১১ নভেম্বর, ২০১৬ তারিখে ‘দৈনিক আমাদের সময়’-এ কবি ও সম্পাদক অমিত গোস্বামী ‘ভারতীয় ভিসা প্রাপ্তি নিয়ে টালবাহানা’ শিরোনামে একটি কলাম লেখেন। তার লেখা পড়ে এবং বাংলাদেশের মানুষের ভোগান্তির কথা স্মরণ করে আজকের এই লেখা লিখতে চাই। যারা ভারতের ভিসা পাওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ করেছেন বা আগামীতে দৌড়ঝাঁপ করবেন বলে মনে করেছেন এই লেখা তাদের জন্য একটু হলেও সাবধান হতে সাহায্য করবে। কয়েক মাস পূর্বে ‘ভারতীয় ভিসা সোনার হরিণ’ শিরোনামে আমি একটা কলাম লিখেছিলাম। এখন কতটা সহজ হয়েছে জানি না! তবে বিভিন্ন জায়গায় ভিসা সেন্টার খোলা হয়েছে।
ভারত বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ। বাংলাদেশ ভারতের কাছে জন্মসূত্রে ঋণী। বাংলাদেশের মাটিতে বাঙালির রক্ত আর ভারতবাসীর রক্ত মিশে একাকার হয়ে গেছে। দুটি দেশ মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে যেভাবে এক সাথে কাজ করেছে এবং এখনো ভারত যেভাবে বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বপূর্ণ মানসিকতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তা ভাবতে গেলে বিস্মিত হতে হয়। আমরা বাংলাদেশের পক্ষে থেকে চাই আমাদের এই দুই দেশের বন্ধন অটুট থাকুক।
২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মান্যবর নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে এসে বলেছিলেন, ‘জল, বায়ু ও পাখির কোনো ভিসা লাগে না।’ তাহলে মানুষের ভিসা লাগবে কেন? মোদি মহোদয়ের কথার সঙ্গে আমিও সম্পূর্ণ একমত। বর্তমানে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য ভারতের ভিসা পাওয়া ভোগান্তির চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক ভারতে যায়। এদের বেশির ভাগই যায় চিকিৎসা, তীর্থস্থান দর্শন, পড়াশুনা, কেনা-কাটা, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মিলিত হতে ও সভা-সেমিনারে যোগদান করতে। এ ছাড়া ভারত ভ্রমণ ও ব্যবসার উদ্দেশ্যেও অনেকে ভারত গমন করেন। যারা ভিসা নিয়ে ভারত যান তাদের প্রথমেই ই-টোকেন সংগ্রহ করতে হয়। এই কাজটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভিসা প্রার্থী নিজে নিজে করতে পারেন না। তাকে অবশ্যই দালাল বা অন্যকোনো মাধ্যমের সাহায্য নিতে হয়। ই-টোকেন সংগ্রহ করতে একজন ভিসাপ্রার্থীকে আড়াই থেকে পাঁচ হাজার টাকা গুণতে হয়।
ই-টোকেন পাওয়ার পর ভারতীয় ভিসা সেন্টারে গিয়ে লাইন ধরে একদিন পাসপোর্ট জমা দিতে হয়। জমাকৃত পাসপোর্ট আরেক দিন গিয়ে ফেরত আনতে হয়। যারা ভিসার জন্য পাসপোর্ট জমা দেয় তাদের সবার ভাগ্যেই ভিসা মেলে না। ভিসা পাওয়ার সকল শর্ত পূরণ করার পরেও ভিসা পায় না বেশিরভাগ মানুষ। নামের বানান ভুল, ঠিকানায় দাড়ি-কমার ভুল, ইত্যাকার টুকিটাকি ভুলের কারণে বেশিরভাগ ভিসা প্রত্যাশীকেই ভিসা দেওয়া হয় না। যা খুবই দুঃখজনক এবং ভোগান্তির বিষয়। একটি বিষয় লক্ষণীয় বাংলাদেশ থেকে যারা ভারতে যায়, তারা কেউই খালি হাতে যায় না। একেক জন বাংলাদেশি নাগরিক কমপক্ষে দুই হাজার ডলার নিতে পারে, এক থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা নিয়ে ভারতে যায় তাদের প্রয়োজনীয় কাজে। এই টাকাটা পুরোটাই ভারতে খরচ করে, অথচ ভিসা পাওয়ার বিষয়টি যদি আরো একটু সহজ হতো তাহলে ভারত আরো বেশি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতো, বাংলাদেশের মানুষও উপকৃত হতো।
বাংলাদেশ জনসংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র। ধর্মীয় কারণে কোরবানিসহ মুসলমানদের খাদ্য তালিকায় গরুর মাংস অগ্রগণ্য। শুধু খাদ্য হিসেবেই নয়Ñ কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে কৃষিতেও গরুর চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। ভারত ও নেপাল থেকে গরু আসে বলেই বাংলাদেশে গরুর চাহিদায় ভারসাম্য বজায় থাকে। কিন্তু ইদানীং উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। ভারত ও নেপাল থেকে পর্যাপ্ত গরু না পাওয়ায় বাংলাদেশ গো-সংকটে পড়েছে। ভারত যদি গরুর চোরাচালান বন্ধ করতে চায়, সেটাকে আমরা অবশ্যই সাধুবাদ জানাবো। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো যখন ভারত থেকে ফেনসিডিলের চোরাচালান ঢোকে, ইয়াবা-কোকেনের মতো ভয়ংকর মাদকের চোরাচালান ঢোকে তখন ভারত তা থামাতে পারে না। তাহলে গরুর বেলায় এত আপত্তি কেন? বছরের প্রায় প্রতিদিনই দেখা যায়, বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি গরু ব্যবসায়ী নিহত হচ্ছে কিন্তু কোনোদিন কোনো ফেনসিডিল ব্যবসায়ী বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছে এমন খবর শোনা যায়নি। বাংলাদেশের জঙ্গিরা যে সকল অস্ত্র ব্যবহার করে তাও ভারত থেকেই আসে। কই কোনোদিন তো বিএসএফের গুলিতে কোনো অস্ত্রব্যবসায়ী মারা গেল না। গরিব গরু ব্যবসায়ী গুলিতে প্রাণ হারাবে আর মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের টিকিটিও কেউ ধরতে পারবে না এটা কোনো ভালো কথা নয়। অবশ্যই এই বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জোরালো ভূমিকা পালন করা দরকার।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস আমি ভারতে ছিলাম। ’৭৫-পরবর্তী সময়ে আরো সাড়ে তিন বছর ভারতে স্বেচ্ছায় নির্বাসনে ছিলাম, ভারতের অনেক কিছুই আমি জানি। ভারতের অনেক কবি-সাহিত্যিক-রাজনীতিকের সঙ্গেই আমার সখ্য আছে। মাঝে মাঝে বিভিন্ন প্রয়োজনে আগে ভারতে যেতাম। এখন যাই কালেভদ্রে। সম্প্রতি ভারতের ভিসা নিতে গিয়ে আমার যে অভিজ্ঞতা হলো তা অত্যন্ত তিক্ত ও বিরক্তিকর। ভিসা নিতে গিয়ে এত ঝামেলা পোহাতে হলো যা অকল্পনীয়। ভারত কি ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে শত্রু-রাষ্ট্রে পরিণত করছে?
মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার বিমান বন্দরে অন অ্যারাইভাল ভিসা পাওয়া যায়। আমি মনে করি ভারতসহ সার্কভুক্ত সকল দেশে রেল, নৌ, সড়ক ও আকাশ পথে অন অ্যারাইভাল ভিসা (on arrival visa) চালু হওয়া উচিত। বাংলাদেশ ও ভারতের খুনি, সন্ত্রাসী, দুর্বৃত্তরা যদি ভিসা ছাড়াই একদেশ থেকে আরেক দেশে যেতে পারে, তাহলে সাধারণ নিরীহ মানুষগুলো কেন এত ঝামেলা পোহাবে? আজ দুই দেশের মাঝে যে কাঁটাতারের বেড়া তা যেন শুধু বেড়া-ই নয়Ñ রূপ নিয়েছে দুর্ভেদ্য বার্লিন ওয়ালে। কিন্তু আমরা এটাও তো জানি, আজ আর বার্লিন ওয়াল নেই। তাহলে আমরা কেন আটকে আছি কাঁটাতারের বেড়ায়? এই কাঁটাতারের বেড়া ডিঙাতে ভিসা জটিলতা দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিরসন করা দরকার। তা নাহলে বাংলাদেশের মানুষ খুব শিগগিরই ভারত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে।
ভারত আমাদের যে উপকার করেছে তার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। আবার ভারত আমাদের যে ক্ষতি করেছে তারও কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল মার্কিন গোষ্ঠীর মদদেই জাসদ সৃষ্টি হয়েছিল। এই জাসদ আওয়ামী লীগের একটি বিশাল মিলিট্যান্ট অংশকে বিভ্রান্ত করে তথাকথিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে বঙ্গবন্ধুকে পলিটিক্যালি হত্যা করেছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের অনেক আগেই। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শারীরিকভাবে শহিদ হয়েছেন মাত্র। শুধু তাই নয় বঙ্গবন্ধুর খুনি রিসালদার মুসলেহ উদ্দীনও বহুদিন ভারতে বহাল তবিয়তে পলাতক ছিল। ভারত যদি আজ নিজেকে ‘বিগ ব্রাদার’ মনে করে তাহলে ভারত মস্ত বড় ভুল করবে। কেননা বাংলাদেশ আজ আর আগের জায়গায় নেই। বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। ভারতের সাহায্য আমাদের প্রয়োজন আছে বটে, তবে বাংলাদেশের সহযোগিতাও ভারতের আজ অনেক বেশি দরকার। বিশেষ করে ভারতের পূর্বাঞ্চলের প্রদেশগুলোকে দিল্লির সঙ্গে যুক্ত করার জন্য ট্রানজিটের কথা ভুলে যাওয়া মোটেই উচিত হবে না।
কবি বলেছেন, ‘সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি।’ এ কথা আজ বাংলাদেশের মানুষকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করা দরকার। আমাদের মাঝে দেশপ্রেম জাগত করা দরকার। বিদেশী মোহ আমাদের মাঝে ব্যাধির রূপ নিয়েছে। এই মোহ থেকে আমাদের মুক্ত হওয়া প্রয়োজন। অকারণে ভারত ভ্রমণ বাদ দিন। লেখাপড়া, চিকিৎসা কিংবা ঘোরাঘুরিরর জন্য বিনা কারণে ভারত যাওয়ার প্রবণতা পরিহার করুন। আমাদের এখন উচিত হবে নিজের দেশে চিকিৎসা নেওয়া। নিজের দেশে শিক্ষা নিন এবং নিজের দেশেই শিক্ষা দিন। বাংলাদেশের সুন্দর নিসর্গ না দেখে ভারতের প্রকৃতি দেখার কোনো মানে নেই। ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশি হাই কমিশনে ভারতীয়দের ভিসা পেতে কোনো ভিসা ফি লাগে নাÑ যদিও এ ব্যাপারে আমাদের ৬০০ টাকা সার্ভিস চার্জ দিতে হয়। আমি মনে করি, বাংলাদেশি হাইকমিশনেও সার্ভিস চার্জ নির্ধারণ করা উচিত, তারা যদি আমাদের কোনো ছাড় না দেয়, তাহলে তাদেরকেও ছাড় দেওয়া আমাদের ঠিক হবে না। যারা একাধিকবার এমনকি ৫০-৬০ বার ভারতে গিয়েছেন তাদের on arrival visa দিতে বাঁধা কোথায়?
আসুন দুই দেশের ভিসা সংক্রান্ত একটি পরিসংখ্যান দেখিÑ প্রতিদিন ভারতীয় হাইকমিশন (ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন, রাজশাহীর সহকারী হাইকমিশন এবং চট্টগ্রামের সহকারী হাইকমিশন) অফিস হতে প্রায় তিন হাজার ভিসা প্রদান করা হয়। এই হিসেবে বছরে সাত লক্ষ আশি হাজার ভিসা প্রদান করা হয়। ভিসার আবেদন অনলাইনে পূরণের ক্ষেত্রে প্রায়ই সার্ভার ডাউন পাওয়া যায়। অনলাইনে আবেদন পূরণ করা গেলেও তা সাবমিট করা যায় না। শুধুমাত্র কতিপয় দালালের মাধ্যমে অনলাইন আবেদন সাবমিট করা যায় এবং সাক্ষাৎকারের তারিখও পাওয়া যায়। যে সকল দালালের মাধ্যমে ভিসা আবেদন অনলাইনে সাবমিট করা যায়, তাদের ভিসার প্রকারভেদে তিন হাজার টাকা থেকে দশ হাজার, পনেরো হাজার টাকার লেনদেন হয়। যদিও ভারতীয় ভিসার জন্য কোনো ধরনের ভিসা ফি প্রদান করতে হয় না। ভারতীয় ভিসার জন্য প্রতি আবেদনকারীকে ছয়শত টাকা সার্ভিস চার্জ জমা দিতে হয়। সেই হিসেবে এক বছরে ভারতীয় ভিসা প্রার্থীকে কমপক্ষে ছিয়াশি কোটি আশি লক্ষ টাকা ভারতীয় ভিসার সার্ভিস চার্জ প্রদান করা হয়।
পক্ষান্তরে ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন (দিল্লীর বাংলাদেশ হাইকমিশন, কলকাতা ও মুম্বাই উপ-হাইকমিশন এবং আগরতলা সহকারী হাইকমিশন) অফিসসমূহ হতে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার ভিসা প্রদান করা হয়। এই হিসাবে বছরে দুই লক্ষ ষাট হাজার ভিসা প্রদান করা হয়। ভিসা প্রার্থীরা নিজেরা বা তাদের যথোপযুক্ত প্রতিনিধির মাধ্যমে Over the counter ভিসার আবেদনপত্র জমা দিতে পারেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জমা দেওয়ার পরদিন ভিসা প্রদান করা হয়। বাংলাদেশি ভিসার জন্য কোন ধরনের সার্ভিস চার্জ জমা দিতে হয় না।
এই লেখাটা শুরু করেছিলাম অমিত গোস্বামীর কথার সূত্র ধরে। তিনি বলেছেন, ‘মাত্র ১৫ বছর আগেও ভারতীয় ভিসা পাওয়া যেত কোনোরকম ভোগান্তি ছাড়াই। অতীতে দিনে দিনে ভিসা হয়ে যেত, এখন প্রায় সাত থেকে পনেরো দিন সময় লাগে। এমতাবস্থায় ভারতীয় দূতাবাস অবিলম্বে যদি কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ না করে কিছুদিনের মধ্যেই এটা উচ্চ পর্যায়ের আন্তর্জাতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে এবং ভারতের ভাবমূর্তির পক্ষে চূড়ান্ত কলঙ্কজনক হবে সেটা তাদের বোঝার সময় এসেছে।’ সদিচ্ছা থাকলে কোনো সমস্যাই সমাধানের ঊর্ধ্বে নয়। এখন ভারত ভিসা জটিলতার সহজ সমাধান খুঁজবে নাকি এভাবেই বাংলাদেশি নাগরিকদের ভোগাবেÑ এটাই দেখার বিষয়। আগামী ডিসেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সম্ভাবনা রয়েছে। ওই সফরে দুই দেশের নিরাপত্তা-সহযোগিতা বিষয়ক রূপরেখা প্রাধান্য পেলেও বাংলাদেশের অনেক সমস্যার কথা ভারতের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করার কথা রয়েছে। সেই সফরে ভিসা ব্যবস্থা সহজীকরণ নিয়েও আলোচনা করা হবে বলে জানা যাচ্ছে। বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করব অবশ্যই আপনি এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উত্থাপন করবেন এবং ভারতীয় ভিসা জটিলতা থেকে আমাদের মুক্ত করবেন। আপনার দৃঢ় পদক্ষেপে ভারতীয় ভিসা ব্যবস্থা সহজ হবে এমনটিই আশা করে বাংলাদেশের অসহায় মানুষ।
২৪ নভেম্বর, ২০১৬
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের দুই বছর পরেই ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে এক ঝাঁক লড়াকু নেতার অংশগ্রহণে এই দলটির জন্ম হয়। দেখতে দেখতে বৃহৎ এই রাজনৈতিক দল ৬৭ বছর অতিক্রম করল। এই ৬৭ বছরে দলটির নেতৃত্ব দিয়েছেনÑ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো অনন্য নেতৃবৃন্দ। এখন এই দলের হাল ধরে আছেন মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা। গত ২২-২৩ অক্টোবরে দলটির ২০তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনকে ঘিরে বাংলাদেশের মানুষ নানারকম স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। অবশ্য গণমানুষের এই স্বপ্ন দেখা অযৌক্তিক কিছু নয়। যারা বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস করে তাদের একমাত্র ভরসা তো আওয়ামী লীগই। বাংলাদেশের ইতিহাস মানে আওয়ামী লীগেরই ইতিহাস। আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা শুধু অকল্পনীয় বিষয়ই নয়, অযৌক্তিকও। আওয়ামী লীগের এবারের সম্মেলনের স্লোগান ছিলÑ ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে চলছে দুর্বার। এখন সময় বাংলাদেশের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার।’ এই স্লোগানের প্রতিটি শব্দই আজ বাংলাদেশের জন্য সত্য ও বাস্তব। দারুণ এক ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশের হাল ধরেছিলেন শেখ হাসিনা। সেই ভগ্নদশা থেকে দল ও দেশকে টেনে তুলেছেন তিনি। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে মডেল। বিগত সাড়ে সাত বছরে বাংলাদেশে যে অসম্ভব উন্নয়ন হয়েছে আগামী দিনের ইতিহাসে তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে থাকবে।
সাম্প্রতিক জাতীয় সম্মেলন নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। যারা আওয়ামীপন্থী তাদের কাছে এবারের সম্মেলন ছিল স্মরণকালের সেরা সম্মেলন। যারা আওয়ামী লীগ বিদ্বেষী তাদের কাছে এই সম্মেলন তেমন সার্থক নয় বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। বিএনপি এই সম্মেলনের কোনো ইতিবাচক দিকই খুঁজে পায়নি। এটা অবশ্য না পাওয়ারই কথা। বিএনপির নেতা-নেত্রীরা কখনোই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে না। তাদের আগ্রহ ষড়যন্ত্র আর মৌলবাদ বিস্তারের দিকে। সুতরাং আওয়ামী লীগ যেহেতু এবারের সম্মেলনে তাদের গঠনতন্ত্রে মৌলবাদ তথা জঙ্গিবাদ সম্পর্কে প্রস্তাব পেশ করেছে এবং রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের দলীয় বৃত্তের বাইরে রাখতে সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তাই বিএনপির মতো ডানপন্থী দলের চোখে এসব ভালো না লাগারই কথা। ২০তম জাতীয় সম্মেলনে সম্মেলনস্থলসহ পুরো ঢাকা শহর নতুন সাজে সেজে ছিল। মধ্যরাতেও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নেমেছিল মানুষের ঢল। দিকে দিকে নেতাকর্মীদের মিছিল সাধারণ মানুষের কৌতূহল এবং বিদেশি বন্ধুদের আগমনে এই সম্মেলন পেয়েছিল নতুন মাত্রা। প্রায় পৌনে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সম্পন্ন হওয়া এই সম্মেলনে উৎসব উদ্যাপন নয় বরং দলের আত্মসমালোচনাই ছিল মুখ্য বিষয়।
শুরুর দিকে আওয়ামী লীগ ছিল একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম। এই রাজনৈতিক প্লাটফর্ম পরে রূপ নেয় সাহসী রাজনৈতিক পার্টিতে। সূচনালগ্নে নেতা ও নীতিই ছিল এই দলের অমূল্য সম্পদ। এখন নেতা আছেন কিন্তু নীতির প্রশ্নে নানারকম কথা শোনা যাচ্ছে। নীতির প্রশ্নে দলটি যদি অনড় ও অবিচল না থাকে তাহলে এই পার্টি জনগণের কাছ থেকে শ্রদ্ধা ও সমর্থন পেতে ব্যর্থতার পরিচয় দিবে।
এবারের সম্মেলন এমন একটি মুহূর্তে সম্পন্ন হলো যেই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বর্ণযুগ পার করছে। এই যুগকে আরো দীর্ঘ করতে হলে তাকে আগামী নির্বাচনে কৌশলগত অনেক পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। সম্মেলন থেকে সেই বার্তাও পেয়েছে দলীয় নেতা-কর্মীবৃন্দ ও দেশের সাধারণ মানুষ। যারা দুর্নীতিবাজ, লোভী, সুযোগ সন্ধানী (হাইব্রিড) ও চিহ্নিত সন্ত্রাসী এই সম্মেলনে তারা ঝরে পড়েছে। অপরদিকে যারা বিনয়ী, ভদ্র, পরিশ্রমী তরুণ ও প্রগতিশীল তাদেরকে বেশি বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা পর্যালোচনা এবং দলটিকে জঞ্জালমুক্ত করে একটি গণতান্ত্রিক বাতাবরণ তৈরি করাও এই সম্মেলনের অন্যতম সাফল্য বলেই আমি মনে করি। আওয়ামী লীগে বিশুদ্ধ গণতন্ত্রের চর্চা আগেও ছিল এখনও আছে। তবে মাঝে মাঝে সুস্থ দেহেও ক্যান্সারের জীবাণু বাসা বাঁধেÑ তদ্রƒপ আওয়ামী লীগের বিশাল বৃক্ষেও কখনো কখনো নীড় খুঁজেছে দলছুট, দুর্নীতিবাজ-নীতিভ্রষ্ট সুবিধাবাদীরা। আবার তারা যাযাবর পাখির মতো চলেও গেছে আওয়ামী লীগ ছেড়ে। এ রকম যাওয়া-আসা দলের ভেতরে থাকেই। তবে দলের নীতি-নির্ধারক মহল যদি বিচক্ষণ হয়, তাহলে এতে দলের কোনো ক্ষতি হয় না। আওয়ামী লীগ থেকে এবার যারা পদ হারালো এটা তাদের কর্ম ফলের কারণে হয়েছে। এমন কি যারা নতুন করে পদ-পদবি পেয়েছে, তারা তা কর্মফলের কারণেই পেয়েছে। আওয়ামী লীগ বুঝেছে দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো। দুষ্টু গরুর উপদ্রব থেকে পুরো গোয়াল মুক্ত রাখতে যা করণীয় তা-ই আওয়ামী লীগ করছে। এটা করতেই হবে। কেননা অতীত ইতিহাস বলছে, যারা আওয়ামী লীগ থেকে দলছুট হয় তারা ধ্বংস হয়ে যায়, যারা আওয়ামী লীগে এসে যোগ দেয়, তাদের ভাগ্য খুলে যায়। আওয়ামী লীগ পরশপাথরতুল্য রাজনৈতিক সংগঠন। দিনে দিনে এর উত্থান আরো ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে।
২.
বর্তমান বাংলাদেশকে শেখ হাসিনা তার দূরদর্শী নেতৃত্বের মাধ্যমে যেই জায়গায় নিয়ে গেছেন তা কল্পনারও বাইরে। এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কোনো রাজনৈতিক শক্তি দেশে নেই। তাছাড়া দলটি গত আট বছরে বেশ কিছু দৃশ্যমান উন্নয়ন কর্মকা- করেছে। দারিদ্র্য বিমোচনের আপেক্ষিক হার হ্রাস, আট বছর ধরে অব্যাহতভাবে ছয় ভাগের বেশি প্রবৃদ্ধির হার ধরে রাখা (বর্তমানে যা ৭.১১ শতাংশ), বিশ্ব ব্যাংকের বিরোধিতার মুখেও নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জন, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি প্রতিপালন তথা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যকর প্রভৃতি সাফল্য আওয়ামী লীগকে দিয়েছে ব্যাপক গণভিত্তি। এর পাশাপাশি কূটনৈতিকভাবেও বর্তমান সরকারের সাফল্য শুধু বাংলাদেশের মানুষের নয়, বিশ্ববাসীরও দৃষ্টি কেড়েছে। ভারত-চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র হলেও এই চারটি শক্তিধর রাষ্ট্রের সঙ্গেই আওয়ামী লীগ সরকারের সুসম্পর্ক রয়েছে। সম্প্রতি চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরকালে দুই দেশের মধ্যে প্রায় ৩৮ বিলিয়ন ডলার ঋণচুক্তির সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। বিশ্ব ব্যাংক প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফর করে দুই বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি স্বেচ্ছায় দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার এর আগে কখনো এমন সুসময় পার করেছে বলে ইতিহাসে নজির নেই। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছেÑ অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বিশ্বের শীর্ষ ৫টি দেশের একটি এখন বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বর্তমানে ১ হাজার ৪৬৬ মার্কিন ডলার। দারিদ্র্যের হার এখন ৪১.৫ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২২.৪ শতাংশ। বর্তমানে দেশে রিজার্ভের পরিমাণ ৩১.৩২ বিলিয়ন ডলার। এই সরকারের আমলে দেশে-বিদেশে প্রায় দেড় কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। বাংলা নববর্ষে উৎসব ভাতা, আশ্রয়ণ, একটি বাড়ি একটি খামার, দুস্থ ভাতা, বিধবা ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ অসংখ্য সেবা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। দেশে বর্তমানে শিক্ষার হার ৭১ শতাংশ, উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার মেগাওয়াট। সড়ক, নৌ, রেল ও বিমানসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন বাংলাদেশে এখন দৃশ্যমান সত্য।
পূর্ববর্তী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বাংলাদেশকে বানিয়েছিল মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের কারখানা। সে সময় যেখানে সেখানে বোমা হামলা হতো, এমন কি ৬৩টি জেলায়ও এক সঙ্গে বোমা হামলার নজির রয়েছে। সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হয়েছে। মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ দমনে সরকারের অনমনীয় দৃঢ়তা জনগণের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে। বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ হিসেবে গড়তে হলে অবশ্যই বাহাত্তরের সংবিধানে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। বাহাত্তরের সংবিধান আওয়ামী লীগের হাতেই রচিত হয়েছিল। ওই সংবিধানই আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের রক্ষাকবচ। সময় লাগলেও শেখ হাসিনা সরকারকে বাহাত্তরেই ফিরে যেতে হবে। তাহলে সমস্ত উন্নয়ন টেকসই হবে। তা না হলে মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মান্ধ ও রক্ষণশীল মুসলিম দেশগুলোর ভাগ্যই বরণ করতে হবে বাংলাদেশকে।
৩.
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এবং আওয়ামী লীগের ভাগ্য একসূত্রে গাঁথা। যখনি বাংলাদেশের মাটিতে ঘাতকচক্র ও বিরোধী শিবিরের ষড়যন্ত্রে আওয়ামী লীগ বিপর্যস্ত হয়েছে তখনই বাংলাদেশের ভাগ্যে নেমে এসেছে চরম
অশান্তি কিংবা সামরিক থাবা। বাংলাদেশের জন্য লড়েছে আওয়ামী লীগ, বর্তমানে দেশও গড়ছেও আওয়ামী লীগ। উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত রাখতে হলে অবশ্যই আওয়ামী লীগকে স্বচ্ছ, সুন্দর ও আত্মসমীক্ষার মুখোমুখি হওয়া দরকার। দল এখন ক্ষমতায় আছে। ক্ষমতায় থাকলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে কিন্তু পর্যবেক্ষণ শক্তি কমে। আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনা বর্তমান বিশ্বে অতুলনীয় নেত্রী। তিনি একাই আওয়ামী লীগের ভার বহন করতে সক্ষম। কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, শেখ হাসিনা যতই ক্লিন ইমেজ তৈরি করুন না কেন যদি তার দলীয় লোকজন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, দলীয় নীতি বিসর্জন দিয়ে অবৈধভাবে মানুষকে হয়রানি করে, তাহলে সামনে ভরাডুবি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। অনেক নেতারই মাঠে জনপ্রিয়তা নেই, অনেকেই এলাকায় তেমন কোনো কাজ করছেন না, অনেকেই শুধু ধান্ধায় আছেন কিভাবে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা বানাবেন ও বিত্ত-বৈভবের মালিক হবেন। আওয়ামী লীগের অনেক নেতার বিরুদ্ধেই সীমাহীন দুর্নীতি ও ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগ আছে। কেউ কেউ শুধু নিজে নয়, পুত্র ও জামাতাকেও ব্যবহার করেছে দুর্নীতি করতে। কারো কারো সন্ত্রাসী কার্যকলাপে প্রশ্রয় পাচ্ছে দুই খুন, তিন খুন, সাত খুনের আসামিরা। এগুলো জনগণের কাছে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে ভুল বার্তা পৌঁছায়। এই বিষয়ে অবশ্যই সভানেত্রীর সুদৃষ্টি থাকা দরকার। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এমনকি পৌরসভার নির্বাচনেও কোনো কোনো নেতা দলীয় প্রতীক নৌকা টাকার বিনিময়ে বিএনপি ও জামায়াতি লোকের হাতে তুলে দিয়েছে। এইসব নির্বাচন বাণিজ্যে তারা লক্ষ লক্ষ নয়, কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দাপট লক্ষণীয়। তাদের ঘুষ-দুর্নীতির কথাও মাঝে মাঝে প্রকাশ হচ্ছে পত্রিকায়।
এসব ব্যাপারে এখনি সচেতন হওয়া দরকার। তা না হলে আগামী নির্বাচনে দলের ভাগ্যে কি হবে কেউ বলতে পারে না। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও পুলিশের উৎপাত বাংলাদেশের মানুষকে ভীষণ ভোগাচ্ছে। বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীর সীমাহীন দুর্নীতি ও অকারণ হয়রানি জনমনে ভীষণ ভীতি ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। এ ব্যাপারে সচেতন না হলে ভবিষ্যতে দল গর্তে পড়তে পারে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগকে আরো কন্ট্রোল করা দরকার। এদের বিরুদ্ধে মানুষের অনেক অভিযোগ রয়েছে। গত আট বছরে এই তিন সংগঠনের আটটি ভালো কাজের দৃষ্টান্ত আছে কিনা সন্দেহÑ তবে তাদের বিরুদ্ধে আট লক্ষাধিক অভিযোগ তৈরি হয়েছে জনমনে। দলীয় শৃঙ্খলা যারা ভঙ্গ করবে, যারা দলের সুনাম-সুখ্যাতি নষ্ট করবে, তাদের দলে না রাখাই সমীচীন হবে। নির্বাচনের আগে মনোনয়ন দেওয়ার মুহূর্তে তাদেরই মনোনয়ন দিতে হবে যাদের বিজয়ে বিন্দু পরিমাণ সন্দেহ থাকবে না। এজন্য অবশ্য দলীয় প্রধানকে একটু কঠোর হতে হবে। আমি জানি তিনি অতটুকু কঠোর হওয়ার মানসিকতা পোষণ করেন।
ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। বিশ্বের সেরা ৪৪টি বক্তৃতা নিয়ে জেকব এফ. ফিল্ড যে বক্তৃতা সংকলন বের করেছেন, যার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের বক্তৃতা স্থান পেয়েছে। জেকব তাঁর সংকলনের নাম দিয়েছিলেন চার্চিলের বক্তৃতার অংশ থেকে ডব ংযধষষ ভরমযঃ ড়হ ঃযব ইবধপযবং (ঞযব ংঢ়ববপযবং ঃযধঃ রহংঢ়রৎবফ ঐরংঃড়ৎু)। সেই চার্চিলও পরবর্তী নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন। আমাদের দেশেও বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামী লীগ কোনো প্রতিবাদ, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়েছিল। সেই কথা মনে রেখে আওয়ামী লীগ নেত্রীকে দল ও সরকার পরিচালনা করতে হবে। দীর্ঘ তেইশ বছর সংগ্রাম করে বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যেভাবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিলেন এবং প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগকে দাঁড় করিয়েছিলেন ঠিক সেই জায়গায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে নিয়ে যেতে হবে। মৌলবাদী ও পাকিস্তানি ভাবধারা থেকে মানুষের ‘মাইন্ডসেট’ পরিবর্তন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক ভাবধারায় বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে হবে। দেশের উন্নয়নের পাশাপাশি এটাও অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগের জন্য।
বাংলাদেশকে শেখ হাসিনা উচ্চতম স্থানে নিয়ে গেছেন। এখন মানুষের মাঝে অনেক আশা তৈরি হচ্ছে। মানুষ বুঝতে পারছে আসলেই দেশের উন্নতি হচ্ছে। এই জন্যই রাজপথে বিরোধী দলের মিছিল-মিটিং জনশূন্য। কেউ আর অকারণে রাজনীতি নিয়ে ভাবছে না। এটা আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত শুভ লক্ষণ। কিন্তু আগামী নির্বাচনে যদি কোনো কারণে বা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়, তাহলে বাংলাদেশ তার সব উন্নয়ন সূচক হারাবে ঠিকই কিন্তু আওয়ামী লীগ হবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। সব দিক সামাল দিয়ে এখন ঠান্ডা মাথায় সরকার ও দল পরিচালনা করতে হবে। মন্ত্রিপরিষদকেও স্বচ্ছতা ও দুর্নীতিমুক্ত করার প্রয়োজনে পরিবর্তন করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেখানে বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে চান সেখানে নিতে গেলে অবশ্যই আওয়ামী লীগ ও সরকারের ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতি সঠিক ও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে, কেননা আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ আর বাংলাদেশের ভাগ্য একসূত্রে গাঁথা।
২৯ অক্টোবর, ২০১৬
বঙ্গীয় ভূখ-ে রাজনৈতিক দুরবস্থার অবসান ঘটাতে প্রথম যে দল জনগণের আশা-আকাক্সক্ষাকে বাস্তবায়ন করতে বুক ফুলিয়ে দাঁড়ায় তার নাম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আজকের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আর দল গঠিত হওয়ার মুহূর্তের আওয়ামী লীগ কোনোভাবেই এক নয়। সময়ের ব্যবধানের সঙ্গে সঙ্গে দলের অনেক কিছুই বদলেছে অথবা বদলাতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ যখন পূর্ব বঙ্গে গঠিত হয় গঠনকালীন সময়েই তা বৃহৎ দল হিসেবে পরিচিত ছিল। আজকের বাংলাদেশেও আওয়ামী লীগ সর্ববৃহৎ দল। কিন্তু এই সর্ববৃহৎ দলের ট্র্যাজেটিও অনেক বড়, অনেক বেশি নির্মম। ইতিহাসের অসংখ্য রক্তাক্ত পথ পাড়ি দিয়ে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করেছে ঠিকই, তবে এই জন্য আওয়ামী লীগের শরীর থেকেও কম রক্ত ঝরেনি। বলতে গেলে এটাই সত্য যে, শুরুর দিকে যারা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তারাই দেশ স্বাধীনের সময় সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং তারা প্রায় সকলেই নিজের বুকের রক্ত দিয়ে স্বদেশকে স্বাধীন করার খেসারত দিয়ে গেছেন। পৃথিবীর কোনো দেশের একটি রাজনৈতিক দল এত ভাঙাগড়া-দলন-নিপীড়নের মধ্যে দিয়ে টিকে আছে কিনা তা আমার জানা নেই। আওয়ামী লীগের টিকে থাকার কারণ তার আদর্শবাদ ও সাংগঠনিক শক্তি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববতী ও পরবর্তী আর কোনো দল বাংলাদেশে নেই যার ভূমিকা আওয়ামী লীগের মতো এত সাহসী ও নির্ভীক। শুধু সাহসিকতা আর নির্ভীকতাই নয় আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, ধর্মনিরপেক্ষতা, শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থায়। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক দলই এই তিনটি অনন্য বৈশিষ্ট্য মনে প্রাণে ধারণ করে না। তাই ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন তারিখে ঢাকার রোজ গার্ডেনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়েও নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে আটষট্টি বছর অতিক্রম করছে এই দল।
২২-২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ তারিখে আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে। এই ২০তম কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের ভেতরে-বাহিরে তৈরি হয়েছে নানারকম হিসেব-নিকেশ। বিভিন্ন তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আওয়ামী লীগের এই সম্মেলনকে বিভিন্নভাবে মূল্যায়ন করছেন। তবে সকলেই মোটামুটি একটি বিষয় প্রত্যাশা করেছেন যে, নতুন কমিটিতে যেন দুর্বৃত্তরা ঢুকতে না পারে সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে এবং আগামী দিনের কঠিন মুহূর্তগুলো যারা সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারবে দল যেন তাদেরকেই মূল্যাযন করার চেষ্টা করে। এ রকম দাবি আমিও বহুদিন ধরে বিভিন্ন প্রবন্ধে-নিবন্ধে-কলামে করে আসছি। সুতরাং অন্য সবার মতো আমিও চাইÑ সৎ, যোগ্য, শিক্ষিত, জনপ্রিয় ও ত্যাগী নেতাদের দলে বেশি বেশি স্থান দিতে হবে সেই সাথে দলছুট, হাইব্রিড নেতাদের যথাসম্ভব পরীক্ষার ভেতর দিয়ে গ্রহণ-বর্জন করতে হবে। এ প্রসঙ্গে ২০০১ সালের নির্বাচনের কথা মনে রাখা দরকার। সেই নির্বাচনে কতিপয় দুর্বৃত্তের কারণে ও বিএনপি-জামায়াতের আসন ভাগাভাগির চক্রান্তে আওয়ামী লীগ সর্বাধিক ভোট পেয়েও আসনসংখ্যায় হেরে ক্ষমতায় যেতে পারেনি। বেনোজলে অনেক কিছুই ভেসে আছে। প্রয়োজনীয় পলি যেমন আসে আবার লবণও আসে। মনে রাখা দরকার, পলিই ভূমিকে উর্বর করে, লবণ নয়। সুতরাং সঠিক নেতৃত্ব কেবল সঠিক নেতার পক্ষেই সম্ভব, তাই নেতা মনোনীত করা আসলেই একটি কঠিন বিষয়।
বাংলাদেশের সব মানুষ আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলন নিয়ে যেমন করে ভাবছে, আমার ভাবনাও ঠিক তেমনই। এক সময় আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলাম। দলের অনেক নীতি-নির্ধারণেরও গৌরবময় অংশীদার ছিলাম। দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় রাজনীতির বাইরে থাকলেও এটা ভুলে যাইনি আওয়ামী লীগই বাংলাদেশের নির্মাতা। আওয়ামী লীগের হাতেই বাংলাদেশ সবচেয়ে নিরাপদ ও নির্ভার। বঙ্গবন্ধুর আরেক নাম যদি বাংলাদেশ হয়, তাহলে আওয়ামী লীগেরও আরেক নাম হওয়া উচিত বাংলাদেশের নির্মাতা বা বাংলাদেশের বিনিন্দ্র রূপকার। আজ বঙ্গবন্ধুর পরে বিশ্বব্যাপী যেই নাম উচ্চারিত হচ্ছে, তার নাম ‘শেখ হাসিনা’। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবন নিয়ে প্রশ্ন তোলা বেয়াদবির সামিল বলেই আমি মনে করি। কিন্তু এ কথা আজ বলতে বোধহয় অতুক্তি হবে না যে, দেশনায়ক বঙ্গবন্ধু ও দেশনায়ক শেখ হাসিনা দু’জনেই আজ বিশ্ববরেণ্য। শুধু তাই নয়, দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে এবং সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা বঙ্গবন্ধুর চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। বঙ্গবন্ধুর পা ধরলেই সব অপরাধ ক্ষমা পেয়ে যেত, কিন্তু শেখ হাসিনা ক্ষমা করেন বিচার-বিশ্লেষণ করে। কারণ বঙ্গবন্ধু ছিলেন ‘ঞড়ড় মড়ড়ফ ধহফ মৎধপরড়ঁং’
পূর্বেই বলেছি, আওয়ামী লীগ ছাড়া বাংলাদেশের আর সকল পার্টিই আঙ্গুল ফুলে কলা গাছের মতোন। বেশির ভাগ পার্টিই জন্ম হয়েছে বিশেষ উদ্দেশ্যে ও অন্ধকারে। তাদের পেছনে ছিল ক্ষমতার লোভ, নয়তো ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থতা। যার ফলে দেখা গেছে সে সব পার্টি কিছুদিন ঢাক-ঢোল পেটালেও এক সময় ঠিকই নিস্তেজ হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ থেকে ছুটে গিয়েও কেউ কেউ নতুন নতুন দল তৈরি করেছেনÑ নতুন পার্টির নেতা হয়ে পত্র-পত্রিকার শিরোনাম হয়েছেন। কিন্তু আশ্চর্য হলো, যে সব নেতারা আওয়ামী লীগে থেকে এম.পি-মন্ত্রী হতেন, রাষ্ট্রপতি বা উপরাষ্ট্রপতি হওয়ার যোগ্য ছিলেন তারা যখন নিজ নিজ দল গঠন করে নির্বাচন করতে লাগলেন, তখন তারা শুধু হারলেন না, নির্বাচনে তাদের জামানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হয়ে গেল। এ থেকেই প্রমাণ হয়, আওয়ামী লীগ হলো বহতা নদীর মতো। এই বিশাল-বিপুল নদী থেকে দুই-এক ফোঁটা জল এদিক-সেদিক হলে নদীর অবয়বগত যেমন পরিবর্তন হয় না, তেমনি নদীর গতিপথও বদলায় না। বরং যে দুই-একটা ফোঁটা পানি এদিক-সেদিক হয়, তারাই কিছুদিন পরে শূন্যে মিলিয়ে যায়। উদাহরণ দিলে এমন উদাহরণ চারপাশে অভাব নেইÑ কিন্তু কারো নাম না নেওয়াই নিরাপদ বোধ করছি। কেননা জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আজ আর শত্রু বাড়াতে চাই না।
পত্র-পত্রিকায় দেখছি, আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলন-২০১৬-কে কেন্দ্র করে এবং সেখানে শেখ পরিবারের কিছু নতুন মুখ কাউন্সিলর হিসেবে যোগ দেবার প্রসঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কেউ কেউ ‘ডাইন্যাস্টির’ প্রসঙ্গ তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এ প্রসঙ্গেই আমি মূলত দুই-একটি কথা বলতে চাই। পৃথিবীর সব দেশেই কম বেশি ডাইন্যাস্টি দেখা যায়। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, চীন, ভারত, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ভূটান, থাইল্যান্ড কোথায় ডাইন্যাস্টি নেই? সবখানেই ডাইন্যাস্টির প্রাধান্য। ডাইন্যাস্টি ছাড়া রাজনীতি নেই। অতীতেও ছিল না, বর্তমানেও নেই। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলাও তার নানা আলিবর্দি খাঁ-র (মাতামহ) উত্তরাধিকারী ছিলেন। সুতরাং ডাইন্যাস্টি খারাপ কিছু নয়। এটা তখনই খারাপ হয় যখন কুলাঙ্গার কোনো উত্তরাধিকারীর হাতে গিয়ে ডাইন্যাস্টির ভার অর্পিত হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে বাংলাদেশে তখন বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা নিষিদ্ধ করা হয়। ঠিক সেই মুহূর্তে দীর্ঘ ছয় বছরের দুর্বিষহ নির্বাসন জীবন শেষে ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফিরে এসে আওয়ামী লীগের ভার গ্রহণ করেন। সেই সময় রক্তের উত্তরাধিকার আর আদর্শের উত্তরাধিকার নিয়েও যে প্রশ্ন ওঠেনি তা নয়, বরং অনেক জোরেশোরেই সেই প্রশ্ন তুলেছেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কেউ কেউ। কিন্তু তারা বেশি দূর এগোতে পারেননি, মুখ থুবরে পড়ে গেছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই দীর্ঘ পনেরো বছর পর দল ক্ষমতায় আসে। মাঝখানে ঘটে আরো অনেক ষড়যন্ত্র। সে সব কৌশলে ও ধৈর্য সহকারে প্রতিহত করে আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয় এবং এখন দেশের ও বিশ্বের নেতৃবৃন্দের সমর্থন ও ভালোবাসা নিয়ে দেশ সেবায় নিয়োজিত আছে। বর্তমানে আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। এই আওয়ামী পরিবারেই আবার যুক্ত হচ্ছে এক ঝাঁক নতুন মুখÑ যারা একই সঙ্গে রক্তের উত্তরাধিকারী তো বটেই, আবার আদর্শের উত্তরাধিকারীও। সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুল আজ তারা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কেড়েছে স্বীয় যোগ্যতার বলে। শেখ রেহেনার পুত্র রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি সে লন্ডনে লেখাপড়া শিখেছে। টিউলিপ ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট মেম্বার ও লেবার পার্টির মন্ত্রিসভার শিক্ষামন্ত্রকের দায়িত্বপ্রাপ্ত। অন্যদিকে রূপন্তী সেও অক্সফোর্ড থেকে নিজের পঠিত বিষয়ে অর্জন করেছে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান। আজ শেখ পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম প্রত্যেককেই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ও দেশে-বিদেশে প্রশংসিত। বাংলাদেশের মানুষ এতদিন ‘এইট পাশের’ কলঙ্কে ¤্রয়িমান ছিলÑ এবার অক্সফোর্ড পাশ করা লিডারের লিডার শিপে গৌরববোধ করবে।
শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে ক্ষমতায় বসিয়ে যাননি। জনগণই শেখ হাসিনাকে দলের প্রধান ও পরবর্তীতে সরকারপ্রধান করেছেন। আজ যদি মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণে সজীব ওয়াজেদ জয়, শেখ রেহেনার পুত্র ববি, সোহেল তাজের মতো তরুণ নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শৃঙ্খলা মেনে দলের কাউন্সিলর হয়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এমন কি শেখ রেহানা নিজেও যদি রাজনীতিতে আসেন, তাতেও বাংলার মানুষ বিস্মিত হবে না। বরং বাংলার মানুষ এই ভেবে খুশি হবে যে, আর যাই হোক বিএনপির তারেক রহমানের মতো তারা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে উড়ে এসে ভাইস চেয়ারম্যানের পদ দখল করেনি।
একটু পেছনে গেলে দেখা যাবে, বঙ্গবন্ধুর আমলেও ডাইন্যাস্টির প্র্যাকটিস ছিলÑ সেরনিয়াবাত, শেখ ফজলুল হক মণিÑ এরা কিন্তু সে সময় কম প্রভাবশালী ছিলো না। আজকের দিনে শেখ সেলিম, শেখ ফজলে নূর তাপস, শেখ হেলালÑ এরা তো আছেনই। এমনকি বঙ্গবন্ধু পরিবারের অতি ঘনিষ্ঠ সুহৃদ ইলিয়াস আহম্মদ চৌধুরী দাদা ভাইয়ের দুই পুত্রÑ লিটন চৌধুরী ও নিক্সন চৌধুরীর কথাই কেন বাদ যাবে। নিক্সন চৌধুরী যতটা না রাজনৈতিক শক্তিতে তার চেয়ে ডাইন্যাস্টির জোরেই আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে। রাজশাহীর মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদের পুত্র-কন্যাগণও এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ডাইন্যাস্টি খারাপ কিছু নয়Ñ যদি এর উদ্দেশ্যে ভালো হয়। ডাইন্যাস্টি ছাড়া কখনো কখনো দেশ ও দল দারুণ হুমকির মুখে পড়ে। এখন যেমন পড়েছে বিএনপি। বিএনপি-খালেদা জিয়ার পরে তারেক রহমান অনেক সম্ভাবনা নিয়ে দেখা দিলেও সে এখন অনেকটাই ম্লান। তারেকের বিদ্যা-বুদ্ধি ও কুসঙ্গ তারেক রহমানকে বিপথগামী করেছে। সেখান থেকে সে আর মুক্তি পাবে কিনা কে জানে। আর তাছাড়া তারেক রহমানের অশালীন মন্তব্যে ও খাম খেয়ালি ব্যবহারে বাংলার মানুষ ভীষণ বিরক্ত। প্রথম প্রথম তারেককে দেখে যারা সমর্থন দিয়েছিল বা দেবার মনস্থ করেছিল, এখন তারা অনেকেই তারেকের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারেক ও মৃত কোকোর চৌর্যবৃত্তির কথা নাই বা বললাম।
সাম্প্রতিক সময়ে চীনের প্রেসিডেন্ট ও বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর শুধু বাংলাদেশিদেরই নয়Ñ বিশ্ববাসীরও দৃষ্টি কেড়েছে, এই দুইজনের বাংলাদেশ সফর এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের বক্তব্য এ কথাই প্রমাণ করছে যে, বাংলাদেশ আসলেই এগিয়ে চলছে। সময় এখন আওয়ামী লীগের। আগামীতে যারা আওয়ামী লীগের হাল ধরবেÑ এরা হবে দেশপ্রেমিক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, শিক্ষিত, সৎ, নির্লোভ ও আদর্শবান মানুষ। এদের হাতে দেশ ও দেশের মানুষ নিরাপদ থাকবে। প্রতিষ্ঠিত হবে মানুষের সার্বিক অধিকার। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলন সফল হোক, এই সম্মেলনের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসুক আগামী দিনের বাংলাদেশের যোগ্য নেতৃত্ব।
১৮ অক্টোবর, ২০১৬
আজ তেসরা নভেম্বর জাতীয় জেলহত্যা দিবস। ১৯৭৫ সালের এই দিনে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নির্মমভাবে শহিদ হয়েছিলেন জাতীয় চার নেতা। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম আজকের পত্র-পত্রিকায় মর্মন্তুদ জেলহত্যা দিবস নিয়ে খুব কমই লেখালেখি হয়েছে। আমাদের ফাউন্ডেশনে প্রতিদিনই প্রায় পঁচিশের ঊর্ধ্বে পত্রিকা রাখা হয়। এতগুলো পত্রিকার মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া বেশিরভাগ পত্রিকাই বিষয়টি উপেক্ষা করার চেষ্টা করেছে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় একদল বুদ্ধিজীবী আওয়ামী বিদ্বেষী ও ভারতবিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করতেন। তারা এখনো সক্রিয় আছেন। তাদের সেই সক্রিয়তা বর্তমান প্রজন্মকেই বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। এই সুচতুর গোষ্ঠীবদ্ধ বুদ্ধিজীবীরা ’৭৫-পরবর্তী কালপর্ব থেকে বর্তমানেও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিষোদগার করে যাচ্ছেন। এ সকল জ্ঞানপাপী বুদ্ধিজীবীগণ বুঝতে পারছেন না, আওয়ামী বিদ্বেষী বা ভারত বিদ্বেষী হয়ে তারা মূলত বাংলাদেশকে পেছনে নিয়ে যেতে চান। তারা এখনও প্রহর গুণছেন পাকিস্তানি মৌলবাদী ভাবধারায় বাংলাদেশ নিয়ে যেতে। কিন্তু আমার বিশ্বাস বাংলার মাটিতে তারা এ সুযোগ আর কোনোদিনই পাবেন না।
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীগণ বাংলাদেশ জন্মের পূর্ব থেকেই বিভিন্ন ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে আসছেন। যদি ধরে নিই বর্তমান বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের পূর্ব পুরুষ রাজা রামমোহন রায় কিংবা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো প্রতিভাবানেরা তাহলে এ কথা অবশ্যই বলতে হয়Ñ ভারতীয় উপমহাদেশের দুটি দুর্বিষহ অভিশাপ থেকে এরাই ভারতবর্ষের নারী সমাজকে রক্ষা করেছেন। সতীদাহ প্রথা আজকের সভ্য দুনিয়ায় কারো কাছেই পুণ্যের কাজ নয়, কিন্তু একদিন এই নির্মম সতীদাহ প্রথা রদ করতে রামমোহন রায়কে ভীষণ বেগ পেতে হয়েছিল। ১৮২৯ সালে সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত হলে হিন্দু বিধবা নারীরা যেন চিতাগ্নি থেকে নতুন জীবন পান। কিন্তু এই নতুন জীবন নিয়ে দেখা গেল আরেক রকম বিড়ম্বনা। বিধবারা জীবন পাচ্ছে বটে কিন্তু সেই জীবন উপভোগ করতে পারছে না। এগিয়ে এলেন জ্ঞান ও দয়ার সাগরÑ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি শাস্ত্র ঘেঁটে বিধবা বিবাহের আইন পাস করলেন। নিজের উপার্জিত অর্থ খরচ করে বিধবাদের বিবাহের আয়োজন করতে লাগলেন। ধীরে ধীরে প্রচলন হলো বিধবা বিবাহের। শুধু রামমোহন আর বিদ্যাসাগরই ননÑ ইয়াং বেঙ্গলদের বুদ্ধিবাদী আন্দোলনও সেদিন স্থবির, প্রথাবদ্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছিল। এমন কি নারীশিক্ষা ও পর্দাপ্রথার বিরুদ্ধে বুদ্ধিবাদী আন্দোলন করে বেগম রোকেয়া স্মরণীয় হয়ে আছেন।
১৯২৬ সালে ঢাকায় যে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেই সমাজের সভ্যরা ‘শিখা’ পত্রিকাকে ঘিরে যে বুদ্ধিবৃত্তিক নব আন্দোলন গড়ে তোলেন তার মূল্যও অপরিসীম ছিল। শিখা পত্রিকার সেই কথা এখনো আমার মনে আছেÑ ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’ আজ আমাদের বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের দেখলে শিখা গোষ্ঠীর কথা ভীষণভাবে মনে পড়ে। অর্থাৎ আমাদের পূর্ববর্তী বুদ্ধিজীবীরা দেশ-জাতি-সমাজের অমঙ্গলজনক কোনো চিন্তাই মাথায় স্থান দিতেন না কিন্তু বর্তমান বুদ্ধিজীবীদের একাংশ হীন গোষ্ঠীর স্বার্থ ছাড়া যেন অন্য কিছু ভাবতেই পারছেন না। এই যদি হয় আমাদের বুদ্ধিজীবীদের চরিত্র, তাহলে এদেশের স্বাধীনতা বলি আর উন্নয়নই বলি কিছুই টেকসই হবে না।
আমাদের দেশে একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী আছেন তারা কোনো কিছুতেই ইতিবাচক কিছু খুঁজে পান না। ভালো কাজের মধ্যেও মন্দকে খুঁজে বের করা তাদের একমাত্র কাজ। এসব বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশকে পেছনে নিয়ে যেতে চায়। এরা সেই অন্ধকার চায়Ñ যেই অন্ধকারে দেশ ঢেকে গেলে তাদের ব্যক্তিস্বার্থ ও গোষ্ঠীস্বার্থ হাসিল হবে। বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করা কোনো ভালো কাজ নয়। অন্তত বুদ্ধিজীবী পদবাচ্য যাদের গায়ে লেগেছে তাদের পক্ষে ‘বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা’কে আমি পাপ বলেই গণ্য করি। আমাদের দেশের কিছু কিছু বুদ্ধিজীবী সময়ের হাওয়া ধরে পাল তোলার চেষ্টা করেন। এ ঘটনা পাকিস্তান আমলে দেখেছি, বিভিন্ন সামরিক সরকারের সময়ে দেখেছি এমন কি মৌলবাদ ও পাকিস্তানি ভাবধারায় বিশ্বাসী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলেও দেখেছি। বুদ্ধিজীবীদের সর্বশেষ দ্বিমুখিতা দেখেছি ১/১১-এর ঐতিহাসিক দুঃসময়ে। তখন যাদের কলাম-বক্তৃতা পেপারে-টেলিভিশনে পড়েছি-শুনেছি আজ তারা অনেকেই হারিয়ে গেছেন। হারিয়ে গেছেন ১/১১-এর কুশীলব ও তাদের মদদদাতা ডক্টরগং। সত্য মাঝে মাঝে ঢাকা পড়ে যায় বটে, তবে বেশিক্ষণ সত্য ঢেকে রাখা যায় না। সত্য স্বপ্রকাশ। সে নিজে নিজেই বেরিয়ে আসে। সত্যকে যারা মিথ্যার প্রলেপ দিয়ে মিথ্যা বানাতে চায় তারাই মিথ্যুক বলে একদিন প্রমাণিত হয়ে যায়।
একটি কথা না বললেই নয়Ñ বিগত ২১ বছরে অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে এদেশে একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী তৈরি হয়, যারা বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে চায় পাকিস্তানি ভাবধারায়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হলে ২১ বছর বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকে বাংলাদেশ বিরোধীচক্র ’৭৫ থেকে ’৯৬ সাল পর্যন্ত এই একুশ বছরে বাংলাদেশ উল্টো দিকে যাত্রা শুরু করে। স্বাধীন-সার্বভৌম ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পরিবর্তে এখানে মাথা চাড়া দিয়ে উঠে পাকিস্তানপন্থী সাম্প্রদায়িক শক্তি। তারা ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়ার পরিবর্তে সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেয়। এর ফলে এখানে তৈরি হয় উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী। সেই গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ মদদে তৈরি হয় একদল সাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজীবী। এরা কারণে-অকারণে বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এদের চোখে আওয়ামী লীগের কোনো কিছুই ভালো নয়। আওয়ামী লীগ যা করে তারা তার বিরুদ্ধেই তীব্র ও মারমুখী আচরণ করতে শুরু করে। কিন্তু তারা বুঝে নাÑ এ দেশের মানুষ এখন আর মিথ্যে কথায় ভুলে না। আজ আওয়ামী লীগের সাফল্য দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও প্রশংসিত হচ্ছে। দেশের উন্নয়নে এখন অনেকেই বিস্মিত ও অভিভূত। এহেন পরিস্থিতিতে এই সাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী দিশেহারা হয়ে গেছে। এখন তাদের উচিতÑ অযথা দেশের ও আওয়ামী লীগের বদনাম না করে গঠনমূলক সমালোচনায় নিজেদের নিয়োজিত করা। লালন ফকির বলেছিলেন, ‘সময় গেলে সাধন হবে না,’ তাই সময় থাকতেই এই বিভ্রান্ত বুদ্ধিজীবীদের সুপথে ফিরে আসার অনুরোধ করব, নইলে বাংলাদেশের মানুষ এই সব বুদ্ধিজীবীদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে।
যারা বাংলাদেশের বর্তমান উন্নয়ন-অগ্রগতিকে অস্বীকার করতে চান, তারা কি আবার বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় দেখতে চান? বিএনপি-জামায়াত জোট বাংলাদেশকে এমন কি দিয়েছে যে তাদের জন্য তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের এত মায়াকান্না করতে হবে? ইনিয়ে বিনিয়ে তাদের পক্ষে কথা বলতে হবে? হ্যাঁ বিএনপি-জামায়াত জোট বাংলাদেশকে আর কিছু না দিতে পারুক, মৌলবাদকে উস্কে দিতে পারে, দেশের সিরিজ বোমা হামলা করতে পারে। অবাধ ঘুষ লেনদেন করতে পারে, দেশদ্রোহী চিহ্নিত রাজাকারদের হাতে তিরিশ লক্ষ শহিদের রক্তে সিক্ত পতাকা তুলে দিতে পারে। যারা শহিদের রক্ত নিয়ে প্রহসন করে তাদের পক্ষে যারা ওকালতি করতে চায়, এদেশের প্রতিবাদী মানুষ তাদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতে শুরু করেছে। বিগত ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচনে সেই বার্তাটিই এদেশের মানুষ দিয়েছে।
আমি বলবো না আওয়ামী লীগের কোনো দোষ নেই। নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের অনেক ত্রুটি আছে। দেশ এগিয়ে গেলেও এখনো দেশে দুর্নীতি আছে, আইনের শাসন পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি, কোনো কোনো সেক্টরে এখনো তেমন আশানুরূপ সাফল্য আসেনি। আওয়ামী লীগের দোষ-ত্রুটি নিয়ে আমিও পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করছি। আবার পাশাপাশি সরকারের সাফল্যকেও স্বাগত জানাচ্ছি। বুদ্ধিজীবীদের কাজ হলো সরকারের প্রতিটি কাজ বিচার বিশ্লেষণ করে দিক-নির্দেশনা দেওয়া। সরকারকে বিভ্রান্ত বা দোষী সাব্যস্ত করা নয়। যারা সরকারকে বিভ্রান্ত বা দোষী বানাতে চান তাদের উদ্দেশ্যে শুধু একটি কথাই বলবো, আগে নিজের ছিদ্র বন্ধ করুন, তারপর সরকারের ছিদ্রান্বেষণ করুন। নিজের একরাশ কলঙ্ক থাকতে অন্যের কলঙ্কতিলক না দেখানোই সমীচীন।
ধর্মীয় একটি বইতে পড়লাম দোজখে দোজখিদের জাক্কুম ফল খেতে দেওয়া হবে। ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির হয়ে দোজখিরা এই ফল খাবে কিন্তু এই ফল দোজাখিরা গিলতে পারবে না। তখন তারা ছটফট করতে থাকবে এবং দোজখের ফেরেস্তাদের জিজ্ঞেস করবে এখন আমরা কী করবো? তখন দোজখের ফেরেস্তারা বলবেন, তোরা কী-ও করতে পারবি না। এদেশের সাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজীবীদের অবস্থা দোজখের ফেরেস্তাদের মতো। এরা আওয়ামী লীগ সরকারকে কীও করতে দিতে চায় না। অর্থাৎ তাদের পছন্দ মতো সরকার ছাড়া অন্য সব কিছুতেই তাদের ঘোর আপত্তি।
আমাদের দেশে উন্নয়নের পাশাপাশি বিদ্যুৎ, যোগাযোগ ও অন্যান্য অবকাঠামোও নির্মাণ করা প্রয়োজন। কিন্তু যখন সরকার বিদ্যুৎ শক্তি বৃদ্ধির জন্য নানারকম পরিকল্পনা করছে, কতিপয় বুদ্ধিজীবী তাতে নানা বাধা দিচ্ছে। রামপাল ও রূপপুরে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন করছে। এগুলো কিসের স্বার্থে, কার স্বার্থে? নিশ্চয়ই দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থে নয়। তারা ভাবে নাÑ প্রকল্প করতে গেলে এদেশেরই কোথাও না কোথাও করতে হবে। সবখানে বাধা আসলে সরকার উন্নয়ন করবে কিভাবে?
এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থের বাইরে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নাই। সুতরাং জনগণের উচিত ধৈর্য ধরে শেখ হাসিনার কাজকে সমর্থন করে যাওয়া। যেহেতু দেশ ধীরে ধীরে উন্নয়নের মাইলফলক স্পর্শ করছে এবং মাথাপিছু আয়সহ জিডিপি বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই দিশেহারা বুদ্ধিজীবীদের বলব আপনারা পজেটিভ হোন। দায় নিয়ে সমালোচনা করুন। তা না হলে এদেশের মানুষ আপনাদের কারণে প্রকৃত বুদ্ধিজীবীদেরকেও সন্দেহের চোখে দেখবে। বুদ্ধিজীবীদের সত্য বলার ও সুপথে চলার সাহস থাকা দরকার। আমি বিশ্বাস করি আমাদের বুদ্ধিজীবীগণ সত্য বলবেন ও সুপথে চলবেন।
১৬ নভেম্বর, ২০১৬
বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে জনমনে সীমাহীন অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এমন কোনোদিন নেই যেদিন পত্র-পত্রিকায় ও টেলিভিশনের টক-শোগুলোতে আমাদের শিক্ষার অব্যবস্থাপনা কিংবা শিক্ষার ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা না হচ্ছে। কিন্তু আমাদের শিক্ষামন্ত্রক বা শিক্ষা-বিষয়ক নীতি-নির্ধারকরা তাতে কর্ণপাত করছে এমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। একটি অসুস্থ ধারার বিকলাঙ্গ শিক্ষা ব্যবস্থায় ভর করে পুরো জাতি আগামীতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে বিষয়ে এখনই পরিকল্পনা নির্দিষ্ট করা দরকার। বাংলাদেশে মোটামুটি চার স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চতর স্তর (বিশ্ববিদ্যালয়)। এই হলো আমাদের শিক্ষার প্রচলিত কাঠামো। এই চার স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতরে আছে আরো নানা উপস্তর (মক্তব, গ্রামভিত্তিক শিক্ষা, কওমি শিক্ষা, তথাকথিত ইংরেজি মাধ্যম ইত্যাদি)। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাস্তর আগের চেয়ে আধুনিক হয়েছে এবং পাঠ্যক্রমে যুক্ত হয়েছে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, এমনটিই শিক্ষা সংশ্লিষ্ট মহল মনে করেন।
কিন্তু ভেতরের খবর খুবই হতাশাব্যঞ্জক। আমাদের অবুঝ শৈশবে আমরা যে প্রাথমিক শিক্ষা পেয়েছি সেই শিক্ষাকে যদি বর্তমান দৃষ্টিকোণে ত্রুটিপূর্ণ বলে ধরা হয়, তাহলে এই প্রশ্ন করা নিশ্চয়ই অসঙ্গত নয় যে, সেই ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা নিয়েই আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু বর্তমানে আধুনিক শিক্ষার সমস্ত-সুযোগ পেয়েও, পরীক্ষায় সোনালি প্রতীক (গোল্ডেন এ+) পেয়েও কেন এ যুগের শিক্ষার্থীরা দুই জনের বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে না তা পুরো জাতিকে চিন্তিত করে তুলেছে। তাহলে কি প্রশ্ন উঠতে পারে নাÑ কোন শিক্ষা ভালো ছিল আগের কাঠামোবদ্ধ শিক্ষা পদ্ধতি নাকি আধুনিক সৃজনশীল পদ্ধতি?
৭ অক্টোবর, ২০১৬ দৈনিক ইত্তেফাকে ড. জাফর ইকবাল ‘আমার ভাঙা রেকর্ড’ কলামে দেখিয়েছেন কোনো রকম লেখাপড়া না করেও বর্তমান পদ্ধতির শিক্ষা ব্যবস্থায় ৬০-৭০ শতাংশ নম্বর পাওয়া সম্ভব। আর কেউ যদি একটু খাটাখাটুনি করে ১০-২০ নম্বর পায়, তাহলে গোল্ডেন এ+ পাওয়া কোনো ব্যাপারই না। তার মানে হলো আমাদের সময়ের সনাতন পদ্ধতির শিক্ষা ব্যবস্থার মানদ-ের বিবেচনায় এখন যারা জিপিএ ফাইভ পাচ্ছে, তারা মূলত ফেল করা শিক্ষার্থীর কাতারেই পড়ে। অর্থাৎ এখনকার ৮০ শতাংশ নম্বর পাওয়া ছাত্র এক হিসেবে অকৃতকার্য ছাত্রই বটে।
এই অকৃতকার্যকে কৃতকার্য করে তোলা এটা এক হিসেবে জাতির শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র বলেই মনে হয়। কোনো কোনো শিক্ষাবিদ মনে করেন বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো দরকার। অবশ্য তাদের এসব কথার পেছনে অকাট্য যুক্তিও রয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আসলেই ঢেলে সাজানো দরকার কিনা সে বিষয়ে চূড়ান্ত কথা বলার অধিকার আমরা কেউই রাখি না, যদি না সরকার সে কথা স্বীকার না করেন। কেননা প্রতিষ্ঠিত সরকারি পলিসির বিরুদ্ধে কথা বলা এক অর্থে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। কিন্তু কথা হলো সমাজে যেহেতু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতি ও শুভঙ্করের ফাঁকি ধরা পড়েছে সেই বিষয়ে অবশ্যই সরকারের বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া দরকার। যদি জনগণের পর্যবেক্ষণই ঠিক হয় তাহলে সরকারের উচিত জনপ্রত্যাশা ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলিত সমস্যা সমাধান করা। আর তা না হলে সরকারের উচিত সরকারে শিক্ষা পলিসি যে ঠিক তা যুক্তি দিয়ে জনগণকে বুঝিয়ে দেওয়া।
পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে পঞ্চম শ্রেণির কোনো শিশুর পরীক্ষা এত সমারোহে হয় নাÑ সেটা হয় বাংলাদেশের মতো একটা গরিব দেশে। এখনকার পিএসসি পরীক্ষা (প্রাইমারি স্কুল সার্টিফিকেট) যেভাবে হয়, সেইভাবে হতো আমাদের সময়ের এসএসসি (ম্যাট্রিকুলেশন) পরীক্ষা। আমাদের আমলে ম্যাট্রিক পাশ করলে একটা ছোটখাটো চাকরি পাওয়া যেত। আমার পরিচিত অনেক লোকই ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করেছে। অথচ আজকের দিনে পিএসসি নামের যে অদ্ভুত ও শিশু নির্যাতনকারী পরীক্ষা চালু হয়েছে তার ফলাফল ও সার্টিফিকেট কোনো কাজেই লাগে না। মাঝখান থেকে কিছু অপ্রত্যাশিত দুর্বৃত্তপনা যুক্ত হয়েছে। আমাদের সময়ে স্কুলে স্কুলে প্রাইমারি পরীক্ষা হতো, যে পাস করতো সে হাইস্কুলে যেত এবং হাইস্কুলের গ-ি পেরুতে পারলে যেত কলেজে। উচ্চ শিক্ষা নিত খুবই অল্প লোকে। যাদের মেধা ও সচ্ছলতা ও অটুট ধৈর্য ছিল তারাই উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করতো। এখনকার সিস্টেমটা এতই অদ্ভুত যে, বাংলাদেশে প্রাইমারি স্কুলে ফেলের সংখ্যা নেই বললেই চলে (বেশিরভাগ পাস করে বা করানো হয়)। তাহলে কি আমাদের শিক্ষা অনেক এগিয়ে গেছে বলবো? সংখ্যায় এগিয়ে থাকলেও আসলে আমরা অনেকখানি পিছিয়ে গেছি। অনেকখানি ক্ষতি হয়ে গেছে আমাদের। এখন সবাই পাস চায়, জ্ঞান চায় না। পাস এখন বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার এক নম্বর চাওয়া। শিক্ষার গুণগত মান যাই হোক না কেন সংখ্যাগত মান বৃদ্ধিতে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও সরকার সদা তৎপর। এখন একটা ফাইভের শিশুকে আঠারো ঘণ্টা লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় (শুধু ঘুমানো ও প্রাতঃকৃত্য ছাড়া)। তার অবশ্যই কোচিং করানোর অর্থ জোগান দিতে হয়। একজন লোক (বাবা/মা, কাজের ছেলে বা মেয়ে) তার দেখাশোনার জন্য ব্যস্ত থাকতে হয়, প্রশ্ন ফাঁস হলে সেই ফাঁস করানো প্রশ্ন জোগাড় করার অনৈতিক কাজে জড়িত থাকতে হয়। রেকর্ড সংখ্যক নম্বর পাওয়ার জন্য প্রশ্ন ফাঁস করানোর চেষ্টা করতে হয়। সব মিলিয়ে একটা বাজে বিষয়ের চর্চা আর কি। সরকারি ব্যয়ে একটি পরীক্ষা চালাতে রাষ্ট্রের সব স্তরের কর্মকর্তা, কর্মচারী ব্যবহার করতে হয় (প্রয়োজন অনুযায়ী)। এটা একটা দক্ষযজ্ঞই বটে। অথচ মজার বিষয় হলো এই পরীক্ষার কিছুই কোনো কাজে লাগে না। আগের দিনে ফাইভ পাস কোনো কাজে লাগতো না, এখনকার দিনের ফাইভ পাসও কোনো কাজে লাগে না, অথচ আগের দিনে ফাইভ পাস করাতে সরকারের এক টাকাও অপচয় হতো না। এখন ফাইভ করাতে সরকারের শত শত কোটি টাকা বিনা কারণে অপচয় হচ্ছে। মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে অবুঝ শিশুরা। পরিবারের টাকা ব্যয় হচ্ছে। কোচিং ব্যবসায়ীরা ধনী হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে অভিভাবকের মূল্যবান কর্মঘণ্টা।
আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতি বদলানো দরকার, পাঠ্যক্রম বদলানো দরকার, শিক্ষকদের মর্যাদার বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো দরকার। বদলানো দরকার শিক্ষার সার্বিক পরিবেশ। খোলা আকাশের নিচে আর যাই হোক ডিজিটাল কন্টেন্ট কিংবা সৃজনশীল পদ্ধতি হয় না। পৃথিবীর যারা বিখ্যাত মানুষ তারা কেউই সৃজনশীল পদ্ধতির পাস নয়। বহু জ্ঞানী-গুণী যেমন লালন-হাসন-গগন-রবীন্দ্র-নজরুল সৃজনশীল পাস নয়, তারা নিজেরাই সৃজনশীলতার উদাহরণ। বাংলাদেশে কোনোদিনই শিক্ষার উন্নয়ন আশা করা ঠিক হবে না যদি নাÑ (১) শিক্ষাক্ষেত্র সরাসরি সৎ-জ্ঞানী-গবেষক ও সৃজনশীল শিক্ষকের হাতে তুলে দেওয়া না হয়। (২) সবখাতের চেয়ে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বেশি দেওয়া না হয় (বর্তমানে আমাদের দেশে জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ ব্যয় করা হচ্ছে ভারতে এর পরিমাণ ৪ শতাংশের উপরে)। (৩) শিক্ষার পরিবেশ তথা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সুস্থ-সুন্দর নিরাপদ করা না হয়, (৪) শিক্ষকদের মর্যাদা-সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা না দেওয়া হয়, (৫) পাঠ্য পুস্তকে বিজ্ঞানমনস্ক, ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা না হয় (৬) সমাজে বিভিন্ন কর্মকা-ের মাধ্যমে জ্ঞানের প্রতি আকাক্সক্ষা তৈরি করা না হয়।
পেটে ক্ষুধা নিয়ে কেউ কাজ করতে চায় না। যে চায় এক সময় সেও কাজ করা থেকে বিরত হয়। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে পাঁচ বছরেই একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সম্ভব। এই জন্য লাগবে জনগণের যৌক্তিক পরামর্শ শোনার উদারতা আর সেই অনুযায়ী কাজ করার মানসিকতা। বর্তমানে বাংলাদেশে যেভাবে শিক্ষা ব্যবস্থা চলছে এই শিক্ষা ব্যবস্থায় দেশের একজন মানুষও খুশি কিনা সন্দেহ। তবু আমাদের শিক্ষা চলছে এবং ভালো করেই চলছে। এই চলাকে বিজ্ঞাপনের জোরে চলা বলাই ভালো। বাজারে নতুন পণ্য এলে বিজ্ঞাপনের জোরে কিছু দিন তা চলেÑ তারপর ভালো না হলে আমজনতা সেই পণ্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকেও মানুষ এখন মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশের কোনো স্কুল-কলেজে শিক্ষক নিয়োগে ঘুষ লেনদেনের চিত্র দেখলে যে কোনো বিবেকবান মানুষই আঁতকে উঠবেন। এ দেশের কোনো স্কুলে-কলেজে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে হরে ৫ থেকে ১০ লক্ষ টাকা ঘুষ দিতে হয়। একজন এমএলএসএস বা নৈশ প্রহরী নিয়োগের ক্ষেত্রে ২ থেকে ৫ লক্ষ টাকা ঘুষ দিতে হয়। কোনো শিক্ষক যখন শিক্ষাদানের মতো পবিত্র পেশায় ঢোকার আগেই মোটা অংকের টাকা ঘুষ দেন তখন তিনি কিভাবে শিক্ষার্থীকে নীতি-নৈতিকতা শিক্ষা দিবেন? ৭ সেপ্টেম্বর (২০১৬) দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন বের হয়Ñ যার শিরোনামÑ ‘টাকার কাছে হার মানছে মেধা।’ যারা সেই প্রতিবেদন পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন বাংলাদেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থার চিত্র মোটেই উৎসাহব্যঞ্জক নয়। কিছুদিন আগেও শিক্ষাখাতের দুর্নীতি ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে। এখন সেই দুর্নীতি যাও কমেছে তা উল্লেখ করার মতো নয়।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমানে দুর্নীতির ও অব্যবস্থাপনার এমন এক কঠিন জালে আটকা পড়েছে যা থেকে মুক্তি পেতে হলে স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহোদয়কেই হস্তক্ষেপ করতে হবে। তার হস্তক্ষেপ ছাড়া শিক্ষা খাতের এই অচলায়তন ভাঙ্গা মোটেই সম্ভব নয়। অবশ্য তিনিও কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন কিনা সে বিষয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে একবার কিছু ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার এসে আমাকে বলেছিলেনÑ স্যার, আমাদের কোর্স যদি তিন বছরের পরিবর্তে চার বছর করা হতো, তাহলে বিদেশে গিয়ে আমরা ইঞ্জিনিয়ারের মর্যাদা পেতাম। দেশেও রেমিটেন্স আসতো। এ সম্পর্কে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার কোর্স চার বছর করার ঘোষণা দেন। তখন শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন প্রয়াত এস.এইচ.কে সাদেক সাহেব। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরেও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের তিন বছরের কোর্স চার বছর হতে সময় লেগেছিল সাড়ে তিন বছর। একদিন আমি আমার একটি নিবন্ধে লিখিÑ শিক্ষা মন্ত্রণালয় কি ডিপ্লোমা কোর্সের ব্যাপারটা এনজয় করছে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরেও কেন এটা কার্যকর হচ্ছে না? ঘটনার উল্লেখ করলাম এই জন্য যে, যে দেশে প্রধানমন্ত্রীর আদেশ কার্যকর হতে সাড়ে তিন বছর লাগে সেদেশের শিক্ষা রাতারাতি বদলাবে না।
বলা হয়ে থাকে প্রকৃতিই মানুষের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। কিন্তু বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় দেখা যায় প্রকৃতির কাছে যাবার সুযোগই পায় না ছোট ছোট শিশু-কিশোরেরা। পিএসসি, জেএসসি’র মতো অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে শিশুরা তাদের শৈশব-কৈশোর হারিয়ে ফেলছে, নষ্ট করে ফেলছে তাদের সৃজনশীলতা। সারাক্ষণ চার দেয়ালে বন্দী থেকে মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ হচ্ছে আমাদের আগামী দিনের স্বপ্ন। শিশুদের উপর থেকে যতটা সম্ভব লেখাপড়ার চাপ কমাতে হবে। এ জন্য সময়ের কথা বিবেচনায় রেখে তাদের পাঠ্যপুস্তক তৈরি করতে হবে। পাঠ্যবই থেকে আবোল-তাবোল বিষয় বাদ দিয়ে যুগোপযোগী বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ ব্যাপারে উদাসীন হওয়া মোটেই চলবে না। বর্তমান শিক্ষা আইনে শিক্ষকদের জন্য শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে কিন্তু গবেষণার জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করা হয়নিÑ এটাও একটু ভেবে দেখা দরকার। আরো ভেবে দেখাÑ একজন এসি ল্যান্ডের চেয়ে একজন অধ্যাপক পদ-পদবিতে অনেক মর্যাদাবানÑ অথচ এসি ল্যান্ডের জন্য সত্তর লক্ষ টাকা দামের গাড়ি কেনার, উন্নত আবাসনের কথা চিন্তা করা হচ্ছে কিন্তু অধ্যাপকদের জন্য ন্যূনতম জীবনমানের নিশ্চয়তা নেই। এ বিষয়গুলোও সুনজরে আনা দরকার। কিছুদিন আগে বিবিসি-র একটি সাক্ষাৎকারমুলক অনুষ্ঠানে শুনছিলাম। সেখানে তরুণ প্রজন্মকে তাদের ক্যারিয়ার নিয়ে প্রশ্ন করা হলে কেউই শিক্ষক হতে আগ্রহ দেখায়নি। এর কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছেÑ শিক্ষকতা পেশায় কোনো জৌলুস নেইÑ সচ্ছলতা নেই, জীবন উপভোগের কোনো ব্যবস্থাই নেই। সুতরাং সর্বস্ব ত্যাগ করে মেধা দিতে এখনকার প্রজন্ম আগ্রহী নয়। কথাটা শুনতে যতই খারাপ শোনাক আসলে এটাই বাস্তবতা।
একটি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছেÑ আমেরিকা তার সামরিক খাতে বছরে ব্যয় করে ৯০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আর শিক্ষা খাতে ব্যয় করে মাত্র ১ বিলিয়ন ডলার। প্রকৃত শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সামরিক খাতে এ অর্থ অপচয় আমেরিকাকে তো আজ সর্বস্বান্ত করছেই সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীকেও ফেলেছে চরম হুমকির মধ্যে। এই হুমকি আরো প্রকট হবে যদি ডোনাল্ড ট্র্যাম্পের মতো বদ্ধ পাগল প্রেসিডেন্ট হয়। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা আজ যেভাবে চলছে, এভাবে চললে অদূর ভবিষ্যতে আমরাও ট্রাম্পের মতো হিতাহিত জ্ঞানশূন্য প্রেসিডেন্ট হয়তো পাবো।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী (১৯০৪-৭৪) সাহেবের সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্য হয়েছিল। তিনি একবার কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেনÑ ‘জ্ঞানার্জন ধনাজনের চেয়ে মহত্তর’Ñ এ কথা যদি সত্যি সত্যি আমরা বিশ্বাস করি, তাহলে অবশ্যই জ্ঞানার্জনের পথ সহজ, সুন্দর ও নান্দনিক করতে হবে। সংখ্যাগত পাস না বাড়িয়ে গুণগত পাস বাড়াতে হবে। কোচিং, গাইড বই, প্রশ্ন ফাঁসের মতো ব্যবস্থা থেকে রক্ষা পেতে হলে এমন পদ্ধতি আবিষ্কার করতে হবে, যাতে টেকসই শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করা যায়। শিক্ষা সংক্রান্ত সকল প্রতিষ্ঠানের অবাধ দুর্নীতি নির্মূল করে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে না পারলে দেশের কোনো উন্নয়ন ফলপ্রসূ হবে না। আগে মানুষকে মানুষ বানাতে হবে। মানুষ যদি সত্যিকারের মানুষ হয়, উন্নয়ন অবশ্যই সম্ভব।
১১ অক্টোবর, ২০১৬
যখন প্রশ্ন আসে যুদ্ধ না শান্তি? আমরা জবাব দেই শান্তি শান্তি শান্তি!
মোনায়েম সরকার
বর্তমান পৃথিবী হিংসা আর স্বার্থপরতায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। তাই দেশে-দেশে ও মানুষে-মানুষে মারামারি, কাটাকাটি, রক্তপাত লেগেই আছে। মানুষের জন্য যা ক্ষতিকর সে সব করা মানুষের উচিত নয়, তবু মানুষ মোহে অন্ধ হয়ে বা ক্ষমতার অপব্যবহার করতে এমন কিছু আবেগী সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে যা সভ্যতার জন্য কলঙ্ক তিলক হয়ে থাকে। যুদ্ধ পৃথিবীতে কেউ চায় না, তবু আজ পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আছে। এই ভয়াবহ যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে আজ মানুষ মুক্তি চায়, চায় সার্বিক শান্তি। কিন্তু শান্তির পথে না হেঁটে মানুষ যদি অস্ত্রের পথে হাঁটে ও অস্ত্রের ভাষায় কথা বলেÑ তাহলে রক্ত¯্রােত বন্ধ হবে না, বন্ধ হবে না ঘরে ঘরে নর-নারী ও শিশুদের ক্রন্দন।
ভারতীয় উপমহাদেশে কিছুদিন যাবৎ যুদ্ধের দামামা বেজে চলেছে। বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তান যেভাবে অমীমাংসিত জম্বু ও কাশ্মীর ইস্যুতে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে তাতে মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর এক নাটকীয়তা মঞ্চস্থ হবে উপমহাদেশবাসীর সামনে। ইতোমধ্যে দুই দেশের সীমান্ত থেকে সীমান্তবর্তী হাজার হাজার মানুষকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখনও প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টায় দিগি¦দিক ছুটে বেড়াচ্ছে প্রাণভয়ে ভীতু সাধারণ মানুষ।
বিশ্ববাসীর সামনে দুই-দুটি মহাযুদ্ধ ও আরো অসংখ্য ছোট-বড় যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আছে। সেই অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই সুখকর নয়। ইতিহাস থেকে মানুষ অনেক বিষয়ে শিক্ষা নিলেও যুদ্ধ বিমুখতার শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। যুদ্ধে সামরিক বাহিনীর লোকজনের চেয়ে বেসরমারিক লোকজনই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় ১৯৭০-এর দশকে বিভিন্ন যুদ্ধে যারা নিহত হয়েছেন, তাদের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষই বেসামরিক জনগণ। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও এর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ লগ্নে জাপানের উপর যে নির্মম অত্যাচার চালানো হয়েছিল পারমাণবিক বোমা ফেলে পৃথিবীর মানুষ তা ভুলে যায়নি। মার্কিন বিমান বাহিনীর একটি বি-২৯ বিমান হিরোশিমার উপর যে পারমাণবিক বোমা ফেলেছিল তার ফলে সঙ্গে সঙ্গে ৮০ হাজার মানুষ নিহত হয়। আহত হয় আর ৭০ হাজার মানুষ। হিরোশিমা হামলার তিনদিন পরে নাগাসাকিতে দ্বিতীয় যে পারমাণবিক বোমা ফাটানো হয় সেই বোমাতেও তৎক্ষণাৎ ৪০ হাজার লোক প্রাণ হারায়। আহত হয় আরও প্রায় ৪০ হাজার। আর পারমাণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তায় গত অর্ধশতাব্দী ধরে প্রাণ হারাচ্ছে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ, কেউ কেউ পঙ্গু জীবন, বিকলাঙ্গ জীবন নিয়ে বেঁচে আছে কোনোরকম।
যুদ্ধে জাপানি জাতির হিং¯্রতাও পৃথিবীবাসী কমবেশি প্রত্যক্ষ করেছে। বিশেষ করে চীন-জাপান যুদ্ধে জাপানি বাহিনীর বর্বরতার ঘটনা সারাবিশ্বে অমানবিক দলিল হয়ে আছে। ১৯৩৭ সালের ৭ জুলাই জাপান ‘মার্কোপোলো’ ব্রিজের নাটক সাজিয়ে চীনের সঙ্গে পুরোদমে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিলে সেই যুদ্ধের রেশ ধরেই আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্র। চীনের রাজধানী নানকিং-এ ৫০ হাজার জাপানি সৈন্য প্রবেশ করে ছয়-সাত সপ্তাহ ধরে চালায় ধ্বংসযজ্ঞ। সেই সময় এই শহরে প্রায় ছয় লাখ লোক বাস করতো। তাদের অর্ধেককেই জাপানিরা হত্যা করে। হত্যা করার জন্য তারা যেসব পন্থা অবলম্বন করে সেগুলোর মধ্যে ছিলÑ গুলি করা, পেট কাটা, হৃৎপি- বের করে ফেলা, মু-চ্ছেদ করা, আগুনে পুড়িয়ে মারা, জান্ত মানুষকে মাটিতে পুতে মারা, মুগুর দিয়ে পিটিয়ে মারা ইত্যাদি। বলা হয়ে থাকেÑ জ্যান্ত মানুষকে জাপানি সৈন্যরা গুলি করার লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ব্যবহার করতো। এ ছাড়া জিভের সঙ্গে বড়শি বিঁধিয়ে ঝুলিয়ে হত্যা করা ও কোমর পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে কুকুর দিয়ে কামড়িয়েও মানুষ হত্যা করে। নানকিং যুদ্ধে জাপানিরা কে কতজনকে হত্যা করতে পারল এ নিয়ে সৈন্যদের মধ্যে প্রতিযোগিতাও দেখা গিয়েছিল। ধর্ষণ ছিল সেই যুদ্ধের খুবই সাধারণ ঘটনা। মেয়েদের দেয়ালের সঙ্গে পেরেক দিয়ে গেঁথে ধর্ষণ করানো হতো।
মার্কিন বাহিনীর ভিয়েতনাম আগ্রাসনও বিশ্বের ইতিহাসে কালো অধ্যায় হয়ে আছে। পৃথিবীর ইতিহাসে ভিয়েতনাম যুদ্ধ ছিল দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধগুলোর অন্যতম। এই যুদ্ধে তারা ৪০ লাখ মানুষের জীবন কেড়ে নেয়। ৫৮ হাজার মার্কিন সেনা নির্মমভাবে নিহত হয়। এছাড়া আহত ও পঙ্গু হয় আরও তিন লাখ মার্কিন সেনা। ইতিহাস বলে, একটি বানোয়াট অভিযোগের ভিত্তিতে আমেরিকা এই যুদ্ধ শুরু করেছিল। এমন একটি বানোয়াট অভিযোগে ২০০৩ সালে ইরাকেও তারা যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়, আমেরিকা তখন বলেছিল, ইরাকে গণবিধ্বসী অস্ত্র আছে, পরে দেখা যায়Ñ সবই মিথ্যা।
১২ আগস্ট ১৯৯০ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ইরাক এবং কুয়েতের মধ্যে যে যুদ্ধ বাঁধে তাকে উপসাগরীয় যুদ্ধ বলেই মানুষ জানে। অফিসিয়ালি এই যুদ্ধ সমাপ্ত হয় ৩০ নভেম্বর, ১৯৯৫ সালে। এই যুদ্ধে প্রায় দেড় লাখ লোক মারা যায়, আহত হয় আরো লক্ষাধিক মানুষ। যুদ্ধ শেষে ইরাক ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়। শুরুতেই বলেছিলাম উপমহাদেশের কথা। ভারতীয় উপমহাদেশে বেশ কয়েকবার যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং সে সব যুদ্ধের ভয়াবহতাও সামান্য নয়। একটি বিষয় লক্ষণীয় যে ১৯৭১ সালের যুদ্ধ ছাড়া ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যে তিনটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলÑ ১৯৪৭-৪৮, ১৯৬৫ ও ১৯৯৯Ñ এই তিনটি যুদ্ধই লেগেছিল কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে। কাশ্মীরের মূল ভূখ-ের প্রায় অর্ধেক ভারত নিয়ন্ত্রিত, এক তৃতীয়াংশের বেশি অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তানের আর বাকি অংশ চীনের নিয়ন্ত্রণাধীন। একাধিক বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কাশ্মীরকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য যুগ যুগ ধরে লড়াই করে যাচ্ছে। কাশ্মীর সমস্যা, ভারত-পাকিস্তানের জন্য কর্কটরোগে রূপ নিয়েছে। বর্তমান কাশ্মীর পরিস্থিতি নিয়ে ইতোমধ্যেই বিবদমান দেশ দুটি ছাড়াও অন্যান্য দেশও চিন্তার মধ্যে পড়েছে। অর্থনৈতিকভাবে ক্রমশ উন্নয়নশীল দক্ষিণ এশিয়ার দিকে রয়েছে বিশ্বসন্ত্রাসী আমেরিকার লোলুপ দৃষ্টি। যদি কোনো অজুহাতে দক্ষিণ এশিয়ায় বিশেষ করে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বাধানো যায়, তাহলে তার ফায়দা আমেরিকাই লুটবে। তাই কাশ্মীর সমস্যার রক্তপাতহীন সমাধান প্রয়োজনÑ যুদ্ধ মোটেই কাম্য নয়। এমনকি এই যুদ্ধ থেকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, যেমনটি ঘটেছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়।
একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বর্তমান বিশ্বে সামরিক শক্তির দিক দিয়ে আমেরিকা শীর্ষস্থানে রয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে রাশিয়া, চীন তৃতীয় ও ভারতের অবস্থান চতুর্থ স্থানে। ইরান ও পাকিস্তান আছে পঞ্চম ও ষষ্ঠ স্থানে। যদি ভারতের সঙ্গে সত্যি সত্যিই এবার পাকিস্তানের যুদ্ধ বাঁধে তাহলে সেই যুদ্ধ কতটা ভয়াবহ হবে তা সহজেই আন্দাজ করা যায়। ভারতের সামরিক বাহিনীতে আছে ১৩ লক্ষ ২৫ হাজার জন নিয়মিত সেনা, ১১ লক্ষ ৫৫ হাজার জন সংরক্ষিত সেনা এবং ১২ লক্ষ ৯৩ হাজার ৩ শত জন আধা সামরিক সেনা। ভারতের সামরিক ভা-ারে আছে ৫ হাজার ৯৭৮টি সাঁজোয়া ট্যাংক, ২টি বিমানবাহী যুদ্ধ জাহাজ। ৬টি উভচর যুদ্ধ জাহাজ, ১৫টি ডেস্ট্রয়ার যুদ্ধ জাহাজ, ২৮টি ফ্রিগেট, ১৮টি সাবমেরিন, ৯০১টি যুদ্ধ বিমান, ৯০ থেকে ১০০টি পরমাণু অস্ত্র।
অপরদিকে পাকিস্তানের আছে ৬ লক্ষ ১৭ হাজার জন নিয়মিত সেনা, রিজার্ভ আর্মি ৫ লক্ষ ১৩ হাজার জন, আধা সামরিক বাহিনীতে আছে ৩ লক্ষ ৪ হাজার জন সদস্য। পাকিস্তানের রয়েছে ৪ হাজারটি সাঁজোয়া ট্যাংক, ৪টি ডেস্টয়ার যুদ্ধ জাহাজ, ১৪টি ফ্রিগেট, ৮টি সাবমেরিন, ২৫০টি জঙ্গি বিমান, ১১০টি পরমাণু অস্ত্র। এসব বিপুল শক্তি নিয়ে যদি দুটি দেশ মুখোমুখি হয়, কি পরিমাণ রক্তপাত ও প্রাণহানি ঘটবে এটা অনুমান করে এখনই বিশ্বনেতাদের এ বিষয়ে সচেতন হওয়া দরকার। বিশ্ববাসী অনেক যুদ্ধ দেখেছে, আর যুদ্ধ দেখতে চায় না। যুদ্ধের বাণী প্রচার না করে এখন মানুষকে শান্তির পথে হাঁটা দরকার। পৃথিবীতে শান্তি বিরাজ করুক, বেঁচে থাকুক শিশু-বৃদ্ধ-নারী। মানব সভ্যতা ও প্রকৃতিকে ধ্বংস করে নয়, একে সুন্দর করেই বেঁচে থাক মানুষ।
মানুষকে যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য পৃথিবীর সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, সাহসী ভূমিকা নিতে হবে জাতিসংঘকে। জাতিসংঘে প্রস্তাব করা হোকÑ কোনো দেশ আর গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র উৎপাদন করতে পারবে না। যে সব দেশের হাতে মারণাস্ত্র আছে সে সব দেশকেও বাধ্য করতে হবে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র ধ্বংস করার জন্য। শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যেসব সাধারণ অস্ত্র দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরা ব্যবহার করেন, সেগুলোকে নিরাপত্তার স্বার্থে রক্ষা করে বাকি সব অস্ত্র সকল দেশের সম্মতিক্রমে ধ্বংস করার সময় এসেছে আজ। পৃথিবী এখন অস্ত্র ব্যবসা ও মাদক ব্যবসাই সবচেয়ে জমজমাট আর লাভজনক। নগদ মুনাফার লোভে ক্ষমতাসীন দেশগুলো আজ নির্বিচারে মারণাস্ত্র ও মাদক দ্রব্য উৎপাদন করছে এবং এগুলো বিক্রির জন্য দেশে দেশে সৃষ্টি করছে ইচ্ছাকৃত সংকট। বাঁধিয়ে দিচ্ছে যুদ্ধের মতো জীবনবিপন্ন পরিস্থিতি। মানুষের সদিচ্ছা আর জাতিসংঘের সাহসী ভূমিকাই পৃথিবীকে এখন যুদ্ধ ও মারণাস্ত্রের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। পৃথিবীতে এই মুহূর্তে যে পরিমাণ মারণাস্ত্রের মজুদ আছে তা দিয়ে কয়েকবার পৃথিবীকে ধ্বংস করা যাবে। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজ যোগ্যতাবলে আজ বিশ্বনেতায় পরিণত হয়েছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব রেখে তিনি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ও শ্রদ্ধা কুড়িয়েছেন। আমরা আশা করবো, তিনিও যুদ্ধ ও যুদ্ধাস্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিবেন এবং জাতিসংঘে প্রস্তাব উত্থাপন করবেন।
বিংশ শতাব্দীর ¯œায়ুযুদ্ধের সময় রাশিয়া ও আমেরিকা অস্ত্র উৎপাদনের খেলা খেলতে গিয়ে রাশিয়া দারুণভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। টুকরো টুকরো হয়ে যায় রাশিয়া। আমেরিকাও যদি আজ এই অস্ত্রের খেলা বন্ধ না করে, তাহলে তার অবস্থাও হবে রাশিয়ার মতো। ইতোমধ্যে আমেরিকা অর্থনৈতিক ক্ষতির মধ্যে পড়েছে, অনাগত ভবিষ্যতে যে আমেরিকাও খ–বিখ- হবে না, তার গ্যারান্টিও কেউ দিতে পারে না।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা ও শান্তিকামী রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে আমরা বলতে চাইÑ ‘যখন প্রশ্ন আসে যুদ্ধ না শান্তি?/ আমরা জবাব দেই শান্তি শান্তি শান্তি!/ আর যুদ্ধ নয়, নয়/আর ধ্বংস নয় নয়/আর নয় শিশুদের মায়েদের কান্না হাহাকার।’
০৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬