশজুড়ে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটায়। বিএনপির রক্তলোলুপ চক্রান্তে শাহ এ এম এস কিবরিয়া, আহসান উল্লাহ মাস্টারসহ আওয়ামী লীগের শত শত নেতাকর্মী নিহত হন। শেখ হাসিনাও ১৯ বার মৃত্যু ঝুঁকি থেকে বেঁচে যায়। এর মধ্যে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার কথা সবচেয়ে নির্মম আর মর্মান্তিকÑ এ সবই জ্বলন্ত ইতিহাস।
বিএনপি ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় এসে যেমন ক্ষমতা ছাড়তে চায়নি তেমনি ২০০১ সালে ক্ষমতা পেয়েও তারা মেয়াদ পূর্ণ করে ক্ষমতা ছাড়তে টালবাহনা শুরু করে। এরপর আবির্ভূত হয় কিছু উচ্চাভিলাশী সামরিক ও বেসামরিক নেতার নেতৃত্বে আর্মি সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তারাও দুই বছর গণতন্ত্রকে জিম্মি করে রাখে। চেষ্টা চালাতে থাকে দুই নেত্রীকে মাইনাস করার। কিন্তু গণ-আন্দোলনের মুখে তারাও বাধ্য হয় ২০০৮ সালে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে এবং মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার কাজে মনোনিবেশ করে। দেশে এখন সেই ধারাই অব্যাহত আছে। উপরের বিশ্লে-ষণ থেকে একটি বিষয় প্রতীয়মান হয়েছে যে, যখনই বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে তখনই আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে। এ ধারা ১৯৭০ থেকে শুরু হয়ে ২০১৪ পর্যন্ত বিদ্যমান, ২০১৮ সালেও তার ব্যতয় হবে না।
ব্রেখটের একটি নাটকে সাতটি ঘোড়ার গল্প পড়েছিলাম। ছয়টি ঘোড়া সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খাটে অথচ তাদের দানাপানি কম, একটি ঘোড়া কাঁধে বন্দুক নিয়ে শুধু ঘুরে বেড়ায়। তার খানাপিনার ব্যবস্থা সবার চেয়ে আলাদা ও বেশি। বন্দুক কাঁধে ঘোড়াটি মূলত স্বৈরশাসক বা সেনাশাসকের প্রতীক। একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, যতদিন জিয়া, এরশাদ, খালেদাÑ এই তিনজন ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন, ততদিন তাদের হাতে ক্ষমতা ছিল। যেই তারা ক্যান্টনমেন্টের বাইরে চলে গেছেন অমনি তাদের ক্ষমতাও বদলে গেছে। ২১ বছর বাংলার মানুষ ক্যান্টনমেন্ট নির্ভর শাসনে থেকেছে। খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়িতে এখন ৪৫টি পরিবার বসবাস করে। অথচ এই বাড়িটি তার পরিবার একাই ভোগ করতো।
বাংলার মানুষ আজ ক্যান্টনমেন্ট নির্ভর ক্ষমতাবানদের চায় না। তারা ‘গণভবন’ আর ‘বঙ্গভবন’ নির্ভর ক্ষমতা দেখতে চায়। কেননা ‘গণভবন’ ও ‘বঙ্গভবন’ দুটোর সঙ্গেই বাংলার আপামর জনতার আবেগ জড়িয়ে আছে। ক্যান্টনমেন্টের সঙ্গে বাঙালির কোনো আবেগ জড়ানো নেই। ওখানে কেবলই ষড়যন্ত্র আর নিষ্পাপ সেনা সদস্যদের রক্তের দাগ লেগে আছে। যেই সেনাসদস্যরা জিয়া আর এরশাদের আমলে শহীদ হয়েছেন।
জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল এরশাদ উভয়েই অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। উভয়েই নানাপ্রকার চক্রান্ত করে আওয়ামী লীগকে তথা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ও গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে চেয়েছেন। আজ এদের পক্ষে কথা বলা মানে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কথা বলা, গণতন্ত্রের বিপক্ষেই কথা বলা। দেশে অনেক জঞ্জাল জমেছে। সেই জঞ্জাল পরিষ্কার করতে হলে, দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে আওয়ামী লীগকে সময় ও সমর্থন দেওয়া দরকার। আশাকরি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ সে সুযোগ আওয়ামী লীগকে দেবে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে দুর্বৃত্ত, চাঁদাবাজ বর্জন ও দুর্নীতি মুক্ত ইমেজ নিয়ে জনগণের কাছে যেতে হবে। দেশের মানুষ ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ চায়। যা একমাত্র আওয়ামী লীগেই দিতে পারে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে।
শেখ হাসিনার মতো এমন ব্যতিক্রমী নেতৃত্ব দেশবাসী বিগত ৪৫ বছরে দেখেনি। তিনি চলনে-বলনে-আহ্বানে বাংলার নারীর প্রতিচ্ছবি। নেতৃত্বে দৃঢ়চেতা, রাজনৈতিক কৌশলে দূরদর্শী এবং সিদ্ধান্তে দৃঢ়চেতা এক ব্যক্তিত্ব। নেতাকর্মীদের শাসন-সোহাগ করা মা-মাটি-মানুষের ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের মানুষের নেত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার হাত ধরে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, আজ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা সোনার বাংলা গড়ে তুলবো।
১৬ মে, ২০১৭
বর্তমান বিশ্ব দারুণ অস্থিতিশীল প্রকৃতি, প্রতিবেশ ও পরিবেশের ভেতর দিয়ে এগোচ্ছে। সারা পৃথিবীতে কোথাও কোনো শান্তি নেই। প্রত্যেকেই আজ বেপরোয়া ও উদ্ধত। আজকের দুনিয়ায় হয় কোনো রাষ্ট্র যুদ্ধাক্রান্ত, নয়তো দুর্বল বা শত্রু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিকল্পনায় রত। কোনো কোনো দেশ আবার প্রতিবেশী রাষ্ট্রের শরণার্থী সামাল দিতে গলদঘর্ম। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে অত্যন্ত দূরদর্শিতার সঙ্গে সবকিছু সামাল দিয়ে দেশকে ও দেশের মানুষের জীবনমান এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন আধুনিক সুখী-সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক জননেত্রী শেখ হাসিনা।
রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই শেখ হাসিনা ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ছুটে চলছেন। তাঁর পিতার মতো তিনিও নিরন্তর লড়াই-সংগ্রাম করছেন, বাংলার শোষিত-বঞ্চিত নিরন্ন মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য। একটা মানুষ যে কী পরিমাণ ত্যাগী আর দেশপ্রেমিক হতে পারেন যারা কাছ থেকে শেখ হাসিনাকে না দেখেছেন তাদের পক্ষে তা অনুধাবন করা পুরোপুরি সম্ভব নয়।
কে ভেবেছিল বাংলার রাজনীতি শেখ হাসিনার হাতে নবপ্রাণ লাভ করবে? তিনি নিজেও কোনোদিন স্বদেশ গড়ার এই স্বপ্ন দেখেছেন কিনা সে বিষয়ে সংশয় আছে। অথচ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন হওয়া বাংলা যখন দুঃসময়ের মুখোমুখি, সামরিক স্বৈরশাসক যখন কালো বুটের তলায় পিষ্ট করে চলেছে ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ, তখন সহায়-স্বজনহীন শেখ হাসিনা রাজনীতির মঞ্চে পা রাখেন। তাঁরই বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু হত্যার ২১ বছর পরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। শুরু হয় আওয়ামী লীগের নব উত্থান। ২০০১ সালে আবার আওয়ামী লীগ দিকভ্রান্ত হয়। ২০০৪ সালে শেখ হাসিনা গ্রেনেড হামলার শিকার হলে অনেক নেতাকর্মী নিহত ও আহত হন। ২০০৫ সালে শাহ এ এম এস কিবরিয়া গ্রেনেড হামলায় নিহত হন। ২০০৮ সালে পুনরায় বাংলার মানুষের নিরঙ্কুশ ভোটে ক্ষমতা পায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন দল। এখনও তারা ক্ষমতায় আছে।
আজ থেকে ৪৬ বছর আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ও আপামর জনতার স্বতঃ¯ফূর্ত ও সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা যাদের পরাজিত করেছি তারা অনুকূল পরিবেশ পেয়ে এই ৪৬ বছরে অসামান্য শক্তি সঞ্চয় করেছে। বিশেষ করে ’৭৫ পরবর্তী কালপর্বে সামরিক শাসন এবং তাদের মদদপুষ্ট রাজনৈতিক দলের সাহায্য-সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা এম.পি, মন্ত্রী হয়েছে। এমনকি রাষ্ট্রপতি পদেও আসীন হয়েছে। তারা বিচ্ছিন্ন হয়নি, বরং প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নিজেদের অবস্থান সংহত করার জন্য তারা সুদূরপ্রসারী ও সুচতুর পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়েছে। অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসনÑ সবক্ষেত্রেই তারা মারাত্মক শক্তি অর্জন করেছে। ভোটের রাজনীতিতেও তারা আজ ‘ফ্যাক্টর’ হিসেবে বিবেচিত। সাধারণ মানুষের সমর্থন তাদের প্রতি ততটা জোরালো না হলেও তাদের মূল উৎপাটন মোটেই সহজ কাজ নয়। দেশের মধ্যে যেমন, তেমনি দেশের বাইরেও তাদের মিত্র ও মুরুব্বি আছে। যেমনটি ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে।
শেখ হাসিনা ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। অনেকেরই এই বিষয়টি ভালো লাগছে না। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যারা বিশ্বাসী নয় তাদের চোখে এটা মোটেই সহ্য হচ্ছে না। ইদানীং বাংলাদেশে কিছু সুজন জন্মেছে, এদের কাজ শুধু কূজন করা। এদের লোকসংখ্যার চেয়ে কণ্ঠের আওয়াজ বেশি। পত্র-পত্রিকায় এদের ছবি দেখা যায়, জোরালো কণ্ঠ শোনা যায়। দুর্ভাগ্য আমাদের! এই কণ্ঠগুলো দেশপ্রেমের চর্চা করে যদি দুঃখ ও অপমান সহ্য করতো তাহলে সান্ত¦না থাকতো। তারা শুধু উপদেশ ও জ্ঞান দিয়ে বেড়ান। কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেনÑ ‘গুরুদেব (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) আমাকে একবার বলেছিলেন, ‘বাইরের ল্যাজ কাটা সহজ কিন্তু মনের ল্যাজ কাটবে কে?’
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো পার্টির পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের ধারা অব্যাহত রাখা আপাতত সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে শুরু থেকে ষড়যন্ত্র চলেছে এখনও চলছে। অনেকেই আওয়ামী লীগ ছেড়ে গেছে, আবার অনেকে এসেই ভিড়েছে আওয়ামী লীগের ছায়াতলে। যারা আওয়ামী লীগ থেকে চলে গেছে তারা নিজেদের কপাল নিজেরাই পুড়িয়েছে। এদেশে ছোট ছোট পার্টির কিছু বড় বড় নেতা আছেন, যারা সুযোগ বুঝে দল ও ভোল পাল্টান। এদেরকে দেশ-জাতি সনাক্ত করেছে। এদের কথায় এখন এদেশের মানুষ ভুলে না। আগামী দিনে এরা জাতীয় শত্রু বলেই বিবেচিত হবে।
বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে কিছুতেই সেক্যুলার ধারার বাইরে যেতে দেওয়া ঠিক হবে না। আজ সেক্যুলার ভারতে বিজেপি ক্ষমতায়। এর প্রধান কারণ কংগ্রেসের দুর্বলতা। কংগ্রেসের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার জন্যই আজ আরএসএসের প্রতিনিধি কট্টর বিজেপি ভারতের রাষ্ট্র ক্ষমতায়। যদি জিন্নাহর চামড়ার নিচে পরীক্ষা করা যেতো তাহলে দেখা যেতো তার চামড়ার নিচে মুসলমানিত্ব ছিল। তদ্রƒপ নেহেরুর চামড়ার নিচেও ছিল হিন্দুত্ব। আসলে দু’জনেরই সাম্প্রদায়িক মন ও ধর্মনিরপেক্ষ মুখ ছিল, ভারত বর্ষের এই রাজনৈতিক মহাপুরুষেরা যদি সত্যিকার সেক্যুলার হতেন তাহলে ভারত ভাগ হতো না। ভারত ও বাংলাদেশে এত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও জাতিগত বিদ্বেষও মাথা চাড়া দিয়ে উঠত না। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে আজ ‘ট্রু সেক্যুলার’ হতে হবে। তা না হলে মৌলবাদী গোষ্ঠীর থাবা থেকে বাংলাদেশকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। এ জন্য যত কৌশল প্রয়োগ করা দরকার শেখ হাসিনার সরকারকে তা-ই করা উচিত। একটি কথা মনে রাখতে হবেÑ সাধারণ মানুষ ধর্ম পালন করে, হজ্জ্ব ও বিশ্ব ইজতেমা তাঁর প্রকৃষ্ট প্রমাণ কিন্তু তারা মৌলবাদী নয়।
বিএনপি আজ বাংলাদেশে মৌলবাদীদের তোষণ, সীমাহীন দুর্নীতি আর মানুষ হত্যার রাজনীতির কারণে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। দেশের মানুষ ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করছে বিএনপির জামায়াত ঘেঁষা পলিসি। বেগম জিয়ার দুই পুত্রের সীমাহীন অর্থলিপ্সা ও স্বেচ্ছাচারী আচরণ, হাওয়া ভবন কেন্দ্রিক দুর্নীতি বিএনপির মুখে চুনকালি লেপে দিয়েছে। সেই সঙ্গে জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া বাধা তাদেরকে রসাতলের শেষ স্তরে নিয়ে গেছে। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থেকে গণভবনে নয়, ক্যান্টনমেন্টে থাকতে পছন্দ করতেন। রাজাকারদের মন্ত্রী বানাতে গর্ববোধ করতেন। বাংলাদেশবিরোধী শক্তির সঙ্গে আঁতাত করতে তার জুড়ি মেলা ভার। এগুলো বাংলার মানুষ ভুলে যায়নি। কোনোদিন ভুলে যাবে বলেও মনে হয় না। মুক্তিযুদ্ধের কালপর্বে তিনি কোথায় ছিলেন? কেন ছিলেন?
জেনারেল জিয়া রাজাকারদের পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে নাগরিকত্ব প্রদান করেছিলেন, স্বামীর ফিরিয়ে আনা রাজাকারদের মন্ত্রীর পদ দিয়ে তাদেরকে আঁচলতলে পুষে রেখেছেন খালেদা জিয়া। জিয়া ও খালেদা জিয়া শুধু মুক্তিযুদ্ধকেই অস্বীকার করেছেন এমন নয়, তারা তলে তলে পাকিস্তানি ভাবধারাকেই উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছেন। তবে এটাও ঠিক শুধু মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের সমালোচনা করলেই হবে না আওয়ামী লীগের ভেতরেও শুদ্ধতার চর্চা করতে হবে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে আওয়ামী লীগের মধ্যেও কম আবর্জনা জমেনি। এগুলো এখন পরিষ্কার করার সময় এসেছে। দলের মধ্যে যেসব দুর্বৃত্ত, ধান্ধাবাজ, টেন্ডারবাজ ও সুযোগসন্ধানীরা রয়েছে তাদেরকে এখনি বিতাড়ন করা দরকার। এদের কোনোক্রমেই ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না। বঙ্গবন্ধু তাঁর শাসনামলে দল থেকে দুর্বৃত্ত ও দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গকারীদের বিতাড়িত করে দলকে অনেকটাই সংহত করেছিলেন। শেখ হাসিনাকেও দলীয় স্বার্থে কঠোর হওয়া জরুরি। তবে এটাও ঠিক শেখ হাসিনাই সেই সাহসী নেতা যিনি দলীয় এম.পি. ও মন্ত্রীকে অন্যায়ের জন্য বহিষ্কার করতে পারেন। সাম্প্রতিক কিছু বহিষ্কারের ঘটনা সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে, ভবিষ্যতে জনগণ অনুরূপ শুদ্ধি অভিযান আশা করে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নির্বাচনমুখী দল। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হলে মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করতে হবে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যেভাবে বাংলার মানুষ আওয়ামী লীগকে ভালোবেসে ভোট দিয়েছিল সেভাবে আবার গণজোয়ার সৃষ্টি করতে হবে। নৌকায় যেসব পালকাটা ইঁদুর আছে সেগুলো নৌকা থেকে বাছাই করতে হবে। ঘরে ও বাইরে শত্রু রেখে সামনের দিকে এগিয়ে চলা সম্ভব নয়। ভাবমূর্তি নষ্ট করে এমন কাউকে দলে প্রশ্রয় দেওয়া হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। অন্যায়কারী ও অপরাধী যেই হোক আওয়ামী লীগে তাকে ঠাঁই দেওয়া মোটেই ঠিক হবে না। মানুষ স্বভাবতই লোভী। লোভের কারণে যারা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে তাদের চিহ্নিত করতে হবে এবং দল থেকে বহিষ্কার করতে হবে। যারা হত্যাকারী ও সন্ত্রাসী বলে পরিচিত, যারা মাদকব্যবসায়ী ও মানবপাচারকারী তাদেরকেও শাস্তি দিতে হবে। মাঠ পর্যায়ের ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করে হাইব্রিডদের পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পত্র-পত্রিকায় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের নামে যেসব অভিযোগ উঠছে তাদের বিরুদ্ধে এখনি কঠোর না হলে পরিণাম ভালো হবে না। বিপদ আসার আগেই সাবধান হওয়া ভালো। পরাজিত হয়ে আত্মসমালোচনা না করে, পরাজয়ের আগেই ত্রুটি বিচ্যুতি-সংশোধন করা বুদ্ধিমানের কাজ। অন্য কোনো দলের সাহায্য নিয়ে নয়, আওয়ামী লীগকে একা-একাই ৫১ শতাংশ ভোট ও ৫১ শতাংশ আসন পেয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার কৌশল নিতে হবে। আওয়ামী লীগ এখন সাবালক রাজনৈতিক দল। একে এখন নিজের দু’পায়ে দাঁড়ানো শেখা দরকার। পোলিও আক্রান্ত আওয়ামী লীগ নয়, বাংলাদেশকে গড়তে হলে সবল আওয়ামী লীগ তৈরি করতে হবে।
শেখ হাসিনা শক্ত হাতেই আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের হাল ধরেছেন। বর্তমান সরকার ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ হাতে নিয়েছে। দেশ তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উন্নীত হয়েছে নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশে। অচিরেই পরিণত হবে মাধ্যম আয়ের দেশে। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন শুধু আর স্লোগান নয়Ñ বাস্তব বিষয়। মৌলবাদ রুখে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও অগ্রগতির সঙ্গে একাকার হয়ে আছে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাÑ এটা যতদিন না বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পারবে ততদিন বাংলাদেশের কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না। সেই জায়গাটাতেই অতন্ত বুদ্ধিমত্তা ও সাহসের সঙ্গে হাত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের ভাগ্য একই সূত্রে গাঁথা। উন্নয়নশীল বাংলাদেশের ভার শেখ হাসিনার হাতেই থাকুক, সুখে-শান্তিতে-নিশ্চিন্তে থাকুক বাংলার মানুষ। আজকের শেখ হাসিনা শুধু বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়কই নন, তিনি একজন রাজনীতিপ্রাজ্ঞ বিশ্বনেতাও।
২২ জানুয়ারি, ২০১৭
বাংলা ভাষা এক সহ¯্রাব্দ অতিক্রম করে আরেকটি নতুন সহ¯্রাব্দের দিকে যাত্রা শুরু করেছে। শুরু থেকেই বাংলা ভাষার যাত্রাপথ নানা সংকটে আকীর্ণ ছিলÑ এখনও বাংলা ভাষার আকাশ থেকে সংকটের কালো মেঘ পুরোপুরি সরে যায়নি। প্রতিনিয়তই বাংলা ভাষা নানামুখী চক্রান্তের মুখোমুখি হচ্ছে। সে সব চক্রান্ত ছিন্ন করে বাংলা ভাষা এগিয়ে যাচ্ছে তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে। পৃথিবীতে যত ভাষা আছে সেসব ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষাই সবচেয়ে সংগ্রামী আর প্রতিবাদী। বারবার বাংলা ভাষার উপর আক্রমণ এসেছে বারবারই বাংলা ভাষা সেসব আক্রমণ প্রতিহত করে আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। এখনো বাংলা ভাষা তার আত্মমর্যাদা রক্ষার্থে অবিরাম লড়াই করে যাচ্ছে। যতদিন না বাঙালি জাতি বাংলা ভাষাকে মনে প্রাণে ধারণ করবে, ততদিন বাংলা ভাষাকে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে যেতেই হবে। আত্মপ্রতিষ্ঠার এই অবিরাম লড়াই থেকে যেদিন বাংলা ভাষা ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে সরে দাঁড়াবে সেদিনই তার পতন অনিবার্য হয়ে উঠবে। তবে আশার কথা হলো বাংলা ভাষা মৃতুঞ্জয়। এ ভাষার কোনো লয় নেই, ক্ষয় নেই, ধ্বংস নেই। মাঝে মাঝে ভিনদেশি রাক্ষুসে ভাষা এসে বাংলা ভাষাকে গ্রাস করতে চায় বটে কিন্তু বাংলা ভাষা এমনই এক মৃত্যুহীন ভাষা যে একে কিছু সময়ের জন্য বন্দী করা যায় কিন্তু চিরতরে ধ্বংস করা যায় না। অবিনশ্বর বাঙালি জাতি সত্তার মতো বাংলা ভাষাও অমর, অজর, মৃত্যুহীন।
মুঘল আমলে ফারাসি যখন রাজভাষা হিসেবে প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন বাংলা ভাষা তার নিজস্ব ভূখ-েই কোণঠাসা হয়ে পড়ে। রাজার অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য এবং সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার জন্য এই ভূখ-েরই একদল লোক ফারসি ভাষা চর্চা করতে উঠে পড়ে লাগে। আরেকটি দল থেকে যায় দরিদ্র বাংলা ভাষার কাছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ফারসি ভাষা বাংলা ভাষার উপর চাবুক মারতে থাকে, ফারসি ভাষা বাংলাকে গ্রাস করতে চায় কিন্তু পারে না। মরতে মরতে বেঁচে যায় বাংলা ভাষা। মুঘলদের পরে ইংরেজরা এলে বাংলা ভাষার উপর শুরু হয় নতুন অত্যাচার। তখনও বাংলা ভাষার বন্ধনকে উপেক্ষা করে, ভুলে গিয়ে বাংলা ভাষার মহিমা একদল সুবিধাভোগী ইংরেজি ভাষাকে সাদরে গ্রহণ করে। তারা হয়ে ওঠে কালো সাহেব। তাদের ভাবখানা এমন যেন বাংলা তাদের বৈমাত্রেয় বোন। তারা এড়িয়ে চলতে থাকে বাংলা ভাষার সংস্পর্শ। বাংলাকে তারা শুধু অনাদর আর অবহেলা করেই ক্ষান্ত হলেন না তারা বাংলাকে ‘ল্যাংগয়েজ অব ফিসারম্যান’ বলতে শুরু করেন। এদের মধ্যে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩ খ্রি.)-ও ছিলেন। কিন্তু যখন তার মোহ ভঙ্গ হয় তখন তিনি ঠিকই এসে মুখ লুকান বাংলা ভাষার আঁচলতলে। বঙ্কিম চন্দ্রও প্রথম প্রথম ইংরেজি ভাষা চর্চা শুরু করেছিলেন। কিন্তু তিনিও অবশেষে আশ্রয় নিয়েছেন বাংলার কুঁড়েঘরে।
বাংলা ভূখ- যখন ব্রিটিশ মুক্ত হলো তখন আশায় বুক বাঁধে বাংলা ভাষা। বাংলা ভাষা ভাবতে শুরু করে তার দুঃখের রাত বুঝি শেষ হয়ে গেল। কিন্তু না, নতুন করে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় উর্দু নামের এক অদ্ভুত ভাষা। উর্দু বাংলার বিরুদ্ধে এমনই ষড়যন্ত্র শুরু করে যে, বাংলা ভাষার তখন নাভিশ্বাস উঠে যায়। ফারসি, ইংরেজি ভাষার উৎপাত বাঙালিরা মেনে নিলেও উর্দুর বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। বলতে গেলে উর্দুর হাত থেকে বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার আন্দোলনই বাঙালির প্রথম ভাষা রক্ষা বিষয়ক আন্দোলন। এর আগে বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার জন্য কোনো সংঘবদ্ধ আন্দোলন আর গড়ে ওঠেনি। উর্দুর বিরুদ্ধে চার বছর বাঙালি রক্তঝরা ভাষা আন্দোলন করে। ১৯৪৮ সালে যে আন্দোলন শুরু হয় তার সমাপ্তি ঘটে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে। এর মাঝে ঘটে যায় অনেক ঘটনা। অনেক প্রাণ বিসর্জিত হয় রাজপথে। জেল-জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেন অনেক ভাষা সৈনিক। অসংখ্য মানুষের প্রাণদান আর নির্যাতনের বিনিময়ে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পায় বাংলা ভাষা। ১৯৫২ সালই সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত যে মুহূর্তে বাংলা ভূখ-ে বাংলা ভাষা প্রথম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পায়।
বাংলা সাহিত্যের একমাত্র প্রাচীন গ্রন্থ ‘চর্যাপদ’। চর্যাপদের ভাষা বাংলা ভাষা বলেই আজ স্বীকৃত। চর্যাপদের ভাষা দিয়েই বাংলা ভাষার বয়স যদি হিসাব করা হয়, তাহলে দেখবো যে যুগে চর্যাপদ রচিত হয়েছে সে যুগে অভিজাত কেউ বাংলা ভাষার চর্চা করেননি। চর্যাপদ যারা রচনা করেছিলেন তারা প্রায় প্রত্যেকেই ছিলেন পলাতক মানুষ। তারা স্থির হয়ে কেউই বাংলা ভাষা চর্চা করার সুযোগ পাননি। যদি পেতেনই তাহলে শুধু একখানা গ্রন্থ রচনা করেই তারা ক্ষান্ত হতেন না, তাদের হাত দিয়ে আমরা আরো অসংখ্য গ্রন্থ পেতাম। তাছাড়া চর্যাপদ আবিষ্কারের মধ্যেও আছে চমৎকার বিস্ময। বাংলা ভাষার গ্রন্থ বাংলা ভূখ- পাওয়া গেল না, এটা পাওয়া গেল নেপালে। কেন বাংলা ভাষার গ্রন্থ নেপালে আবিষ্কৃত হলোÑ এ সম্পর্কেও নতুন করে গবেষণা হওয়া দরকার।
মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম তাঁর ‘নুরনামা’ গ্রন্থে বলেছিলেনÑ
“যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি।”
কেন আবদুল হাকিম এ কথা বলেছিলেন তা আজ অনেকেরই জানা। কেননা তখনও একদল বাংলা ভাষা বিদ্বেষী মানুষ ছিলেন যারা বাংলা ভাষাকে মোটেই সুনজরে দেখতেন না। বাংলা ভূখ-ে এক শ্রেণির মানুষ বাস করে যারা এদেশের খায়, এদেশের পরে কিন্তু স্বপ্ন দেখে ইরান, তুরান, ইউরোপের, পাকিস্তানের। এরা পরগাছার মতো। এদের ভাষাপ্রেম তো নেই-ই, দেশপ্রেমও নেই। দেশপ্রেম আর ভাষাপ্রেম পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যার দেশপ্রেম থাকে তার ভাষাপ্রেমও থাকে। যার দেশপ্রেম থাকে না, তার ভাষাপ্রেমও লোপ পায়।
যুগে যুগে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে যে কত রকম ষড়যন্ত্র হয়েছে তার দুই-একটি নমুনা তুলে ধরতে চাই। ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে ‘রওশন হেদায়েত’ নামে একটি পত্রিকা তার ‘লেখক-লেখিকাগণের প্রতি’ নিবেদন করে বলেÑ “হিন্দুয়ানী বাঙালি না হইয়া দোভাষী অর্থাৎ বাঙ্গালা ভাষার মধ্যে আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষা প্রয়োগ বাঞ্ছনীয়। অ-ইসলামিক শব্দ যেরূপ স্বর্গ, নরক, যুগ, ত্রিভুবন, ঈশ্বর, ভগবান, নিরঞ্জন, বিধাতা ইত্যাদি প্রবন্ধে থাকিলে, সে প্রবন্ধ বাহির হইবে না। লেখকগণের খেয়াল করা দরকার, বোজর্গানে দীনে যখন এদেশে ইসলাম প্রচার করেছিলেন তখন তাঁহারা এদেশের ভাষার মধ্যে ইসলামিক ভাষা প্রবেশ করাইয়া সর্বসাধারণকে ইসলাম শিক্ষা দিয়াছিলেন। ‘রওশন হেদায়েতে’রও প্রধান উদ্দেশ্য ইসলাম শিক্ষা দেওয়া; কাজেই কালামে কুফর প্রকাশ হওয়া উচিত নয়।” অর্থাৎ যারা মনে করে আরবি, ফারসি, উর্দু ছাড়া অন্য ভাষা গ্রহণ করলেই বাংলা ভাষার চরিত্র নষ্ট হয় তারা প্রকারান্তরে বাংলা ভাষার শত্রুই। পৃথিবীতে হাতেগোনা কয়েকটি ভাষা ছাড়া সব ভাষার মধ্যই প্রচুর ঋণ শব্দ আছে। বাংলা ভাষার মধ্যেও প্রচুর ঋণ শব্দ ঢুকে পড়েছে কিংবা বলা যায়Ñ নিজের প্রয়োজনেই বাংলা ভাষা বিদেশি শব্দ ঋণ নিয়েছে। যারা শব্দ বিচার করে ধর্ম বিচার করে, তাদের উদ্দেশ্যে বলতেই হয়Ñ আল্লাহ, খোদা, নামাজ, রোজা, এবাদত, রাসুল, আদমÑ এগুলো আমাদের ভূখ-ের শব্দ নয়। জেনে শুনে কেন আমরা এই শব্দগুলো আত্মীকৃত করবো?
অধ্যাপক যতীন সরকার তার একটি প্রবন্ধে (বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার সম্পর্ক নিয়ে হিন্দু-মুসলমানি কা-) বলেছেনÑ ‘বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা বাংলা না উর্দু?’Ñ এই অদ্ভুত প্রশ্নটি তো উনিশ শতকেই উঠেছিল। সে সময়েই তো নবাব আবদুল লতিফ মুসলমানের মাতৃভাষা যে উর্দু সে বিষয়ে স্থির নিশ্চিত ছিলেন। তবে, নি¤œশ্রেণির যে সব মুসলমান উর্দুকে ঠিক মতো রপ্ত করে উঠতে পারেনি, তাদের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য তিনি ‘মুসলমানি বাংলা’র সুপারিশ করেছিলেন। সেই মুসলমানি বাংলা হবে প্রচলিত বাংলা থেকে আলাদা, সংস্কৃতের বদলে এতে থাকবে সেইসব আরবি-ফারসি শব্দ যেগুলো উর্দু ভাষায় বহু ব্যবহৃত। নবাব আবদুল লতিফরা হয়তো বিশ্বাস করতেন যে এরকম মুসলমানি বাংলার পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ‘আতরাফ’ মুসলমানরা এক সময় উর্দুর মঞ্জিলে পৌঁছে ‘আশরাফ’দের কাতারে শামিল হয়ে যেতে পারবে।”
নবাব আবদুল লতিফগংদের মতো এরকম আরো অসংখ্য ষড়যন্ত্র ও নীলনকশা একদিন বাংলা ভাষাকে ঘিরে ধরে ছিল। দুর্মর বাংলা ভাষা সেসব অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে আজ গৌরবের মর্যাদায় আসীন। এখানে অবশ্য একটি কথা না বললেই নয় যে, বাংলা ভাষাই এশিয়া মহাদেশে প্রথম ভাষা যে ভাষার কবি (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) নোবেল পুরস্কার ঘোষিত হওয়ার মাত্র তেরো বছরের মাথায় এই দুর্লভ পুরস্কারে ভূষিত হন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যে লড়াই শুরু হয়েছিল ও রক্ত ঝরেছিল, ১৯৯৯ সালে তা মর্যাদা পায় ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এর। সারা পৃথিবীর মানুষ আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে জানতে ও বুঝতে শিখছে। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটা খবর। যে ভাষাকে একদিন গলাটিপে হত্যা করার চক্রান্ত হয়েছিল সেই ভাষার সম্মানার্থেই আজ পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। এর চেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার আর কি হতে পারে। তবু দুশ্চিন্তার ব্যাপার হচ্ছে, এখনো বাংলা ভাষা সর্বস্তরে সমানভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া ক্রীতদাসেরা এখনও বাংলার বদলে ইংরেজি আওড়াতে বেশি সম্মানিত বোধ করে। প্রতিক্রিয়াশীল, মৌলবাদীরা এখনও স্বপ্ন দেখে এদেশে আবার ফিরে আসবে আরবি, ফারসি, উর্দু মিশেল খিচুড়ি ভাষা, বাংলা বিদ্বেষী এই কুলাঙ্গারেরা শুধু বাংলা ভাষারই শত্রু নয়, এরা বাংলাদেশেরও শত্রু। এদের যথাযথভাবে প্রতিহত করতে হলে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন করা এখন সময়ের দাবি। যদিও এই দাবি অনেক আগে থেকেই উঠেছে।
বর্তমান সরকার বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ বান্ধব সরকার। বঙ্গবন্ধুর হাতেই নির্মিত হয়েছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উপাখ্যান। বাংলা ভাষার বৈশ্বিক মর্যাদাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার হাতে। যদি আমরা সত্যি সত্যিই বাংলা ভাষাকে দেশের মাটিতে এবং বিদেশিদের কাছে মূল্যবান করে তুলতে চাই, তাহলে এখনই সুযোগ সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন ঘটানোÑ কেননা এমন সুযোগ অতীতে কখনো আসেনি। ভবিষ্যতেও আসবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। বাংলা ভাষা দীর্ঘজীবী হোক, আত্মমর্যাদায় বলিয়ান হোক আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষা।
২৪ ডিসেম্বর, ২০১৬
In 20th-Century the term fascist was first applied to a political movement combining ultra nationalism with hostility both to the left and to established conservatism by Mussolini in 1919. Three years later Mussolini came to power at the head of a coalition backed by conservatism. In 1926 he began to establish a full-scale dictatorship. By this time Fascism was widely admired by a plethora of distinguished political and literary figures outside Italy, not all of them on the right. During the economic, social and political crisis beginning in 1929 Nazism made its break through and came to power in January 1933. While Mussolini set out to create a totalitarian society, Hitler embarked on the creation of a racial Utopia, a dream that entailed the elimination of Jews about six million from Germany and military conquest of Eastern Europe. Meanwhile significant fascist movements emerged in many other European countries and in Brazil. We have witness to how the political class & institution have been misusing nationalism to serve their own vested interest.
Increasingly, the struggle between fascism and its opponents dominated the political landscape. Popular front against fascism won power in France & Spain. Even in countries where there was little indigenous fascism, such as Sweden.
After 1945 fascism legacy continued to structure the political landscape, Political leaders in the Allied countries drew legitimacy from their role in defeating fascism, while governments in Italy & Germany claimed descent from the antifascist resistance. The left accused conservative anti communists of being fascists, while the right equated communism with fascism. Given that fascism has become an all-purpose term of abuse.
Along with Liberalism, Conservatism, Communism, Socialism and Democracy, Fascism is one of the great political ideologies that shaped the 20th century. Why? What made the twentieth century, particularly the fifty years from 1904 until 1953, to bloody? That this era was exceptionally violent may seem Paradoxical. After all, the hundred years after 1900 were a time of unparalleled progress. In real terms, it has been estimated, average per capita global domestic product- an average individual’s income, allowing for fluctuations in the value of money- increased by little more than 50 percent. By the end of the twentieth century, thanks to myriad Technological and Scientific advances improvement in knowledge, human being on average lived longer and better lives than any other time in history. In a substantial proportion of the world, men succeeded in alluding premature death, thanks to improve nutrition and conquest of infections diseases.
In my life time I could not see my grand father & grand mother since I am the youngest in my family though I was born in the mid-20th century. When I was a schoolboy, the history text books offered a variety of explanations of twentieth-century violence. Sometime they related it to economic crisis, as if depression and recessions could explain political conflict. Then there was the theory that the century was all about class conflict- that the Socialist Revolution were one of the main causes of violence. But were not ethnic divisions actually more important than the supposed struggle between proletariat and bourgeoisie? Adolf Hifler ‘Seizure’ of power, which in turn was supposed to explain the Second World War. But I wonder, might not rapid economic growth sometimes have been just as destabilizing as economic crisis?
But were not religious & ethnic divisions actually more important than the supposed struggle between proletariat and bourgeoisie? Another argument was that the problems were the consequences of extreme versions of political ideologies, notably communism & fascism, as well as earlier evil, notably colonialism and imperialism. But what about the role of traditional system like Religions or other apparently non-political ideas and assumptions that nevertheless had violent implications?
In the books, read as a boy, the leading roles were always played by nation states : Britain, Germany, France, Russia, United States and so on. But was it not the case of that some or all these politics were in some measure Multinational rather than National- were, indeed, Empires rather than states?
But ultimately good always triumphed over evil. The two World Wars and the Cold War were thus morality play on a global stage. World Peace Council developed under the leadership of honest & educated people around the globe. But after the collapse by USSR, peace movement almost dies down. But were they? And did the west really win the hundred years war that was the Twentieth Century?
By the middle of the century many organization developed under the leadership of America like NATO, IMF, World Bank, even OIC etc. After the fall of colonies, power game developed and Martial Law dictators take over about 70 countries under the connivance of USA. In the Middle of 20th century the world witness the rise of nationalist politics in the developing world for national liberation and establishment of new states. Nationalism during those years represented the anti-imperial emancipatory role that helped legitimize the struggle of the oppressed peoples.
What will happen in the Twenty-first century? Now America wants to dominate the whole world. They have become the most Imperialist Power. After 9/11 in 2001, Terrorism has developed all over the world. Now the whole Middle Estate is burning, after Afghanistan, Iraq, Libya now Turkey & Syria. Entire Europe is affected by refugees and their economies are already in limbo.
Only the war Industries are thriving. America wants to keep the world in war-war situation to sell their war arsenals. America even using OIC wants to escalate war in Europe & Russia. OIC defecto endorses terrorist action in Ukrainian activists and nationalist as well as the Crimean Tatar radical groups which are carrying out hostility, hatred, starvation & suffering of the Muslim in Crimea. Now all the Muslim Refugees are starving & suffering in Europe. It will affect the European economy. But America is safe due to Atlantic Ocean. Even two world wars did not affect USA.
USA which practices unilateralism as an instrument of its diplomacy. Preserving the moral health of body polity and maintaining the ecological balance are conditions present to survival and growth of this entire earth. If it is not done in time, we will continue to suffer from the consequences of the unresolved dilemmas of the nuclear age. The dilemma of the nuclear age is how to use Nuclear Weapons diplomatically so that they are not used militarily. History will thus be defined as a process of interaction between people & the power structure existing at a given time and in a given country with its culture & civilization specificities. Such an interactions historically evolved in that country. If, as a result of this interaction the overwhelming mass of people finds their passions & values, being neglected, one can confidently predict that a process of alienation would gather momentum & the power structure would collapse. In our twentieth century we have seen the collapse of Empires specially the British Empire. Finally, the utter destruction of the USSR also because it fell victim to the denial of legitimacy to ‘Human Passion’ and ‘Permanent Values’ embedded in like ‘Bread & Liberty’.
Now only future can say, how America behave under Donald Trump, its Imperialist policy & one world theory which they followed in last century, where fascism & terrorism dominate the entire world. Trump may bring Peace or War. Trump is an unpredictable fellow :
The fact remain that ultra-nationalism is intolerant. Intolerance places democracy under siege. A liberal democracy accepts the fact that in a free country one can have different opinion and should have equal rights. This is pluralism and tolerance is its ultimate rationale. Even the preamble of the charter of UN underlines the need to ÒPractices tolerance and lives together in peace with one another as good neighbours.Ó What will be the fate of Mankind in Twenty-first century : will it be Hegemony of Ultra-Nationalism as a New World Order or a Humane World Order, only time can say.
17 December, 2016
এবারের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ৪৫তম বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের এই বিশেষ দিনটিতে ২৬ মার্চ ’৭১-এ সূচিত মহান মুক্তিযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। এক সাগর রক্ত, ৩০ লক্ষ শহিদ আর ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমাদের দামাল মুক্তিযোদ্ধারা মিত্র বাহিনীর সক্রিয় সহযোগিতায় ‘অপরাজেয়’ বিশাল পাক-হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে এ বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল। এই দিনটিতেই ৯৫ হাজার পাক হানাদার বাহিনীর সদস্য তাদের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান জেনারেল নিয়াজির নেতৃত্বে রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যৌথ বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করেছিল। এই রমনা রেসকোর্স ময়দানে, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ কিন্তু বলদর্পী পাক সামরিক শাসকরা বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষাকে পদদলিত করে ২৫ মার্চ গভীর রাতে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণের উপর অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধু চূড়ান্ত ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে ঐ রাতেই, গ্রেফতারের আগে, বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেশবাসীকে যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই বর্বরতার নিন্দা এবং বাংলাদেশের পক্ষে সাহায্য ও সহযোগিতার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন। যে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ অপরাহ্ণে কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, সেই ময়দানেই ক্ষমতাদর্পী ৯৫ হাজার পাক হানাদার বাহিনীকে ১৬ ডিসেম্বর অপরাহ্ণে আত্মসমর্পণ করতে হয়।
২০১৬ সালের বিজয় দিবস বাঙালি জাতির নিকট নতুন পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে হাজির হয়েছে। ২০০৮-এর ২৯শে ডিসেম্বর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর গড়া দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ‘মহাজোট’ ভূমিধ্বস বিজয়ের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। ২০০৯-এর ১৯ নভেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এক সর্বসম্মত রায়ে, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসির চূড়ান্ত রায় দিয়ে, দেশ ও দেশবাসীকে পিতৃহত্যার দায় থেকে মুক্ত করেছেন। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর ৩৫ বছর (মাঝে ৫ বছর আওয়ামী লীগ শাসন ছাড়া) দেশে বঙ্গবন্ধুকেই অপাংক্তেয় করে রাখা হয়েছিল, সেখানে স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবস উদ্যাপন ছিল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এই কালপর্বে যারা ক্ষমতায় ছিলেন তারা আওয়ামী লীগ, প্রতিবেশী মিত্র দেশ ভারতের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে এবং সাম্প্রদায়িকতাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে উস্কিয়ে দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। তারা কথায় কথায় ভারতকে বাংলাদেশের সকল সমস্যার জন্য দায়ী করে জনগণকে বিভ্রান্ত করে তাদের স্বার্থ হাসিল করার প্রয়াস পেয়েছে।
স্বাধীনতাবিরোধীদের কাছে বাংলাদেশের বিজয় দিবসের তাৎপর্য স্বাধীনতার মূল চেতনার পরিপন্থী। কারণ, বিজয় দিবস মানে পাকিস্তানের পরাজয়ের দিবস। পাকিস্তানের পরাজয় বিএনপি-জামায়াত জোট নিজেদের পরাজয় বলেই মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করে ঘাতকরা আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মূলে আঘাত করেছিল। হত্যাকা-ের সুবিধাভোগী জিয়া-এরশাদ ও খালেদা-জামায়াত জোট সরকারগুলি আমাদের পবিত্র সংবিধানকে বিকৃত করে পাকিস্তানি ভাবধারা প্রতিস্থাপন করেছিল। খুনিদের রক্ষায় এ হেন হীন পন্থা নেই যা তারা গ্রহণ করেনি।
জিয়া-এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার জোট সরকারের আমলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালের বন্ধু প্রতিবেশী ভারতকে হেয় করার জন্য ভারতকে ‘নন্দঘোষ’ বানানো হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষ পাকিস্তানের সাথে চলতে স্বস্তিবোধ করে। তাদের শাসনামলে বকলমে পাকিস্তানের কুখ্যাত আই.এস.আই.ই. রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করেছে। ভারতকে অস্থিতিশীল করার জন্য আই.এস.আই-কে বাংলাদেশ ভূখ- ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে। ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফাকে ট্রেনিং, অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য-সহযোগিতা করার অনুমতি দিয়েছে। ভারতের বিরুদ্ধে অকারণে কুৎসা রটনা করে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে। যে ভারত ৯ মাস বাংলাদেশের ১ কোটি শরণার্থীকে খাইয়ে-পরিয়ে অতুলনীয় সহযোগিতা করেছে, লক্ষ লক্ষ মুক্তিবাহিনীর সদস্যকে ট্রেনিং ও অস্ত্র দিয়ে হানাদার পাক বাহিনীর মোকাবেলা করতে সক্ষম করে গড়ে তুলেছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে হাজার হাজার ভারতীয় সেনা বাহিনী সদস্য রক্ত দিয়েছেন, অসংখ্য আহত হয়েছেন। সে কথা আমরা স্মরণ করলেও এদেশীয় পাকিস্তানি দালালরা তা করে না। ভারতীয় সৈন্য ফিরে যাওয়ার সময় আমাদের কি কি নিয়ে গেছে সেগুলি ফলাও করে প্রচার করতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী এ দেশীয় পাকিস্তানি দালালরা কখনও বিবেকের দংশন অনুভব করেনি। তখন ঘটা করে প্রচার করা হয়েছে যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী সেনানিবাসের বাতিগুলি পর্যন্ত নাকি খুলে নিয়ে গিয়েছিল। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তখন ক্ষমতাসীন না হয়ে অন্য কেউ ক্ষমতাসীন থাকলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সাফল্য আসতে কত দিন লাগত তা গবেষণা করে বের করার বিষয় হতে পারতো। প্রসঙ্গত তিব্বতের দালাইলামার পরিণতির বিষয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তুলনীয় হতে পারে। অর্থাৎ যুগ যুগ ধরে দালাইলামা যে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ভোগ করছেন, আমাদেরও তেমন অবস্থা হওয়ার আশঙ্কা ছিল। মহান নেত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন করে, পরাশক্তি আমেরিকা ও চীনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে। ভারতকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিয়োজিত করেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পরিণতি দিতে। সেই নেত্রীকে খাটো করতেও পাকিস্তানি মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিরা পিছ পা হয়নি। এর চেয়ে অকৃতজ্ঞতা আর কি হতে পারে! যে রেসকোর্স ময়দানের মঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন, যে মঞ্চ থেকে ইন্দিরা গান্ধী স্বাধীনতার পর ঢাকা সফরকালে বঙ্গবন্ধুসহ ভাষণ দিয়েছিলেন সেই স্থানটিকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে এবং পাক বাহিনীকে আত্মসমর্পণের গ্ল¬ানি মুক্ত করতে সেই স্থানটিতে নির্মিত ‘ইন্দিরা মঞ্চ’ ভেঙ্গে শিশু পার্ক নির্মাণ করেছিলেন সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া। অন্যদিকে উদার মনোভাব প্রদর্শন করে ভারতের জনগণ কলকাতা শহরে দুইটি সড়কের নামকরণ করেছে শেরে বাংলা ও বঙ্গবন্ধুর নামে। আমরা কিন্তু আজ পর্যন্ত মহাত্মা গান্ধী বা ইন্দিরা গান্ধীর নামে কোনো সড়ক বা স্থাপনার নামকরণ করতে পারিনি।
আমরা এ কথা ভুলে যাই যে, ইতিহাস বদলানো গেলেও ভূগোল বদলানো যায় না। আমরা যদি প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র ভারতকে কারণে-অকারণে শত্রুর পর্যায়ে ঠেলে দেই তাহলে নিজেদের আয়-উন্নতি করার সময় ও সুযোগ কি করে পাবো। ভারত একটি আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। তার অর্থনৈতিক অবস্থান এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম। তার সামরিক শক্তি বিশ্ব সামরিক শক্তির এক উল্লে¬খযোগ্য পর্যায়ে পৌঁছেছে। তার সাথে পাকিস্তানের মতো গায়ে পড়ে বিবাদে লিপ্ত হওয়া কি বাংলাদেশের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ? ভারতের ভূত দেখতে দেখতে পাকিস্তানের আজ কি হাল হয়েছে, সে দিকেও আমাদের খেয়াল রাখা প্রয়োজন। অথচ পঁচাত্তর পরবর্তী প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক ও বেসামরিক সরকারগুলি (১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের সরকার ছাড়া) আমাদের সে পথে চালিত করেছে। পররাষ্ট্রনীতির মূলকথা হচ্ছে ‘দেশের স্বার্থ’ এ কথা মনে রেখে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করলে সকল ঝামেলা থেকে আমরা মুক্ত হতে পারি। কোনো অবস্থাতেই পাকিস্তানের স্বার্থ ও বাংলাদেশের স্বার্থ এক হতে পারে না।
বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শিখা চিরন্তন, পৃথিবীর সর্বোচ্চ গ্লাস টাওয়ার ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ধারণ করে জাদুঘর স্থাপিত হয়েছে। জননেত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট, শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইন্সটিটিউট, বিশেষ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকাজুড়ে সাংস্কৃতিক বলয় গড়ার প্রচেষ্টা চলছে।
বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-ের বিচার সম্পন্ন হয়েছে, মৃত্যুদ-াদেশপ্রাপ্ত খুনিদের বিরুদ্ধে আদালতের দেওয়া রায় কার্যকর হয়েছে। বর্তমানে যুদ্ধাপরাধী রাজাকার, আলবদরদের বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। এখন সুযোগ এসেছে বাংলাদেশের সংবিধানকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে আনার এবং বঙ্গবন্ধুর আমলের পররাষ্ট্র নীতিকে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির আলোকে পুনর্বিন্যাস করার। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ফেব্রুয়ারি (২০১৭) মাসে ভারতে রাষ্ট্রীয় সফর করবেন, এই সুযোগে ভারতের সাথে অমীমাংসিত বিষয়গুলির (বিশেষ করে ভিসা জটিলতা) মীমাংসা এবং ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী ও সহযোগিতার নবযুগের সূচনা হবে। পঁয়তাল্লি¬¬শতম বিজয় দিবসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত জনগণের সামনে যে-সুযোগ সমুপস্থিত তা কাজে লাগিয়ে একাত্তরের চেতনায় জেগে উঠার সময় এসেছে।
১২ ডিসেম্বর, ২০১৬
২৫ নভেম্বর, ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে নব্বই বছর বয়সে বর্ণাঢ্য বিপ্লবী জীবনের ইতি টেনে চিরবিদায় নেন কিউবান বিপ্লবী নেতা ফিদেল আলেজান্দ্রো ক্যাস্ট্রো রুজ। অবশ্য পৃথিবীর মানুষের কাছে তিনি ফিদেল ক্যাস্ট্রো নামেই পরিচিত ছিলেন। এক ভূস্বামী পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি। পিতা ছিলেন আখের খামারী। মা ছিলেন একেবারে আটপৌরে নারী। ভূস্বামী পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি আজীবন লড়াই করেছেন নিরন্ন-নির্যাতিত মানুষের পক্ষে। প্রতিক্রিয়াশীল পরিবেশে বেড়ে উঠেও তিনি হয়েছেন প্রগতিশীল চেতনার মুক্ত মনের মানুষ। সারা জীবন লড়াই জারি রেখেছেন সর্বহারা মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য। কিভাবে এটা সম্ভব হলো? সম্ভব হলো এই কারণে যে, যৌবনেই তিনি দীক্ষা নিয়েছিলেন মার্কসবাদে। মার্কসবাদই তাঁকে নিপীড়িত মানুষের পক্ষে লড়াই করার মানসিকতা তৈরি করে দিয়েছে।
শৈশব থেকেই ফিদেল লক্ষ্য করেছেন সমাজে একদল মানুষ আছে যারা কোনোদিনই মানুষের অধিকার নিয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতে পারে না। এরা কম খায়, জীর্ণ বস্ত্র পরিধান করে, কিন্তু কাজ করে সবার চেয়ে বেশি। এই অল্পে তুষ্ট শ্রমজীবী মানুষগুলো নিজের গায়ে ধূলি লাগিয়ে, কাদা-জলে জীবন কাটিয়ে সমাজের উঁচু তলার মানুষগুলোকে সেবা দিয়ে যায় কিন্তু তাদের ভাগ্যে কখনোই এতটুকু সম্মান বা সমাদর জোটে না। এই ধূলিমলিন মানুষগুলোই সভ্যতার নির্মাতা, এদের বুকে পা ফেলেই আসে নব উত্থান। এই অবহেলিত মানুষগুলোর ভাগ্য পরিবর্তনের উদ্দেশ্যেই বিপ্লবীর খাতায় নাম লেখেন ফিদেল। পরবর্তীতে তিনিই হয়ে ওঠেন অবিনাশী বিপ্লবী বীর।
পঁচাত্তর পরবর্তী কালপর্বে আমি স্বেচ্ছানির্বাসনে কলকাতা চলে যাই। সেসময় আমার হাতে দিল্লীতে একটা অনুবাদ সংকলন আসে যে বইটির নাম ছিল ‘হিস্ট্রি উইল অ্যাবসোলভ মি’। এই বইটির বাংলা নামকরণ করা হয়Ñ ‘ইতিহাস আমার শাপমোচন করবে’। আমার স্পষ্ট মনে আছে ভারতের বেশ কয়েকটি ভাষার সংকলন ছিল বইটিতে।
১৯৫৩ সালে ফিদেল তাঁর গেরিলা বাহিনী নিয়ে মনকাডা আর্মি ক্যাম্পে হামলা চালাতে গিয়ে ধরা পড়ে যান। তখন একনায়ক বাতিস্তা সরকার তাঁর বিচার শুরু করেন। মনকাডা হামলায় অভিযুক্ত হিসেবে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ফিদেল যে জবানবন্দী দিয়েছিলেন সেই জবানবন্দীই ‘হিস্ট্রি উইল অ্যাবসোলভ মি’ নামে খ্যাত। ফিদেল আজ শুধু একজন বিপ্লবী ব্যক্তিত্বই নন, তিনি একটি আদর্শিক ইতিহাস ও কিংবদন্তি নায়ক। তাঁকে জানতে বা বুঝতে হলে আমাদের একটু অতীতে ফিরে যাওয়া দরকার। দরকার ইতিহাস ও মার্কসবাদকে বিশ্লেষণ করা। আমি সেই জায়গায় দাঁড়িয়েই দুই-একটি কথা লেখার চেষ্টা করব।
১৮৪৮ সালে যখন কাল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলের মতো দুই স্বাপ্নিক যুবক ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ প্রণয়ন করেন তখনকার বিশ্ব পরিস্থিতি আর এখনকার বিশ্ব পরিস্থিতি এক নয়। মার্কসও জানতেন পৃথিবী পরিবর্তিনশীল। তাই তিনি নিজেই বলেছিলেন- ÔMarxism is not a dogma, its a creative science.Õ কিন্তু তথাকথিত কমিউনিস্টরা এ কথা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না। তারা গায়ের জোরেই যেন সব কিছু বদলে ফেলতে চায়। কিন্তু গায়ের জোরে আর যা কিছুই হোক বিপ্লব হয় না। আর হলেও সেই বিপ্লব স্থায়ী হয় না। ফিদেল মাত্র ৩৩ বছর বয়সে বিপ্লবের মাধ্যমে স্বৈরশাসক বাতিস্তাকে পরাজিত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন। ৫০ বছরের অধিককাল তিনি ক্ষমতায় টিকে ছিলেন। ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথ আর থাইল্যান্ডের রাজার পর তিনিই বিশ্বের তৃতীয় রাষ্ট্রনায়ক, যিনি দীর্ঘকাল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। ক্ষমতায় থাকাকালীন ফিদেল সুনাম-দুর্নাম দুটোই কুড়িয়েছেন। পৃথিবীতে যে সকল দেশে বিপ্লবীরা বিপ্লব করে ক্ষমতায় গিয়েছেন সে সকল দেশেই বিপ্লবীরা কিছু দুর্নামের ভাগি হয়েছেন। এর পেছনে সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির আঙুলি ইশারা তো থাকেই, ব্যক্তিগত লোভ-লালসাও পরবর্তীকালে বিপ্লবীকে পথ ভ্রষ্ট করে ফেলে। এক সময় কমিউনিস্টরা পৃথিবীর মানুষকে নতুন সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ত্যাগী ও আদর্শবান প্রচুর নেতা ছিলেন। এসব নেতাদের অনেকেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বিপ্লবের মাধ্যমে দখল করেছিলেন। তাদের বিরুদ্ধবাদীদের হয় গুলি করে হত্যা করেছেন, নয়তো কারাগারে নিক্ষেপ করেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে শুরু করে চীন, কিউবা, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়াসহÑ সবখানেই দেখা গেছে একই ঘটনা।
এক সময় পৃথিবীতে দাসপ্রথা ছিল। দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলে সামন্ততন্ত্র এসে সেই জায়গা দখল করে নেয়। সামন্ততন্ত্রও একদিন পরাজিত হয় পুঁজিবাদের অভিনব কৌশলের কাছে। পুঁজিবাদ পুঁজির বিকাশের জন্য বাজার খুঁজতে থাকে। শুরু হয় একের পর এক দেশ দখল। ব্রিটিশ আমলে দেখা গেছেÑ ব্রিটিশ সূর্য অস্ত যায়নি। কেন যায়নি? যায়নি এই কারণে যে সারা পৃথিবীব্যাপীই ব্রিটিশের উপনিবেশ ছিল, এমনকি আমেরিকাও। ব্রিটিশের উপনিবেশ থেকে একেকটি দেশ যখন স্বাধীন হতে শুরু করে তখন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে সা¤্রাজ্যবাদী আমেরিকা। আমেরিকা সরাসরি দেশ দখল না করে তারা দেশে দেশে তাদের অনুগত দালালগোষ্ঠী তৈরি করতে শুরু করে। এই দালালগোষ্ঠী দিয়ে তারা স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোতে বশংবদ সামরিক সরকারকে ক্ষমতায় বসায় নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য। বিংশ শতাব্দীতে আমেরিকার ইন্ধনে সারা পৃথিবীতে প্রায় সত্তরটির মতো রাষ্ট্রে সামরিক শাসন ছিল। সেই সংখ্যা কমতে কমতে এখন অঙ্গুলিমেয় হয়ে পড়েছে। এখন তারা নিয়েছেন আরো ঘৃণ্য পথ। এই ঘৃণ্য পথে তারা তৈরি করছে বিপথগামী, ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি। তালেবান, আল কায়দা, বোকোহারাম, আইএসের মতো সাম্প্রদায়িক জঙ্গিগোষ্ঠী তৈরি করে এখন তারা দেশে দেশে সৃষ্টি করেছে ভীতিকর পরিস্থিতি। দেশে দেশে অনাসৃষ্টি করে তারা অস্ত্রের রমরমা ব্যবসা করতে চায়। অস্ত্র ব্যবসা আমেরিকার সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। এই অস্ত্র ব্যবসা বন্ধ হলে আমেরিকারও বারোটা বাজবে। তাই অস্ত্র ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হলে দেশে দেশে যুদ্ধ লাগিয়ে রাখা ছাড়া আজ আর কোনো গতি নেই।
আমেরিকা তেল সম্পদের জন্য সাদ্দাম ও গাদ্দাফিকে হত্যা করেছে। তথাকথিত আরব বসন্তের নামে সিরিয়ায়ও চলছে আক্রমণ। মার্কিন ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদ। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা যে আগুন লাগিয়েছে সে আগুনের উত্তাপ এখন ইউরোপের গায়েও লেগেছে। আমেরিকার কোনো আদর্শিক চরিত্র নেই, তার চরিত্র হচ্ছে টাকা, টাকা…। আমেরিকা অনেক কিছু করতে পারে কিন্তু সবকিছু করতে পারে না। তারা হয়তো মনে করে পৃথিবীর সবদেশ তাদের কথায় উঠবে-বসবে, কিন্তু বাস্তবতা মোটেই সে রকম নয়, বরং ইহিাসে তার উল্টোটাই দেখি। আমেরিকার সাথে যারা হাত মিলিয়েছিল তারা বেশিরভাগই আজ শেষ হয়ে গেছে বা শত্রু রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। যেমন ইরান ও পাকিস্তান তারা সেল্টো সিয়েটোতে যুক্ত ছিল। আর যারা বুক ফুলিয়ে আমেরিকাকে রুখে দাঁড়িয়েছে তারাই বিজয়ী হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হো চে মিনের ভিয়েতনাম, ফিদেল ক্যাস্ট্রোর কিউবা, হুগো শ্যাভেজের ভেনিজুয়েলা ও ইভো মোরালেসের বলিভিয়ার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। আমেরিকার নানামুখী ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে এই সব বিপ্লবী নেতারা যেভাবে আমেরিকাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছে তা এক নতুন ইতিহাসই বটে।
আমেরিকা, ও.আই.সি, জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে যুদ্ধ পরিস্থিতি বজায় রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। তাই আমেরিকা আজ যুদ্ধের নতুন ফ্রন্ট খোলার চেষ্টা করছে। ইউক্রেন, ক্রিমিয়াতে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করেছে। সে সব দেশের ষড়যন্ত্রকারীদের মদদ দিচ্ছে। আমেরিকার আচার-আচরণ থেকে মনে হয়, ন্যাটোর মাধ্যমে শীতল যুদ্ধ বা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধানোর পাঁয়তারা করছে।
পৃথিবী এখন আর এক নায়কের শাসন চায় না, চায় না এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থাও। যে নামেই হোক না কেন একনায়ক অবশ্যই ভয়ঙ্কর। এক সময় সেও ক্ষমতার মোহে যা ইচ্ছে তাই করে বসেÑ যেমন করে এক কেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা। পৃথিবীর সব মানুষই আজ ক্ষমতার ভারসাম্য দেখতে চায়। আমেরিকার অপ্রতিরোধ্য গতি কিছুটা হলেও এ মুহূর্তে মন্থর মনে হচ্ছে। নবনির্বাচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি উল্টা-পাল্টা কিছু করেই বসে, তাহলে ভাবতেই হবে আমেরিকার রক্ত দিয়ে হোলি খেলার যুগ শেষ হতে চলেছে বা পুনরায় শুরু করবে।
এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, বর্তমান বিশ্ব একটা নতুন আর্থ সামাজিক ব্যবস্থার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। কেন বিশ্ববাস্তবতা নতুন আর্থ সামাজিক ব্যবস্থা চায় তারও একটা যৌক্তিক কারণ আছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে মানুষের লোভ আর স্বার্থপরতা। সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য ব্যক্তিমানুষকে যে পরিমাণ নির্লোভ আর পরার্থপর হওয়া দরকার তা কি একবিংশ শতাব্দীর অতৃপ্ত, লোভী মানুষের পক্ষে আদৌ সম্ভব? ইতিহাস স্বাক্ষী দেয়Ñ যা হয়েছে সমাজ প্রগতির ধারাতেই হয়েছে, যা হবে তাও সমাজ প্রগতির স্বাভাবিক ধারাতেই হবে। সমাজ প্রগতির ধারার বিরুদ্ধে দাঁড়ালে মানুষ শুধু নির্বুদ্ধিতারই পরিচয় দেবে না। সঙ্গে সঙ্গে মানব সভ্যতার পতনও ডেকে আনবে। প্রকৃতি ও ইতিহাস তার অমোঘ নিয়মে চলে। বর্তমানে সা¤্রাজ্যবাদী দেশগুলির এই সত্য কথাটা উপলব্ধি করা একান্ত জরুরি। সারা বিশ্বের মানুষ আজ মানবিক বিশ্বব্যবস্থা (Humane world order) কামনা করছে। মানুষকে তার কাক্সিক্ষত সমাজ ব্যবস্থা অবশ্যই দিতে হবে।
ইউরোপের দেশগুলোকে আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্র বলা হয়। এসব দেশে নাগরিক অধিকার অনেকাংশেই সুরক্ষিত। কল্যাণ রাষ্ট্রের উদ্ভব সমাজতন্ত্রকে সামাল দিয়ে সমাজ বির্বতনের সঙ্গে তাল মিলানোর চেষ্টা। তাই যদি হয়, তাহলে বলবো, এটাও একটি বড় মাপের ঐতিহাসিক পরিবর্তন। এমন পজেটিভ পরিবর্তন দেখে কার্ল মার্ক্স কী বলতেন জানি না, কিন্তু এই পরিবর্তনের জন্য অবশ্যই লেলিন, মাও, ফিদেল ক্যাস্ত্রোর মতো লড়াকু মানুষের প্রয়োজন ছিল।
ফিদেল ক্যাস্ত্রের জীবনীকার গেওর্গি এন গোয়ার ফিদেলকে বলেছিলেন, ‘সত্যিকার অর্থে শেষ কমিউনিস্ট।’ ফিদেল শেষ কমিউনিস্ট কিনা জানি নাÑ তবে আধুনিক কিউবা তার কাছে অনেক কারণেই ঋণী। দীর্ঘজীবী এই প্রয়াত চিরবিপ্লবীর প্রতি রইল আমাদের বিন¤্র শ্রদ্ধা।
৫ ডিসেম্বর, ২০১৬