১০ জানুয়ারি ১৯৭২ : স্বর্ণাক্ষরে লেখা ঐতিহাসিক দিন
মোনায়েম সরকার
লন্ডনের হোটেল ‘ক্ল্যারিজস’। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ঐ দিনই লন্ডনে পৌঁছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিুবর রহমান। হোটেল লবিতে জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি যতদ্রুত দেশে ফিরতে চাই। আমার জনগণকে ছেড়ে আমি এক মুহূর্ত শান্তি পাচ্ছি না।’ মহান নেতার এ কথায় অভিভূত হয়ে পড়েন ব্রিটেনের সাংবাদিকরা। প্রায় দশ মাস পাকিস্তানের কারাগারে একাধিকবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা মহান পুরুষ মুক্তি লাভ করে আগে ভাবছেন তার দেশের জনগণের কথা। স্মরণ করেছেন মুক্তিযুদ্ধে বাংলার জনগণের আত্মত্যাগের কথা। বিশ্বের সাংবাদিকদের জন্যে অভিভূত হবার মতো বিশাল ঘটনা তখনো অপেক্ষা করছিলো সামনে। দিল্লী হয়ে ঢাকা ফেরার পথে ভারতের জনগণ যে রাজকীয় সংবর্ধনা দিয়েছিলো বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে, তাতে মুগ্ধ হয়েছিলো সারা বিশ্বের মানুষ। চমৎকৃত হয়েছিলো ১০ জানুয়ারি ঢাকার চিত্র দেখে। মুক্তিকামী একটি জাতির হৃদয়জ আশা-আকাক্সক্ষার কতটা ধারণা করতে পারলে বঙ্গবন্ধুর মতো বিশাল ব্যক্তিত্ব হওয়া যায়, সারা বিশ্ব তা উপলব্ধি করেছিলো।
২৫ মার্চ রাতে পাক বাহিনীর হাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হলেন। দীর্ঘ ন’মাসের যুদ্ধ শেষে বিজয় অর্জন করলো বাঙালি। কিন্তু বিজয়ের সে আনন্দ যেন অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছিলো। যে মহামানবকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে মুক্ত করে আনতে ’৬৯ এ বাংলার মানুষ সেনাবাহিনীর ব্যারিকেড ভাঙার জন্যে উন্মুক্ত হয়ে উঠেছিলো, যে মহানায়ক ’৭১-এর ৭ মার্চ চূড়ান্ত সংগ্রামের প্রস্তুতি নেবার নির্দেশ দিয়ে জনতাকে উজ্জীবিত করলেন তাঁর অনুপস্থিতিতে বাংলার মানুষ বিজয়ের পূর্ণাঙ্গ আনন্দ পাচ্ছিলো না। যুদ্ধকালীন নয় মাস বাংলার ঘরে ঘরে নির্যাতিত মানুষ প্রার্থনা করেছে বঙ্গবন্ধুর জন্যে। বিজয় অর্জনের পর ২৫ দিন আশঙ্কার দোলাচলে দুলেছে মানুষ। অবশেষে জানা গেলো বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন। দেশে আসছেন। সে সংবাদ পাবার পর গোটা দেশে কি পরিমাণ আনন্দের জোয়ার বয়ে গিয়েছিলো তা প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়া আর কেউ অনুভব করতে পারবে না।
জানুয়ারির ৮ তারিখে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। রাওয়ালপিন্ডি বিমানবন্দর থেকে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজের ৬৩৫ নং ফ্লাইটটি লন্ডনে পৌঁছালে ব্রিটেনের পররাষ্ট্র এবং কমনওয়েলথ অফিসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিমান বন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান। এ সময় ব্রিটেন প্রবাসী বাঙালিদের গগণবিদারী ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে বিমানবন্দর।
লন্ডনে বঙ্গবন্ধু হোটেল ‘ক্ল্যারিজস’এ ওঠেন। এখানে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি কথা বলেন। তাঁর প্রতি সাংবাদিকদের প্রথম প্রশ্ন ছিলো, তিনি কেন ঢাকা না গিয়ে প্রথমে ব্রিটেনে এসেছেন। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি স্বেচ্ছায় আসিনি। আমাকে লন্ডন পাঠানোর সিদ্ধান্ত পাকিস্তান সরকারের। আমি তাদের বন্দি ছিলাম।’
লন্ডনে অবস্থানকাল সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি সুনির্দিষ্ট সময় জানতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে তিনি জানান, লন্ডন ত্যাগের আগে তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। বঙ্গবন্ধু’র এ কথা প্রচারের কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্রিটেনের সরকারি কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেন, প্রধানমন্ত্রী এ্যাডওয়ার্ড হীথ এর সঙ্গে সন্ধ্যায় তার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু তার বন্দি জীবনের কথা তুলে ধরেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা প্রসঙ্গে মতামত ব্যক্ত করতে অনুরোধ জানানো হলে তিনি বলেন, ‘আমি বন্দি ছিলাম। অনেক কিছুই আমার জানার উপায় ছিলো না। আমি ঢাকায় ফিরে আমার দেশবাসীর কাছে সব জানবো।’
ব্রিটিশ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতকি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত এ সংবাদ সম্মেলন সম্পর্কে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ৫১ বছর বয়সী সুঠামদেহী শেখ মুজিবুর রহমানকে বেশ কৃশকায় দেখাচ্ছিলো। দীর্ঘ দিনের বন্দি জীবনের ছাপ পড়েছিলো তার চেহারায়। তা সত্ত্বেও তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিটি কথা উচ্চারণ করেছেন। যত দ্রুত দেশে ফেরার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমি আমার জনগণকে ছেড়ে আর এক মুহূর্ত শান্তি পাচ্ছি না। তারা প্রত্যেকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে চরম মূল্য দিয়েছে।’ ২০ মিনিট সংবাদ সম্মেলন শেষে বঙ্গবন্ধু জানান তিনি খুব ক্লান্ত। দৃঢ় কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করে তিনি তার বক্তব্য শেষ করেন। এ সময় হোটেলের বাইরে সমবেত প্রবাসী বাঙালিরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে পুরো এলাকা প্রকম্পিত করে তোলে।
এদিকে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তান সরকার বেশ কিছু সময় নীরবতা অবলম্বন করে। রাত তিনটায় রেডিও পাকিস্তান থেকে ঘোষণা দেয় হয়, ‘শেখ মুজিব’ বর্তমানে লন্ডনে রয়েছেন। তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো বিমানবন্দরে ‘শেখ মুজিব’কে বিদায় জানিয়েছেন।
এ ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত বাংলার আপামর জনগণের মধ্যে উৎকণ্ঠা বিরাজ করছিলো। ৮ তারিখেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়ার দাবি জানিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভুট্টো যদি পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষা এবং ভারতীয় উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চান, তাহলে অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে দিন।’ তাজউদ্দিন বলেন, ‘আমরা আমাদের প্রিয় নেতাকে মুক্ত করতে যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ভয় পাই না।’ তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আমেরিকা ও চীনের ন্যাক্কারজনক ভূমিকার তীব্র নিন্দা জানান।
ঐদিন সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের সঙ্গে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিট-এ সাক্ষাৎ করেন। এ সাক্ষাতের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা হয়ে থাকবে। বাংলাদেশ তখন সদ্য স্বাধীন একটি দেশ। রাষ্ট্র হিসেবে ব্রিটেনের তুলনায় কিছুই নয়। অথচ মহাপরাক্রমশালী ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী সে সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর বাসার সামনে। বৈঠকে শেখ মুজিবুর রহমান ব্রিটেন কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টি উত্থাপন করেন। এডওয়ার্ড হীথ যথাসম্ভব স্বল্পতম সময়ে স্বীকৃতিদানের আশ্বাস দেন। প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের পর কমনওয়েলথ এর সেক্রেটারি জেনারেল আর্নল্ড স্মিথ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার হোটেল কক্ষে গিয়ে সাক্ষাৎ করেন। পরদিন ৯ জানুয়ারি ভোরে বঙ্গবন্ধু দিল্লির উদ্দেশ্যে লন্ডন ত্যাগ করেন।
১০ জানুয়ারি দিল্লি পৌঁছেন বঙ্গবন্ধু। ব্রিটেনের রয়েল এয়ার ফোর্স কমেটে দিল্লি বিমানবন্দরে অবতরণ করে। উজ্জ্বল সূর্যালোকে দৃপ্ত পায়ে বিমান থেকে নেমে আসেন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনতার নয়নের মণি। এই সময় তার পরণে ছিলো গাঢ় ধূসর রঙের স্যুট এবং কালো ওভারকোর্ট। তিনি বিমান থেকে নামার আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ বিমানে প্রবেশ করেন। সেখানে তিনি কয়েক মিনিট তীব্র আবেগে জড়িয়ে ধরেন প্রিয় নেতাকে। ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচরের আলিঙ্গনমুক্ত হয়ে কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধু নেমে আসেন। ২১ বার তোপধ্বনি করে ভারত অভিবাদন জানায় বাংলাদেশের মহান নেতাকে। ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি স্বাগত জানান বঙ্গবন্ধুকে। বিশ্বের ২০টির বেশি রাষ্ট্রের কূটনীতিকরা উপস্থিত ছিলেন। তিন বাহিনীর একটি চৌকষ দল তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। পুরো এলাকা বাংলাদেশ ও ভারতের পতাকায় সজ্জিত ছিলো। আমাদের প্রিয় জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ এবং ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ‘জনগণমন অধিনায়ক’ বাজছিলো যখন বঙ্গবন্ধু তিন বাহিনীর স্যালুট গ্রহণ করছিলেন। দিল্লি সেনানিবাসে বঙ্গবন্ধু একটি জনসভায় ভাষণ দেন। এ সময় এক মাইলের বেশি এলাকা জুড়ে মানুষ গিজ গিজ করছিলো, সবাই শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে একনজর দেখার প্রত্যাশা নিয়ে ছুটে এসেছিলো। এরপর বঙ্গবন্ধু একটি মার্সিডিজ বেঞ্চ গাড়িতে চড়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে যান। পুরোটা পথের দুধারে সুসজ্জিত ব্যানার ছিলো। যাতে লেখা ছিলো, ‘বাংলাদেশের ¯্রষ্টা দীর্ঘজীবী হোক’, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার নায়ক দীর্ঘজীবী হোক।’ শত শত মোটর গাড়ি অনুসরণ করছিলো রাষ্ট্রীয় অতিথির গাড়ি বহরকে। সেদিনই বঙ্গবন্ধু ঢাকার উদ্দেশ্যে দিল্লি ত্যাগ করেন।
সকাল থেকেই বাংলাদেশের মানুষ অপেক্ষা করছিলো। ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণের পূর্বে ব্রিটিশ এয়ার ফোর্স এর কমেট বিমানের পাইলটরা বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে প্রায় পৌনে একঘণ্টা বিমানটিকে নিয়ে ঢাকার আকাশে চক্কর দেন। বঙ্গবন্ধু বিমান থেকে প্রাণভরে দেখেন তাঁর সোনার বাংলাকে।
অবশেষে এলো সেই বহু প্রতীক্ষিত ক্ষণ। পাকিস্তানের কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে একাধিকবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা মহান নেতা এসে দাঁড়ালেন তার প্রিয় জনগণের মধ্যে। বাংলার মানুষ আন্দাশ্রু আর ফুলের মালায় বরণ করে নিলো প্রিয় নেতাকে। পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের ইজেলে আঁকা স্বাধীনতা নামক অমর চিত্রে তুলির শেষ আঁচড় পড়লো। পূর্ণ হলো স্বাধীনতার আনন্দ। যার বহিঃপ্রকাশ হৃদয়ের গভীরতম অনুভবে চোখের জল হয়ে ঝরে পড়েছিলো বাংলার পবিত্র মাটিতে। ৩১ বার তোপধ্বনি হয় তেজগাঁ বিমানবন্দরে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এবং মন্ত্রী পরিষদ সদস্যরা স্বাগত জানান প্রিয় নেতাকে। অগণিত ফুলের মালা আর লাখো জনতার ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানের মধ্যে অশ্রুসিক্ত বঙ্গবন্ধু জড়িয়ে ধরেন প্রিয় জনগণকে। তাকে বহনকারী গাড়িটি জনতার ভিড়ে অত্যন্ত ধীরগতিতে এগুতে থাকে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের দিকে।
তেজগাঁও পুরানো বিমানবন্দর থেকে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীদের বহনকারী ট্রাকটি লক্ষ লক্ষ জনতার মধ্য দিয়ে পিঁপড়ার মতো হেঁটে প্রায় দু’ঘণ্টায় ঐতিহাসিক সেই রমনার ময়দানে পৌঁছে। বঙ্গবন্ধু আবার এসে দাঁড়ালেন, যেখান থেকে তিনি শেষ আহ্বান বাঙালি জাতিকে জানিয়েছিলেন : ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’
ইয়াহিয়ার বন্দিশালার দুর্বিসহ নিঃসঙ্গতা আর চিন্তায় শুকিয়ে যাওয়া দীর্ঘদেহী বঙ্গবন্ধু লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ মুছতে মুছতে যখন বললেন : ‘আমি আবার আপনাদের কাছে এসেছি। লক্ষ লক্ষ ভাই, মা আর বোন নিজেদের জীবনের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন, আমাকে মুক্ত করেছেন। আমার প্রতি ভালোবাসার কোনো পরিমাপ নেই। এর কোনো প্রতিদান আমি দিতে পারিনে…” তখন এমন কোন বাঙালি মাঠে ছিল না, যার নিজের চোখেও পানি জমেনি এবং আবেগে গলাটা রুদ্ধ হয়ে আসেনি।
কান্না ছিলো সেদিনের একমাত্র কণ্ঠস্বর। তিনি কাঁদছিলেন। কাঁদছিলো লাখো মানুষ। যুগে যুগে অনেক কেঁদেছে বাঙালি, অনেক কান্না বুকের রক্ত হয়ে ঝরেছে। কিন্তু সেদিনের প্রেক্ষপট ছিলো ভিন্ন। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির জন্যে অসীম মমতার আবাস যে মহামানবের বুকে, তাঁকে ফিরে পাবার আনন্দে উদ্বেল বাঙালি অঝোরে কেঁদেছে ১৯৭১-এর ১০ জানুয়ারি। আর তিনি কাঁদছিলেন তার প্রিয় মাতৃভূমিতে প্রাণাধিক প্রিয় জনতার মাঝে আসতে পেরে।
মহান ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত অধ্যায় সংঘাতের প্রথম স্মারক। এরপর থেকে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ এগিয়ে নিয়েছেন বাঙালিকে জাতি হিসেবে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের পথে। কিন্তু তাদের কেউই চেতনার ভিত্তিমূলে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার বিদ্রোহী অনুভবে উদ্দীপ্ত করতে পারেননি বাংলার মানুষকে। যা সম্ভব ছিলো একমাত্র বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই। আর তাই ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে বাঙালি স্বাধীনতার পূর্ণ-আলোকে উদ্ভাসিত হয়েছিলো।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ২১টি বছর শাসকগোষ্ঠী নানানভাবে চেষ্টা করেছে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার। কিন্তু সত্যকে অস্বীকার করে মিথ্যার রাজত্ব কতদিন চলে? আকাশে যখন সূর্য ওঠে, আঁধার পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সন্ধ্যা নেমে এলে নিঃশব্দ আততায়ীর মতো আবারো আঁধার হানা দেয়। ’৭৫-এর পনেরো আগস্ট আঁধার হানা দিয়েছিলো বাংলার জনপদে। ২১ বছর বছর পর আবারো মাথা উঁচু করে বাংলাদেশ অভিষিক্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শানিত সূর্যালোকে। সূর্যের ন্যায় উদিত হয়েছে জাতির জনক তাঁর স্ব-মহিমায়। এ সূর্য, এ আলোকিত দিন কখনো হারাবার নয়। ঝোপ-ঝাড়ের আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকা আঁধাররূপী দানবীয় শক্তির উত্থান যাতে আর কখনো ঘটতে না পারে, সে দায়িত্ব নিতে হবে নতুন প্রজন্মকে। বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশকে জানতে হবে। জাতির জনকের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ৪৮তম বার্ষিকীতে সে দায়িত্ব পালনে অবিচল থাকার অঙ্গীকারই করতে হবে নতুন প্রজন্মকে। বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানার জন্যে এ প্রজন্মের প্রতি অনুরোধ থাকবে সত্যের সন্ধ্যানে ব্রতী হবার। শিকড়ের সন্ধান করার। শতাব্দীর মহানায়ক বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বিগত বছরগুলোতে তার দৃঢ় নেতৃত্বে বাংলাদেশকে প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক ধারায় প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের পুনর্জন্ম ঘটিয়েছেন উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
০৯ জানুয়ারি, ২০১৯
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের পুনর্জন্ম
মোনায়েম সরকার
বাংলাদেশ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। একদিন এদেশের হাতে ছিল পরাধীনতার হাতকড়া। শোষণ-বঞ্চনা-নিপীড়ন ছিল এই দেশ তথা বাংলার মানুষের ভাগ্যলিখন। নিজেদের অধিকার বুঝে পেতে বাংলার নিরীহ মানুষ শোষণ-দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জেগে ওঠে। অনেক প্রাণ ও রক্তের বিনিময়ে তারা অর্জন করে প্রিয় স্বাধীনতা। বাংলার স্বাধীনতা বারবার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, দেশি-বিদেশি চক্রান্তে বারবার দিকভ্রান্ত হয়েছে বাংলার স্বপ্নতরী। সেই ধারার বাইরে এনে যে মানুষটির মহান নেতৃত্ব বাংলাদেশকে আজ মর্যাদার আসনে আসীন করেছে তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার জন্য কোনো প্রশংসাই আজ আর যথার্থ নয়। তিনি সকল প্রকার প্রশংসার ঊর্ধ্বে। একটি নিমজ্জিত দেশকে, একটি অন্ধকার আচ্ছন্ন পতিত জাতিকে তিনি যেভাবে বদলে দিয়েছেন পৃথিবীর ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত আসলেই বিরল।
৩০ ডিসেম্বর, ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনকে ঘিরে শুরু থেকেই তৈরি হতে থাকে একের পর এক নাটক। এই নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত দুটি ধারা লক্ষ্য করা যায়। একটি ধারা বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, অন্যটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে নেতৃত্ব দেন শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অবিশ্বাসীরা এক হতে থাকে ড. কামাল হোসেনসহ আরো বেশ কয়েকজনের নেতৃত্বে।
শুরু থেকেই নির্বাচন নিয়ে দেশের সাধারণ জনগণের মাঝে বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। সারাদেশ মেতে ওঠে ভোটের উৎসবে। শেখ হাসিনার শাসনামলের পূর্বের বাংলাদেশ আর পরের বাংলাদেশ এক বাংলাদেশ নয়। যারা এক বাংলাদেশ মনে করে তাদের দৃষ্টিতে কোনো নতুনত্ব খুঁজে পায় না বলেই এদেশে এখনো স্বাধীনতার বিরুদ্ধ শক্তি ভোটের মাঠে লড়াই করার সাহস পায়। অনেক সুশীলের ভাবখানা এমন ছিল যেন স্বাধীনতাবিরোধীরাই আবার ক্ষমতায় বসতে যাচ্ছে। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষের মতো আমারও আস্থা ছিল জনতার প্রতি। আমি বিশ্বাস করি বাংলার মানুষ কখনোই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিবে না। তারা ঠিকই শেষ পর্যন্ত সঠিক সিদ্ধান্ত নিবে। নিয়েছেও তাই। এবারের নির্বাচনে বাংলাদেশের পুনর্জন্ম হয়েছে। আমি এই পুনর্জন্মপ্রাপ্ত বাংলাদেশ সম্পর্কে দুই একটি কথা বলতে চাই। কথাগুলো শুনতে কেমন লাগবে জানি না। তবে সবগুলো কথাই ঐতিহাসিকভাবে সত্য ও গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে আমি কিশোর ছিলাম। সেই নির্বাচনের একটি ঘটনা এখনো আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। আমি তখন দেখেছিলাম বাংলার মানুষ কিভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে যুক্তফ্রন্টকে নির্বাচিত করেছিল। সেই সময় সাধারণ ভোটারের লাইনে এসে অকারণে পুলিশ লাঠিপেটা করেছে। ভোটাররা পুলিশের লাঠির বাড়ি খেয়ে পুকুরে পড়ে গেছে। পুকুর থেকে উঠে এসে ভেজা কাপড় নিয়ে আবার লাইনে দাঁড়িয়েছে তার পছন্দের প্রার্থী ও দলকে ভোট দিয়ে জয়ী করার জন্য। ঘটনাটা বলা হলো এই কারণে যে, মানুষ যখন পরিবর্তনের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে তখন কোনোভাবেই তাদের দমিত করে রাখা যায় না। নৌকার পক্ষে এবার যে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল এর সঙ্গে কেবল ’৭০ সালের নির্বাচনেরই তুলনা হতে পারে।
এবারের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার পক্ষে যে গণজোয়ার তৈরি হয়েছিল সত্যিই তা অবিশ্বাস্য। বিগত দশ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার যে পরিমাণ উন্নয়ন করেছে, দেশসেবা করেছেÑ বাংলার মানুষ আওয়ামী লীগকে এই নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করেছে। ইতিহাস সৃষ্টি করেছে নৌকাকে বিস্ময়করভাবে জয়ী করে। এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্বাধীনতাবিরোধীরা আখ্যা দিয়েছে ‘ভোট-ডাকাতি’ বলে। যারা বাংলাদেশের জন্মকে রোধ করতে চেয়েছে, যারা এখনও মেনে নেয় না বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য-অস্তিত্বকে তাদের পক্ষে বাংলাদেশের কোনো কিছুই সুন্দর নয়। তারা সব সুন্দরের ভেতর থেকেই খুঁত বের করার চেষ্টা করে। এবারও তাই করেছে। যে নির্বাচনকে ঘিরে এত উচ্ছ্বাস, এত আনন্দ, জনতার এত স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণÑ যে নির্বাচনকে দেশি-বিদেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষকগণ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন বলে ঘোষণা করেছেনÑ কিভাবে সেই নির্বাচনকে ঘিরে ভোট-ডাকাতির বদনাম রটানো হলো তা দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। দেশবিরোধী শক্তিরা এখনো মনে করে ওরাই দেশ শাসন করবে। বাংলাদেশের সচেতন মানুষ ওদের ক্ষমতায় বসাবে। বাংলাদেশে এমন অসম্ভব ঘটনা ঘটা কি আদৌ সম্ভব? একাত্তরের পরাজিত শক্তিরা এ দেশের মাটিতে আর কখনোই পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ পাবে না। এবারের গণরায়ে সেই বিষয়টিই নিশ্চিত হয়েছে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তিকে নির্বাচিত করে তরুণ ভোটাররা এই কাজটি খুব আগ্রহের সঙ্গে করেছে।
এবারের নির্বাচনে নিষ্প্রাণ বিএনপি অর্ধডজন আসন পাওয়ায় জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন বিএনপির ভাগ্যে একটি আসনও জোটার কথা নয়। অথচ তারা এতগুলো আসন কিভাবে পেল। আবার কেউ বলছেন, বিএনপিকে কমপক্ষে ৫০টি আসন দেওয়া উচিত ছিল। অর্থাৎ ভাবখানা এমন যেমন আসন দেওয়া-না দেওয়া সরকারের হাতে। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। জনগণ তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করে যাকে নির্বাচিত করবে সেই নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করবে। গণরায়কে কমানো-বাড়ানো জনতার পক্ষেই সম্ভব, সরকারের পক্ষে নয়। সুতরাং সরকারকে মিথ্যা দোষারোপ করে কোনোই লাভ নেই। নিজেদের দোষ-ত্রুটি শুধরে আগামী নির্বাচনের জন্য তৈরি হওয়াই এই মুহূর্তে বিএনপির জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে। যার বা যাদের ঘাড়ে চড়ে বিএনপি নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে চেয়েছিল তাদের কারো আমলনামাই ভালো নয়। এরা বেশির ভাগই পতিত আওয়ামী লীগার। পরিত্যক্ত আওয়ামী লীগারের কাঁধে চড়ে নির্বাচনের নদী পার হতে চেয়ে বিএনপি শুধু ভুল করেনি, তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব প্রকাশ করেছে। এরা যে অর্ধডজন আসন পেয়েছেÑ এটাই তো এই মুহূর্তে বিস্ময়কর ঘটনা। যারা আগুন-সন্ত্রাস করেছে, পেট্রোল বোমা মেরে জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে, যারা নিরীহ মানুষের জনসভায় বোমা হামলা চালিয়েছে, নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে। জনগণ তাদের ভোট দেবে কেন? বিএনপির ২৮৬ জন প্রার্থীর মধ্যে ১৬৩ জন প্রার্থীই জামানত হারিয়েছেন। তাদের সবারই জামানত হারানোর কথা ছিল। সেটা হলেই রচিত হতো নতুন ইতিহাস।
আমি এ প্রসঙ্গে ’৫৪ সালের মুসলিম লীগ মন্ত্রী টি. আলীর কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাইÑ যার একটি ভোটের দাম পড়েছিল ৭৭০০ টাকা। তিনি ভেবেছিলেন বিজয়ী হবেন, পরে দেখা গেছে তিনি জামানতও রক্ষা করতে পারেননি। নির্বাচনটা আসলে এমনই। জনগণ কখন কাকে কিভাবে নামাবে-ওঠাবে তা কেবল জনগণই জানে। এ প্রসঙ্গে ১৯৯১ সালের কথা বলা যেতে পারে। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ের ব্যাপারে শত ভাগ আশাবাদী ছিল, কিন্তু ভোটের ফলাফল ছিল ঠিক উল্টো। ভোটের মারপ্যাঁচে পড়ে নিশ্চিত জয়ও রূপান্তরিত হয় নিশ্চিত পরাজয়ে। এবারের এই সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনেও এই ঘটনাটি ঘটেছে।
বিজয়ী আওয়ামী লীগকে এবং জননেত্রী শেখ হাসিনাকে আমি অভিবাদন জানাই। সেই সঙ্গে তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাইÑ আপনার হাতেই এখন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। বাংলার মানুষ ভালোবেসে আপনার হাতে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির শাসনভার স্বেচ্ছায় তুলে দিয়েছে। এবার আপনি আপনার নির্বাচনী ইশতেহারে যেসব অঙ্গীকার করেছেন সেগুলো অবশ্যই বাস্তবায়ন করবেন। দেশ থেকে দুর্নীতি বিদায় করতে যে যে পথ অনুসরণ করা দরকার আপনি সেসব পথই অনুসরণ করুন।
বাংলাদেশকে আপনি উন্নত বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে যে স্বপ্ন বুনে চলেছেন সেই স্বপ্ন আপনার হাতে বাস্তবায়ন হোক এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা। আওয়ামী লীগের এক সময় যারা প্রাণপুরুষ ছিলেনÑ যেমন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামানসহ অনেকেরই গাড়ি-বাড়ি ছিল না। কিন্তু আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা ছিল। এখন পরিস্থিতি বদলেছে নিশ্চয়ই, তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ থাকতেই হবে। ব্যবসায়ীদের দলীয় বৃত্তের বাইরে রাখাই সঙ্গত হবে। ব্যবসায়ীরা কখনোই দলের দুঃসময়ে দলের পাশে থাকে না। দলছুট হাইব্রিড নেতারাও দুঃসময়ে দল থেকে কেটে পড়ে। সুতরাং আগামী দিনের প্রতিটি সিদ্ধান্তই ভেবেচিন্তে গ্রহণ করতে হবে। উন্নয়নের মহাসড়কে যে বাংলাদেশ ছুটে চলছে তার গতি ঠিক রেখে আরো বেগবান করার পাশাপাশি বাংলাদেশের পুনর্জন্ম শেখ হাসিনার হাতেই পূর্ণতা পাবে, ষোলো কোটি মানুষের মতো আমিও এ কথা বিশ্বাস করি।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
০১ জানুয়ারি, ২০১৯
যেসব কারণে আওয়ামী লীগের জয় অবশ্যম্ভাবী
মোনায়েম সরকার
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল কি হবে এটা নিয়ে এখনই নানা মনে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে। তবে সকলেই একটি বিষয়ে নিশ্চিত আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগই সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। আমি এর পূর্বে বেশ কয়েকটি লেখা লিখেছি আওয়ামী লীগকে নিয়েÑ সেসব লেখার একটি হলোÑ ‘আওয়ামী লীগের বিজয় কেন জরুরি’। এই লেখাটি পড়ে অনেকেই আমাকে টেলিফোনে, ই-মেইলে, মেসেঞ্জারে ধন্যবাদ জানিয়েছেন এবং এ বিষয়ে আরো লেখা প্রত্যাশা করেছেন। সে কারণেই আজকের এই লেখার সূত্রপাত।
আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন রাজনৈতিক দল। এই দলের প্রতীক ‘নৌকা’ মূলত বিজয়েরই প্রতীক। নৌকা মার্কা হক-ভাসানীর ছিল, শেখ মুজিবের নৌকা সত্তরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশভাবে জয়ী হয়েছিল। নৌকা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বিজয়ের বন্দরে পৌঁছেছিল। ২০০৮ সালেও নৌকা মার্কা জয়ী হয়ে বাংলাদেশে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। নৌকাই এখন উন্নয়ন আর সম্মান বয়ে আনছে বাংলাদেশের মানুষের জন্য। সুতরাং যে নৌকার এত অবদান সেই নৌকার বিজয় ঠেকানো আজ আর কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।
আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ী হওয়ার অনেকগুলো কারণ আছে। এই কারণগুলো একে একে তুলে ধরলে দেখা যাবে এককভাবেই আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে পারবে। আওয়ামী লীগের মতো একটি শক্তিশালী দল এককভাবে সরকার গঠন করতে না পারা অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। এককভাবে সরকার গঠন করতে হলে আওয়ামী লীগের অর্জনগুলো বিভিন্নভাবে জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগই সেই দল যে দলের হাত ধরেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বিস্ময। আজ প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে চমক দেখাচ্ছে তাতে অভিভূত না হওয়ার কোনো কারণ নেই। ভিক্ষুকের জাতি থেকে বাঙালিকে শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগ স্বনির্ভর জাতিতে রূপান্তরিত করেছে এটা শুধু গৌরবের বিষয় নয়, অহংকার করার মতো ঘটনাও বটে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জাতির জনকের হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও একুশে আগস্টের নৃশংস গ্রেনেড হামলার বিচার করে বাংলাদেশের বিচারহীন পরিবেশে ন্যায় বিচারের দৃষ্টান্ত প্রতিস্থাপন করেছে। স্ব-অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ করে প্রমাণ করেছে দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা। এছাড়া পায়রা বন্দর, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবার যে দৃষ্টান্ত রেখেছে তার কোনো তুলনা নেই।
গত দশ বছরের বাংলাদেশ আর তার আগের বাংলাদেশ কোনোভাবেই এক নয়। দুই সময়ের বাংলাদেশের মধ্যে আছে আকাশ-পাতাল ফারাক। এই ফারাকটুকু জনগণকে বুঝতে না পারলে জনগণ গুজবে কান দিয়ে বিভ্রান্ত হতে পারে। জনগণ বিভ্রান্ত হলে আওয়ামী লীগের ভোট কমবে। সুতরাং সঠিকভাবে প্রতিটি অর্জনের প্রচার জনগণের মধ্যে করতে পারলে বিজয় নিয়ে ভাবতে হবে না। আওয়ামী লীগ উন্নয়নের দল। তাদের জন্মই হয়েছিল সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করার জন্য। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানায় বাঙালি চিরদিন সুখে-শান্তিতে হাসিমুখে জীবনযাপন করবে এটাই ছিল আওয়ামী লীগের আকাক্সক্ষা। সেই আকাক্সক্ষা এত দিনে নানা কারণে বাস্তবায়ন হয়নি। সেই কারণগুলো আমাদের সবারই কমবেশি জানা আছে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা-বিরোধীরা শুরু থেকে প্রচার-প্রপাগা-া চালিয়ে বাংলার মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। সেই চেষ্টা এখনও সক্রিয় আছে। হয়তো অনুকূল পরিবেশ পাচ্ছে না বলে স্বাধীনতা-বিরোধী পরাজিত শক্তি নিশ্চুপ আছে, তবে তারা একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়নি। জঙ্গিরা যেভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠে বাংলাদেশে তা-ব সৃষ্টি করেছিল, আওয়ামী লীগই জঙ্গিদের কঠোর হাতে দমন করে বাংলাদেশকে জঙ্গিমুক্ত করেছে। এ কারণেও আওয়ামী লীগ জনতার ভোট পাওয়ার দাবিদার এবং আওয়ামী লীগের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে প্রবল। মানুষ আজ বুঝতে পারছে, দেশের মঙ্গল ও জনগণের কল্যাণ কেবল আওয়ামী লীগের পক্ষেই সম্ভব। অন্যান্য দল কখনোই বাংলাদেশের মঙ্গল চায় না। তাদের অতীত অত্যন্ত কলুষিত। বর্তমান নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ, তাদের ভবিষ্যৎ অজানা, অন্ধকার। সুতরাং বাংলাদেশের রাজনীতিকে বিশুদ্ধ ধারায় নিয়ে যেতে হলে আওয়ামী লীগকেই জনগণ বিপুল ভোটে নির্বাচিত করবে।
আগে মানুষ নির্বাচনী ইশতেহার খুব একটা গুরুত্ব দিত বলে মনে পড়ে না। এবার দেখছি বিভিন্ন দলের নির্বাচনী ইশতেহার নিয়েও পত্র-পত্রিকায়, টকশোগুলোতে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এটাকেও আমি ইতিবাচক দিক বলেই মনে করি। বিশ্লেষকরা বলার চেষ্টা করছেন এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বড় চমক হলো আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার। এই ইশতেহার জনগণের মধ্যে ব্যাপক আশার সঞ্চার করেছে। যুব সমাজকে আশার আলো দেখিয়েছে। আগামী একশ’ বছরে বাংলাদেশ কোথায় যাবে তার একটা নিখুঁত ও কাক্সিক্ষত লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এই ইশতেহারে বাংলাদেশের মানুষ স্বস্তিবোধ করছে। সুতরাং নির্বাচনী ইশতেহারের কারণেও আওয়ামী লীগের জয়ের পালে কিছুটা অনুকূল বাতাস লাগবে বলে মনে করা যায়।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী পরিচালনা কমিটিতে দুইবার কাজ করার সুযোগ হয়েছিল আমার। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে আমরা যখন নির্বাচন পরিচালনা করেছি, তখনকার নির্বাচন আর এখনকার নির্বাচন এক না হলেও খুব বেশি পার্থক্য আছে বলে আমি মনে করি না। আমার স্পষ্ট মনে আছেÑ নির্বাচনী ইশতেহার আওয়ামী লীগ যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই তৈরি করে থাকে। তারা এমন এমন কিছু বিষয় তুলে ধরতে চায়, যে বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করলে সত্যি সত্যি দেশ এগিয়ে যাবে। এবারের ইশতেহারেও সেসব বিষয় লক্ষ্য করে আওয়ামী লীগের বিজয়ে আশাবাদী হয়ে উঠছি।
আওয়ামী লীগ এখন নির্ভার এ কথা বলা না গেলেও আওয়ামী লীগের সামনে বড় কোনো বাধা নেই এ কথা বলা যেতেই পারে। তবে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র অতীতে ছিল, বর্তমানেও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। যতদিন বাংলাদেশের মাটিতে বাংলাদেশবিরোধী অপশক্তি এবং তাদের দোসররা থাকবে ততদিন আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকবে। আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করতে পারলেই বাংলাদেশকে ধ্বংস করা সম্ভবÑ এটা দেশদ্রোহীরা জানে বলেই বিভিন্নভাবে আওয়ামী লীগকে ঘায়েল করার নীল নকশা করতে থাকে। তবে আশার কথা হলোÑ জনগণ এখন বুঝতে পারছে আওয়ামী লীগের হাতেই বাংলাদেশের ভাগ্যবন্দি। বাংলাদেশকে একমাত্র আওয়ামী লীগই সার্বিকভাবে মুক্তি দিতে পারে। তাই এদেশের জনগণ এখন আওয়ামী লীগেই বেশি আস্থাবান। কোনো রাজনৈতিক দলের উপর জনতার আস্থা তৈরি হলে সেই দল নির্বাচনে জয়ী না হয়ে পারে না। তাই আওয়ামী লীগই এবারের নির্বাচনে বিজয় লাভ করে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিবে।
এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ে আরেকটি বিষয় ভূমিকা রাখবেÑ সেটি হলো পরিত্যক্ত, ছদ্মবেশী বুড়ো রাজনীতিবিদদের হাস্যকর ঐক্য। এই ঐক্যবাদীরা যা-ই করছে, তাতেই আওয়ামী লীগের ভোট বাড়ছে। এরা ভাবে মানুষ তাদের খুব সম্মান করে, বাংলাদেশের ত্রাতা বলে মানেÑ আসলে এসবের কিছুই সত্য নয়। পরিত্যক্ত বুড়োরা এদেশের মানুষের কাছে কতটা হাস্যকর হয়ে উঠেছে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আমি ভেবে পাই নাÑ কিসের লোভে ওই সম্মানিত বুড়োরা এখন নিজেদের অপমানিত, খেলো করে তুলছেন? ক্ষমতার কি এতই খায়েস তাদের? তারা কি এখন সেই জনপ্রিয়তা ধারণ করেন, যা তাদের যৌবনে ছিল, ছিল আওয়ামী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকার সময়ে? এরা নিজেদের যত বড় নেতাই মনে করুনÑ এরা ভোটে দাঁড়ালে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়, এ কথা এদেশের মানুষ জানে। আজ অনেকেই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ঠিকাদারী স্বেচ্ছায় নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন বলে প্রচার করছেন। আমার শুধু একটাই জিজ্ঞাসাÑ বাংলাদেশে এখন যে গণতন্ত্র চলছে, অতীতে কোনো সরকার কি এইটুকু গণতন্ত্রও চালু রেখেছিল? দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই বলছি দেশদ্রোহী, যুদ্ধাপরাধী রাজাকার ছাড়া বাংলাদেশের কোনো সাধারণ মানুষ এখন আর গণতন্ত্র নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। কেননা গণতন্ত্র কেবল বাকস্বাধীনতা নয়, গণতন্ত্র কেবল অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন নয়Ñ গণতন্ত্রের সংজ্ঞা আরো ব্যাপক ও বিস্তৃত। সত্যিকারের গণতন্ত্র যদি বাংলাদেশে কেউ দেখিয়ে থাকেনÑ তাহলে সেই গণতন্ত্র দেখিয়েছেন মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা। এ কারণেই তিনি পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয় সেরা প্রধানমন্ত্রীর গৌরব অর্জন করেছেন। বিশ্বের এত এত দেশ থাকতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কেন দ্বিতীয় এটাও আমাদের ভাবা দরকার। দেশে এবার নির্বাচনী-পূর্ব সংঘাত খুবই কম হয়েছে। মৃত্যুর হার দেখে এটা বলে দেওয়া যায়। বিগত বছরের চেয়ে এবার নির্বাচন-পূর্ব সংঘাতে নিহতের হার কম। পরিস্থিতি এখনো পুরো নিয়ন্ত্রণে আছে। এভাবে থাকলে নৌকার বিজয় তথা আওয়ামী লীগের জয় নিশ্চিত হবে বলেই মনে করি। সম্প্রতি আরডিসির জরিপে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটকে ২৪৮ আসনে বিজয়ী দেখানো হয়েছে। এই জরিপ সত্য হবে এটাই আমার বিশ্বাস। আওয়ামী লীগ এবারের নির্বাচনে উন্নয়নের প্রতিফলন দেখবে এটাই স্বাভাবিক, এটাই জনতার গণরায় হবে।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
২৭ ডিসেম্বর, ২০১৮
ক্রান্তিকালে বাংলাদেশ : কতিপয় বিপথগামী রাজনীতিকের অতীত-বর্তমান
মোনায়েম সরকার
পৃথিবীর দেশে দেশে রাজনীতি আজ ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠছে। সবদেশে এখন পরিলক্ষিত হচ্ছে অপরাজনীতির হিংস্র বিভৎস রূপ। ইউরোপ বলি আর এশিয়া, আমেরিকাই বলিÑ সর্বত্রই এখন অপরাজনীতি শেকড় গেড়ে বসেছে। এই মুহূর্তে পুরো পৃথিবী জুড়েই বয়ে যাচ্ছে লোভী, উন্মাদ, ষড়যন্ত্রকারী রাজনৈতিক নেতাদের তপ্ত নিশ্বাস। তাদের জীবনবিনাশী উষ্ণ নিশ্বাসে দগ্ধ হচ্ছে পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ। যতই দিন যাচ্ছে ততই বেড়ে চলছে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ। আগের দিনে রাজনীতির উদ্দেশ্য ছিল গণমানুষের সেবাদান। আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি এর ঠিক উল্টো ছবি। উল্টো দিকে চলা রাজনীতি কখনোই মানুষের জন্য মঙ্গলজনক হতে পারে না। দেশে দেশে অপরাজনীতির এ ধারা অব্যাহত থাকলে পৃথিবী ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে পৌঁছাবে।
বাংলাদেশের ভূখণ্ডে স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই দুই শ্রেণির লোকের বাস। একশ্রেণি এদেশের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী ও এদেশের মানুষের পারস্পরিক সম্প্রীতিতে আস্থাবান। অন্য শ্রেণি এদেশের অখ-তায় মোটেই বিশ্বাসী নয়। এরা ধর্মের নামে অধর্ম চালিয়ে শোষণ করতে চায়। এদেশের নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে নিজেদের হীন স্বার্থ বজায় রাখতে চায়। একটা বিষয় লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ১৯৭১ সালে যারা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলার মুক্তিকামী জনতার কাছে পরাজিত হয়েছিল, সেই পরাজিত শক্তিরা তাদের পরাজয়কে মেনে না নিয়ে উল্টো বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এই শান্তিবিঘœকারী দেশদ্রোহীরা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি ক্ষমতায় থাকলে তাদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দেশ চালনার দায়িত্ব পেলে সুযোগ বুঝে গর্তে ঢুকে যায়। স্বাধীনতার এত বছর পরেও এদের নির্মূল করা যায়নি। এদের বিনাশ করতে না পারলে এদের হাত থেকে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের শান্তি ও উন্নয়নকামী, অসাম্প্রদায়িক জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ রাখা সম্ভব নয়।
গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারায় নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনের মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক দেশে সরকার পরিবর্তন হয়। দেশের জনগণ ঠিক মতো বুঝে শুনে ভোটাধিকার প্রয়োগ না করলে, দেশবিরোধীরা ক্ষমতায় চলে আসতে পারে। সেক্ষেত্রে পেছন দিকে চলে যাবে দেশ। দেশের স্বার্থেই সঠিক ব্যক্তি ও দলকে ভোট দেওয়া প্রত্যেকটি নাগরিকের একান্ত দায়িত্ব। এবার বাংলাদেশের বিজয়ের মাসে (৩০ ডিসেম্বরে) একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এবারের নির্বাচন নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। এই নির্বাচন বাংলাদেশের মানুষের সামনে অতীতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষেরই মুখোশ খুলে দিচ্ছে। এবারের নির্বাচনে অনেক মুক্তিযোদ্ধাই যোগ দিয়েছেন রাজাকার-দেশদ্রোহীদের ছাতার তলে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সোনালি অতীত ভুলে গিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ঘাতকদের রক্ষা করতে জোটবদ্ধ হয়েছেন। ঠিকাদারি নিয়েছেন দেশবিরোধীদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পুনর্বাসিত করার। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এই দৃশ্য আমি কখনো কল্পনা করতে পারিনি। এদের এই দৃষ্টিকটু পরিবর্তন আমাকে ভীষণ ব্যথিত করেছে। আমি মনে করি, আমার মতো পুরো জাতি আজ এদের উদ্ভট পরিবর্তনে বিস্মিত-বেদনাহত। যা অকল্পনীয় ছিল তা-ই এখন ঘটে যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে। একটি কথা আছেÑ ‘রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই’। কথাটি যে কতখানি সত্য বাংলাদেশের ষোলো কোটি মানুষ আজ হাড়ে হাড়ে তা উপলব্ধি করছে।
আজ আমি প্রবীণদের জন্য নয়, নবীনদের জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের দুই একটি ঘটনা উত্থাপন করতে চাই। আমি মনে করিÑ নবীনরাই বর্তমান বাংলাদেশের কাণ্ডারি। এরাই এখন আমাদের ভরসা। এদের কাছেই তুলে ধরতে চাইÑ কতিপয় বিপথগামী রাজনীতিকের অতীত ও বর্তমানের দিনলিপি। আজ যারা ঐক্য-ঐক্য বলে জাতির সামনে জাতির হাজির হয়েছেÑ তাদের অতীত না জেনে অনেক তরুণই বিভ্রান্ত হচ্ছে। এই সুযোগ সন্ধানী বিভীষণদের কালো ইতিহাস জেনে রাখা দরকার। এরা বাইরে বলছে মুক্তির কথা, ভেতরে ভেতরে এরা দেশ ও দেশের মানুষের হাতে শৃঙ্খল পরাতে বদ্ধ পরিকর। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে এদেশ চলে যায় বাংলাদেশবিরোধী চক্রের হাতে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তাদের বিকৃত উল্লাস আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। ’৭৫-পরবর্তী কালপর্বে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতাকর্মীরা দলে দলে আওয়ামী লীগ থেকে সরে দাঁড়াতে শুরু করে। এই নেতারা রাজনীতি থেকে সরে গেলে তখন খুব একটা সমস্যা হতো না; কিন্তু এরা গিয়ে জুটে ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেওয়া বিএনপিতে। এই দলত্যাগী নেতাদের মধ্যে ছিলেনÑ ইউসুফ আলী, সোহরাব হোসেন, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, কে এম ওবায়দুর রহমান প্রমুখ। পরবর্তীকালে রক্তের উত্তরাধিকার বনাম আদর্শের উত্তরাধিকারÑ এই দ্বন্দ্বে ১৯৮৩ সালে আবদুর রাজ্জাক ও মহিউদ্দিনের বাকশালের পুনর্গঠনও আওয়ামী লীগকে কম বিপদে ফেলেনি। ছাত্র সংগঠনের প্রায় সবাই বাকশালে যোগ দেয়। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর মিসেস ইন্দিরা গান্ধির কথা। আমি তখন ভারতে স্বেচ্ছানির্বাসনে ছিলাম। দেখেছি সেই মুহূর্তে তিনি কী পরিমাণ অসহায় হয়ে গিয়েছিলেন।
১৯৯১ সাল বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনার জন্ম দেয়। এই তথাকথিত গণতান্ত্রিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ী হওয়ার কথা থাকলেও আওয়ামী লীগ বিজয়ী হতে পারেনি। যদিও সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিএনপির চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিল, কিন্তু আসন সংখ্যায় পিছিয়ে যায় আওয়ামী লীগ। এই নির্বাচনের ভোট কারচুপি দেশবাসীর বিস্মৃত হওয়ার কথা নয়। নির্বাচন-পরবর্তী এক প্রতিক্রিয়ায় শেখ হাসিনা ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’র কথা উল্লেখ করলেও আওয়ামী লীগের আরেক নেতা ড. কামাল হোসেন বিবিসিকে জানান নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। এর ফলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কামাল হোসেনের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ড. কামাল হোসেন প্রথমে গণতান্ত্রিক ফোরাম নামে সেমিনারের আয়োজন করেন। এই সেমিনারে দেশের অনেক বুদ্ধিজীবীই অংশ নেন। পরে ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগ থেকে অব্যাহতি নিয়ে গণফোরাম নামে একটি দল গঠন করেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দলছুট সুবিধাবাদী নেতাদের সমন্বয়ে। গণফোরামে সেদিন যারা যোগ দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক, সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নাহিদ, সামসুদ্দোহা, নূহ-উল-আলম লেনিন, শেখর দত্ত, ন্যাপের পঙ্কজ ভট্টাচার্য, রণেশ মৈত্র, আওয়ামী লীগের ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, জহুরুল ইসলাম, মোস্তফা মহসীন মন্টু ছিলেন।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠন করে মেয়াদ পূর্ণ করার পরেও ক্ষমতা ছাড়তে টালবাহানা শুরু করে। তারা অন্যায়ভাবে ক্ষমতায় থাকার জন্য ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ‘ভোটার বিহীন ভোট’ করে। জনগণ এই প্রহসনমূলক নির্বাচন ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। শুরু হয় গণ-আন্দোলন। ঢাকার বুকে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জনতার মঞ্চ’। গণআন্দোলনের মুখে মাত্র তিন মাসের মাথায় বিএনপি পুনরায় নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। গণফোরাম ও ড. কামাল হোসেন সম্পর্কে আরেকটি পুরাতন কথা দেশবাসীকে একটু মনে করিয়ে দিতে চাই। যদিও অনেকেই এসব কথা জানেন। ড. কামাল যখন আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন তখন তিনি মন্ত্রী ছিলেন। এমনকি আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্টশিয়াল প্রার্থী ছিলেন। অথচ সোনালি অতীত তিনি এক নিমিষেই ভুলে গেলেন দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের প্রলোভনে। আওয়ামী লীগের উপর তখন আমেরিকার চাপ ছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করা যাবে নাÑ এই প্রস্তাব শেখ হাসিনা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেন না। তখন আওয়ামী লীগে ভাঙন ধরানোর জন্য আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দিয়েই ‘গণফোরাম’ নামে আরেকটি প্যারালাল আওয়ামী লীগ গঠন করা হয়।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে সেই দুঃখজনক কাজটিই অত্যন্ত ঠা-া মাথায় সম্পন্ন করেন ড. কামাল হোসেন ও তার কয়েকজন স্বার্থপর অনুগত। এই গণফোরামের সদস্যসচিব ছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। আরেকজন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার জন্য বহুদিন গণফোরামের সেক্রেটারির পদ শূন্য রাখা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার আর গণফোরামে যোগ দেওয়া হয়নি। দলের মধ্যে এত ভাঙনের পরেও বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর মতো দৃঢ় মনোবল ও সাধারণ নেতাকর্মীর জীবনবাজি রেখে সংগ্রাম করার ফলে আওয়ামী লীগ আবার ঘুরে দাঁড়ায়। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগের দলছুট নেতারা লজ্জা- শরমের মাথা খেয়ে একে একে উঠতে থাকে আওয়ামী লীগের নৌকায়। আওয়ামী লীগের সুবিধাবাদী নেতারা আওয়ামী লীগের শরীরটাকে বহুবার ক্ষতবিক্ষত করেছে। এখনও সেই ধারা অব্যাহত আছে। চক্রান্তকারীরা এখনও চক্রান্ত করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। এ ব্যাপারে নবীন ভোটার তথা কা-ারিকে হুঁশিয়ার থাকা অতীব জরুরি। একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, আওয়ামী লীগ কখনোই দেশবাসীর সঙ্গে প্রতারণা করেনি। অথচ আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যসব দলই বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে সীমাহীন প্রতারণা করেছে।
বাংলাদেশে তথাকথিত ‘সুশীল সমাজ’ বলে বিশেষ প্রজাতির একদল মানুষ আছে। এরা টকশোতে কথার ফুলঝুড়ি ছোটান। দর্শকহীন সভা-সেমিনারে দেশবিরোধী বিষোদ্গার করেন। এরা আওয়ামী লীগ সরকারের নেতিবাচক সমালোচনা ছাড়া কোনো ইতিবাচক কথা খুঁজেই পান না। এরা বলেনÑ দেশে গণতন্ত্র নেই, মানবাধিকার নেই, ভোটের অধিকার নেই, জীবনের নিরাপত্তা নেই, বাক-স্বাধীনতা নেই ইত্যাদি। যেসব সুশীল এসব কথা বলেন, তাদের আমি জিজ্ঞেস করতে চাইÑ স্বৈরাচারী জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার আমলে কি গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ভোটের অধিকারের নিশ্চয়তা ছিল? ওই সময় এসব সুবিধালোভী সুশীল-সুজন কোথায় ছিলেন? তখন তো কোনো সভা-সেমিনারে এদের দেখা যায়নি। সেদিনের চেয়ে বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি আজ সর্বাংশেই উন্নত ও বিশ্বকর্তৃক প্রশংসিত। যেই পাকিস্তানের কাছ থেকে আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম, সেই পাকিস্তানের জনগণই আজ সেদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বলছেনÑ ‘তারা বাংলাদেশের মতো হতে চায়’। পাকিস্তানের জনগণই যখন বাংলাদেশের জীবনমান প্রত্যাশী তখন ধরেই নিতে হবে বাংলাদেশ আসলেই অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ সুশীলই ঘুষের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ, অথচ এরা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য নিজেরাই ঘুষ লেনদেন করেন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে ঘর-বাড়ি, জায়গা-জমি কেনেন, আয়কর ফাঁকি দেন। এই সুশীলদের বেশির ভাগের গায়েই আছে উৎকট দুর্গন্ধ। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবেÑ এই সব সুশীলদের ইনকামের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, চলা-ফেরা-বিলাস-ভ্রমণে আকাশ-পাতাল ফারাক। এরা কিভাবে চলে, কাদের টাকায় চলেÑ বাংলাদেশের মানুষ আজ এসব জানতে চায়। আজকাল অনেকেরই ফোনালাপ ফাঁস হচ্ছে। সুশীলদের ফাঁস হওয়া ফোনালাপে যেসব তথ্য বেরিয়ে আসছে তাতে দেশের মানুষ হতবাক হয়ে যাচ্ছে। এরা বেশিরভাগই মুখোশ পরে আছে, এরা পারে না এমন কোনো কাজ নেই। এসব সুশীলদের ইরিয়ে-বিনিয়ে বলা মিষ্টি ভাষা থেকেও দেশের মানুষ ও তরুণ প্রজন্মকে সতর্ক থাকা দরকার।
’৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস মূলত ষড়যন্ত্র আর ছদ্মবেশীদের ইতিহাস। বাংলাদেশের মানুষ আজ সুষ্ঠু ধারার গণতান্ত্রিক রাজনীতি পছন্দ করেন। আর কোনো অশুভ শক্তি বাংলাদেশের উপর শ্যেনদৃষ্টি না ফেলুক। বাংলাদেশ এগিয়ে যাক পরিচ্ছন্ন গণতান্ত্রিক ধারায়। এটাই আজ ষোলো কোটি মানুষের আন্তরিক প্রত্যাশা। আমরা কথায় কথায় ক্রান্তিকাল শব্দটি উচ্চারণ করি। বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থেই আজ ক্লান্তিকাল অতিক্রম করছে। আজ বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম তথা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তিকে বিজয়ী করে দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এর ব্যত্যয় হলেই দেশে নেমে আসবে সেই পরিচিত অন্ধকার। একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশকে আমরা অন্ধকার নয়, আলোর পথেই এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
০৯ ডিসেম্বর, ২০১৮
আওয়ামী লীগের বিজয় কেন জরুরি
মোনায়েম সরকার
আমি একজন রাজনীতি-সচেতন নাগরিক এবং ভোটার। ১৯৭০ সালের নির্বাচনসহ বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিয়েছি। সরকার গঠন ও সরকার পরিবর্তনে ভোটের গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা যদি সবাই নিজেদের বুদ্ধি-বিবেচনা খাটিয়ে সৎ-যোগ্য ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিকে নির্বাচিত করি, উন্নয়নমুখী দলকে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দেই তাহলে দেশ অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যায়। এর অন্যথা হলে দেশে দেখা দেয় রাজনৈতিক সংকট ও জটিলতা, জনজীবনে নেমে আসে দুর্ভোগ-যন্ত্রণা। এর প্রমাণ হিসেবে সামরিক সরকার (জিয়া-এরশাদ), প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদীদের শাসন ও সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনচিত্র উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে আমরা দেশের স্বাধীনতা পেয়েছি। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর দেশে যে অগণতান্ত্রিক শাসনের ধারা সূচিত হয়, তার অবসান ঘটানোর জন্য, জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশের গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল শক্তিকে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম করতে হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হলেও দুঃখজনক এটাই যে আওয়ামী লীগ শাসন ক্ষমতায় থাকার সুযোগ পেয়েছে খুব কম সময়ই। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মাত্র সাড়ে তিন বছর ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। ওই সময় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের জটিল কাজটি অত্যন্ত সফলভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিল। সে অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে রাজনীতির গতিমুখ পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছিল। তারপর দীর্ঘ ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সুযোগ পেয়েছিল। সে-বার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ধারা সূচনা করতে সক্ষম হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচারকাজ শুরু করে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছিল। এছাড়াও পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর, গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তিসহ দীর্ঘদিনের জিইয়ে থাকা বেশ কিছু সমস্যা সমাধানের যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তারপরও ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পুনরায় নির্বাচিত হতে পারেনি। তুলনামূলকভাবে ভালো শাসন উপহার দিয়েও ভোটে না জেতাটা ছিল অপ্রত্যাশিত। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত অপশাসন-কুশাসনে অতিষ্ঠ দেশবাসী পরের নির্বাচনে আবার সঠিক রায় দিতে ভুল করেনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
দেশের বিভিন্ন সঙ্কট দেখে কখনো কখনো মনে হয়, দূর ছাই, ভোটই দেবো না। আমি একজন ভোট না দিলে কী হবে? আবার পরক্ষণেই মনে হয়, আমার মতো যদি অনেকেই ভোট না দেয়, অসৎ ও অযোগ্য ব্যক্তিরা জয়ী হতে পারে, সেটা তো দেশের জন্য আরও বেশি ক্ষতির কারণ হবে। মন্দ লোকেরা ভোটে জিতে ক্ষমতায় গেলে দেশের মানুষকে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হবে। সমাজের মানুষ হিসেবে আমিও তা থেকে রেহাই পাবো না। সে জন্যই সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়বোধ থেকেই সঠিক দলকে ভোট দেয়ার আকাক্সক্ষা মনের মধ্যে তীব্র হয়ে ওঠে।
মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল আজ থেকে ৪৭ বছর আগে। এরপর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিই বেশিরভাগ সময় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেছে। এই দীর্ঘ সময়ে তারা নিজেদের পাপকে ধুয়েমুছে ফেলার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছে। তারা মুক্তিযুদ্ধের নায়কদের ভিলেন হিসেবে চিহ্নিত করার এবং ভিলেনদের নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টা চালিয়েছে। নতুন প্রজন্ম তাদের হিংস্ররূপের পরিচয় তেমনভাবে পায়নি। এই দীর্ঘ সময়ে তারা সামাজিক, রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এমন ব্যক্তিদের বিচারের পেছনে আওয়ামী লীগের যে ‘মতলব’ই থাকুক না কেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এদেশের কোটি কোটি মানুষ তাকে খাটো করে দেখতে পারে না। বাংলাদেশের মতো মীরজাফর-কবলিত দেশে গোলাম আযম-সাঈদী-নিজামী-মুজাহিদ-কাদের মোল্লাদের কেউ টিকি স্পর্শ করতে পারবেÑএটা সত্যিই অবিশ্বাস্য ছিল। যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকাতে, এই বিচারকে বানচাল করতে চেষ্টা কিছু কম হয়নি। জামায়াত এবং তাদের সমর্থকরা বিশ্বব্যাপী প্রচারণা চালিয়েছে। আওয়ামী লীগবিরোধী প্রগতিশীলদের পক্ষ থেকেও আওয়ামী লীগকে জব্দ করতে ধর্মান্ধ-দেশবিরোধী শক্তির সঙ্গে সুর মিলিয়ে এই বিচার প্রক্রিয়ার সমালোচনা করা হয়েছে, ছোট-খাট ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলোকে অনেক বড় করে উপস্থাপন করা হয়েছে।
একটা বিষয় লক্ষণীয়। বিএনপি সমর্থকরা কখনোই বিএনপির কোনো কাজের সমালোচনা করে না, নিন্দা করে না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সমর্থকরা কিংবা আওয়ামী লীগের শুভাকাক্সক্ষীরাও প্রকাশ্যেই আওয়ামী লীগের নিন্দা-সমালোচনা করে কার্যত শত্রুর হাতেই যে অস্ত্র তুলে দেন, সেটা বিবেচনায় রাখেন না। আওয়ামী লীগকে কোণঠাসা ও অজনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মিথ্যা প্রচারণা যেমন দায়ী, তেমনি আওয়ামী লীগের শুভাকাক্সক্ষীদের তীব্র সমালোচনাও কম দায়ী নয়। আওয়ামী লীগের সীমাবদ্ধতা, ত্রুটি-বিচ্যুতি অবশ্যই আছে। কিন্তু সেগুলো বিএনপি-জামায়াতের চেয়ে বেশি নয়। আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী গোষ্ঠীর উত্থানের পথ সুগম করে দেয়া কোনোভাবেই যৌক্তিক কাজ হতে পারে না।
মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে আমাদের জীবনের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল কালপর্ব। সবচেয়ে বড় পাওয়া। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। আজকে আমাদের যতটুকুও যা উন্নতি, তা সম্ভব হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে বলেই। আজ যদি আমরা পাকিস্তানের অংশ থাকতাম, তাহলে এই ভূখ- হতো জঙ্গি তালেবান অধ্যুষিত একটি গরিব অঞ্চল। স্বাধীনতার আগে যেভাবে পাকিস্তানিরা একই দেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও আমাদের উপর শোষণ-নির্যাতন-জুলুম চালিয়েছিল, আমাদের গরিব মজুরে পরিণত করেছিল, আমরা স্বাধীন না হলে সেই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। এখনও আমাদের পাকিস্তানিদের গোলামি করেই কাটাতে হতো। আমরা সৌভাগ্যবান যে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। আর বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে এদেশের লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষ জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাদের অপরিসীম ত্যাগ, সাহস ও বীরত্বের জন্যই আমাদের আজকের স্বাধীন স্বদেশ। প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ!
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই স্বাধীনতার জন্য আমাদেরকে কোন দল নেতৃত্ব দিয়েছিল? সেই সময়ে অন্যান্য দল কি করেছিল, কাদের ভূমিকা কেমন ছিল, তা কি আমাদের বিবেচনাবোধকে সতর্ক করে দেয় না? হ্যাঁ, দেয়। দেয় বলেই আমরা মনে করি, সংবিধানবিরোধী অগণতান্ত্রিক পন্থায় সৃষ্ট বিএনপির সামগ্রিক ভূমিকার কারণে এই দলটিকে কোনো যুক্তিতেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেয়া যায় না। ওদেরকে কেন আমরা ভোট দেবো না? কারণ ওরা গণবিরোধী, দেশবিরোধী। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলাম ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে, পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতকে ‘অপরাধী সংগঠন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিএনপি নামক দলটির তখন জন্ম হয়নি। কিন্তু জন্মের পর থেকে বিএনপি সব সময় ওই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ‘অপরাধী’ দলটিকেই আশ্রয়-প্রশ্রয়-সমর্থন দিয়ে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি হিসেবে আমরা জামায়াতকে ঘৃণা করি। আর জামায়াতকে সমর্থন ও সহযোগিতা দেয়ার কারণে বিএনপিকে ভোট দেয়াটাও যে-কারো কাছে বাংলাদেশের আদর্শবিরোধী কাজ বলেই বিবেচিত হওয়া উচিত।
বাংলার মানুষ আজ ক্যান্টনমেন্ট নির্ভর ক্ষমতাবানদের চায় না। তারা ‘গণভবন’ আর ‘বঙ্গভবন’ নির্ভর ক্ষমতা দেখতে চায়। জেনারেল জিয়া অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। নানাপ্রকার চক্রান্ত করে আওয়ামী লীগকে তথা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ও গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে চেয়েছেন। আজ বিএনপির পক্ষে কথা বলা মানে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কথা বলা, গণতন্ত্রের বিপক্ষেই কথা বলা। দেশে অনেক জঞ্জাল জমেছে। সেই জঞ্জাল পরিষ্কার করতে হলে, দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে আওয়ামী লীগকে অকুণ্ঠ সমর্থন দেওয়া দরকার। আশাকরি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ সে সুযোগ আওয়ামী লীগকে দেবে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে দুর্বৃত্ত, চাঁদাবাজ ও দুর্নীতিগ্রস্তদের নৌকা থেকে ফেলে দিতে হবে। দেশের মানুষ উন্নত ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ চায়। হাওয়া ভবন বা খোয়াব ভবন দেখতে চায় না। শেখ হাসিনার মতো এমন ব্যতিক্রমী নেতৃত্ব দেশবাসী বিগত ৪৫ বছরে দেখেনি। তিনি চলনে-বলনে-আহ্বানে দৃঢ়চেতা, রাজনৈতিক কৌশলে দূরদর্শী এবং সিদ্ধান্তে সাহসী এক ব্যক্তিত্ব।
বাংলাদেশের কতিপয় সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবী ও বামনেতা পত্র-পত্রিকায়, টকশোতে বলার চেষ্টা করছেন দেশে গণতন্ত্র নেই, বাক-স্বাধীনতা নেই, মানুষের ভোটের অধিকার নেইÑ একথা সত্য নয়। দেশে গণতন্ত্র ও বাক-স্বাধীনতা না থাকলে তারা এত কথা বলেন কিভাবে? ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তারা কোথায় ছিলেন? ওয়ান ইলেভেনের সময়ও তারা নিশ্চুপ ছিলেন কেন? খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়াÑ উভয়েই দুর্নীতির কারণে দ-প্রাপ্ত। বর্তমানে অনেক দেশেই দুর্নীতির কারণে নেতা-নেত্রীরা জেল খাটছেন। খালেদা জিয়া ও তার পুত্র তারেক জিয়া রাজবন্দী হলে তাদের পক্ষে কথা বলা যেতোÑ তারা যেহেতু দুর্নীতির কারণে দ-িত তাদের পক্ষে কথা বলা কি প্রকারান্তরে দুর্নীতির পক্ষেই কথা বলা নয়? এদেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও দিকভ্রান্ত বাম-নেতাদের অতীত অত্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ। মানুষ এখন আর এদের বিশ্বাসযোগ্য মনে করে না।
শেখ হাসিনা তার সুচিন্তিত ও সুদৃঢ় নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে মর্যাদার আসনে আসীন করেছেন এ কথা সর্বাংশে সত্য। তবু কিছু কিছু মানুষ ভুল পথে আছে, তারা এখনো বিশ্বাস করে পাকিস্তানি ভাবধারায়। এই ভুল পথে চলা মানুষগুলোকে সুপথে ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রতিটি নেতাকর্মীর অঙ্গীকার হোকÑ অবাধ, সুষ্ঠু, সুন্দর ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আওয়ামী লীগের ক্ষমতারোহণ। এ জন্য আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতাকর্মীকে সৎ, দুর্নীতি মুক্ত, সদালাপী, সদাচারী ও দেশপ্রেমিক হতে হবে। আওয়ামী লীগ গণমানুষের দল। মানুষের প্রতি বিশ্বাস রেখেই আওয়ামী লীগকে এগিয়ে যেতে হবে। দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ রেখে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবে আওয়ামী লীগ। সবার পক্ষে নতুন ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নয়। বাংলার মানুষ বিশ্বাস করে শেখ হাসিনার জন্য কোনো কিছুই আজ অসম্ভব নয়। তিনিই পারবেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সুখী, সমৃদ্ধিশালী সোনার বাংলা গড়তে। উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে আওয়ামী লীগকে আবারও ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া জরুরি। আর দেশকে এগিয়ে নেয়ার যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগেরই বেশি। তাই আসুন সব ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-মান-অভিমান পরিহার করে ’৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনের মতো ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান তুলে নির্বাচনে নিজে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নৌকা মার্কায় ভোট দেই এবং অন্যকেও একই সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনুপ্রাণিত করি।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
০১ ডিসেম্বর, ২০১৮
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে
আওয়ামী লীগকে কেন নির্বাচিত করবেন
মোনায়েম সরকার
বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ
২৩, চামেলীবাগ, ঢাকা-১২১৭
ফোন : ৯৩৩৩৫৪৩, মোবাইল : ০১৯১১৩২৪৮৭২
ওয়েব পেজ : www.bfdr-bd.com
প্রকাশকাল
নভেম্বর, ২০১৮ / কার্তিক ১৪২৫
প্রকাশক
বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ
২৩, চামেলীবাগ, ঢাকা-১২১৭
আমি একজন রাজনীতি-সচেতন নাগরিক এবং ভোটার। ১৯৭০ সালের নির্বাচনসহ বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিয়েছি। সরকার গঠন ও সরকার পরিবর্তনে ভোটের গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা যদি সবাই নিজেদের বুদ্ধি-বিবেচনা খাটিয়ে সৎ-যোগ্য ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিকে নির্বাচিত করি, উন্নয়নমুখী দলকে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দেই তাহলে দেশ অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যায়। এর অন্যথা হলে দেশে দেখা দেয় রাজনৈতিক সংকট ও জটিলতা, জনজীবনে নেমে আসে দুর্ভোগ-যন্ত্রণা। এর প্রমাণ হিসেবে সামরিক সরকার (জিয়া-এরশাদ), প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদীদের শাসন ও সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনচিত্র উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে আমরা দেশের স্বাধীনতা পেয়েছি। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর দেশে যে অগণতান্ত্রিক শাসনের ধারা সূচিত হয়, তার অবসান ঘটানোর জন্য, জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশের গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল শক্তিকে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম করতে হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হলেও দুঃখজনক এটাই যে আওয়ামী লীগ শাসন ক্ষমতায় থাকার সুযোগ পেয়েছে খুব কম সময়ই। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মাত্র সাড়ে তিন বছর ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। ওই সময় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের জটিল কাজটি অত্যন্ত সফলভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিল। সে অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে রাজনীতির গতিমুখ পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছিল। তারপর দীর্ঘ ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সুযোগ পেয়েছিল। সে-বার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ধারা সূচনা করতে সক্ষম হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচারকাজ শুরু করে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছিল। এছাড়াও পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর, গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তিসহ দীর্ঘদিনের জিইয়ে থাকা বেশ কিছু সমস্যা সমাধানের যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তারপরও ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পুনরায় নির্বাচিত হতে পারেনি। তুলনামূলকভাবে ভালো শাসন উপহার দিয়েও ভোটে না জেতাটা ছিল অপ্রত্যাশিত। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত অপশাসন-কুশাসনে অতিষ্ঠ দেশবাসী পরের নির্বাচনে আবার সঠিক রায় দিতে ভুল করেনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
দেশের বিভিন্ন সঙ্কট দেখে কখনো কখনো মনে হয়, দূর ছাই, ভোটই দেবো না। আমি একজন ভোট না দিলে কী হবে? আবার পরক্ষণেই মনে হয়, আমার মতো যদি অনেকেই ভোট না দেয়, অসৎ ও অযোগ্য ব্যক্তিরা জয়ী হতে পারে, সেটা তো দেশের জন্য আরও বেশি ক্ষতির কারণ হবে। মন্দ লোকেরা ভোটে জিতে ক্ষমতায় গেলে দেশের মানুষকে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হবে। সমাজের মানুষ হিসেবে আমিও তা থেকে রেহাই পাবো না। সে জন্যই সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়বোধ থেকেই সঠিক দলকে ভোট দেয়ার আকাক্সক্ষা মনের মধ্যে তীব্র হয়ে ওঠে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে মিল-অমিল নিয়ে কিছু কথা
আগেই বলেছি আমি নিজেকে একজন রাজনীতি সচেতন নাগরিক বলে মনে করি। দীর্ঘসময় আমি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত ছিলাম। এখনো নিজেকে রাজনীতির বাইরে ভাবি না। প্রতিদিন বেশ কয়টি সংবাদপত্র পাঠ করি। দেশ নিয়ে ভাবি, পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করি। এটা স্বীকার করতেই হয়, আমাদের দেশে যারা রাজনৈতিক কলাম লেখেন, যারা টকশোতে কথা বলেন, তারা সমস্যার গভীরে না গিয়ে হালকা চালে এমন সব কথা লেখেন বা বলেন, যা সাধারণ মানুষের চিন্তাজগতকে সমৃদ্ধ না করে বিভ্রান্ত করে। যাদের বিশিষ্ট ভাবা হয়, যাদের কাছে মানুষ ‘আলো’ প্রত্যাশা করে, তারা প্রায়ই চটুল কথা বলে বা লিখে বাহবা কুড়াতে চান। সাধারণ মানুষের মধ্যে যেমন হুজুগপ্রিয়তা আছে, তেমনি বিশিষ্ট জনেরাও এ প্রবণতা থেকে মুক্ত নন। ফলে পক্ষপাতহীন আলোচনা কিংবা লেখালেখি খুব একটা দেখা যায় না।
ইদানীং টকশো এবং লেখালেখিতে অনেকেই বলেন যে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির কোনো পার্থক্য নাই। যদিও আমি সাদা চোখে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতি দেখে এটা বুঝি যে, এই দুই দলের মধ্যে আদর্শগত বিরাট পার্থক্য আছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে মিল-অমিল নিয়ে একটা লেখা পড়েছিলাম। প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসার লেখাটি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ইতিহাস ও রাজনীতি সম্পর্কে জানতে খুবই সহায়ক মনে করে লেখাটি তুলে ধরতে চাই।
আওয়ামী লীগের জন্ম অবশ্যই গণতান্ত্রিক ধারায় ঘটেছে। তৎকালীন স্বৈরতান্ত্রিক মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে, তাদের অপশাসনের অবসান ঘটাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একটি গণজাগরণ সৃষ্টি করেছিল আওয়ামী লীগ। আচম্বিতে অথবা কোনো কলকাঠি নেড়ে এ-দল ও-দল ভাঙিয়ে নীতি-আদর্শহীন রাজনীতিচর্চাকারীদের সমন্বয়ে দলটির জন্ম হয়নি, যেমনটি হয়েছিল বিএনপির। যাঁরা এককালে মুসলিম লীগে ছিলেন, প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির মোহভঙ্গের পর আওয়ামী মানে জনগণের, মধ্যপন্থী প্রগতিশীল আদর্শের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভিত্তি স্থাপন করেন। অন্যদিকে বিএনপি, তার আদিরূপ জাগদল’ অগণতান্ত্রিক পন্থায় সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সৃষ্টি।
একথা ঠিক যে, ক্যান্টনমেন্টে বিএনপি ও তার পূর্বসূরি ‘জাগদলে’র জন্ম হয়নি। কারণ, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা তখন অবৈধভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে এসে গেছেন, জগদ্দল পাথরের মতো জনগণের কাঁধে সওয়ার হয়েছেন। জেনারেল নূরুল ইসলাম শিশু, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান মেজর জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরী ও তাঁদের সহায়তাকারী আমলা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সালাহউদ্দিন আহমদ আদর্শচ্যুত, সুবিধাবাদী, রাজনীতিবিদদের সমন্বয়ে ‘জাগদল’ গঠন করেছিলেন। একসময় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সামরিক পোশাকটি ছাড়লেও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেননি, সাফারি-স্যুট পরে সিভিলিয়ানের ভেক ধরেছেন। তার সিভিলিয়ান কাম মিলিটারি মনোনীত পরামর্শক ও মন্ত্রীদের মধ্যে ছিলেন কার্যরত ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা আর তাদের উচ্ছিষ্টভোগী রাজনীতিক। উভয় শ্রেণির অনেকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন।
বিএনপি গঠন করে জেনারেল জিয়াউর রহমান ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’ নয়, বহির্বিশ্বকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য একটি ‘মাল্টি-পার্টি’ তথা আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে সাজানো নির্বাচনে অংশগ্রহণে প্ররোচিত করে, রাজনীতি করার সীমিত সুযোগ দিয়ে ‘বহুদলীয় সংসদ’ গঠন করেছিলেন। এ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি গণতন্ত্রের প্রতি মায়ার কারণে নয়, বহির্বিশ্বে তাঁর সরকারকে গ্রহণযোগ্য করতে। এর আগে একটি প্রহসনের গণভোটে (হ্যাঁ/না ভোটে) তিনি ১১০ ভাগ ভোট আদায় করেছিলেন!
এখন সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ে রূপান্তরের ইতিহাস। আওয়ামী লীগ থেকে আমার অতি শ্রদ্ধেয়, ব্যক্তিগতভাবে আমি যাঁর স্নেহভাজন ছিলাম, মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে মতদ্বৈধতা প্রকাশ করে কাগমারি সম্মেলনের পর আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন, ত্যাজ্য করেননি। আদর্শ, নীতি, বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস, অসাম্প্রদায়িকতা-গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় দুই দলের মধ্যে ৯৯ শতাংশ মিল ছিল। জিয়াউর রহমান এসবের সম্পূর্ণ বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পাকিস্তান আমলের ভাবধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে ধর্মান্ধতাকে পুঁজি, সাম্প্রদায়িকতার বীজ লালন করে একটি রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়া তৈরি করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু ও শহীদ জিয়াউর রহমানসহ অগণিত মুক্তিযোদ্ধার হত্যাকারী কারা? ‘কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল’ সেনাসদস্যের অপকর্ম বলে কি সমগ্র সেনাবাহিনীকে দায়মুক্ত করা যাবে? উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। কিন্তু জিয়াউর রহমানের প্রকৃত হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে বর্তমানের বিএনপি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
মিল-গরমিলের তুলনায় আওয়ামী লীগ দল ও সরকারের মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে, সেই আলোচনায় অনেক তথ্য ও সত্য বিবেচনায় আনতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে অবশ্যই জিয়াউর রহমানের অবদান রয়েছে। সেই অবদানটি যুদ্ধক্ষেত্রে, দুই দশকের মুক্তি আন্দোলনে নয়। মুক্তি আন্দোলনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ও অংশগ্রহণে দুই দশকের চরম পর্যায়ের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের পর তিনি যে দলটি প্রতিষ্ঠা করেছেন, তার কোনো অবদান ছিল না। বায়ান্ন, বাষট্টি ও ঊনসত্তর পেরিয়ে আমরা একাত্তরে পৌঁছেছি। সেই ক্রমবিকাশেই বাঙালি অনেক ত্যাগের মাধ্যমে ধাপে ধাপে স্বাধীনতার পথে এগিয়েছে। ড্রামের ওপর দাঁড়িয়ে শিঙা ফুঁকে কেউ স্বাধীনতাযুদ্ধের সূচনা করেননি। সেসব ধাপ তৈরিতে জেনারেল জিয়া অথবা বিএনপির কোনো অবদান নেই।
আমার সর্বশেষ বক্তব্য হচ্ছে, এখন অতীত নিয়ে বর্তমানের দুই দলের অবস্থান নির্ণয় করা অথবা তুলনামূলক আলোচনা অর্থহীন। আওয়ামী লীগ সরকার যা-ই করুক, আওয়ামী লীগ দলটি তার ত্যাগী, সাত দশকের গভীরে প্রোথিত শিকড়ের কারণে তৃণমূল কর্মীরা দলের দুর্দিনেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অটল থাকেন। তারা সবাই ‘তালেবান’ মানে বঙ্গবন্ধুর নামে, তাঁর কন্যার প্রতি ভালোবাসা ও প্রশ্নোর্ধ্ব আনুগত্যের কারণে সুসময়ে-দুঃসময়ে সমানতালে নাচতে থাকেন। সুযোগসন্ধানী নব্য আওয়ামী লীগাররা হলো ‘ফলেবান’ মানে দল ক্ষমতায় এলে ফল ভোগ করে। অন্যদিকে বিএনপির অবস্থা হচ্ছে, ক্ষমতায় গেলে বীরত্বের সঙ্গে বাগেরহাট-ভোলায় তা-ব করে। কেমন তা-ব তা বোঝাতে সেই আর্তনাদটি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। ভোলা, নাকি বাগেরহাটে এক মায়ের সেই আর্তনাদ: ‘বাবারা! আমার মেয়ে ছোট, তোমরা একজন-একজন করে আইসো।’ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ক্ষমতা হারালে সংঘবদ্ধ হয়, বিএনপি হয় বিপর্যস্ত-ছত্রভঙ্গ। এটি হলো দুই দলের ক্ষমতাধর ও ক্ষমতাহীন অবস্থায় গরমিল চেহারা (বিএনপি আওয়ামী লীগে কিছু মিল অনেক গরমিল, এবিএম মূসা, প্রথম আলো, ৫ মে ২০১১)।’
জনাব মূসার এই দীর্ঘ উদ্ধৃতিটি ব্যবহার করার কারণ- তিনি একজন দলনিরপেক্ষ, নির্ভীক, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য দেশপ্রেমিক সাংবাদিক। এরপরও যারা মনে করেন, আওয়ামী লীগ বিএনপির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, তাদের জন্মান্ধ কিংবা জ্ঞানপাপী ছাড়া আর কিছু বলা যায় কি?
বিগত দুঃখ-কষ্ট ও কয়েকটি প্রশ্ন
বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মীর আচরণে দুঃখ লেগেছে, কষ্ট পেয়েছি। তাদের কিছু কথা, কিছু কাজ আমাকে আহত করেছে। কিন্তু তারপরও আমার মনে হয় না যে, আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপিই ভালো, বিএনপিকেই এরপর ভোট দিবো। আওয়ামী লীগের একটা শিক্ষা হওয়া দরকার- এমন ভাবনা আমার মধ্যে আসে না এ কারণেই যে আওয়ামী লীগকে শিক্ষা দিতে গেলে সেটা দেশবাসীর জন্য বুমেরাং হতে পারে।
২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোটের সেই বিভীষিকাময় শাসনামলের কথা চিন্তা করলে সত্যিই শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে! সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়, না, আওয়ামী লীগের বিকল্প বিএনপি-জামায়াত কোনোভাবেই হতে পারে না।
বিএনপি জামায়াতকে সঙ্গে নিয়েই ক্ষমতায় গিয়েছিল। ক্ষমতা হারানোর পরও জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ আছে বিএনপি। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষ নেতার দ- হওয়ায় দেশের ভেতর জামায়াত-শিবির যে তা-ব চালিয়েছে, তার তুলনা কেবল একাত্তরের সঙ্গেই করা যায়। এ ক্ষেত্রে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির কাছ থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি। জামায়াতের রাজনীতি ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার অবস্থান অত্যন্ত পীড়াদায়ক। একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জিয়া যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে পরাজিত করেছিলেন সেই পরাজিত শক্তিকে বিএনপি এখন আগলে রাখছে কেন? রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের আগলে রাখার পরও বিএনপিকে দেশের বিবেকবান ভোটাররা সমর্থন করবে কোন যুক্তিতে?
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক ভূমিকা
রাজাকার-আলবদর ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে অনেকের মুখে অনেক রকম সমালোচনা শোনা যায়। বলা হয়, এটা নাকি মতলবের বিচার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে ব্যবসা ইত্যাদি। এসব কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলার কথা এটাই যে, গত ৪৭ বছরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দল কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কি? ৪৭ বছরের অধিকাংশ সময় যারা ক্ষমতায় থেকেছে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কোনো উদ্যোগ নেয়নি কেন? কারণ একটাই। আওয়ামী লীগই একমাত্র দল যে দল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে। সেজন্যই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে ক্ষমতায় এসে একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি রয়েছি, যারা মনে করি বাংলাদেশের জন্ম না হলে আমরা আজকের এই অবস্থায়ও পৌঁছতে পারতাম না, তারা নৌকা মার্কা ছাড়া কোন প্রতীকে ভোট দেবো? যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই যে গোলাম আযম-নিজামীদের বিচারের পেছনে আওয়ামী লীগের মতলব আছে, তারপরও বলবো, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমাদের জীবনে নিঃসন্দেহে একটি শ্রেষ্ঠ ঘটনা, শ্রেষ্ঠ পাওয়া। বাংলাদেশের মাটিতে এটা সম্ভব হবে কেউ তা ভাবতে পেরেছিল? ’৭৫ পরবর্তী প্রজন্মকে ভুল ইতিহাস শিক্ষা দিয়ে তাদের মাইন্ডসেট পরিবর্তন করে পাকিস্তানি ভাবধারায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাদেরকে বুঝানো হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যা ঘটেছিল তা সব সত্য নয়। এমনকি আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে মনগড়া ইতিহাস রচনা করে এ যুগের নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার হীন প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। আর এটা সম্ভব হয়েছে, দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে ছিল বলে।
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে, তাদের ফাঁসির রায় হবে, যাবজ্জীবন কিংবা ৯০ বছরের কারাদ- হবেÑএটা কেউ বিশ্বাস করেনি। আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, রাজাকার-ঘাতক দালালদের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়গুলো আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম। একাত্তরে যারা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছিল, সেই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি যখন জাতীয় পতাকাশোভিত গাড়িতে করে দেশের মন্ত্রী হয়েছেন, তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তি কেবলই দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন। সেই পরাক্রমশালী মন্ত্রীরা যুদ্ধাপরাধের কারণে ফাঁসির দ- পাবেন, এটা কেউ কখনও ভেবেছিল? নাকি তা ভাবা সম্ভব ছিল? শুধু এই একটি মাত্র কারণেই আওয়ামী লীগের অন্য সব দোষ-ত্রুটি মার্জনা করে অভিনন্দন জানাতে হয়। সমর্থন করতে হয়। ভোট দিতে হয়।
মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল আজ থেকে ৪৭ বছর আগে। এরপর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিই বেশিরভাগ সময় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেছে। এই দীর্ঘ সময়ে তারা নিজেদের পাপকে ধুয়েমুছে ফেলার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছে। তারা মুক্তিযুদ্ধের নায়কদের ভিলেন হিসেবে চিহ্নিত করার এবং ভিলেনদের নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টা চালিয়েছে। নতুন প্রজন্ম তাদের হিংস্ররূপের পরিচয় তেমনভাবে পায়নি। এই দীর্ঘ সময়ে তারা সামাজিক, রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এমন ব্যক্তিদের বিচারের পেছনে আওয়ামী লীগের যে ‘মতলব’ই থাকুক না কেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এদেশের কোটি কোটি মানুষ তাকে খাটো করে দেখতে পারে না। বাংলাদেশের মতো মীরজাফর-কবলিত দেশে গোলাম আযম-সাঈদী-নিজামী-মুজাহিদ-কাদের মোল্লাদের কেউ টিকি স্পর্শ করতে পারবে- এটা সত্যিই অবিশ্বাস্য ছিল। যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকাতে, এই বিচারকে বানচাল করতে চেষ্টা কিছু কম হয়নি। জামায়াত এবং তাদের সমর্থকরা বিশ্বব্যাপী প্রচারণা চালিয়েছে। আওয়ামী লীগবিরোধী প্রগতিশীলদের পক্ষ থেকেও আওয়ামী লীগকে জব্দ করতে ধর্মান্ধ-দেশবিরোধী শক্তির সঙ্গে সুর মিলিয়ে এই বিচার প্রক্রিয়ার সমালোচনা করা হয়েছে, ছোট-খাট ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলোকে অনেক বড় করে উপস্থাপন করা হয়েছে।
একটা বিষয় লক্ষণীয়। বিএনপি সমর্থকরা কখনোই বিএনপির কোনো কাজের সমালোচনা করে না, নিন্দা করে না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সমর্থকরা কিংবা আওয়ামী লীগের শুভাকাক্সক্ষীরাও প্রকাশ্যেই আওয়ামী লীগের নিন্দা-সমালোচনা করে কার্যত শত্রুর হাতেই যে অস্ত্র তুলে দেন, সেটা বিবেচনায় রাখেন না। আওয়ামী লীগকে কোণঠাসা ও অজনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মিথ্যা প্রচারণা যেমন দায়ী, তেমনি আওয়ামী লীগের শুভাকাক্সক্ষীদের তীব্র সমালোচনাও কম দায়ী নয়। আওয়ামী লীগের সীমাবদ্ধতা, ত্রুটি-বিচ্যুতি অবশ্যই আছে। কিন্তু সেগুলো বিএনপি-জামায়াতের চেয়ে বেশি নয়। আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী গোষ্ঠীর উত্থানের পথ সুগম করে দেয়া কোনোভাবেই যৌক্তিক কাজ হতে পারে না।
সেই ভয়াল স্মৃতি কি ভোলা যায়?
নির্বাচনকে সামনে রেখে এখনই কেউ কেউ আমাদের অতীত ভুলে গিয়ে সামনে তাকাতে বলছেন। বলছেন, নতুন ধারার রাজনীতির কথা ভাবতে। কিন্তু আমরা কি করে ভুলবো মুক্তিযুদ্ধের কথা, কীভাবে ভুলবো ত্রিশ লাখ শহীদের কথা? কি করে ভুলবো রাজাকার-আলবদরদের নৃশংসতার কথা, দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা? কিভাবে ভুলে যাবো বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় চার নেতা হত্যা, কি করে ভুলবো বিএনপি-জামায়াতের অপশাসন? কীভাবে ভুলে যাবো ২০০১ সালে নির্বাচনের পরের সব ঘটনা, ভুলে যাবো পাকিস্তানি স্টাইলে সংখ্যালঘুদের উপর জুলুম-নির্যাতন, দেশ ত্যাগে বাধ্য করা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইউনুস, আওয়ামী লীগ নেতা আহসানউল্লাহ মাস্টার, মঞ্জুরুল ইমাম, সাবেক অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শাহ এ এম এস কিবরিয়া, চট্টগ্রামের গোপাল কৃষ্ণ মুহুরিকে নির্মমভাবে হত্যা, লেখক হুমায়ুন আজাদের উপর হামলার ঘটনা। বানিয়ার চর খ্রিস্টান গির্জা, যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠান, ময়মনসিংহের সিনেমা হল, সিপিবির জনসভা, পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান, ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে বোমা-গ্রেনেড হামলা করে আমাদের প্রিয় স্বদেশকে এক অন্ধকার মৃত্যু উপত্যকা বানানোর স্মৃতি কী এত সহজে ভোলা যায়?
আমরা কেমন করে ভুলবো, ২০০১-এ ক্ষমতায় এসেই বিএনপি-জামায়াতের তিন মাসে পাঁচশ’র কাছাকাছি মন্দির ধ্বংসের কথা? কেমন করে ভুলে যাবো, শ’য়ে শ’য়ে নারীর ধর্ষিত হওয়ার স্মৃতি! কেমন করে ভুলে যাবো জাগ্রত মুসলিম জনতা (জেএমবি) আর হরকাতুল জিহাদ জঙ্গি নামের সন্ত্রাসী দলের কথা, বিএনপি-জামায়াতের প্রশ্রয়ে দেশের ৬৩টি জেলায় একযোগে বোমা হামলার কাহিনী? মন্দির-গির্জা-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-যাত্রা-সার্কাস এমনকি সিলেটের হজরত শাহজালাল ও সুফি মাজারে বোমা হামলার ঘটনা? বিদ্যুৎ চাওয়ার অপরাধে প্রায় এক ডজন নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে গুলি করা হয়েছে পোশাক শ্রমিকদের। হাওয়া ভবনের লুটেরা তথা তারেক-কোকো-মামুনরা কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছে। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় অনেক জাতীয় পত্রিকায় তা সবিস্তারে প্রকাশিতও হয়েছে। এসব কথা আমরা কীভাবে ভুলবো?
আওয়ামী লীগের চলার পথে বাধার পাহাড়
ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ কী করতে পারেনিÑ তা নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলছেন। আওয়ামী লীগ কি কি খারাপ কাজ করেছে তা বার বার বলা হচ্ছে। কিন্তু একবারও কী আমরা ভেবেছি, আওয়ামী লীগের চলার পথ কতটা মসৃণ ছিল? আওয়ামী লীগের ঘরে-বাইরে কি শত্রুর অভাব আছে? ২০০৮ সালে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য ষড়যন্ত্র কি কম হয়েছে? সরকার গঠনের পরপরই ঘটে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা। এই ঘটনার পেছনে কারা কলকাঠি নেড়েছে, কারা আর্মিদের উস্কানি দিয়েছে, কারা সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছে তা কি আমরা বিবেচনায় নেবো না?
শেখ হাসিনা সরকারের মেয়াদ শুরু হওয়ার পর থেকেই চলছে নানামুখী ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত। অন্য কোনো গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচিত কোনো সরকারকে এত সব বিরুদ্ধ পক্ষ মোকাবিলা করতে হয় না। পিলখানা হত্যাকা-, যুদ্ধাপরাধের বিচার থেকে শুরু করে ব্লগার ইস্যুসহ বিভিন্ন ইস্যুতে যে রকম নোংরা ও ঘৃণ্য অপপ্রচার ও মিথ্যাচার করা হয়েছেÑ এসব মোকাবিলা করে সরকারকে স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়া-অবশ্যই কঠিন। আমরা কি ভুলে যাবো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরের ঘটনাবলি, পবিত্র কোরান শরীফ পোড়ানো, আড়াই হাজার মানুষ হত্যার চরম মিথ্যা প্রচারণা এবং তাঁর সমর্থনে সংসদে বিএনপির নারী এমপির বক্তব্য?
পবিত্র ধর্মের নামে সারাদেশে যে মিথ্যাচার করা হচ্ছে, তাকে কি রাজনীতি বলা যায়? মসজিদের মাইকে মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে নিরপরাধ ব্যক্তিদের খুনের উন্মাদনা ছড়ানো হয়েছে। প্রতিপক্ষের উপর হামলা করা হয়েছে। একাত্তরে তিন লক্ষাধিক নারীর ধর্ষণের শিকার হওয়ার স্মৃতি কি আমাদের তাড়া করে না? ইসলামের নাম করে একাত্তরের খুনী-ধর্ষক সাঈদীকে চঁাঁদে দেখার গুজব ছড়িয়ে যারা শত শত মন্দির ভাঙ্গলো, বৌদ্ধ ও হিন্দুদের অসংখ্য বসত-বাড়িতে আগুন দিলো তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক জোট করাকে আমরা সহজভাবে মেনে নিলে আমরা কি বিবেকের কাছে ছোট হয়ে যাবো না?
আমরা ভুলি নাই বিএনপির শাসনামলে জঙ্গি সংগঠন জেএমবি’র পৃষ্ঠপোষক এসপি মাসুদ মিয়া, বাংলা ভাইয়ের কথা, এসপি কোহিনূরকেও ভুলি নাই- যে কি-না রাজপথে জাতীয় নেতাদের পিটিয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল!
বিএনপি’র উস্কানিতে হেফাজতের অবরোধ কর্মসূচির সময় (৫ মে ২০১৩) বায়তুল মোকাররম মসজিদে আগুন দেয়া হয়েছে, শত শত কোরান শরীফ ও জায়নামাজ পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ এসব জঘন্য কাজের নিন্দা-সমালোচনা না করে বিএনপি-জামায়াত সবাই মিলে প্রচার করলো, শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতকে সরাতে নাকি এক লাখেরও বেশি গুলি ব্যবহার করা হয়েছে। আড়াই হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া স্বয়ং প্রথমে আড়াই হাজার মানুষকে হত্যার অভিযোগ এনেছেন। পরে অবশ্য জাতীয় সংসদে প্রদত্ত বক্তৃতায় তা ৬১ জনে নেমে এসেছে। কিন্তু এই ৬১ জন নিহতের নামও তারা যোগাড় করতে পারেনি। তার মানে হচ্ছে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য তারা প্রমাণবিহীন অতিরঞ্জন করেছে। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ অত্যন্ত সরলপ্রাণ এবং আবেগপ্রবণ। যুক্তির চেয়ে গুজব তাদের কাছে কখনো কখনো বেশি বিশ্বাসযোগ্য হয়। আড়াই হাজার মানুষ খুন করে গুম করতে কতটা সময় লাগে এ প্রশ্ন তারা করে নাÑ গুজবটাই বিশ্বাস করে। যে ৬১ জনের কথা বেগম জিয়া বলেছেন, তাদের নিশ্চয়ই কবর দেয়া হয়েছে। সেই কবরই বা কোথায়? প্রশ্ন হলো, মিথ্যা বলা কি ইসলামসম্মত? মানুষের মৃত্যু নিয়ে এমন মিথ্যাচার যারা করে তাদের আমরা ভোট দিবো কোন্ বিবেচনায়?
পবিত্র ও শান্তির ধর্ম ইসলাম নিয়ে বিএনপি এবং তার সহযোগী দলগুলো প্রতিনিয়ত মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছে। সরকারের উপর কলঙ্ক লেপনের জন্য এমন মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতসহ সরকারবিরোধী পক্ষ থেকে এমন অপপ্রচারও চালানো হয়েছে যে, ৫ মে রাতে ঢাকায় হেফাজতের কর্মসূচিতে দেশের সব ইমাম-মোয়াজ্জিনদের হত্যা করা হয়েছে। কোনো মসজিদে নাকি আর আযান হবে না! আগেও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়েছিল যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে মসজিদে আযানের ধ্বনি শোনা যাবে না, উলুধ্বনি শোনা যাবে! কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দেশবাসী দেখেছে মসজিদে আযানই হয়েছে, অন্যকিছু হয়নি। ইসলাম ধর্মের জন্য আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি কাজ বিগত কোনো সরকার করেছে বলে জানা নেই। জামায়াত পবিত্র রমজান মাসেও হরতাল দিয়ে মানুষ মেরেছে, জনজীবন বিঘিœত করেছে। অথচ বিএনপি এ নিয়ে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেনি। হেফাজত ইসলামের আলেম-ওলামারা শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ উপাধি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, শেখ হাসিনার হাতেই ইসলাম সুরক্ষিত।
আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গুজব এবং মিথ্যাচার
একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর দেশে পুলিশ, আওয়ামী লীগ কর্মীসহ অসংখ্য মানুষকে খুন করা হয়েছে। দেশজুড়ে সৃষ্টি করা হয়েছে ত্রাসের রাজত্ব। অগ্নিসংযোগ, ভাঙ্গচুর, হামলা, বোমা, ইট মারাসহ জামায়াত-শিবির ও বিএনপির কর্মীরা দেশজুড়ে তা-ব চালিয়েছে। একের পর এক দেয়া হয়েছে হরতাল। হরতাল পালনে মানুষকে বাধ্য করা হয়েছে। যেসব পরিবহন শ্রমিক পেটের তাগিদে গাড়ি চালিয়েছে, তাদের দিকে বোমা ও ইট মারা হয়েছে। সিএনজি চালক, ট্রাক ড্রাইভারসহ অনেক দরিদ্র মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।
সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে গরিব বেকার ছেলেদের ব্যবহার করা হয়েছে। চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে এক গরিব দিনমজুরকে পঞ্চাশ টাকা দেওয়া হয়েছে মসজিদের দেয়াল ভাঙ্গার জন্য। টাকার জন্য সে নিজে মুসলমান হয়েও মসজিদের দেয়াল ভেঙ্গেছে। পরদিন সেই দোষ হিন্দুদের ঘাড়ে চাপিয়ে তাদের ডজন খানেক মন্দির পুড়িয়ে ফেলে স্থানীয় স্বার্থান্বেষী, মৌলবাদী চক্র। কক্সবাজারের রামুতে এক বৌদ্ধ ছাত্র কোরানের অপমান করেছেÑএই গুজব ছড়িয়ে একই কায়দায় বৌদ্ধ মন্দির ও বাড়িঘরে ব্যাপক হামলা ও ভাংচুর চালানো হয়। সবখানে ধর্মকে ব্যবহার করেছে জামায়াত-শিবির চক্র। আর তাদের হাওয়া দিয়েছে বিএনপির সুবিধাবাদী নেতারা।
আওয়ামী লীগকে বেকায়দায় ফেলার জন্য ধর্ম নিয়ে মিথ্যাচার নতুন নয়। সেই পাকিস্তানি আমল থেকেই আওয়ামী লীগকে ইসলামের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর অপচেষ্টা লক্ষ করা যায়। আওয়ামী লীগ ধর্মবিরোধী দল নয়, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে না, তারা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে বলে তাদের মিথ্যা অপবাদ সহ্য করতে হয়। ধর্ম ব্যবসায়ীরা আওয়ামী লীগকে ধর্মের প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রচার করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য? আওয়ামী লীগ করেন এমন কাউকে কি পাওয়া যাবে যিনি প্রকাশ্যে ধর্মের সমালোচনা করেছেন অথবা ধর্মবিরোধী কোনো কাজ করেছেন? নিজের পাশের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নামাজ-রোজা করা সত্ত্বেও তাদের ‘নাস্তিক’ বলা হয়। যারা এগুলো বলে তারা কি সত্যিকারের ধার্মিক? ধর্ম তো মানুষের অন্তরের বিশ্বাসের ব্যাপার। এটা তো দেখানোর ব্যাপার নয়। আওয়ামী লীগের দুর্ভাগ্য এটাই যে, ধর্ম নিয়ে মিথ্যাচারের শিকার তাদের জন্ম থেকেই হতে হয়েছে বারবার। এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী এদেশের অনেক নিরক্ষর, নিরন্ন মানুষকে ধর্মের কথা বলে ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে। তারা রাজাকারদের বাঁচানোর জন্য গুজব আর মিথ্যা কথা ছড়ানোটাকেই মূল কাজ হিসেবে বেছে নিয়েছে। ধর্ম নিয়ে রাজনীতির ফল কি হয় তা আমরা দেখেছি। পাকিস্তানের পরিণতি আমরা দেখছি। আমরা নিশ্চয়ই শান্তির ধর্ম ইসলামকে সহিংসতার ধর্ম হিসেবে পরিচিত করতে চাই না। তাই ইসলামকে রক্ষা করার নামে যারা হিংসার রাজনীতির বিস্তার ঘটাচ্ছে, তাদের যদি আমরা প্রতিহত করতে না পারি তাহলে আমরা আর নিশ্চিত ও নিরাপদ জীবনযাপন করতে পারবো না। পাকিস্তানে মসজিদে যারা হামলা করছে, তারা কেউ ‘নাস্তিক’ নয়Ñ ধর্ম ব্যবসায়ী রাজনীতির ধ্বজাধারী। আল্লাহ পরম দয়ালু, ক্ষমাশীল। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী কেউ কি আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে হত্যার জন্য প্ররোচনা দিতে পারে? অথচ এক শ্রেণির ধর্মোন্মাদ এই অপকর্মটি করছে। সে জন্য ধর্ম নিয়ে রাজনীতি বন্ধ করতে সবাইকে সচেতনভাবে এগিয়ে আসতে হবে। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করাটা চিরতরে বন্ধ করার পথ সুগম করতে হবে। নির্বাচনের কালপর্বে ধর্মের নামে আওয়ামী লীগের বিজয় ও অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে আমরা ১৯৫৪, ১৯৭০, ১৯৭৩, ১৯৯৬ ও ২০০৮ ও ২০১৪ সালেও দেখেছি, কিন্তু ধর্ম ব্যবসায়ীরা পরাজিত হয়েছে।
বিএনপিকে কেন ভোট দেওয়া উচিত নয়
ভোট একটি মূল্যবান নাগরিক অধিকার। প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য ভোট দেয়ার সময় একজন ভোটারের মাথায় অনেক রকম ভাবনা-চিন্তা থাকে। অনেকে পরিবারের লোকদের কথায় ভোট দেন। অনেকে আবার সবার মতামতের বাইরে গিয়ে ভিন্ন একটা দল বা মার্কাকে ভোট দেন। কেউ আবার হুজুগে মেতে কিংবা অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়েও ভোট দিয়ে থাকেন। যার যেরকম জানাশোনা, যুক্তি, জ্ঞান, স্মরণশক্তি সে সেরকমভাবে প্রার্থীকে মূল্যায়ন ও বিচার-বিবেচনা করতে পারে। কিন্তু ভোট একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার। এক সময় সামরিক স্বৈরশাসকরা নাগরিকদের এই অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। ভোটকে তামাশায় পরিণত করা হয়েছিল। জাল ভোট, ভোট ডাকাতি, মিডিয়া ক্যু, ভোট কেনা, ভোটের ফলাফল পাল্টে দেয়া নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। এরশাদ স্বৈরাচারের পতনের পর দেশে বিএনপির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার পরও ভোট নিয়ে ছিনিমিনি খেলার শেষ হয়নি। বেগম জিয়ার প্রথম শাসনামলেই মাগুরা ও মিরপুরের বিতর্কিত নির্বাচন হয়েছিল, যাতে ভোটাররা তাদের ইচ্ছামতো ও স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। ভোট কারচুপি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ‘আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশি তাকে দেবো’ এই স্লোগান নিয়ে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তার পরিণতিতেই আসলে দেশে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে শুরু করেছে।
আমি নিজে পরিণত বয়সের একজন রাজনীতি সচেতন নাগরিক। ছাত্রজীবন থেকেই আমি রাজনৈতিক আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক-সমতাভিত্তিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমি আমার অবস্থান থেকে সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছি। ষাটের দশক থেকে দেশের রাজনীতির উত্থান-পতনের অসংখ্য ঘটনার আমি প্রত্যক্ষ সাক্ষী। সত্তরের ঐতিহাসিক নির্বাচন থেকে শুরু করে দেশের প্রায় সবগুলো নির্বাচনেই আমি অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছি। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে কিছু কথা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন বোধ করছি।
মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে আমাদের জীবনের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল কালপর্ব। সবচেয়ে বড় পাওয়া। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। আজকে আমাদের যতটুকুও যা উন্নতি, তা সম্ভব হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে বলেই। আজ যদি আমরা পাকিস্তানের অংশ থাকতাম, তাহলে এই ভূখ- হতো জঙ্গি তালেবান অধ্যুষিত একটি গরিব অঞ্চল। স্বাধীনতার আগে যেভাবে পাকিস্তানিরা একই দেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও আমাদের উপর শোষণ-নির্যাতন-জুলুম চালিয়েছিল, আমাদের গরিব মজুরে পরিণত করেছিল, আমরা স্বাধীন না হলে সেই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। এখনও আমাদের পাকিস্তানিদের গোলামি করেই কাটাতে হতো। আমরা সৌভাগ্যবান যে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। আর বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে এদেশের লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষ জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাদের অপরিসীম ত্যাগ, সাহস ও বীরত্বের জন্যই আমাদের আজকের স্বাধীন স্বদেশ। প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ!
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই স্বাধীনতার জন্য আমাদেরকে কোন দল নেতৃত্ব দিয়েছিল? সেই সময়ে অন্যান্য দল কি করেছিল, কাদের ভূমিকা কেমন ছিল, তা কি আমাদের বিবেচনাবোধকে সতর্ক করে দেয় না? হ্যাঁ, দেয়। দেয় বলেই আমরা মনে করি, সংবিধানবিরোধী অগণতান্ত্রিক পন্থায় সৃষ্ট বিএনপির সামগ্রিক ভূমিকার কারণে এই দলটিকে কোনো যুক্তিতেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেয়া যায় না। ওদেরকে কেন আমরা ভোট দেবো না? কারণ ওরা গণবিরোধী, দেশবিরোধী। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলাম ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে, পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতকে ‘অপরাধী সংগঠন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিএনপি নামক দলটির তখন জন্ম হয়নি। কিন্তু জন্মের পর থেকে বিএনপি সব সময় ওই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ‘অপরাধী’ দলটিকেই আশ্রয়-প্রশ্রয়-সমর্থন দিয়ে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি হিসেবে আমরা জামায়াতকে ঘৃণা করি। আর জামায়াতকে সমর্থন ও সহযোগিতা দেয়ার কারণে বিএনপিকে ভোট দেয়াটাও যে-কারো কাছে বাংলাদেশের আদর্শবিরোধী কাজ বলেই বিবেচিত হওয়া উচিত।
উন্নয়ন নয় সন্ত্রাস ও দুর্নীতি, বিএনপি-র মূল নীতি
বিএনপি যখনই ক্ষমতায় এসেছে, তখনই তারা সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করতে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছে। বাংলাদেশের উন্নয়নে তথা বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে এরা বিন্দু পরিমাণ মনোযোগ দেয়নি। দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে দেশের রাজনীতিবিদদের বিভিন্নভাবে হত্যা করে দেশকে লুটপাটের অভয়ারণ্য বানানোর পাঁয়তারা বিএনপি সৃষ্টির পর থেকে করে আসছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে (১৯৯১, ২০০১) বিএনপি এমন কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেনি, যা দেখে বাংলার মানুষ অহংকার করতে পারে। তারা শুধু লাটপাট করেছে এবং জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দিয়ে বাংলার মানুষকে আগুনের সন্ত্রাস উপহার দিয়েছে। নি¤েœ বিএনপি-র বাংলাদেশ বিরোধী কিছু কর্মকাণ্ডের দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো:
বরিশালে বিএনপির দখল অভিযান
সরকার গঠনের আগেই বরিশালে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দখল অভিযানে নেমেছে বিএনপি। গতকাল রাত থেকে শহরের কয়েকটি আওয়ামী লীগ অফিস ক্লাব দখল করে নিয়েছে বিএনপির ক্যাডাররা। এছাড়াও শহরে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত কয়েকটি এলাকা থেকেও বিএনপি কর্মীদের হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের খবর পাওয়া গেছে। এদিকে মঙ্গলবার রাতে শহরের ভাটিখানা ও কাউনিয়া এলাকায় বেশ কিছু হিন্দু পরিবারকে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মী-সমর্থকরা বাড়িঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ৪ অক্টোবর ২০০১, প্রথম আলো।
আওয়ামী লীগ সমর্থক ও সংখ্যালঘুরা অসহায়
বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় নির্যাতিন অব্যাহত, প্রশাসন নীরব : বরিশাল জেলাসহ বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় ভোটের পরদিন থেকে আওয়ামী লীগ কর্মী, সমর্থকদের উপর একের পর এক হামলা, বাড়িঘর দোকারপাট ভাঙচুর লুটপাট অব্যাহত রয়েছে। এসব সহিংসতা বন্ধে প্রশাসন থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। বরিশালের উজিরপুরে শুধু আওয়ামী লীগই নয় ওয়ার্কাস পার্টি, জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থীদের সমর্থক সংখ্যালঘু পরিবারের ওপরও চলছে নির্যাতন। কেবল হামলা, ভাঙচুর, লুট বা হুমকিই নয়, নারী নির্যাতনের ঘটনাও ঘটে গেছে ভোটের দিন থেকে এ পর্যন্ত কয়েক দফা। ৯ অক্টোবর ২০০১ মঙ্গলবার, প্রথম আলো।
সরিষাবাড়ীতে বিএনপির নির্বাচনোত্তর তাণ্ডব
আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী-সমর্থক ও সংখ্যালঘুরা ভয়ে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিচ্ছে।
জেলার সরিষাবাড়ীতে নির্বাচনোত্তর বিএনপির সন্ত্রাসী তাণ্ডবলীলা, লুট ও হুমকি-ধামকি অব্যাহত রয়েছে। ওই সন্ত্রাসের শিকায় হয়ে অনেক আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী-সমর্থকরা এলাকা ছেড়ে জামালপুর শহরসহ সরিষাবাড়ীর আশেপাশে আশ্রয় নিচ্ছে। তাদের অভিযোগ থানা পুলিশ গ্রহণ করছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। সরিষাবাড়ীর পিংনা ইউনিয়নের বাড়ইপটল গ্রামের বাসিন্দা সাবেক ইউপি সদস্য সুনীল চন্দ্র ঘোষ গত শনিবার রাতে এ প্রতিনিধিকে জানান বিএনপির স্থানীয় ২০/২৫ জন সশস্ত্র যুবক গত ২ অক্টোবর সকালে মিছিল নিয়ে গিয়ে তার বাড়িতে চড়াও হয়। পরদিন সন্ত্রাসীরা বাড়ইপটল বাজারের রিন্টু ঠাকুর ও লিচু মিয়ার দুটি কাপড়ের দোকান ও মোতালেবের মনোহারী দোকানে ভাঙচুর লুটপাট করে। বাড়ইপটল এলাকায় ২২৫ জন সংখ্যালঘু ভোটার রয়েছেন। সন্ত্রাসীরা তাদের প্রত্যেকের বাড়িতে হুমকি দিচ্ছে। ভয়ে আতঙ্কে অনেকে গ্রাম ছেড়ে শহরে আশ্রয় নিচ্ছে। ৮ অক্টোবর ২০০১, প্রথম আলো।
লুটপাটের পর বাড়ির সামনে ‘বিক্রি হবে’ সাইনবোর্ড!
জেলার বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ সমর্থক ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা অব্যাহত রয়েছে। গত কয়েকদিনে স্থানীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও লুটপাটের কারণে তারা প্রাণ বাঁচাতে অন্য জায়গায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। সদর উপজেলার চরাঞ্চল নলবিনিয়াকান্দিতে বিএনপি সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে সংখ্যালঘুদের গরু-ছাগল ও নৌকাসহ সব কিছু লুট করে নিয়ে যায়। ১০ অক্টোবর ২০০১, প্রথম আলো।
গৌরনদী-আগৈলঝাড়ায় নির্বাচনী বিজয়ের পাশবিক উল্লাস, প্রশাসন নীরব
অষ্টম জাতীয় সংসদের নির্বাচনের আগেই গৌরনদী আগৈলঝাড়ায় যে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন ও সন্ত্রাস শুরু হয়েছে, নির্বাচনের পর তা আরো বেড়ে গেছে। সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা কেউ কেউ নির্যাতনের শিকার হয়ে আবার কেউ কেউ নির্যাতনের আশঙ্কায় ভীত সন্ত্রস্তভাবে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে গৃহবন্দি জীবন কাটাচ্ছেন। গৌরনদী-আগৈলঝাড়া থানার বিভিন্ন গ্রামে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে।
স্থানীয় সূত্র জানায় গৌরনদী থানায় বিএনপির কতিপয় নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার নিপীড়ন চালাচ্ছে, এরা চাঁদাবাজি লুটপাট, ধর্ষণসহ গরুছাগল পর্যন্ত লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। ১২ অক্টোবর ২০০১, আজকের কাগজ।
বরিশালের হিজলায় বিএনপি ক্যাডারদের দাপট
গ্রামছাড়া নিতাই মায়ের মৃত্যুর খরব পেয়েও ঘরে ফিরতে পারেননি।
বরিশালের হিজলার ধুলখোলা ইউনিয়নের আলীগঞ্জ বাজারের ক্ষুদ্র সেলুন ব্যবসায়ী নিতাই শীল বৃদ্ধা মায়ের সঙ্গে শেষ দেখাও করতে পারেননি। ধর্মীয় বিধান অনুসারে মায়ের মৃত্যুর পর শেষ কৃত্যানুষ্ঠানেও যোগ দিতে পারেননি তিনি। বিএনপির সন্ত্রাসীরা তাকে গ্রাম ছাড়া করেই ক্ষান্ত হয়নি, উপরন্তু মায়ের মৃত্যুর পর নিতাইকে নিজ গ্রামে ঢুকতে দেয়নি। ১২ অক্টোবর ২০০১, প্রথম আলো।
নির্বাচনের পর নির্যাতন। পার্বতীপুর নৌকার সমর্থকরা হাটে যেতে না পেরে বসিয়েছে আলাদা বাজার
নির্বাচনোত্তর সহিংসতায় পার্বতীপুরের পরিস্থিতি এখনও অশান্ত ও উত্তপ্ত। আওয়ামী লীগ সমর্থক ও সংখ্যালঘুদের নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে। সুযোগ পেলেই নৌকার সমর্থক বলে তাদের মারধর করা হচ্ছে। এই অত্যাচারে শেষ পর্যন্ত বাজার-হাট করার জন্য আলাদাভাবে বাজার বসানো হয়েছে। ২০ অক্টোবর ২০০১, জনকণ্ঠ।
মীরসরাই দাশপাড়ায় মধ্যরাতে বিএনপি সন্ত্রাসীদের তা-ব। নিহত ১ আহত ৩০
মীরসরাই উপজেলার মিঠানালার দাশপাড়ায় সোমবার মধ্যরাতে বিএনপি সন্ত্রাসীদের হামলায় আওয়ামী লীগ কর্মী সুনিল দাস সাধু (২৮) নিহত এবং প্রায় ৩০ জন নারী ও শিশু আহত হয়েছে। জানা গেছে হামলা ও লুটপাটে ৫১টি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। ৭ নভেম্বর ২০০১, আজকের কাগজ।
নিজ বাসায় নৃশংসভাবে খুন অধ্যক্ষ গোপালকৃষ্ণ মুহুরী
চট্টগ্রামে নিজ বাসভবনে অধ্যক্ষ গোপাল মুহুরীকে গুলি করে হত্যা
হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জামাত-শিবির ক্যাডাররা জড়িত, পুলিশ
গতকাল শুক্রবার সকাল সোয়া ৭টায় নগরীর কেন্দ্রস্থল জামাতখান রোডে নিজ বাসায় নৃশংসভাবে খুন হয়েছে হাটহাজারী উপজেলা নাজিরহাট ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ গোপালকৃষ্ণ মুহুরী (৫৮)। সস্ত্রাসীরা সকালে তার বাসায় ঢুকে মাথায় রাইফেল ঠেকিয়ে গুলি করে তাকে হত্যা করার পর বেবিট্যাক্সি নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। ১৭ নভেম্বর ২০০১, যুগান্তর।
সাকা ক্যাডাররা পাঁচ লাখ টাকা না পেয়ে অপহরণ করেছে নলিনী মাস্টারকে
রাউজানে নলিনী মাস্টার বলে পরিচিত এক ব্যক্তিতে সাকার (সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর) ক্যাডাররা অপহরণ করে নিয়ে গেছে। পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা না দেওয়ায় রাউজানের ডাবুয়া এলাকার জগন্নাথহাট হতে ক্যাডাররা তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। ১২ ডিসেম্বর ২০০১, জনকণ্ঠ।
আমাদের মনে আছে যে, ২০০১ সালের মধ্য জুলাইয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দেশে যে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের সূচনা ঘটে, নির্বাচনের পর তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম তিন মাসে এমন একটি দিন পাওয়া যাবে না, যেদিন দেশের কোথাও না কোথাও সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি। ওইসব সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ধরন লক্ষ করলে দেখা যায় যে হত্যার চেয়ে শারীরিক নির্যাতন, লুন্ঠন, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, বলপূর্বক চাঁদা আদায় ও ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটেছে। ধর্ষণের ক্ষেত্রে ছয় বছরের শিশু থেকে ষাট বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। সিরাজগঞ্জের কিশোরী কন্যা পূর্ণিমাকে গণধর্ষণের কথা আমরা কী করে ভুলবো? আমাদের কি কোনোভাবে ভুলে থাকার উপায় আছে, সেই সময়ের করুণ আর্তির কথা যিনি দুর্বৃত্তদের উদ্দেশ্যে মিনতি করে বলছেন, বাবারা তোমরা একজন একজন করে ঘরে আসো, আমার মেয়েটা খুব ছোট!
বিভিন্ন জায়গায় ধর্ষণের পর ওই নারীর লাঞ্ছনা আরো বাড়ানোর জন্য তাকে বিবস্ত্র করে প্রকাশ্য জনপদে ঘুরিয়ে চরম পাশবিকতার পরিচয় দিয়েছিল বিএনপি-জামায়াত শিবিরের পাষ-রা। সংখ্যালঘু হওয়ার অপরাধে হত্যা করা হয়েছে সদ্যজাত শিশু থেকে আরম্ভ করে পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত। হত্যার কবল থেকে কলেজের অধ্যক্ষ, মন্দিরের পুরোহিত, বৌদ্ধ ভিক্ষু কেউ রেহাই পাননি। চট্টগ্রামের বর্ষীয়ান কলেজ অধ্যক্ষ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরি, বৌদ্ধ ভিক্ষু জ্ঞানজ্যোতি মহাথেরো, ভিক্ষু দুলাল বড়–য়া ও হিন্দু পুরোহিত মদনমোহন গোস্বামীকে হত্যা করা হয়েছে, যাদের সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক ছিল না।
২০০১ সালের নির্বাচনের পর দেশজুড়ে শত শত সহিংসতার মধ্যে সংবাদপত্রে প্রকাশিত মাত্র কয়েকটি শিরোনাম এখানে তুলে ধরছি :
– ২০ জেলায় আওয়ামী লীগ ও সংখ্যালঘুদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা : নিহত ৯ : প্রথম আলো, ৫ অক্টোবর, ২০০১।
– সারা দেশে নির্বাচনপরবর্তী পরিস্থিতিতে ব্যাপক নৈরাজ্য এবং সংঘাত ও সহিংসতা, আইন শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে, সরকার নিষ্ক্রিয়, পুলিশ ও সেনাবাহিনী নীরব দর্শক : সংবাদ, ৫ অক্টোবর, ২০০১।
– বাগেরহাট জেলার গ্রামগুলো থেকে বহুসংখ্যক হিন্দু ও আওয়ামী লীগ কর্মী এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। সংবাদ, ৫ অক্টোবার, ২০০১।
– নৌকায় ভোট দেয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শত শত মানুষ ঘরছাড়া। প্রাণনাশের হুমকি। বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট, পুলিশ নির্বিকার : জনকণ্ঠ, ৬ অক্টোবর, ২০০১।
– দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ সমর্থক ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা অব্যাহত : প্রথম আলো, ৭ অক্টোবর, ২০০১।
– বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ সমর্থক ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, গবাদি পশু ও গাছপালা কেটে নেয়ার অভিযোগ : আজকের কাগজ, ৭ অক্টোবর, ২০০১।
– সাঈদীর এলাকা এখন বিপজ্জনক জনপদ। আগুন দেয়া হচ্ছে সংখ্যালঘুদের বাড়িতে : জনকণ্ঠ, ৭ অক্টোবর, ২০০১।
– বিএনপির শুদ্ধি অভিযানে বরিশালে দুই উপজেলার সংখ্যালঘুরা এলাকা ছেড়েছে, মন্দির ভাঙচুর, বাড়িতে আগুন, লুটপাট, তরুণীদের অনেকেই স্কুল-কলেজ যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে : জনকণ্ঠ, ৮ অক্টোবর, ২০০১।
– তিন জেলার ১৫ হাজার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও সংখ্যালঘু আশ্রয় নিয়েছে কোটালীপাড়ায় : যুগান্তর, ১০ অক্টোবর, ২০০১।
– অব্যাহত হামলার মুখে উত্তরের অনেক জেলা থেকে সংখ্যালঘুরা দেশত্যাগ করছেন : প্রথম আলো, ১০ অক্টোবর, ২০০১।
– গৌরনদী-আগৈলঝাড়ার চিত্র : ধানের শীষে ভোট দিয়েও সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হচ্ছে : যুগান্তর, ১০ অক্টোবর, ২০০১।
– সংখ্যালঘুদের জন্য চনপাড়া এখন আতঙ্কের জনপদ। বিএনপি সন্ত্রাসীদের ভয়ে ঘরছাড়া তরুণরা, মেয়েদের তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি : আজকের কাগজ, ১০ অক্টোবর, ২০০১।
– আতঙ্কিত সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগ; সাতক্ষীরার সীমান্তে নারী শিশুসহ ৯৯ সংখ্যালঘু বিডিআরের হাতে আটক : প্রথম আলো, ১২ অক্টোবর, ২০০১।
– ভোলার নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের আহাজারি : প্রধানমন্ত্রীকে বলবেন, আমরা ভোট দেইনি, আগামীতেও দেবো না, শুধু এ দেশে থাকতে চাই: সংবাদ, ২৩ অক্টোবর, ২০০১।
উপরের ঘটনাগুলো ২০০১ সালের সামগ্রিক ঘটনার খুবই ক্ষুদ্র অংশ। শুধু ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সময়েই নয়, এমন হামলা বিএনপি-জামায়াত এখনো অব্যাহত রেখেছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াত নেতা সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পরও সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় হামলার ঘটনা ঘটেছে। বিএনপিকে যদি আবার ভোট দিয়ে বিজয়ী করা হয়, তাহলে এই দেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বুকের রক্তে ও চোখের জলে জনপদ ভেসে যাবে। সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষে ঢেকে যাবে শ্যামল বাংলা।
দেশের কোনো সচেতন মানুষ কিছুতেই আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিকে আর ভোট দেবে না, ভোট দিতে পারে না।
হাওয়া ভবন আবার ফিরে আসুক তা কি আমরা চাইতে পারি?
বিএনপির আমলে হাওয়া ভবন হয়ে উঠেছিল এক বিকল্প সরকার। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব সাবেক সাংসদ মোসাদ্দেক আলী ফালু বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে দ্বৈতশাসনের কথা স্বীকার করেছেন। বলেছেন :
‘ওই সময়েই একটি ছায়া সরকার তৈরি হয়েছিল হাওয়া ভবনে। তিনি বলেছেন, ওই সময় হাওয়া ভবনকেন্দ্রিক একটি প্যারালাল সরকার পরিচালিত হচ্ছিল। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে নিয়োগ, বদলি থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারণী অনেক সিদ্ধান্তই আসতো হাওয়া ভবন থেকে। ওই ভবন থেকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অনেক মন্ত্রণালয়ে খবরদারির জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছিল হাওয়া ভবন ঘনিষ্ঠ বিএনপির অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতাদের। ওই চক্রটি মন্ত্রণালয়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ‘ডকুমেন্ট’ সংগ্রহ করে তা হাওয়া ভবনে নিয়ে যেতো। তাদের দাপটে অনেক মন্ত্রী ও প্রবীণ নেতা তটস্থ থাকতেন। ফালু বলেছেন, হাওয়া ভবনকেন্দ্রিক ওই চক্রটি গত ৫ বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে। তার মতে, ‘হাওয়া ভবনের কারণেই বিএনপি ডুবেছে’।
ফালু বলেন, ২০০১ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিয়ে বিএনপি জোট ক্ষমতা গ্রহণের পর হাওয়া ভবনের দাপট বেড়ে যায়। ওই ভবনে বসেই কলকাঠি নাড়তেন তারেক রহমান ও তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আল মামুন। এক সময় তাদের সঙ্গে যারা যোগ দেন তাদের মধ্যে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী নাজমুল হুদা, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী মির্জা আব্বাস, স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী আমানউল¬াহ আমান, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমেদ, ভূমি উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ, কৃষি প্রতিমন্ত্রী ও বর্তমান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, নাদিম মোস্তফা, অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু, সংসদ সদস্য আলী আসগার লবি, এএইচএম সেলিম, নাসিরউদ্দিন পিন্টু, সালাহউদ্দিন আহমেদ, হেলালুজ্জামান তালুকদার লালু, আবুল খায়ের ভূঁইয়া ও ছাত্রদল নেতা আজিজুল বারী হেলাল প্রমুখ। হাওয়া ভবনকেন্দ্রিক এসব মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও নেতাদের দাপটে এক পর্যায়ে জিম্মি হয়ে পড়েন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। এ চক্রের সদস্যরা যেমন নিজেরা দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তেমনি তারেক-মামুনকেও এনে দিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। (যুগান্তর, ১৪ জুন, ২০০৭)।
হাওয়া ভবনের কোটি কোটি টাকার ধামাচাপা বাণিজ্য
জোট সরকারের সময় সবক’টি বড়ো দুর্নীতি ও আলোচিত হত্যাকা-ের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার বিনিময়ে দুর্নীতির তীর্থ বনানীর হাওয়া ভবন সংশ্লিষ্টরা কোটি কোটি টাকা উৎকোচ আদায় করেছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান, তাদের পরিবারের সদস্যবর্গ, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও তারেক রহমানের বন্ধু বিতর্কিত ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন আল মামুনসহ হাওয়া ভবন সিন্ডিকেট এসব টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন। বসুন্ধরা গ্রুপের পরিচালক সাব্বির হত্যাকাণ্ড, সিদ্ধেশ্বরী স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সাবেরা বেগম ও তার মেয়ে হত্যাকাণ্ড, যুবদল নেতা সাগীর হত্যাকাণ্ড, চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী জামাল উদ্দিন হত্যাকাণ্ড, বগুড়ার কাহালু ও চট্টগ্রামের ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, বিডি ফুডসের বিদেশে পণ্য সামগ্রী পাঠানোর আড়ালে হেরোইন পাচারের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার বিনিময়ে হাওয়া ভবন সিন্ডিকেট স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের যোগসাজশে প্রায় দেড়শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এসব ঘটনার সঙ্গে দুর্নীতির ত্রিরতœ সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার দুই পুত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান এবং গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের সরাসরি যোগসূত্র রয়েছে। (ভোরের কাগজ, ১০ জুলাই ২০০৭)।
হাওয়া ভবনের চাপে পাঁচশ’ কোটি টাকা ‘ফোর্স’ লোন
বিগত জোট সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে হাওয়া ভবন থেকে চাপ দিয়ে বিএনপির আশীর্বাদপুষ্ট কিছু ব্যবসায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের রাজধানীর রমনা কর্পোরেট ও নারায়ণগঞ্জ মহিলা শাখা থেকে পণ্য রফতানির নামে পানির মতো ঋণ নিয়েছেন। রাজনৈতিক চাপ ও প্রভাবের কারণে সংশ্লিষ্ট শাখা দুটির ব্যবস্থাপকরা গ্রাহকদের ডেকে এনে শুধু আবেদনের ভিত্তিতে ব্যাক টু ব্যাক এলসির বিপরীতে দিয়েছেন ঋণ। এক্ষেত্রে কোনো ব্যাংকিং নিয়মনীতি মানার তোয়াক্কা করা হয়নি। রফতানি শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণ দেয়া হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা অন্য খাতে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ফলে ব্যাংকের ঋণ আদায় হয়নি। এতে ওই দুটি শাখায় প্রায় ৫০০ কোটি টাকার ফোর্স লোনের সৃষ্টি হয়েছে। বেআইনিভাবে এসব ঋণ দিতে ব্যাংকের ওপর বিএনপির বনানীতে অবস্থিত হাওয়া ভবনকেন্দ্রিক ব্যবসায়ীদের একটি গ্রুপ প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছিল বলে জানা গেছে। (দৈনিক সমকাল, ১ আগস্ট ২০০৭)।
চুক্তিতে মানুষ খুনের টাকার ভাগও যেতো হাওয়া ভবনে
দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বিএনপি নেতারা নিজেদের মতো করে ব্যবহার করেছেন। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে তারা চারদলীয় জোটের প্রার্থীদের পক্ষে প্রকাশ্যে প্রচারণা চালিয়েছেন। অনেকে ছিল বিএনপি চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে। জোট সরকারের সময় সন্ত্রাসীরা জমি দখল, গার্মেন্টস ব্যবসা, ঝুট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করেছে কোটি কোটি টাকা। চুক্তিতে মানুষ হত্যা করেছে। এসব টাকা ৩ ভাগ হতো। একভাগ পেতো হাওয়া ভবনকেন্দ্রিক গডফাদাররা, এক ভাগ স্থানীয় প্রশাসন এবং আরেক ভাগ থাকতো সন্ত্রাসীদের। ভারত থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা ৩ শীর্ষ সন্ত্রাসী তাজ, লম্বু সেলিম ও ইব্রাহীম জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানিয়েছে। (ভোরের কাগজ, ১২ অক্টোবর ২০০৭)।
তারেক রহমানের হলফনামা
বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান ২০০৭ সালে কবুল করেছিলেন যে, বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের সঙ্গে অজান্তেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সে সময় একটি লিখিত হলফনামাও দেন তিনি। স্বহস্তে স্বাক্ষরিত ১২ মার্চের ওই হলফনামায় উল্লেখ করেছেন কীভাবে মামুন দুর্নীতি করেছেন। তাকে কখন কীভাবে মামুন টাকা-পয়সা দিয়েছেন। বিদেশি ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা থেকে কীভাবে তিনি ভাগ পেয়েছেন তারও বর্ণনা দিয়েছেন। জনগণের জ্ঞাতার্থে হলফনামাটি তুলে ধরা হলো :
আমি তারেক রহমান নিম্নে বর্ণিত ঘটনার জন্য আমার পরিবার, দেশের মানুষ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সকল শ্রেণীর নেতাকর্মী ও সমর্থকবৃন্দের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।
আমি গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের প্ররোচনায় তার বহু অবৈধ আয় সম্পর্কে জ্ঞাত হইলেও তা থেকে তাকে বিরত হইতে নিষেধ করি নাই, যা পরোক্ষভাবে তাকে সমর্থন দেওয়া হয়। তার ওয়ান গ্রুপ-এর সকল প্রতিষ্ঠানে সে আমাদেরকে মৌখিকভাবে সাথে রাখে এবং ফলে এই প্রতিষ্ঠানগুলি গড়তে সে বিভিন্নভাবে অবৈধ আয় করে। এই অবৈধ আয় থেকে সে আমাকে আমার রাজনৈতিক খরচের নামে বিভিন্ন সময়ে অর্থ প্রদান করেছে, যা নীতিগতভাবে অন্যায়। কিন্তু আমরা তাকে বারণ করি নাই।
গিয়াস উদ্দিন আল মামুন তার বৈধ ও অবৈধ উপার্জনের একটি অংশ বিদেশে গচ্ছিত করে একটি ব্যাংকে রাখে। যার সঠিক পরিমাণ আমার জানা নেই। সেখানে গচ্ছিত অর্থ সম্পর্কে যাতে আমি কোনো অনুসন্ধান বা আপত্তি না করি তার জন্য সে আমাকে তার সেই ব্যাংক-এর একটি সাপ্লি-মিনটারি ক্রেডিট কার্ড তৈরি করে দেয়, যা থেকে বিভিন্ন সময়ে আমি কিছু অর্থ নিজ প্রয়োজনে খরচ করেছি।
বিভিন্ন সময়ে এই ধরনের অবৈধ আয় সম্পর্কে জানলে আমি তাকে প্রশ্ন করি, কিন্তু সে অস্বীকার করে। সরল বিশ্বাসে আমি তার কথা বিশ্বাস করেছি। যার ফলে তার এই দুর্নীতির একটি পরোক্ষ অংশে আমি পরিণত হয়েছি। পরিশেষে আমি আবারও দেশের সকল মানুষের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমি জ্ঞাতভাবে বা অজ্ঞাতভাবে মামুন এবং তার সহযোগীদের দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছি। আমি আল্ল¬াহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমি আমার পরিবার এবং দেশের মানুষের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমার সর্বশেষ অনুরোধ দেশের মানুষের কাছে, আমি ভুল করেছি, আমাকে একটি বারের মতো আপনারা ক্ষমা করুন।
তারেক রহমান
পিতা-শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান
মাতা- বেগম খালেদা জিয়া
৬, শহীদ মঈনুল রোড,
ঢাকা সেনানিবাস, ঢাকা-১২০৬।
তারিখ : ১২ মার্চ, ২০০৭
(দৈনিক মানবজমিন, ২০ মে, ২০০৭)
তারেকের বন্ধু মামুনের হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ
তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও বিতর্কিত ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের হাজার কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। সরকারের নির্ধারিত রেট অনুযায়ী মামুনের এই সম্পদের মূল্য দেড়শ’ কোটি টাকা হলেও বর্তমান বাজার মূল্যে তা এক হাজার কোটি টাকারও বেশি হবে বলে জানা গেছে।
সরকারি মূল্যে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জোট সরকারের পাঁচ বছরেই মামুন চাপপ্রয়োগ এবং অবৈধ পন্থায় এই বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন। এর আগে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত বিএনপি সরকারের সময়ও তিনি অবৈধ উপায়ে অনেক অর্থসম্পদ করেন। তবে তা গত ৫ বছরের তুলনায় নিতান্তই কম। মাত্র দুই মাসের তদন্তে মামুন ও তার স্ত্রীর নামে এই হাজার কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান মেলে। এর মধ্যে অবশ্য কয়েক কোটি টাকার সম্পদ বৈধ করা হয়েছে আয়কর প্রদানের মাধ্যমে। কর্মকর্তারা জানান, স্বল্প সময়ের তদন্তে মামুনের যে পরিমাণ অবৈধ অর্থের সন্ধান মিলেছে তার চেয়ে বহুগুণ টাকা বা সম্পদ রয়েছে বিদেশে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৯১ সালে মামুন মাত্র ৪০ হাজার টাকার পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করে কয়েক বছরের ব্যবধানে ড্যান্ডি ডায়িংসহ একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তারেক রহমানের বন্ধু পরিচয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে মামুন ধীরে ধীরে অর্থসম্পদের পরিমাণ বাড়াতে থাকেন। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের পাঁচ বছরে মামুন অবৈধভাবে তেমন অর্থসম্পদ উপার্জন করতে পারেননি। তদন্ত কর্তৃপক্ষের মতে, মামুনের অবৈধ সম্পদ উপার্জনের সঙ্গে তার স্ত্রী শাহীনা ইয়াসমিনেরও ভূমিকা ছিল। শাহীনার নামেও গড়ে তোলা হয় কোটি কোটি টাকার সম্পদ।
তদন্তে স্থাবর সম্পদের মধ্যে বর্তমান বাজার মূল্যের চেয়ে ৫ থেকে ১০ ভাগেরও কম মূল্যে দলিল করা মামুনের গুলশানের ১০ কাঠা ১৫ ছটাক ২১ বর্গফুটের একটি প্ল¬টের সন্ধান পাওয়া গেছে। ২০০৫ সালের ৮ জুন ওয়ান প্রপার্টিজ লিমিটেডের পক্ষে মামুন তা কেনেন। রেজিস্ট্রেশন খরচসহ ওই জমির মূল্য পড়েছে মাত্র ১ কোটি ১৮ লাখ ৯ হাজার ৬১৮ টাকা। তেজগাঁও শিল্প এলাকায় ৩.৫০ একর জমি রেজিস্ট্রেশন খরচসহ কেনা হয়েছে ৫ কোটি ৫০ হাজার টাকায়। গাজীপুরের মৌচাক মৌজায় এবং কালিয়াকৈর মৌজায় ২০০২ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে ১১টি স্থানে মামুন কিনেছেন প্রায় ৯ একর জমি। যার রেজিস্ট্রেশন মূল্য মাত্র ৩০ লাখ টাকা। অথচ বর্তমান বাজারদর হিসাবে সেই জমির মূল্য রয়েছে প্রায় ২ কোটি টাকা। ভোলা পৌরসভার নবীপুর মৌজায় ৪৮ শতাংশ এবং বোরহানউদ্দিনে ৪০ শতাংশ জমি রয়েছে মামুনের। যার দলিল মূল্য ৯ লাখ ৪ হাজার ৬৯৫ টাকা।
কক্সবাজার সদরে ২০০২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ১৪ দাগে মামুন কিনেছেন প্রায় ১৩ একর সম্পত্তি। যার দলিল বা রেজিস্ট্রি মূল্য পাওয়া গেছে ৫১ লাখ ২১ হাজার ৭৭৫ টাকা। যদিও কক্সবাজারের মতো পর্যটন এলাকায় এই জমির বর্তমান বাজার মূল্য তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। উত্তরায় ১০.৬০ কাঠার ওপর ২০০৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি মামুন নিজ নামে গড়ে তোলেন আলিশান বাড়ি। বাড়ির মূল্য দেখানো হয়েছে রেজিস্ট্রেশন খরচসহ ১৬ লাখ ৪৩ হাজার ১৩১ টাকা। কিন্তু দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তা সহকারী পরিচালক সৈয়দ তাহসিনুল হকের নেতৃত্বে গঠিত টিম জমির ওপর নির্মিত ভবন পরিমাপ করে দেখতে পায়, কমপক্ষে ৩ কোটি টাকার মতো খরচ হয়েছে বাড়িটি করতে।
মামুন ২০০৫ সালের ২৮ জুন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় তার মেয়ের নামে ২০ কাঠার প্লট কেনেন। যার দলিল মূল্য ৪ লাখ ৯৫ হাজার ২৪৭ টাকা হলেও বাজার মূল্য ৪ কোটি টাকার উপরে বলে মনে করেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। তবে যেহেতু এলাকাভেদে সরকারের নির্ধারিত রেটে জমিগুলো রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে তাই জমির দাম বাজারদরের চেয়ে অনেক কম পাওয়া যায়। প্রাপ্ত হিসাবে সরকারি রেটে মামুনের জমিজমা রয়েছে ১০ কোটি ২৫ লাখ টাকার।
মামুন তার স্ত্রী শাহীনা ইয়াসমিনের নামে ৬ নম্বর পুরাতন ডিওএইচএস এলাকায় ২০০২ সালে সাড়ে ১২ কাঠা জমি কেনেন এবং গড়ে তোলেন আলিশান বাড়ি। মামলার এজাহার অনুযায়ী ওই জমি ও বাড়ির রেজিস্ট্রেশন মূল্য ৭ কোটি ৮ লাখ ৪৫ হাজার ৬৭৭ টাকা। এ জমি ও বাড়ি আয়কর বিভাগে প্রদর্শন করা হয়েছে। শাহীনার নামে গাজীপুরের সাউথ ছায়াবীথি এলাকায় ১৭.২৫ কাঠা জমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছে তিনতলা বাড়ি। তদন্তে সরকার নির্ধারিত রেট অনুযায়ী বাড়িটির মূল্য পাওয়া যায় ৫৪ লাখ ৩৩ হাজার ৬১০ টাকা। ২০০৫ সালের ৪ জুন এ জমি কেনা হয়। যদিও বর্তমান বাজারদর হিসাবে এর বাজার মূল্য হবে অন্তত ৫ কোটি টাকার মতো। বনানীতে শাহীনার নামে ২০০৩ সালের ১৪ জানুয়ারি তিন হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কেনা হয়। যার রেজিস্ট্রেশন মূল্য দেখা যায় মাত্র ৩১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ২০০৩ সালের বাজারদর অনুযায়ী ওই ফ্ল্যাট কেনা হয়েছে কোটি টাকার উপরে। তাছাড়া মামুনের স্ত্রীর নামে ধানম-ির ১০/সি, ফ্রি স্কুল স্ট্রীটে ১৪ শতাংশ জমি ও গুলশান-২ এ ৫ কাঠা জমি কেনা হয়। দলিল মূল্য অনুযায়ী দেখা যায়, গুলশানের জমিটি কেনা হয়েছে মাত্র ৪২ লাখ ৩৪ হাজার এবং ধানমন্ডিরটি ২০ লাখ ২৯ হাজার ১৪০ টাকায়। বাস্তবে এ জমির প্রকৃত মূল্য দলিলের মূল্যের চেয়ে অন্তত দশগুণ বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তদন্ত টিম মামুনের অস্থাবর সম্পদের মধ্যে শুধু ঢাকা ব্যাংক বনানী শাখাতেই মামুন ও তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে ২৪টি এফডিআর, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে ৭টি এফডিআর, আইএফআইসি ব্যাংকে ২টি, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক গুলশান শাখায় ২টিসহ বিভিন্ন ব্যাংকে ১০টি চলতি হিসাবের সন্ধান পেয়েছে। যেখানে অবৈধ উপায়ে অর্জিত মামুনের অর্থ জমা রয়েছে প্রায় ৪২ কোটি টাকার মতো। ঢাকা ব্যাংক বনানী শাখায় কাজী বাবুল নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে মামুনের যৌথ নামে রয়েছে ৫টি এফডিআর, যাতে জমার পরিমাণ প্রায় ৯০ লাখ টাকা। মামুনের একক নামে রয়েছে ১৫টি এফডিআর। এছাড়া বেনামে তথা আসাদুজ্জামান, আজহারুল ইসলাম ছদ্মনাম ব্যবহার করে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে মামুনের রয়েছে ৪টি এফডিআর। যার প্রতিটিতে ৫৮ লাখ ১৭ হাজার ১৩ টাকা করে মোট জমা রয়েছে ২ কোটি ৩২ লাখ ৬৮ হাজার ৫২৮ টাকা।
মামুনের স্ত্রী শাহীনা ইয়াসমিনের নামে ঢাকা ব্যাংক বনানী শাখায় ৬টি এফডিআর, একটি চলতি হিসাব, রূপালী ব্যাংক ক্যান্টনমেন্ট শাখায় একটি চলতি হিসাব, আইএফআইসি ব্যাংক গুলশান শাখায় একটি এফডিআর, উত্তরা ব্যাংক গুলশান শাখায় চারটি এফডিআর, একটি চলতি হিসাব, প্রাইম ব্যাংক বনানী শাখায় ১টি এফডিআর, ইসলামী ব্যাংক গুলশান ও বনানী শাখায় তিনটি চলতি হিসাব, এবি ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ে ২টি এফডিআর, জাতীয় সঞ্চয়পত্র এলিফ্যান্ট রোড শাখায় ১৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রসহ ২০টি এফডিআর ও চলতি হিসাবসহ অর্থের সন্ধান মেলে ৪ কোটি ৪ লাখ ৮৯ হাজার ৮৪ টাকার। তদন্তে পাওয়া যায়, মামুন ওয়ান কম্পোজিট মিলসে ২০০২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ২ বছরে মোট ১৩ কোটি টাকা চেকের মাধ্যমে লেনদেন করেছেন। এ টাকা মামুনের অবৈধ উৎস থেকে বিনিয়োগ করা হয়। তার নামে ওয়ান ডেনিস মিলস লিমিটেডের চেকের মাধ্যমে ২৪ কোটি ৮৭ লাখ ৪৭ হাজার টাকা বিনিয়োগের প্রমাণ মেলে, যার পুরোটাই জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অর্থ। মামুন প্রিকাস্ট কনক্রিট ইন্ডাস্ট্রিজে ২০০৪ সালে বিনিয়োগ করেছেন প্রায় ৭০ লাখ টাকা।
মামুনের খাম্বা লিমিটেডে ২০০৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বিনিয়োগের তথ্য পাওয়া যায় ২৮ লাখ ৯১ হাজার ৬০৫ টাকার। এসব প্রতিষ্ঠানে শেয়ারের বিপরীতে মামুনের মোট বিনিয়োগ ১৬ কোটি ১৪ লাখ ৮৫ হাজার ২৫৫ টাকা। এ টাকা অবৈধ পথে অর্জন করে মামুন কোম্পানির মালিকানা অর্জন করেছেন।
এছাড়া চ্যানেল ওয়ানে মামুনের রয়েছে ২৫০০টি শেয়ার। ৪ কোটি ৩৫ লাখ ১৭ হাজার ৫০০ টাকায় তিনি এ শেয়ার কিনেছেন। তদন্তে চ্যানেল ওয়ানে বিনিয়োগকৃত এই অর্থেরও কোনো বৈধ উৎস খুঁজে পাওয়া যায়নি। (যুগান্তর, ৭ অক্টোবর ২০০৭)।
স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি কখনও স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসন করতে পারে না
আমাদের দেশে অনেক মানুষ আছে যারা নিজেদের স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি মনে করে কিন্তু একাত্তরকে পুরোনো বিষয় মনে করে দেশ গড়ার জন্য বিএনপি জামায়াতের সাথে মিলে-মিশে থেকে জাতীয় ঐক্যের কথা বলে। এরা আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে জামায়াতকে বুকে টেনে নেয়। এই বিশেষ গোষ্ঠীটাই আজ ঐক্যফ্রণ্ট তথা বিএনপি নামের ছাতার নিচে সমবেত হয়েছে। এদের আমরা নির্বাচনে ভোট দেবো না, কোনো মতেই না, কখনই না।
এদেশে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে সামনের আসনে এনে বসান বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা পরিষদে চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন, যেমন শাহ আজিজুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা হত্যা, নারী নির্যাতন, লুট ও অগ্নিসংযোগ করে যুদ্ধাপরাধ করেছিল বঙ্গবন্ধু তাদের বিচারের জন্য ‘দালাল আইন’ ৭২-র সংবিধানে সংযোজিত করেছিলেন। দালাল আইনের আওতায় প্রায় ৩৮ হাজার পাকিস্তানি দালাল গ্রেপ্তার হয়েছিল। তবে এসব দালালদের ভিতর যারা শুধু নীতিগতভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল এবং যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি তাদের বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর সাধারণ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তবে যারা হত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ করেছিল তারা এই ক্ষমার আওতার বাইরে ছিল। সাধারণ ক্ষমার আওতায় ২৬ হাজার ব্যক্তি মুক্তি পেয়েছিল। তবে ১১ হাজারের বেশি দালালের বিরুদ্ধে হত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ থাকায় তাদের বিচারের কাজ বিভিন্ন ট্রাইব্যুনালে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরে স্বাধীনতার চেতনা মুছে ফেলার উদ্দেশ্য নিয়েই যেন জেনারেল জিয়া ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন। ‘যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা’ ছিল তার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। জিয়াউর রহমান যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করার জন্য ’৭৫-এর ৩১ ডিসেম্বর সামরিক শাসনের অধীনে বিশেষ অর্ডিন্যান্স জারি করে ‘দালাল আইন’ তুলে নেন। ফলে চল্লিশ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আলবদর কমান্ডার আমিনুল হক এবং যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্ত রাজাকার চিকন আলীর মতো ঘৃণিত ব্যক্তিরা জেল থেকে বের হয়ে এসে শহীদ পরিবারগুলোকে উপহাস করতে থাকে। জিয়াউর রহমান দালাল আইন তুলে নেয়ার পাশাপাশি সংবিধান সংশোধন করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগিতার জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার গোলাম আযমসহ ৩৯ জন শীর্যস্থানীয় দালাল ও যুদ্ধাপরাধীর নাগরিকত্ব বাতিল করেছিলেন। এসব ঘাতকরা দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে-পরে বিদেশে পালিয়ে যায়। কিন্তু দালাল আইন রহিত হওয়ার ফলে তারা দেশে ফিরতে শুরু করে। পাকিস্তানের পাসপোর্টধারী গোলাম আযম ’৭৮ সালে অসুস্থ মাকে দেখার কথা বলে তিন মাসের ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে এসে আর ফিরে যাননি। পরবর্তী সময়ে খালেদা জিয়া ক্ষমতাসীন হয়ে আইনি প্রক্রিয়ার নাম করে গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়া হয়। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত এক জোট হয়ে নির্বাচন করে। ঐ নির্বাচনে জয়ী হয়ে রাজাকারদের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেয় বিএনপি। জামায়াত-শিবির-রাজাকারদের যারা সমাদরে মাথায় তুলেছে, সেই বিএনপিকে আমরা ভোট দেবো কোন যুক্তিতে? কীসের আশায়?
২১ আগস্ট হামলা-মামলার ঐতিহাসিক রায়ে স্পষ্ট হলো বিএনপি সন্ত্রাসী দল
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার মাটিতে বিএনপি নামক ঘাতক দলের রাজনীতি করার কোনো অধিকার থাকতে পারে না। যে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়া ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পেছনে কলকাঠি নেড়েছে এবং কারা প্রকোষ্ঠে জাতীয় চার নেতাÑ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান এবং এম. মনসুর আলীকে হত্যা করেছে, যে বিএনপি ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে নৃশংস গ্রেনেড হামলায় প্রত্যক্ষ মদদ জুগিয়েছে, সেই বিএনপির আসলেই কি কোনো অধিকার থাকতে পারে বাংলাদেশে রাজনীতি করার? জন্মলগ্ন থেকেই বিএনপি বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় নিয়ে যাওয়ার জন্য নানামুখী চক্রান্ত করে যাচ্ছে। পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে মৌলবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে। জিয়াউর রহমান দল গঠন করে দেশদ্রোহী-রাজাকারদের বাংলাদেশে পুনর্বাসিত করেছিলেন, তার স্ত্রী খালেদা জিয়া ও পুত্র তারেক রহমান জিয়া নির্দেশিত পথেই এগিয়ে গেছেন।
জিয়া পরিবারের জন্য বঙ্গবন্ধু অনেক কিছুই করেছেন। খালেদা জিয়াকে বঙ্গবন্ধু আপন কন্যার মতোই স্নেহ করতেন। খালেদা জিয়ার ভাঙ্গা সংসার বঙ্গবন্ধুই জোড়া লাগিয়ে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এত আদর- স্নেহের মূল্য জিয়া দিয়েছেন ‘বুলেট’ দিয়ে, আর তার স্ত্রী-পুত্র দিয়েছেন ‘গ্রেনেড’ দিয়ে। মানুষ কতটা অকৃতজ্ঞ হতে পারে, ক্ষমতা ও স্বার্থের জন্য কতটা নিচে নামতে পারে, জিয়া পরিবারকে না দেখলে বাংলাদেশের মানুষ কিছুতেই তা বুঝতে পারতেন না।
কথায় বলে- ‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’। আসলেই ধর্মের কল বাতাসে নড়েছে। ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির রায়ের কল নড়েছিল ২৩ বছর ২ মাস পরে আর ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষিত হয় ১৪ বছর ২ মাস ১৯ দিনের মাথায়। দীর্ঘ সময় পরে হলেও আদালতের রায়ে সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মুখোশ খুলে গেছে ষড়যন্ত্রকারীদের। আজ শুধু বাংলাদেশের মানুষই নয়, পৃথিবীর নানান দেশের মানুষই বুঝতে পারছে বিএনপি স্বচ্ছ রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয়, বিএনপির বিশ্বাস হত্যা ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে, বিএনপি একটি সন্ত্রাসী দল, তাই জামায়াত তাদের বন্ধু।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সন্ত্রাসবিরোধী শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বিকেল ৫.৪০ মিনিটে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে নারকীয় গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। সেই হামলায় ঘটনাস্থলেই মারা যান আওয়ামী লীগের ২৪ জন নিরপরাধ নেতাকর্মী। এর মধ্যে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানও আছেন। আহত হন পাঁচশ’র অধিক নেতাকর্মী। বাংলাদেশের ইতিহাসে দিবালোকে এমন নৃশংস ঘটনার আর কোনো নজির নেই। সবশেষে শেখ হাসিনাকে বহন করা গাড়িতেও কয়েকটি গুলি করেছিল তাকে হত্যার জন্য। সেদিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। মূলত শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে এই হামলা চালানো হলেও, এর পেছনে ছিল আরও গভীর চক্রান্ত। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বাংলাদেশকে মৌলবাদীদের অভয়ারণ্য বানাতে চেয়েছিল, বিপথে নিয়ে যেতে চেয়েছিল ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তমূল্যে কেনা সমস্ত অর্জন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চায়নি বিএনপি ও তার দোসররা। এই হামলাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য সমস্ত আলামত নষ্ট করা হয়। আওয়ামী লীগের উপর দোষ চাপানো হয়, সাজানো হয় জজ মিয়া নাটক। নোয়াখালীর সেনবাগের শ্রমজীবী যুবক মোহাম্মদ জামাল উদ্দীন ওরফে জজ মিয়া নিরপরাধ হওয়া সত্ত্বেও তাকে ৪ বছর ২৬ দিন জেলখানায় কাটাতে হয়। রিমান্ডে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন করা হয় জজ মিয়ার উপর। ক্রসফায়ারের হুমকি ও জজ মিয়ার পরিবারকে টাকা দেওয়ার শর্তে শেখানো জবানবন্দি রেকর্ড করা হয় জজ মিয়ার। তবু শেষ রক্ষা হয় না। একে একে বের হতে থাকে আসল ঘটনা। তারপর অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১০ অক্টোবর, ২০১৮ সালে ঘোষিত হয় আদালতের রায়। ৪৯ জন আসামির মধ্যে ১৯ জন মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়, যাবজ্জীবন সাজা হয় ১৯ জনের, বাকি এগারো জন পায় বিভিন্ন মেয়াদের দণ্ড।
আদালতের রায় ঘোষিত হওয়ার পরে নানাজন নানাভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ছাড়াও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ভুক্তভোগী ও সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গ। এই ঐতিহাসিক রায়ে একটি জিনিস স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সেটা হলো- বিএনপি একটি সন্ত্রাসী ও ঘাতক দল। হত্যা, খুন, লুটপাট ও জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতা দান করাই বিএনপির মূল লক্ষ্য। এরা চায় না বাংলাদেশ সুখে-শান্তিতে থাকুক, নিরাপদে বসবাস করুক বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ। এরা ষড়যন্ত্র করে কিংবা মৌলবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সহায়তা যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় তখন দেশে দুর্নীতি বেড়ে যায়, বোমাবাজি বেড়ে যায়, রাষ্ট্র খেতাব পায় অকার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে। বিএনপি স্পষ্টত রাষ্ট্র চালনায় ব্যর্থ এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের আড়ালে এরা গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এরা মুখোশ পরে থাকে, কিন্তু মুখোশের আড়ালে এদের যে মুখটা আছে সেটা খুবই ভয়ঙ্কর।
একটি রাজনৈতিক দলের চেয়ারপার্সন দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে জেলবন্দী, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন পূর্বে দশ বছর সাজাপ্রাপ্ত বর্তমানে হত্যা চেষ্টার দায়ে যাবজ্জীবনের সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি। এদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনীতি কোনো দিনই সুস্থ ধারায় প্রবাহিত হবে না। আজ সময় এসেছে এদের প্রত্যাখ্যান করার। বাংলাদেশের জনগণ যত তাড়াতাড়ি বিএনপি ও তার জোটভুক্ত দলগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে ততই তা বাংলাদেশের জন্য মঙ্গল। বিএনপি পদে পদে ব্যর্থতা, অযোগ্যতা ও নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছে। যারা নৃশংস, সন্ত্রাসী, ব্যর্থ এবং অযোগ্য তাদের হাতে দেশ ও দেশের মানুষ কিছুতেই নিরাপদ থাকতে পারে না।
বাংলাদেশের মানুষ কোন্ পক্ষে যেতে চায়? তারা কি হত্যায় বিশ্বাসী, মৌলবাদে উস্কানিদাতা, দুর্নীতিবাজ বিএনপির সঙ্গে যাবে? নাকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও উন্নয়নে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের পক্ষে থাকবে? বাংলাদেশের মানুষ খুবই আবেগপ্রবণ, তাদের মনও অত্যন্ত কোমল। বাঙালি আবেগপ্রবণ আর কোমল মনের বলে অনেক সহজেই এরা ক্ষমাশীল। ক্ষমা মহৎ গুণ বটে। তবে ঘাতককে, দেশদ্রোহীকে ক্ষমা করার কোনো মানে নেই। এদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে বয়কট করে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। এ জন্য যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি তাদের হাত শক্তিশালী করতে হবে। নির্দ্বিধায় গণরায় দিতে হবে দেশপ্রেমিক, উন্নয়নমুখী, পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক দলকে। বিগত দশ বছরে বাংলাদেশ অনেক দূরে এগিয়ে গেছে, বিদেশেও মর্যাদা বাড়ছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বিএনপি নয়Ñ আওয়ামী লীগই এখন আমাদের একমাত্র ভরসা।
আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আমাদের সামনে প্রশ্ন হচ্ছে, অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে আমরা রক্ষা করবো, নাকি তা বিকিয়ে দেবো? আমরা কি স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধ রক্ষার জন্য চরম মূল্য দিতে প্রস্তুত নাকি ঐক্যফ্রন্ট তথা বিএনপি-জামায়াত-কে ভোট দিয়ে পাকিস্তানি ধ্যান-ধারণায় ফিরে যেতে চাই? আমরা কি অসাম্প্রদায়িক জাতিগত ঐতিহ্য রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর নাকি ধর্মের নামে বিভক্ত হয়ে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী একটি রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব দরবারে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরবো? আমরা কি ঐক্যবদ্ধভাবে বিএনপি জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবিরকে প্রতিহত করতে প্রস্তুত নাকি তাদের হাতে অসহায় আত্মসমর্পণ করবো?
এই প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর যদি আমরা বের করতে না পারি তাহলে আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা বিপন্ন হবে, জাতি হিসেবে গৌরব করার কিছুই আর থাকবে না। আমাদের আজকে নির্ধারণ করতে হবে আমরা কি ধানের শীষে ভোট দিয়ে এমন শক্তিকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করবো যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে তাদের আবার রাষ্ট্রক্ষমতার ভাগিদার করবে?
পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি মনে করছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তারা সরকার গঠনে সক্ষম হবে। সে জন্য বিএনপি ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে হুমকি-ধামকি দেয়া শুরু করে দিয়েছে। একাত্তরের ঘাতক আলবদর-রাজাকার এবং তাদের সমর্থকরাও আশা ও আনন্দে প্রহর গুনছে। তারা ধরেই নিয়েছে আগামীতে তারা ক্ষমতায় আসছে। ভোটে জিতে যুদ্ধাপরাধীদের রেহাই দেয়া হবে, সব কিছুর প্রতিশোধ নেয়া হবেÑ এই কথা এখন বিএনপি-জামায়াতীদের মুখে মুখে। প্রশ্ন হলো, সবকিছু জেনেশুনে তাদের কী ভোট দেয়া যায়? নাকি সচেতন মানুষ হিসেবে আমাদের তা উচিত হবে? ঐক্যফ্রণ্ট তথা বিএনপির হাত ধরে রাজাকার-আলবদর-ধর্মব্যবসায়ী-খুনিরা আবার ক্ষমতায় আসুক তা নিশ্চয়ই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কোনো মানুষ চাইতে পারে না।
বর্তমানে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন। ধর্মের নামে জামায়াত-শিবিরের ধারাবাহিক সহিংস তা-ব, প্রতিশোধের হুমকি, হরতালের নামে বিএনপি-জামায়াতের জ্বালাও-পোড়াও, হুমকির মধ্যে বসে সচেতন ভোটার হিসেবে কেউ কি ধানের শীষে ভোট দেয়ার কথা ভাবতে পারেন?
আমাদের দেশ বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠীর মানুষের দেশ। এ দেশের সাধারণ মুসলমানরা প্রতিবেশী হিন্দুর বাড়িতে হামলা হলে কষ্ট পায়। হিন্দুর মন্দির গড়তে সহযোগিতার হাত বাড়ায়। হিন্দুরা প্রতিবেশী মুসলমানের হৃদয়ের বন্ধন অনুভব করে। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-আদিবাসীসহ এই দেশের অগণিত মানুষের চাওয়া সম্প্রীতির বাংলাদেশ, সব ধর্মের সব জাতির নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব মানুষের অধিকারের বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশের চিত্র ফুটে ওঠে নববর্ষে শহরের বর্ষবরণ ও গ্রামের মেলায়। সেখানে বিচিত্র সব নারী-পুরুষ-শিশু ছুটেছে হাতে হাত ধরে। সেই মানুষের স্রোতে ধাবমান মানুষের মনে কখনও মনে হয় না- কে মুসলমান, কে হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান, কে আদিবাসী। সবাই বাংলা মায়ের সন্তান।
যে পাকিস্তানি ভাবাদর্শকে আমরা একাত্তরে কবর দিয়েছি, সেই পাকিস্তানি ভাবাদর্শের প্রেতাত্মাদের আমরা এখন ২০১৮ সালে আর বিকশিত হতে দিতে পারি না। যারা বিএনপির দেশবিরোধী আদর্শ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার নিয়ে ভোট চায়, আমরা তাদের ভোট দিতে পারি না। কিছুতেই না। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা আমরা করতে পারি না।
আওয়ামী লীগের হাতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ-অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ যতটা নিরাপদ, বিএনপির হাতে তা নয়। সে জন্যই বিএনপিকে ভোট না দিয়ে এবার আবারো আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার পক্ষেই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বিগত দশ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন
আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের সচিত্র বিবরণ
বাংলাদেশ একসময় তলাবিহীন ঝুড়ি বলে পরিচিত ছিল, দুর্নীতিতে পাঁচ-পাঁচবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। খ্যাতি জুটেছিল ব্যর্থ রাষ্ট্রের। জননেত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। খাদ্যে, কৃষিতে, যোগাযোগ ব্যবস্থাপনায়, শিল্পে, শিক্ষায়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে, নারীর ক্ষমতায়নে, উত্তাল সবুজ পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায়, আইনের শাসন বাস্তবায়নে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জঙ্গি দমন করে, বিশ্বে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। আসুন একনজরে আওয়ামী লীগের এক দশকের উন্নয়নের কিছু তথ্য জেনে নিই। যেগুলো কেবল খাতা-কলমের উন্নয়ন নয়, বাস্তবেও তা দৃশ্যমান।
সামষ্টিক অর্থনীতি
১. জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ছিল ৬.০১ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭.৮৬ শতাংশ; একই সাথে মাথাপিছু জাতীয় আয় ২০০৭-০৮ অর্থবছরে মার্কিন ডলার হতে বেড়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে হয়েছে ১ হাজার ৭৫২ মার্কিন ডলার;
২. বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ২০০৭-০৮ অর্থবছরের ১২.৩ শতাংশের তুলনায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫.৭ শতাংশে নেমে এসেছে;
৩. বিবিএসের সর্বশেষ খানা জরিপ ২০১৬ অনুসারে দেশে দারিদ্র্য হার ২১.৩ শতাংশে ও অতি দারিদ্র্যের হার ১০ শতাংশে নেমে এসেছে; ২০০৮ সালে দারিদ্র্য ও অতি দারিদ্র্যের হার ছিল যথাক্রমে ৩৫.০ ও ২১.০ শতাংশ;
৪. সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ ২০০৮-০৯ অর্থবছরের ১৩ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা হতে ৪.৬ গুণ বাড়িয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬৪ হাজার ১৭৭ কোটি টাকায় বৃদ্ধি;
৫. মাতৃত্বকালীন ছুটির মেয়াদ পূর্ণবেতনে চার মাস হতে ছয় মাসে উন্নীতকরণ।
রাজস্ব আহরণ বিশ্লেষণ
১. গত ২০০৭-০৮ অর্থবছরের রাজস্ব আদায় ছিল ৪৭,৪৩৫.৬৬ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১,৭১,৬৫৬.৪৪ কোটি টাকা;
২. গত ১০ অর্থবছরে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি পেয়েছে ১৯৮.১৯ শতাংশ এবং গড় প্রবৃদ্ধি ১৭.১৫ শতাংশ।
বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে উল্লেখ্যযোগ্য অর্জন
১. বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৪,৯৪২ মেগাওয়াট থেকে ২০,১৩৩ মেগাওয়াটে (ক্যাপটিভসহ) উন্নীতকরণ;
২. সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ৩,২৬৮ মেগাওয়াট থেকে ১১,৩৮৭ (১৮ জুলাই ২০১৮) মেগাওয়াট উন্নীতকরণ;
৩. বর্তমানে ১৩,৯৮৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৫৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন;
৪. পায়রা, রামপাল, মাতারবাড়ি ও মহেষখালীতে কয়লাভিত্তিক সর্বমোট ৯,৯৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৮টি মেগা প্রকল্প গ্রহণ;
৫. নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক ৫১৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ৫২ লাখ সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন;
৬. সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ৮ হাজার সার্কিট কিলোমিটার থেকে ১১,১২৩ সার্কিট কিলোমিটার উন্নীত;
৭. গ্রিড সাবস্টেশন ক্ষমতা ১৫,৮৭০ এমভিএ থেকে ৩৬,০৪৬ এমভিএ-তে উন্নীত;
৮. বাংলাদেশ-ভারত ৪০০ কেভি আন্তঃসংযোগ গ্রিডলাইন নির্মাণ এবং ৮০০ কেভি আঞ্চলিক গ্রিড নির্মাণের কার্যক্রম গ্রহণ;
৯. গ্রাহক সংখ্যা ১ কোটি ৮ লাখ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৩ কোটি ৩ লাখে উন্নীত;
১০. বিতরণ লাইন ২ লাখ ৬০ হাজার কিমি হতে ৪ লাখ ৫৭ হাজার কিমি-তে সম্প্রসারণ;
১১. মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ২২০ থেকে ৪৬৪ কিলোওয়াট আওয়ারে উন্নীত;
১২. বিদ্যুৎ সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী ৪৭ থেকে ৯০ শতাংশে উন্নীত।
সড়ক পরিবহন খাতে উন্নয়ন
১. সারাদেশে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের আওতাধীন ২১ হাজার ৩০২ কিলোমিটার জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং জেলা সড়ক, ৪ হাজার ৪০৪টি সেতু এবং ১৪ হাজার ৮৯৪টি কালভার্ট রয়েছে;
২. ২০০৯ থেকে জুন ২০১৮ পর্যন্ত সড়ক ও জনপথ অধিদফতর কর্তৃক উন্নয়ন খাতের আওতায় ৪ হাজার ৩৩১ কিলোমিটার মহাসড়ক মজবুতিকরণসহ ৫ হাজার ১৭১ কিলোমিটার মহাসড়ক প্রশ্রস্তকরণ করা হয়েছে;
৩. অনুন্নয়ন খাতের আওতায় ৪ হাজার ৮৬৯ কিলোমিটার মহাসড়ক কার্পেটিং ও সিলকোট, ১ হাজার ৮৯২ কিলোমিটার ডিবিএসটি এবং ৮ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার ওভারলে করা হয়েছে;
৪. ৪১৭ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক চার-লেন বা তদূর্ধ্ব লেনে উন্নীত করা হয়েছে;
৫. দেশের অর্থনীতির লাইফ-লাইন খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম জাতীয় মহাসড়কের ১৯০ কিলোমিটার চার-লেনে উন্নীত করা হয়েছে;
৬. ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার-লেনে উন্নীত করা হয়েছে;
৭. নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়ক চার-লেনে উন্নীত করা হয়েছে;
৮. রংপুর মহানগরীর বিভিন্ন সড়ক চার-লেনে উন্নীত করা হয়েছে। চট্টগ্রাম-হাটহাজারী সড়ক ডিভাইডারসহ চার-লেনে উন্নীত করা হয়েছে;
৯. কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ দৃষ্টিনন্দন মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ;
১০. যাত্রাবাড়ি-কাঁচপুর সড়ক আট-লেনে উন্নীতকরণ। এটি দেশের প্রথম আট-লেন মহাসড়ক;
১১. এ-সময়ে ৯টি ফ্লাইওভার/ওভারপাস ও ৭টি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ফেনীর মহিপালে ছয়- লেনের ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে;
১২. ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার-লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের আওতায় ফেনীর ফতেহপুর, কুমিল্লার পদুয়ার বাজার, ইলিয়টগঞ্জ ও চট্টগ্রামের কালুশাহ মাজার এলাকায় ৩টি রেলওয়ে ওভারপাস, কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় আন্ডারপাস নির্মাণ করা হয়েছে;
১৩. ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে নির্মিত হয়েছে মাওনা ফ্লাইওভার। এছাড়া ঢাকা মহানগরীতে বনানী রেলওয়ে ওভারপাস, মিরপুর থেকে এয়ারপোর্ট রোড পর্যন্ত মো. জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভার, কুমিল্লা শহরে শাসনগাছা ফ্লাইওভার, টঙ্গীতে আহসান উল্যাহ মাস্টার ফ্লাইওভার, চট্টগ্রাম বন্দর সংযোগ ফ্লাইওভার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য;
১৪. এ-সময়ে ৯১৪টি সেতু ও ৩ হাজার ৯৭৭টি কালভার্ট নির্মাণ/পুননির্মাণ করা হয়েছে;
১৫. ঢাকা মহানগরী ও তৎসংলগ্ন এলাকার যানজট নিরসনে ও পরিবেশ উন্নয়নে উত্তরা তৃতীয় পর্ব হতে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত ২০.১০ কিলোমিটার দীর্ঘ বাংলাদেশের প্রথম এলিভেটেড মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে;
১৬. এতে ১৬ স্টেশন থাকবে এবং উভয় দিকে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা যাবে;
১৭. সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ সম্প্রতি মহান জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে;
১৮. হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালি পর্যন্ত ৮৭০৩.১১ কোটি টাকা ব্যয়ে র্যা ম্পসহ প্রায় ৪৬.৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রকল্পের নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে ১ হাজার ১৮৯টি ওয়ার্র্কিং পাইল ড্রাইভিং, ২৩৬টি পাইল ক্যাপ, ২০টি ক্রস বিম, ১১৯টি কলাম ও ১৫০টি আই গার্ডার র্নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে;
১৯. গাজীপুর হতে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত মোট ২০ কিলোমিটার বাস র্যারপিড ট্রানজিট বা বিআরটি লেনের মধ্যে সেতু বিভাগ কর্তৃক ৯৩৫.১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড অংশের নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। ২০২০ সাল নাগাদ এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন করার পরিকল্পনা রয়েছে।
রেলপথে নতুন দিগন্ত
১. ২০১১ সালে পৃথক ‘রেলপথ মন্ত্রণালয়’ গঠন করা হয়;
২. প্রায় ১০ বছরে ৩৩০.১৫ কিমি নতুন রেললাইন নির্মাণ। ৯১টি স্টেশন বিল্ডিং নতুন নির্মাণ ও ২৪৮.৫০ কিমি মিটারগেজ থেকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর। নতুন ৭৯টি রেলস্টেশন নির্মাণ। ২৯৫টি নতুন রেলসেতু নির্মাণ;
৩. রেলওয়ের পরিকল্পিত উন্নয়নের জন্য ৩০ বছর মেয়াদি (২০১৬-৪৫) একটি মাস্টার প্ল্যান অনুমোদিত;
৪. ৪৩০টি যাত্রীবাহী কোচ পুনর্বাসন শেষে রেলওয়ে বহরে সংযুক্ত করা হয়েছে, যা যাত্রীসেবায় নিয়োজিত রয়েছে;
৫. লালমনিরহাট হতে বুড়িমারী পর্যন্ত ৯৫ কিমি সংস্কারকৃত ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। কালুখালী-ভাটিয়াপাড়া ও পাঁচুরিয়া-ফরিদপুর বন্ধ রেলওয়ে সেকশন পুনঃচালুকরণ।
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার উন্নয়ন
১. স্থানীয় সরকার-ব্যবস্থার উন্নয়ন। জনগণের সুবিধাপ্রাপ্তির ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন;
২. ২০০৯ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত ৫২ হাজার ২৮০ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন;
৩. ৭৫ হাজার ৭৭৩ কিলোমিটার পাকা সড়ক ও ৩১ হাজার ৬৩৭ মিটার ব্রিজ/কালভার্ট রক্ষণাবেক্ষণ/পুনর্বাসন;
৪. ৩ লাখ ১ হাজার ৩৪১ মিটার ব্রিজ/কালভার্ট নির্মাণ/পুননির্মাণ;
৫. ১৬২টি উপজেলা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ/সম্প্রসারণ করা হয়েছে;
৬. ১ হাজার ৪৯১টি ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন সম্প্রসারণ;
৭. ১ হাজার ৯৮৬টি গ্রোথ সেন্টার/হাটবাজার উন্নয়ন;
৮. ৭৬০টি সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণ/পুনর্র্নিমাণ;
৯. ১০৫০.৫০ কিলোমিটার বাঁধ পুনর্র্নিমাণ/উন্নয়ন;
১০. ১ হাজার ২৫৩টি পানিসম্পদ অবকাঠামো/রেগুলেটর নির্মাণ;
১১. শহরাঞ্চলে ৫ হাজার ৫৩৮ কিমি সড়ক/ফুটপাথ নির্মাণ; ২ হাজার ৮৮০ কিমি ড্রেন নির্মাণ; শহরাঞ্চলে সড়কে ৬ হাজার ৯৯৯ মিটার ব্রিজ/কালভার্ট নির্মাণ;
১২. ঢাকা মহানগরীতে একটি ফ্লাইওভার নির্মাণ;
১৩. ৩ লাখ ৩ হাজার ৫৩৯টি পানির উৎস নির্মাণ, ১ হাজার ১৬৬টি উৎপাদক নলকূপ, ১৪৩টি পুকুর খনন/পুনর্খনন, ১৬১টি পানি শোধনাগার, ১৩৪৬১.৭৬ কিমি পাইপলাইন স্থাপন/প্রতিস্থাপন ও ৫৪টি উচ্চ জলাধার স্থাপনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ কার্যক্রম চলমান রয়েছে;
১৪. স্যানিটেশনের জাতীয় কভারেজ ৯৯ শতাংশ। ৭ লাখ ৫৩ হাজার স্বল্পমূল্যের স্যানিটারি ল্যাট্রিন ও ৪ হাজার ৪৮৬টি পাবলিক/ কমিউনিটি টয়লেট স্থাপন;
১৫. ১৩১৪৪.৭৬ কি.মি. পাইপলাইন স্থাপন/প্রতিস্থাপন। ১২২টি পানি শোধনাগার নির্মাণ। ৪৯টি উচ্চ জলাধার নির্মাণ;
১৬. ৩৬ হাজার ১৮৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিরাপদ পানির উৎস নির্মাণ;
১৭. ২৬ হাজার ৮০৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ওয়াশ বণ্টক নির্মাণ;
১৮. ঢাকা ওয়াসার ২৩০ কোটি লিটার পানির চাহিদার বিপরীতে ২৪৫ কোটি লিটার পানি উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন।
কৃষি খাতে উন্নয়ন
১. বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার ২০০৮-০৯ অর্থবছর হতে প্রণোদনা/কৃষি পুনর্বাসন চালু করেছে। অদ্যাবধি এ কর্মসূচির মাধ্যমে ৮২৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা প্রদান করা হয়েছে, যার মাধ্যমে ৭৪ লাখ ৫৪ হাজার ৩১৩ কৃষক উপকৃত হয়েছেন;
২. প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া এবং বিভিন্ন ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের কৃষি প্রণোদনা ও পুনর্বাসন বাবদ ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে;
৩. উৎপাদনমুখী কৃষিবান্ধব সরকার নানাবিধ সহযোগিতা প্রদানের লক্ষ্যে মোট ২ কোটি ৮ লাখ ১৩ হাজার ৪৭৭ কৃষককে কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড প্রদান করেছে;
৪. শেখ হাসিনার সরকার কৃষককে মাত্র ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ করে দেওয়ায় ১ কোটি ১ লাখ ১৯ হাজার ৫৪৮টি ব্যাংক হিসাব খোলা সম্ভব হয়েছে, যেখানে বর্তমান স্থিতি প্রায় ২৮২ কোটি টাকা;
৫. ২০০৮-০৯ অর্থবছরে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সংশোধিত বাজেট ছিল ৭৯২৪.৫৭ কোটি টাকা, যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৩০৩.৮৪ কোটি টাকায়, অর্থাৎ ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে;
৬. ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ। লবণাক্ততা, খরা, জলমগ্নতা সহনশীল ও জিংকসমৃদ্ধ, ধানসহ এ পর্যন্ত ধানের ১০৮টি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এতে ধান উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে;
৭. নিবিড় সবজি চাষের মাধ্যমে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১ কোটি ৫৯ লাখ ৫৪ হাজার মেট্রিক টন সবজি উৎপাদন করে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে;
৮. বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে কৃষি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে লবণাক্ত সহিষ্ণ ধান, ফলমূল, শাক-সবজি উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্ব বৃদ্ধি করা হয়েছে;
৯. আম উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে সপ্তম। দেশে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১২.৮৮ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হয়েছে;
১০. মসলা জাতীয় ফসল চাষ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে;
১১. ডিজিটাল কৃষি তথা ‘ই-কৃষি’র প্রবর্তন করা হয়েছে। দেশে মোট ৪৯৯টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র (এআইসিসি), কৃষি কল সেন্টার-১৬১২৩, কৃষি কমিউনিটি রেডিও, কৃষি তথ্য বাতায়ন, কৃষক বন্ধু ফোন-৩৩৩১, ই-বুক, অনলাইন সার সুপারিশ, ই-সেচ সেবা, রাইস নলেজ ব্যাংক, কৃষি প্রযুক্তি ভাণ্ডর, ই-বালাইনাশক প্রেসক্রিপশন, কৃষকের জানালা, কৃষকের ডিজিটাল ঠিকানা, ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি তথ্য ও যোগাযোগকেন্দ্রসহ বিভিন্ন মোবাইল ও ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন ও সফটওয়্যার ব্যবহৃত হচ্ছে।
শিল্প খাতে উন্নয়ন
১. বার্ষিক ৫ লাখ ৮০ হাজার ৮০০ মে. টন গ্রানুলার ইউরিয়া সার উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন শাহজালাল ফার্টিলাইজার স্থাপন। শাহজালাল ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি বিসিআইসি-এর নিকট হস্তান্তর। দেশে কৃষকদের কাছে স্বল্পমূল্যে ও দ্রুততম সময়ে সার সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে;
২. ৯ বছরে দেশে সারের কোনো সংকট দেখা দেয়নি। দেশের কৃষক ও জনগণের কাছে সার সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে;
৩. রাজধানীর হাজারীবাগসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ট্যানারি শিল্পসমূকে একটি পরিবেশবান্ধব স্থানে স্থানান্তরের লক্ষ্যে ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও সাভার উপজেলাধীন কান্দিবৈলারপুর, চন্দ্রনারায়ণপুর ও চর আলগী মৌজায় ধলেশ্বরী নদীর তীরে ২০০ একর জমিতে পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্পনগরী স্থাপন শেষ পর্যায়ে;
৪. সাভার চামড়া শিল্পনগরীর বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণকাজ সম্পন্ন। ইতোমধ্যে ১১৫টি ট্যানারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরু করেছে। নির্মাণাধীন ঈঊঞচ এবং ডাম্পিং ইয়ার্ড নির্মাণের ২১টি অংশের সিভিল কাজের প্রায় সমাপ্ত। ৪টি মডিউলে পরীক্ষামূলকভাবে বর্জ্য পরিশোধন হচ্ছে। এখানে শিল্প-কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে প্রায় ১ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে;
৫. বর্তমান সরকারের দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে পবিত্র রমজান মাসসহ সারাবছর দেশে চাল, ডাল, তেল, চিনি, ছোলাসহ সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল রয়েছে;
৬. দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ সকল পণ্যের মজুত রয়েছে; কোনো পণ্য সংকটের কোনো সম্ভাবনা নেই। পণ্যের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে। সরকার দক্ষতার সাথে পণ্যের আমদানি-রপ্তানিনীতি প্রণয়নের মাধ্যমে তার যথাযথ বাস্তবায়ন করে চলছে;
৭. ২০০৭-০৮ অর্থবছরে দেশের রপ্তানি ছিল ১৪.১১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৯৯টি দেশে ৭৪৪টি পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৩৬.৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার;
৮. দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে দেশে তৈরি পোশাক রপ্তানি ছিল ১০.৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৭-১৮ সালে সেই রপ্তানি দাঁড়িয়েছে ৩০.৬১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২১ সালে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সরকারের বিশেষ উদ্যোগে এখন তৈরি পোশাক কারখানায় নিরাপদ ও কর্মবান্ধব পরিবেশে শ্রমিকরা কাজ করছে। দেশে বর্তমানে ‘গ্রিন ফ্যাক্টরি’ গড়ে উঠছে;
৯. বিগত জোট সরকারের আমল থেকে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা বিজেএমসি’র ৫টি জুট মিল যথাÑ খালিশপুর জুট মিলস লি., জাতীয় জুট মিলস লি., দৌলতপুর জুট মিলস লি., কর্ণফুলী জুট মিলস লি. এবং ফোরাত কর্ণফুলী কার্পেট ফ্যাক্টরি চালু করা হয়েছে। এই জুট মিলগুলো পুনরায় চালুর মাধ্যমে প্রায় ১০ হাজার জনবলের কর্মসংস্থান করা হয়েছে;
১০. বর্তমান সরকার শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে বন্ধ মিল চালু করা, ছাঁটাইকৃত শ্রমিকদের চাকরিতে পুনর্বহাল, বদলি শ্রমিকদের স্থায়ী করা, শ্রমিকদের মজুরি স্কেল ২০১০ বাস্তবায়ন করার ফলে মিলসমূহে শ্রমিকবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ২০০৯-১৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে;
১১. ২০০৭ সালের চাকরিচ্যুত ৩ হাজার ২৬ শ্রমিককে পুনঃনিয়োগ ও ৮ হাজার ৬৬৫ জন বদলি শ্রমিককে স্থায়ী করা হয়েছে। দৈনিকভিত্তিক প্রায় ২১ হাজার ৭০০ জনকে বদলি শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষা ব্যবস্থায় উন্নয়ন
১. আগামী প্রজন্মকে দক্ষ, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে উদ্ভাসিত ও আলোকিত নাগরিক এবং সুশিক্ষিত ও আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন। বর্তমানে ধাপে ধাপে এর বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। শিক্ষা আইন প্রণয়ন;
২. ৯ বছরে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, ইবতেদায়ী, দাখিল, দাখিল (ভোকেশনাল) ও এসএসসি (ভোকেশনাল) স্তরের সর্বমোট ২৬০ কোটি ৮৫ লাখ ৯১ হাজার ২৯০টি বই বিতরণ করা হয়েছে। ২০১৮-এর জানুয়ারির প্রথম দিন ৪ কোটি ৪২ লাখ ৪ হাজার ১৯৭ শিক্ষার্থী ৩৫ কোটি ৪২ লাখ ৯০ হাজার ১৬২ কপি নতুন বই বিতরণ;
৩. ২০১৭ সালে সরকার ৫টি নৃ-গোষ্ঠীর ভাষায় ৭৭ লাখ ২৮২টি বই ছাপিয়ে বিতরণ। ২০১৮ সালে পার্বত্য তিন জেলায় আদিবাসীদের মধ্যে পাঠ্যবই বিতরণ। ২০১৮ সালে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাক-প্রাথমিক ও প্রথম শ্রেণির ১ লাখ ৪৯ হাজার ২৭৬টি পাঠ্যপুস্তক ও পঠন-পাঠন সামগ্রী মুদ্রণ করা হয়;
৪. ২০১৭ শিক্ষাবর্ষে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রথমবারের মতো ৯ হাজার ৭০৩ কপি ব্রেইল পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ;
৫. ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত সময়ে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে স্নাতক (পাস) ও সমমান পর্যায় পর্যন্ত মোট প্রায় ২ কোটি ৫৫ লাখ ৩৪ হাজার ১৫১ শিক্ষার্থীর (ছাত্র-৬৯,৯৪,০৯২, ছাত্রী-১,৮৫,৪০,০৫৯) মধ্যে ৪৬১৫.৫৪ (৪ হাজার ৬১৫ দশমিক ৫৪ কোটি) টাকা উপবৃত্তিসহ আর্থিক সহায়তা হিসেবে প্রদান করা হয়েছে;
৬. মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের মেধাবৃত্তির আওতায় ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১২ লাখ ৬৭ হাজার ৪২ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৯৮৪ কোটি ৪১ লাখ ১১ হাজার ৮০০ টাকা প্রদান করা হয়েছে;
৭. স্নাতক পর্যায় পর্যন্ত দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদানের লক্ষে ‘প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট’ নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে এবং এই ট্রাস্ট ফান্ডে সরকার ১ হাজার কোটি টাকা সীড মানি প্রদান। ২০১২-১৩ অর্থবছরে এই ফান্ড হতে স্নাতক (পাস) ও সমমান পর্যায়ের ১ লাখ ২৯ হাজার ৮১০ ছাত্রীকে ৭২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা উপবৃত্তি হিসেবে প্রদান;
৮. মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে উপবৃত্তির টাকা পরিশোধ করা হচ্ছে;
৯. এসএসসি, এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলসহ শিক্ষক নিয়োগ ও নিবন্ধন পরীক্ষার ফলাফল ওয়েবসাইটে প্রকাশ করছে। মোবাইল ফোনের এসএমএস এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ই-মেইলের মাধ্যমেও এই ফল অতিদ্রুত প্রকাশ করা হচ্ছে;
১০. ২০১০ সাল থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন ও পরীক্ষার ফরম ফিলআপ অনলাইনে সম্পন্ন করা হচ্ছে। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়া মোবাইল ফোনের এসএমএস’র মাধ্যমে অনলাইনে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে;
১১. ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষ হতে ১১০০ শ্রেণিতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইন ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা হচ্ছে;
১২. পাঠ্যপুস্তকের অনলাইন ভার্সন প্রবর্তন করা হয়েছে;
১৩. দেশের প্রাথমিক স্তরের ৩৩টি, মাধ্যমিক স্তরের ৪৯টি, মাদ্রাসা শিক্ষার ৭৫টি এবং কারিগরি শিক্ষার ৩২টি পাঠ্যপুস্তক আকর্ষণীয় ও সহজে ব্যবহারযোগ্য ‘ই-বুক’-এ কনভার্ট করে ww(w.ebook.gov.bd) ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়েছে;
১৪. ইতোমধ্যে প্রায় ১৬ লাখ ৯৮ হাজার ১৩৬ শিক্ষককে কম্পিউটার, ইংরেজি, গণিতসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান;
১৫. উচ্চ শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের বিগত মেয়াদের ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত দেশে ১৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে এবং ৫০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন এবং পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ’ এবং ‘রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ’ স্থাপনের আইন গত ১৭ জুলাই ২০১৬ মহান জাতীয় সংসদে অনুমোদিত হয়েছে;
১৬. শিক্ষার্থীদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার লক্ষ্যে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র’ (১৫ খণ্ড) ৩৪ হাজার ৬৬৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিতরণ করা হয়েছে;
১৭. সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের পদটি দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়েছে। ফলে তাদের আর্থিক সুবিধা, সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ বেতন পাচ্ছেন ১০০ শতাংশ;
১৮. এ পর্যন্ত বেসরকারি বিদ্যালয় ১ হাজার ১৯টি, বেসরকারি কলেজ ১৬৫টি এবং বেসরকারি মাদ্রাসা ৩১০টি, অর্থাৎ ১ হাজার ৪৯৪টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিও-ভুক্ত করা হয়েছে;
১৯. এ পর্যন্ত বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৭৯ হাজার ৬১ জন এবং বেসরকারি মাদ্রাসার ৩৯ হাজার ৩২৪ জন, অর্থাৎ সর্বমোট ১ লাখ ৩৫ হাজার ৫৫৪ শিক্ষক-কর্মচারীকে এমপিও-ভুক্ত করা হয়েছে;
২০. সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহে সহকারী শিক্ষকের পদ দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীতকরণের পূর্ব পর্যন্ত সময়ে ২ হাজার ৯৮৮ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে;
২১. সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড পদমর্যাদা প্রদান। এবং চাকরি আট বছর পূর্তিতে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে (মোট পদের ৫০ শতাংশ) ৩ হাজার ৮৮২টি পদ প্রথম শ্রেণির গেজেটেড পদমর্যাদায় উন্নীত;
২২. যেসব উপজেলায় কোনো সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ নেই, সেসব উপজেলায় একটি করে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ সরকারিকরণের কাজ চলছে। বিভিন্ন উপজেলায় ২৮৫টি কলেজ সরকারিকরণের জন্য অর্থ বিভাগের সম্মতি পাওয়া গেছে। ২৮৩টি কলেজের deed of gifts স্বাক্ষর করা হয়েছে। ৩৯টি বেসরকারি কলেজ সরকারিকরণ করা হয়েছে। ৩১৬টি বেসরকারি কলেজ সরকারি করা হয়েছে। আরও ১৯টি প্রক্রিয়াধীন আছে;
২৩. কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। শিক্ষা কার্যক্রমকে ডিজিটাইজড করা হয়েছে;
২৪. ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট/সমমানের প্রতিষ্ঠানে নতুন বিভাগ খোলা হয়েছে ও গ্রুপ বৃদ্ধি করা হয়েছে;
২৫. মাদ্রাসা শিক্ষা স্তরে উচ্চ শিক্ষার পথ সুগম করার লক্ষ্যে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ৩১৯(৫২)টি মডেল মাদ্রাসায় অনার্স কোর্স চালু করা হয়েছে।
তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে উন্নয়ন
১. সারাদেশে ৮০৪টি ভিডিও কনফারেন্সিং সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে এবং ১ হাজার ১৩টি বিদ্যুৎবিহীন ইউনিয়নে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করে ‘ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার’ স্থাপন করা হয়েছে;
২. একটি সফটওয়্যার কোয়ালিটি টেস্টিং ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে;
৩. বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৩ হাজার ৯০১টি ল্যাব স্থাপন করে নিরবচ্ছিন্ন দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করা হয়েছে;
৪. শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলিজ পার্ক, যশোর; জনতা টাওয়ার সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, ঢাকা; বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটি, গাজীপুর; সিলেট ইকেকট্রনিক্স সিটি, সিলেট ও দেশের ৭টি স্থানে শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার করা হয়েছে;
৫. ১৩টি বেসরকারি আইটি প্রতিষ্ঠানকে সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষায়িত ল্যাব আইসিটি বিভাগকে একটি ডিজিটাল ফরেনিক ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে;
৬. মোবাইল গ্রাহক সংখ্যা ২০০৮ সালের ৪.৬ কোটি হতে বৃদ্ধি পেয়ে জুন ২০১৮ পর্যন্ত ১৫.০৯ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। এ-সময়ে বাংলাদেশে টেলিডেনসিটি ৯২.৬৭ শতাংশ, যা ২০০৮ সালে ছিল ৩৪.৫ শতাংশ;
৭. ইন্টারনেট গ্রাহক সংখ্যা ২০০৮ সালের মাত্র ৪০ লাখ হতে বৃদ্ধি পেয়ে জুন ২০১৮ পর্যন্ত ৮ কোটি ২ লাখে উন্নীত হয়েছে। জুন ২০১৮ পর্যন্ত বাংলাদেশে ইন্টারনেট ডেনসিটি-৫৩.৬৫ শতাংশ, যা ২০০৮ সালে ২.৬৭ শতাংশ ছিল;
৮. ২০০৮ সালে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ব্যান্ডউইডথ ব্যবহারের পরিমাণ ছিল মাত্র ৭.৫ জিবিপিএস, যা বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি একটি মাত্র সাবমেরিন ক্যাবলের (SEA-ME-WE-4) মাধ্যমে সরবরাহ করত। বর্তমানে দেশে আন্তর্জাতিক ব্যান্ডউইডথ ব্যবহার ৬৭৩ জিবিপিএস ছাড়িয়েছে;
৯. মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান পৃথিবীতে দশম;
১০. বর্তমানে দৈনিক আন্তর্জাতিক কল ৬ কোটি ৭৬ লাখ মিনিট;
১১. বর্তমানে বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের অনুমোদিত কলরেট সর্বনিম্ন ০.৪৫ টাকা হতে সর্বোচ্চ ২.০০ টাকা নির্ধারণ করা আছে। সর্বোচ্চ ১০ সেকেন্ড পালস চালু করায় মোবাইল গ্রাহকরা সাশ্রয়ী মূল্যে কথা বলতে পারছে। ১৯৯৫ সালে প্রতি মিনিট কলচার্জ ছিল ১৩ টাকা। মে ২০১৮ থেকে অফনেট ও অননেটের অভিন্ন কলরেট সর্বনিম্ন ০.৪৫ টাকা চালু করা হয়েছে। আগে অননেট ০.২৫ টাকা এবং অফনেট ০.৬০ টাকা নির্ধারিত ছিল;
১২. বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর সফল উৎক্ষেপণ হয়েছে। সজীব ওয়াজেদ, উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র গাজীপুর ও সজীব ওয়াজেদ উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র বেতবুনিয়ার মাধ্যমে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম ইতোমধ্যে সফলজনকভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
নারীর ক্ষমতায়ন
১. নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল বিশ্বে রোল মডেল। এর স্বীকৃতি হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ইউএন উইমেন ‘প্লানেট ৫০:৫০ চ্যাম্পিয়ন’ ও গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফোরাম ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড-২০১৬’ প্রদান করা হয়। নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারী শিক্ষার প্রতি অঙ্গীকারের জন্য প্রধানমন্ত্রী ২০১৪ সালে ইউনেস্কোর ‘পিস ট্রি’ পুরস্কার পান। এবং এ বছর এপ্রিল মাসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গ্লোবাল ইউমেন লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড-২০১৮ এ ভূষিত হন;
২. এই সরকারের সময়ে বাংলাদেশে ইতিহাসে জাতীয় সংসদে প্রথমবারের মতো নারী স্পিকার নিয়োজিত রয়েছেন। পাশাপাশি এছাড়া সংসদ নেতা, উপনেতা এবং বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে নারীরা দায়িত্ব পালন করছেন। মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীসহ দুজন পূর্ণ মন্ত্রী এবং তিনজন প্রতিমন্ত্রীসহ মোট পাঁচজন নারী মন্ত্রী দায়িত্ব পালন করছেন;
৩. জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্যদের আসন সংখ্যা ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০টি করা হয়েছে;
৪. বর্তমানে নির্বাচিত নারী সংসদ সদস্য ২১ জন। সংরক্ষিত আসনসহ বর্তমানে জাতীয় সংসদে সর্বমোট ৭১ জন নারী সংসদ সদস্য রয়েছেন;
৫. ২০১৫ সালে প্রকাশিত গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট অনুযায়ী নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্বে ষষ্ঠ স্থানে;
৬. উপজেলা পরিষদে একটি করে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে নারীদের জন্য ৩টি করে সংরক্ষিত আসন রাখা হয়েছে;
৭. বর্তমানে মোট ৪ হাজার ৫৪০টি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। সেই হিসাবে সংরক্ষিত আসনে সর্বমোট ১৩ হাজার ৬২০ নারী সদস্য রয়েছেন;
৮. বর্তমানে সচিব পদে সাতজন নারী এবং ৭৮ জন নারী অতিরিক্ত সচিব পদে দায়িত্ব পালন করছেন;
৯. বর্তমান সরকার সর্বপ্রথম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে একজন নারী অধ্যাপককে নিয়োগ প্রদান করেছে;
১০. আওয়ামী লীগ সরকার সর্বপ্রথম সচিব পদে নারীকে নিয়োগ প্রদান করেছে। দেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম একজন নারী মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি পদে একজন নারী দায়িত্ব পালন করছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম নারী প্রো-ভিসি নিয়োগ;
১১. আওয়ামী লীগ সরকার সর্বপ্রথম রাষ্ট্রদূত, সেনা, নৌ, বিমান বাহিনী, সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে নারী বিচারপতি, হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার পদে নারী নিয়োগ করেছে;
১২. প্রথমবারের নারী ‘নির্বাচন কমিশনার’ হিসেবে একজন নারীকে নিয়োগ। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর পদেও ইতোপূর্বে একজন নারী দায়িত্ব পালন করেছেন। ফলে নারীর প্রশাসনিক ক্ষমতায়নের বিষয়টি সর্বক্ষেত্রে দৃশ্যমান হচ্ছে;
১৩. তথ্য আপা : তথ্য আপা প্রকল্পের ১৩টি উপজেলায় প্রতিষ্ঠিত তথ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে আয়োজিত উঠান বৈঠকসমূহে নারী নির্যাতনের শিকার মহিলাদের বিভিন্ন আইনগত সহায়তা প্রদানের জন্য তথ্যসেবা দেওয়া হয়ে থাকে। তাছাড়া তথ্যকেন্দ্রে এসে মহিলারা তাদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য তথ্যসেবা পেয়ে থাকেন। ১ কোটি মহিলাকে তথ্যসেবা প্রদানে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড
পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সমন্বিত সমাজ উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকার ও ইউনিসেফের আর্থিক সহায়তায় প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ে ৩২০ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে বাস্তবায়িত হয়েছে। এই প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য অর্জনসমূহ নিম্নরূপ :
১. ৪ হাজার পাড়াকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে প্রত্যন্ত পার্বত্য এলাকার ১ লাখ ৬৫ হাজার ৩৪৩ পরিবারকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পানি, পয়ঃব্যবস্থা ইত্যাদি মৌলিক সেবা প্রদান করা হচ্ছে;
২. প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ৩টি প্রশিক্ষণকেন্দ্র মেরামতসহ ৫ হাজার ১০৯ পাড়াকর্মীকে মৌলিক প্রশিক্ষণ, ৪ হাজার ৩৪২ পাড়াকর্মীকে সঞ্জিবনী প্রশিক্ষণ, ৪০৩ জন কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ, ৩২ হাজার ৮৪০ জনকে চাকরিকালীন প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে;
৩. শিক্ষা : প্রকল্পভুক্ত তিন-পাঁচ বছর বয়সী ১ লাখ ৭৩ হাজার ১৬৫ শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য প্রস্তুতকরণের লক্ষ্যে পাড়াকেন্দ্রে শিশু বিকাশ ও প্রাক-শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ৪ হাজার পাড়াকেন্দ্রে শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করা হয়েছে;
৪. বর্তমানে ৪ হাজার পাড়াকেন্দ্রে ৫৪ হাজার শিশু প্রি-স্কুলে অধ্যয়নরত। পাড়াকেন্দ্র থেকে ২ লাখের বেশি শিশু প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নতুন দৃষ্টি
১. বর্তমান সরকারের ঐকান্তিক ও সফল শ্রম কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় ৯ বছরে (জানুয়ারি ২০০৯-৩১ ডিসেম্বর ২০১৭) মোট ৫১ লাখ ৯৮ হাজার ৫৩৯ কর্মী কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বিদেশ গমন করেছেন;
২. ২০০৯ সালে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ২৭৮ কর্মী বিদেশে গিয়েছেন এবং তাদের প্রেরিত আয়ের পরিমাণ ছিল ১০,৭১৭.৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৬ সালে ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৭৩১ কর্মী বিদেশে গিয়েছেন এবং ১৩,৬০৯.৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রবাস আয় অর্জিত হয়েছে। ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ লাখ ৮ হাজার ১৫০ কর্মী বিদেশে গমন করেছেন এবং এ-সময় অর্জিত প্রবাস আয় ৭,৭১৩.৫১ ইউএস মার্কিন ডলার;
৩. জোট সরকারের আমলে যেখানে বিশ্বের মাত্র ৯৭টি দেশে কর্মী প্রেরণ করা হতো, সেখানে নতুন আরও ৬৮টি দেশে কর্মী প্রেরণসহ বর্তমানে এই সংখ্যা ১৬৫টি দেশে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছে। চলমান শ্রমবাজারসমূহে গত ২০১৫ সালে ৩৮ শতাংশ দক্ষকর্মী; ২০১৬ সালে ৪২ শতাংশ দক্ষকর্মী প্রেরণ করা হয়েছে।
আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড
১. দেশের অব্যাহত উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক রাখতে সরকার সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছে এবং ইতোমধ্যে জঙ্গিবাদ ও চরমপন্থিদের দমন, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি প্রতিরোধ, যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচারসহ বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর মামলার বিচার নিশ্চিত করার জন্য নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে;
২. জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে মোট ১৮টি নতুন আইন প্রণয়ন, সংশোধন ও যুগোপযোগী করার পদক্ষেপ গ্রহণ।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড
১. সারাদেশে ১০১টি নতুন থানা-ভবন টাইপ প্ল্যানে নির্মাণ, ৫০টি হাইওয়ে আউটপোস্ট নির্মাণ, ১৯টি নৌ পুলিশ ফাঁড়ি নির্মাণ এবং ব্যারাক নির্মাণ, পিবিআই’র কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং তদন্ত সহায়ক যন্ত্রপাতি ক্রয়, ৯টি পুলিশ সুপার ভবন নির্মাণ, পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটে ব্যারাক ভবন নির্মাণ, ১৯টি জেলা/ইউনিটে অস্ত্র-গোলাবারুদ মজুদাগারসহ অস্ত্রাগার নির্মাণ, ৫০টি সার্কেল এএসপি অফিস-কাম-বাসভবন নির্মাণ, পুলিশ স্টাফ কলেজ, ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরি, সিআইডি অফিস ভবন নির্মাণ, জরাজীর্ণ থানা ভবন টাইপ প্ল্যানে নির্মাণ এবং পুলিশ একাডেমি সারদার মর্ডানাইজেশন উল্লেখযোগ্য;
২. বাংলাদেশ কোস্টগার্ড ১৫টি, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী ২টি, বিজিবি ১৫টি এবং এনটিএমসি ২টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে;
৩. ৯ বছরে বাংলাদেশ পুলিশের জনবল ও সাংগঠনিক কাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন। মোট ৭৫ হাজার ২৫১টি পদ সৃজিত হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশের ১০টি নতুন ইউনিট, ৩৩টি থানা এবং ৮১টি তদন্তকেন্দ্র গঠিত হয়েছে;
৪. বাংলাদেশ পুলিশের মোট ১ হাজার ১১ এএসপি, ৫ হাজার ১৯২ এসআই, ১ হাজার ৫৩ পুলিশ সার্জেন্ট এবং ৭৪ হাজার ৮৬৩ জনের কনস্টেবল পদে নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে;
৫. বর্তমান সরকারের আমলে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের কার্যক্রম দৃশ্যমান হয়েছে। সাড়ে তিন বছরে ওপেন হাউস ডে, জনসংযোগ সভা এবং অপরাধবিরোধী সভাসহ মোট বিরোধ নিষ্পত্তির সংখ্যা ৪ লাখ ২১ হাজার ৯৮২টি;
৬. ২০১৭-এর ১৯ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজের গতিশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মন্ত্রণালয়কে সুরক্ষা সেবা বিভাগ ও জননিরাপত্তা বিভাগ নামে দুটি বিভাগে ভাগ করা হয়। সুরক্ষা সেবা বিভাগ একটি সুরক্ষিত সেবামূলক পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের জনগণের সুরক্ষা ও জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড
১. মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিতকরণ এবং মুুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্মৃতি সংরক্ষণের লক্ষ্যে ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন;
২. ২০০৯ সাল হতে পর্যায়ক্রমে মুক্তিযোদ্ধার সম্মানী ভাতার হার মাসিক ৯০০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে মাসিক ১০ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়েছে এবং ১০ হাজার টাকা করে বছরে দুটি উৎসব ভাতা প্রদান করা হচ্ছে;
৩. ২০০৯ সাল হতে ভাতাভোগী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা পর্যায়ক্রমে ১ লাখ থেকে বৃদ্ধি করে ২ লাখে উন্নীত করা হয়েছে;
৪. বিভিন্ন শ্রেণির সর্বমোট ৭ হাজার ৮৩৮ জন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, মৃত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, শহিদ পরিবার ও বীরশ্রেষ্ঠ শহিদ পরিবারের মাসিক রাষ্ট্রীয় ভাতার পরিমাণ প্রায় ৫২ শতাংশ বৃদ্ধি করে পঙ্গুত্বের হার অনুযায়ী মাসিক সম্মানী ভাতা নিম্নরূপ হারে প্রদান করা হচ্ছে।
শ্রমজীবী মানুষের উন্নয়ন
১. বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পরপরই জাতীয় মজুরি ও উৎপাদনশীলতা কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে রাষ্ট্রায়ত্ত কল-কারখানার শ্রমিকদের মজুরি ও ভাতা প্রায় ৭০ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে;
২. সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন সর্বোচ্চ ১২৩ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে;
৩. শ্রমিকদের অবসর গ্রহণের বয়সসীমা ৫৭ থেকে ৬০ বছরে উন্নীত করাসহ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়েছে;
৪. শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৬টি ধাপে সর্বনিম্ন ২ হাজার ৪৫০ থেকে ৪ হাজার ১৫০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৫ হাজার ৬০০ টাকায় মজুরি স্কেল ও ভাতা/প্রান্তিক সুবিধাদি নির্ধারণ করে পণ্য উৎপাদনশীল রাষ্ট্রীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান শ্রমিক (চাকরির শর্তাবলী) আইন, ২০১২ জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে;
৫. জাতীয় বেতন ও মজুরি কমিশন গঠন। রাষ্ট্রায়ত্ত, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার শ্রমিকদের সর্বনিমন্ মজুরি ৩ হাজার ৮৯০ থেকে বাড়িয়ে ৬ হাজার ৬৯০ টাকা করা হয়েছে;
৬. একটি যুগোপযোগী শিল্পনীতি প্রণয়ন করা হয়েছে;
৭. চা-শিল্পের উন্নয়ন এবং শ্রমিকদের কল্যাণে চা-আইন-২০১৫ এবং শ্রমিক কল্যাণ আইন-২০১৫ চড়ান্ত করা হয়েছে। চা-শ্রমিকদের কল্যাণে জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ চা-শ্রমিক কল্যাণ তহবিল বিল ২০১৬ পাস হয়েছে;
৮. ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ৪২৬টি তাঁতের বিপরীতে ১৪২ তাঁতিকে ৪৯ লাখ ২৬ হাজার টাকা ঋণ প্রদান করা হয়েছে এবং সেই সাথে তাঁতিদের প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। গার্মেন্ট শিল্প ও তাঁত শিল্পের মানোন্নয়নে টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ফ্যাশন ডিজাইন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে;
৯. গত ৯ বছরে সারাদেশে তাঁত সংশ্লিষ্ট ১ হাজার ৫০০ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে;
১০. প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিদেশে গমেেনচ্ছুরা এই ব্যাংক থেকে কম সুদে ঋণ নিয়ে বিদেশে যেতে পারছেন। দেশে ফিরে বিনিয়োগের জন্যও ঋণ নিতে পারছেন।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার
১. একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একে একে এই আদালতে বিচারের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মিলে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, অপহরণ ও ধর্মান্তরকরণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে নেতৃত্ব দেওয়া যুদ্ধারপরাধীদের। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত ৩১টি মামলায় ৫৮ জনের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। এসব মামলায় ৬৬ আসামি ছিলেন। দণ্ড দেওয়া হয়েছে ৬৫ জনকে। এর মধ্যে ৩৮ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ২৩ জনকে আমৃত্যু করাদণ্ড, একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান ও একজনকে ৯০ বছরের দণ্ড প্রদান করা হয়। ছয়জনের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে অপ্রত্যাশিত সফলতা
১. বর্তমান সরকার সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে কাজ করছে। যে কোনো মুল্যে সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ দমন এই সরকারের অন্যতম লক্ষ্য;
২. আন্তর্জাতিক বিশ্ব সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে বর্তমান সরকারের কর্মকা-কে প্রশংসা করছে;
৩. ২০১৩ হতে ২০১৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ৯১টি জঙ্গিবিরোধী অভিযানে ৫৮ জঙ্গি নিহত হয়েছে, ২৬০ জনকে গ্রেপতার করা হয়েছে;
৪. যে কোনো প্রয়োজনে পুলিশি সহায়তার জন্য ‘৯৯৯’ সেবা চালু করা হয়েছে। যে কেউ এই নম্বরে কল করে পুলিশের সহায়তা চাইতে পারে।
[পদ্মা রেলওয়ে সেতু প্রকল্প]
[পায়রা সমুদ্রবন্দর প্রকল্প]
১০টি অর্থনৈতিক মেগা প্রকল্প
১. পদ্মাসেতু প্রকল্প;
২. পদ্মা রেলওয়ে সেতু প্রকল্প;
৩. রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প;
৪. রামপুর বিদ্যুৎ প্রকল্প;
৫. মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র;
৬. মেট্রোরেল প্রকল্প;
৭. সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প;
৮. পায়রা সমুদ্রবন্দর প্রকল্প;
৯. দোহাজারি-কক্সবাজার-গুনদুম রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প;
১০. এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প।
[মেট্রোরেল প্রকল্প]
২০০৮-২০০৯ হতে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য অর্জন
১. বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ১৪ হাজার ৯৪০টি শিল্প প্রকল্পের নিবন্ধন প্রদান করা হয়েছে। নিবন্ধিত শিল্প প্রকল্পের প্রস্তাবিত মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৭৭৫০৬৪৮.৬৩৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে মোট ২ কোটি ৮৯ লাখ ৯ হাজার ১৪৮ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে;
২. ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে এফডিআই অন্তৎপ্রবাহের পরিমাণ ২৪৫৪.৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (সূত্র : বাংলাদেশ ব্যাংক);
৩. ২০০৮-০৯ হতে ২০১৬-১৭ অর্থ বছর পর্যন্ত আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের মাধ্যমে ১৩৮৩.৮১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮ হাজার ৫০০ ব্যারাক নির্মাণ করে ৪৭ হাজার ১০০ টি পরিবার পুনর্বাসন করা হয়। ৩৪ হাজার পুনর্বাসিত পরিবারকে পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় এবং তাদের মধ্যে ৪৯.৯০ কোটি ঋণ প্রদান করা হয়;
৪. নিজ জমিতে গৃহহীন ২৭ হাজার পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে;
৫. সারাদেশে ৫ হাজার ২৮৬টি ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদে ৪ হাজার ৫৫৪টি, পৌরসভায় ৩২৫টি এবং সিটি কর্পোরেশনের ৪০৭টি ডিজিটাল সেন্টার চালু রয়েছে। মোট উদ্যোক্তা ১০ হাজার ৫৭২ জন।
[রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প]
[বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রকল্প]
[সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্প]
আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে কেন নির্বাচিত করবেন
১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হলে পূর্ব বাংলা তথা বর্তমান বাংলাদেশ ব্রিটিশ উপনিবেশের খপ্পর থেকে পাকিস্তানি উপনিবেশের খপ্পরে পড়ে। যেই মানুষটিকে ঘিরে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্ন দানা বেঁধে ওঠে তিনি হলেন বাঙালিশ্রেষ্ঠ শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবের সারাজীবনের রাজনৈতিক লক্ষ্যই ছিল স্বাধীন বাংলা ভূখ-। যেদিন থেকে শেখ মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন সেদিন থেকেই তার পেছনে পাকিস্তানপন্থী মৌলবাদী অপশক্তি ছায়ার মতো লেগে থাকে। একের পর এক চক্রান্ত করতে থাকে শেখ মুজিব ও বাংলাদেশ নিয়ে। ১৯৫৪ সালে ইস্কান্দার মির্জার লেখা একটি চিঠিতে আছে-
Sheikh Mujibur Rahman
Has been in prison several times. Is a remarkably good organizer. Has guts. Holds extreme views in politics. Is an experienced agitator. May be described as the stormy petrel of the Awami League. A dangerous gentleman who is best in jail. (মোনায়েম সরকার সম্পাদিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জীবন ও রাজনীতি’, দ্বিতীয় খ-, বাংলা একাডেমি, পৃ. ৯৩৩।)
এই চিঠিটি তিনি লিখেছিলেন তৎকালীন গভর্নর গোলাম মোহাম্মদকে। এই চিঠি থেকেই বোঝা যায়, শেখ মুজিব কত বড় মাপের সংগ্রামী ও মর্যাদাবান রাজনৈতিক নেতা ছিলেন পাকিস্তানিদের চোখে। তাছাড়া ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া খানও বলেছিলেন-‘This time Mujib will not go un punished.’
শেখ মুজিব যখন বাংলাদেশের রাজনীতির মধ্য-গগনে জ্বলজ্বল করছেন তখন তার চারপাশের প্রায় সকলেই নিবু নিবু করছিল। সেই নিবু নিবু নেতাদের বুকে টেনে নিয়ে শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন এবং দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধ শেষে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনেন। সাহসী শেখ মুজিব মরতে প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু পালানো তার স্বভাবে ছিল না। এ প্রসঙ্গে একটি অবিস্মরণীয় স্মৃতি মনে পড়ছে- ন্যাপ সভাপতি আবদুল ওয়ালী খান,এমএনএ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ আর আমি ২০ মার্চ ১৯৭১ সালে গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে। আবদুল ওয়ালী খান বাংলাদেশের তৎকালীন পরিস্থিতি অনুমান করে বঙ্গবন্ধুকে যা বললেনÑ তা এরকমÑ পাকিস্তানিরা মনে করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তোমাকে না মেরে তারা ভুল করেছে। এবার সুযোগ পেলে তারা তোমাকে হত্যা করবেই। সুতরাং সুযোগ বুঝে পালিয়ে যেও। বঙ্গবন্ধু আবদুল ওয়ালী খানকে বলেছিলেনÑ “আমি তো পালানোর রাজনীতি করি না- পালায় তো মুজাফফররা। তারপরেও কবুতরের খোপের পাশে সিঁড়ি লাগিয়ে রেখেছি।” বঙ্গবন্ধু পলায়নপর মনোবৃত্তি নিয়ে কখনোই রাজনীতি করেননি। তিনি সততা, দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমের যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা অতুলনীয় ও অসামান্য। শেখ মুজিবের শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সবটুকু ইতিহাসই রাজনীতির ইতিহাস। অথচ পঁচাত্তরের পরে যারা উড়ে এসে জুড়ে বসল বাংলার মসনদে তারা এমন ভাব দেখাতে শুরু করল যে, শেখ মুজিব কেউ নয়, তিনি কিছুই করেননি, সবকিছু করেছেন ওই উড়ে এসে জুড়ে বসা ছদ্মবেশী নেতারা। শেখ মুজিবের মৃত্যুতে শুধু একটি মানুষেরই মৃত্যু হয়নি, একটি দেশের স্বপ্নের মৃত্যু হয়েছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কক্ষপথচ্যুত হয়েছে। শেখ মুজিবকে হত্যা করে কিংবা হত্যায় ইন্ধন জুগিয়ে যারা বাংলাদেশের ক্ষমতায় এসেছিল ও শিকড় গেড়ে বসেছিল- তারাই হাত মিলিয়েছিল একাত্তরের সেই পরাজিত অপশক্তির সঙ্গে। তারা চায়নি বাংলাদেশ স্বাধীন হোক, বাংলাদেশ নিজের পায়ে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। তারা চেয়েছিল বাংলাদেশ পাকিস্তানের উপনিবেশ থেকে শোষিত হোক, মৌলবাদীদের দিয়ে ভরে যাক। সাম্প্রদায়িক সংঘাতে রক্তাক্ত হোক বাংলার প্রান্তর। যতদিন মুজিববিরোধী তথা আওয়ামী লীগ বিরোধী শক্তি ক্ষমতায় ছিল ততদিন বাংলাদেশে সন্ত্রাস, মৌলবাদ, বোমা হামলা, দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িক সংঘাত লেগেই ছিল। আজ দেশে আওয়ামী লীগ সরকার সুপ্রতিষ্ঠিত, দেশের মানুষ সুখে-শান্তিতে আছে। কারোই তেমন অভাব-অভিযোগ নেই। উন্নয়নের জোয়ার এসেছে সমগ্র বাংলাদেশে। আজ পাকিস্তানিরাই বলছেনÑ পাকিস্তানের উচিত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মডেল অনুসরণ করা। বাংলাদেশ যেভাবে আজ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সকল বাধা সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেÑ তা বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিচ্ছে। এ ধারা আগামীতেও অব্যাহত থাকলে উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ হওয়া মোটেই অসম্ভব নয়।
আর কয়েকদিন পরেই বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আগামী নির্বাচন এমন একটা সময়ে অনুষ্ঠিত হবে যে সময়টা বিএনপির জন্য হবে অগ্নিপরীক্ষাতুল্য। বিএনপি-জামায়াত ছাড়া নির্বাচনে যাওয়া মানে নিশ্চিত ভরাডুবি। বিগত দিনের নির্বাচন পরিসংখ্যান অন্তত তাই বলে। আগামী নির্বাচনে জামায়াত অংশ নিতে পারবে না, সে ক্ষেত্রে জামায়াতের ভোট বিএনপির বাক্সে গেলেও বিএনপিকে একা একাই মাঠে থাকতে হবে। অবশ্য এই মুহূর্তে একা একা মাঠে টিকে থাকার সামর্থ্য বিএনপির আছে কিনা সেই বিষয়েও সন্দেহ রয়েছে। বিএনপি যা লুটপাট করেছিল এতদিনে সেই পুঁজি প্রায় শেষ হয়ে গেছে। হাওয়া ভবনে এখন আর কমিশন ব্যবসা নেই, সিন্ডিকেট নেই, কোকো ১, ২, ৩, ৪ ইত্যাদির ব্যবসা মন্দা, ড্যান্ডি ডাইংও খারাপ অবস্থায়, দলীয় নেতাকর্মীরা সকলেই প্রায় সীমাহীন দুর্নীতির দায়ে পলাতক বা দলত্যাগী। দুর্নীতিবাজ আসামি অর্বাচীন তারেক জিয়ার নেতৃত্বে কোমর ভাঙ্গা দল নিয়ে বিএনপি কতটুকু লড়াই করতে পারবে বা আদৌ পারবে কিনা সেটাই বিবেচ্য। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বর্তমানে বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্ট ফ্যাক্টর নয়, ফ্যাক্টর আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের বিকল্প এখন আওয়ামী লীগই। এ মুহূর্তে উন্নয়নে, পরিকল্পনায়, রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় আওয়ামী লীগের ধারে কাছে কেউ নেই।
স্বাধীন বাংলাদেশে পঁচাত্তরের পরে যে দুটি রাজনৈতিক দল দীর্ঘদিন ক্ষমতা দখল করে রেখেছিল সেগুলো ছিল কৃত্রিমভাবে প্রতিষ্ঠিত দল। ক্ষমতায় আসীন থাকাকালে জেনারেল জিয়া তথাকথিত ১৯-দফার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিএনপি আর পরবর্তীকালে জেনারেল এরশাদ ১৮-দফার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জাতীয় পার্টি। বিএনপি মূলত রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, ন্যাপ, সুবিধাবাদীদের নিয়ে গঠিত ওরস্যালাইন পার্টি। ক্যান্টনমেন্টের অন্ধকার কুঠুরিতে জন্ম নেয়া এই দলটি বাংলাদেশের রাজনীতি ধ্বংস করে দেয়, দেশদ্রোহীদের পুনর্বাসন করে সৃষ্টি করে পাকিস্তানি ভাবধারা।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস যারা জানেন, তারা নিশ্চয়ই মনে করতে পারেন পঁচাত্তর পরবর্তী জিয়া সরকার অবৈধ ছিল। জিয়া আইয়ুব খানের মতো হ্যাঁÑনা ভোটের আয়োজন করেছিলেন দেশকে পাকিস্তানি ধারায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। এই অবৈধ জিয়া সরকার সারাদেশে সৃষ্টি করেন এক দুর্বিষহ আতঙ্ক। তার সীমাহীন নির্যাতনে জেলখানা ভরে যায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী দ্বারা। জিয়ার শাসনামলে প্রতি রাতে দেশে ‘মার্শাল ল’ থাকতো। জনজীবন ছিল চরম অনিরাপত্তার ভেতর। সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়া বাংলাদেশে যে কালো আইন তৈরি এবং মুজিব হত্যাকা-ের বৈধতা দান করে ঘাতকদের পুরস্কৃত করে।
আসুন আমরা বিগত কয়েকটি নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখি- ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে জনগণের প্রিয় পার্টি আওয়ামী লীগ ২৮৮টি আসন, ভোট পায় ৮৯ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগ পায় ২৯৩টি আসন, ভোট পায় ৭৩ দশমিক ২০ শতাংশ। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে জেনারেল জিয়া প্রতিষ্ঠিত বিএনপি পায় ২০৭টি আসন, ৪১ দশমিক ১৬ শতাংশ ভোট আর ষড়যন্ত্র করে আওয়ামী লীগকে দেয়া হয় মাত্র ৩৯টি আসন এবং ২৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ ভোট। এখানে লক্ষ্য করার মতো একটি ব্যাপার হলোÑ ঘাতকের হাতে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পূর্বেও যে আওয়ামী লীগের ভোট ছিল ৭৩ দশমিক ২০ শতাংশ তার মৃত্যুর পরে তার ভোটার সংখ্যা কিভাবে ২৪ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে যায় আর হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা সেনাশাসক জেনারেল জিয়ার বিএনপি পায় ৪১ দশমিক ১৬ শতাংশ ভোট তা বিশ্লেষণের বিষয়ই বটে।
১৯৮৬ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের শাসনামলে যে নির্বাচন হয় সেই নির্বাচন বিএনপি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সরে দাঁড়ায় এবং খালেদা জিয়া তথাকথিত আপসহীন নেত্রীতে পরিণত হন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়কে ঠেকাতে ৪৮ ঘন্টা মিডিয়া ক্যু করে জাতীয় পার্টি নির্বাচনের ফলাফল উল্টে দেয়। এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি পায় ১৫৩টি আসন, ভোট পায় ৪২ দশমিক ১৫ শতাংশ। আওয়ামী লীগ আসন পায় ৭৬টি, ভোট পায় ১৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। মিডিয়া ক্যু না হলে নির্বাচনের ফলাফল আওয়ামী লীগের পক্ষেই যেতো। ১৯৮৮ সালে আবার এরশাদের অধীনে নীল নকশার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেউই অংশ নেয়নি। এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ২৫১টি আসন, ভোট পায় ৬৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ, ফ্রিডম পার্টি পায় ২টি আসন আর ৭২ দলীয় জোটের নেতা আ স ম আবদুর রব ১৯টি আসন পেয়ে বিরোধী দলীয় নেতা হন।
১৯৯১ সালে সর্বদলীয় রাজনৈতিক পার্টির অংশগ্রহণের মাধ্যমে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে বিএনপি পায় ১৪০টি আসন, আওয়ামী লীগ জোট পায় ১০০টি আসন এবং জাতীয় পার্টি পায় ৩৫টি আসন। এই নির্বাচনের ভোটের সংখ্যা বিশ্লে¬ষণ করে দেখা যায় বিএনপির বাক্সে পড়ে ৩০ দশমিক ৮১ শতাংশ ভোট আর আওয়ামী লীগ পায় ৩৩ শতাংশ ভোট, জাতীয় পার্টি পায় ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ ভাট। জামায়াত পায় ১৮টি আসন। জামায়াত-বিএনপির আসন ভাগাভাগির ফলে বিএনপি ১৯৯১ সালে অপ্রত্যাশিতভাবে সরকার গঠন করে।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আবার এসে গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়ে। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নিজের অধীনে আয়োজন করে ষড়যন্ত্রের নির্বাচন। এই নির্বাচনে বিএনপি পায় ২৭৮টি আসন, ফ্রিডম পার্টি পায় ২টি এবং স্বতন্ত্র পার্টি পায় ১০টি আসন। কিন্তু খালেদা জিয়া গণ-আন্দোলনের মুখে শেষ রক্ষা করতে পারেননি। প্রচ- গণ-আন্দোলন ও জনতার মঞ্চ গঠন করার ফলে ১৯৯৬ সালের জুন মাসে তিনি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। যদিও তিনি বলেছিলেনÑ ‘পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ নির্দলীয় নয়’।
এই নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ ১৪৬টি আসন এবং ৩৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ ভোট পেয়ে একুশ বছর পরে অর্থাৎ পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পরে ক্ষমতায় আসীন হয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি পায় ১৯৩টি আসন এবং ৪০ দশমিক ৮৬ শতাংশ ভোট, আওয়ামী লীগ পায় ৬২টি আসন এবং ৪০ দশমিক ২১ শতাংশ ভোট। অর্থাৎ এই নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ প্রায় সমসংখ্যক ভোট পেলেও আসন সংখ্যায় বিএনপি এগিয়ে থাকে। এবারও জামায়াতকে সাথে নিয়ে জামায়াতের ৪ দশমিক ২৯ শতাংশ ভোট নিয়ে এবং ১৭টি আসন নিয়ে বিএনপি এগিয়ে যায়। ২০০১ সালের নির্বাচনে জয় লাভ করে বিএনপি আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার নানামুখী ষড়যন্ত্র করে, রাজাকারদের মন্ত্রী বানায়, বাংলা ভাই সৃষ্টি করে এবং দেশজুড়ে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটায়। বিএনপির রক্তলোলুপ চক্রান্তে শাহ এ এম এস কিবরিয়া, আহসান উল্লাহ মাস্টারসহ আওয়ামী লীগের শত শত নেতাকর্মী নিহত হন। শেখ হাসিনাও ১৯ বার মৃত্যু ঝুঁকি থেকে বেঁচে যায়। এর মধ্যে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার কথা সবচেয়ে নির্মম আর মর্মান্তিক।
বিএনপি ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় এসে যেমন ক্ষমতা ছাড়তে চায়নি তেমনি ২০০১ সালে ক্ষমতা পেয়েও তারা মেয়াদ পূর্ণ করে ক্ষমতা ছাড়তে টালবাহনা শুরু করে। এরপর আবির্ভূত হয় কিছু উচ্চাভিলাশী সামরিক ও বেসামরিক নেতার নেতৃত্বে আর্মি সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তারাও দুই বছর গণতন্ত্রকে জিম্মি করে রাখে। কিন্তু গণ-আন্দোলনের মুখে তারাও বাধ্য হয় ২০০৮ সালে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে এবং মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার কাজে মনোনিবেশ করে। দেশে এখন সেই ধারাই অব্যাহত আছে। উপরের বিশ্লে¬ষণ থেকে একটি বিষয় প্রতীয়মান হয়েছে যে, যখনই বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে তখনই আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে। এ ধারা ১৯৭০ থেকে শুরু হয়ে ২০১৪ পর্যন্ত বিদ্যমান, ২০১৮ সালেও তার ব্যত্যয় হবে না।
বাংলার মানুষ আজ ক্যান্টনমেন্ট নির্ভর ক্ষমতাবানদের চায় না। তারা ‘গণভবন’ আর ‘বঙ্গভবন’ নির্ভর ক্ষমতা দেখতে চায়। জেনারেল জিয়া অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। নানাপ্রকার চক্রান্ত করে আওয়ামী লীগকে তথা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ও গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে চেয়েছেন। আজ বিএনপির পক্ষে কথা বলা মানে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কথা বলা, গণতন্ত্রের বিপক্ষেই কথা বলা। দেশে অনেক জঞ্জাল জমেছে। সেই জঞ্জাল পরিষ্কার করতে হলে, দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে আওয়ামী লীগকে অকুণ্ঠ সমর্থন দেওয়া দরকার। আশাকরি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ সে সুযোগ আওয়ামী লীগকে দেবে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে দুর্বৃত্ত, চাঁদাবাজ ও দুর্নীতিগ্রস্তদের নৌকা থেকে ফেলে দিতে হবে। দেশের মানুষ উন্নত ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ চায়। হাওয়া ভবন বা খোয়াব ভবন দেখতে চায় না। শেখ হাসিনার মতো এমন ব্যতিক্রমী নেতৃত্ব দেশবাসী বিগত ৪৫ বছরে দেখেনি। তিনি চলনে-বলনে-আহ্বানে দৃঢ়চেতা, রাজনৈতিক কৌশলে দূরদর্শী এবং সিদ্ধান্তে সাহসী এক ব্যক্তিত্ব।
জোট ও ভোট নিয়ে চারদেিক নানামুখী তৎপরতা শুরু হয়েছে। যার এক শতাংশ ভোট নেই, যিনি নির্বাচনে প্রার্থী হলে তার জামানত বাজেয়াপ্ত হবে, তিনিও এখন নিজেকে বড় নেতা বলে প্রচার করার চেষ্টা করছেন। নামসর্বস্ব দলের সঙ্গে জোট করে লাভ নেই, তাদের এককভাবে নির্বাচন করতে দেওয়া হোক। তারা জয়ী হলে স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তির সঙ্গে তাদের জোট হবে। বঙ্গবন্ধুর আমলেও ন্যাপ (মোজাফফর) ৪০টি আসন নিয়ে দরকষাকষি করেছিল। বঙ্গবন্ধু ২০টি আসন দিতে চেয়েছিলেন। পরে ন্যাপের ভরাডুবি আমরা লক্ষ্য করেছি। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন জোটের মধ্যে ভাঙনের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। নির্বাচন পর্যন্ত কোন জোটের কি অবস্থা হবে তা বলা মুশকিল।
বাংলাদেশের কতিপয় সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবী ও বামনেতা পত্র-পত্রিকায়, টকশোতে বলার চেষ্টা করছেন দেশে গণতন্ত্র নেই, বাক-স্বাধীনতা নেই, মানুষের ভোটের অধিকার নেই- একথা সত্য নয়। দেশে গণতন্ত্র ও বাক-স্বাধীনতা না থাকলে তারা এত কথা বলেন কিভাবে? ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তারা কোথায় ছিলেন? ওয়ান ইলেভেনের সময়ও তারা নিশ্চুপ ছিলেন কেন? খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়া- উভয়েই দুর্নীতির কারণে দ প্রাপ্ত। বর্তমানে অনেক দেশেই দুর্নীতির কারণে নেতা-নেত্রীরা জেল খাটছেন। খালেদা জিয়া ও তার পুত্র তারেক জিয়া রাজবন্দী হলে তাদের পক্ষে কথা বলা যেতো- তারা যেহেতু দুর্নীতির কারণে দণ্ডিত তাদের পক্ষে কথা বলা কি প্রকারান্তরে দুর্নীতির পক্ষেই কথা বলা নয়? এদেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও দিকভ্রান্ত বাম-নেতাদের অতীত অত্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ। মানুষ এখন আর এদের বিশ্বাসযোগ্য মনে করে না।
শেখ হাসিনা তার সুচিন্তিত ও সুদৃঢ় নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে মর্যাদার আসনে আসীন করেছেন এ কথা সর্বাংশে সত্য। তবু কিছু কিছু মানুষ ভুল পথে আছে, তারা এখনো বিশ্বাস করে পাকিস্তানি ভাবধারায়। এই ভুল পথে চলা মানুষগুলোকে সুপথে ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রতিটি নেতাকর্মীর অঙ্গীকার হোক- অবাধ, সুষ্ঠু, সুন্দর ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আওয়ামী লীগের ক্ষমতারোহণ। এ জন্য আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতাকর্মীকে সৎ, দুর্নীতি মুক্ত, সদালাপী, সদাচারী ও দেশপ্রেমিক হতে হবে। আওয়ামী লীগ গণমানুষের দল। মানুষের প্রতি বিশ্বাস রেখেই আওয়ামী লীগকে এগিয়ে যেতে হবে। দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ রেখে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবে আওয়ামী লীগ। সবার পক্ষে নতুন ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নয়। বাংলার মানুষ বিশ্বাস করে শেখ হাসিনার জন্য কোনো কিছুই আজ অসম্ভব নয়। তিনিই পারবেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সুখী, সমৃদ্ধিশালী সোনার বাংলা গড়তে। উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে আওয়ামী লীগকে আবারও ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া জরুরি। আর দেশকে এগিয়ে নেয়ার যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগেরই বেশি। তাই আসুন সব ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-মান-অভিমান পরিহার করে ’৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনের মতো জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান তুলে নির্বাচনে নিজে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নৌকা মার্কায় ভোট দেই এবং অন্যকেও একই সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনুপ্রাণিত করি।
তথ্য : ইন্টারনেট/দৈনিক, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক পত্রিকা থেকে