বাংলাদেশের অগ্রগতির ধারা অব্যাহত থাকুক
মোনায়েম সরকার
স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশের রাজনীতিতে পঞ্চাশের দশক ছিল অসাম্প্রদায়িক জাতীয় চেতনা বিকাশের কাল আর ষাটের দশক ছিল গণতন্ত্র অর্জন ও আইনের ভেতর দিয়ে জাতীয় চেতনা বহিঃপ্রকাশের প্রচেষ্টা। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বিরূপতা এবং রবীন্দ্রবিরোধিতা যত প্রবল হয়েছে, ততই বাঙালিদের মধ্যে প্রতিবাদী চেতনাও জোরদার হয়েছে। পাকিস্তানের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত জোরালোভাবেই উন্মেষ ঘটতে থাকে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার। স্বায়ত্তশাসনের জন্য ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের পক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬-দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন এবং এর সমর্থনে ৭ জুন দেশব্যাপী হরতাল ডাকেন। পরবর্তীকালে ৬-দফা ছাত্র সমাজের ১১-দফার অন্তর্ভুক্ত হয়ে ’৬৯-এর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দাবির অংশ হয়।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী যতই ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সাম্প্রদায়িকতা ব্যবহার করেছে, ততই বিরোধী দলগুলো অসাম্প্রদায়িক হয়েছে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার যে, আওয়ামী লীগ-আওয়ামী মুসলিম লীগ হিসেবে ১৯৪৯ সালে আবির্ভূত হয়। কিন্তু বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর অভিজ্ঞতার আলোকেই ১৯৫৫ সালে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে দলটি ধর্মনিরপেক্ষতাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব বাঙালির সমর্থন পাওয়ার পথ সুগম হয় এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে।
১৯৫২ কিংবা ১৯৪৮ থেকেই যে ভাষা আন্দোলন বিকশিত হতে শুরু করে তা মূলত বাঙালিদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের জন্যÑ সেখানে ধর্মের কোনো প্রাসঙ্গিকতাই ছিল না। স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক পরিবেশটা পুরোপুরি পাল্টে যায়। পঞ্চাশ ও ষাট দশকের জনপ্রিয় আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত হলো নতুন রাষ্ট্র। আর সময়ের ধারাবাহিকতায় যোগ হলো সমাজতন্ত্র। জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের পরিবর্তে এলো জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামের নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সেই অধ্যায়ের শেষ হলো।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে রাজনীতি খুব দুঃখজনক রূপ ধারণ করে। উগ্র বামপন্থী স্লোগান নিয়ে আওয়ামী লীগের ছাত্র ও শ্রমিক ফ্রন্ট ভেঙ্গে সৃষ্টি হয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। প্রচ- সরকার-বিরোধী ভূমিকা নিয়ে তারা ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও প্রকারান্তরে তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির উত্থানের পথ প্রস্তুত করে। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে নতুন দেশের সংবিধান প্রণীত হয় এবং ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম প্রভৃতি রাজনৈতিক দলসমূহের কোনো অস্তিত্ব বা অংশগ্রহণ ছিল না। নির্বাচনে সরকার প্রায় সব ক’টি আসনে জয়ী হয়। আর দ্বিতীয় বৃহৎ সংসদীয় গোষ্ঠী হিসেবে আবির্ভূত হয় স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরাÑ তারা ১১টি আসনে জয়ী হয়। গোটা পাকিস্তান আমল জুড়েই কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকায় প্রকাশ্যে দলীয় কর্মকা- পরিচালনা করতে পারেনি। তবে তারা প্রথমে আওয়ামী লীগ ও পরে ন্যাপ বা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মাধ্যমে কাজ চালিয়ে যায়। স্বাধীনতার পর তারা স্বনামে প্রকাশ্যে রাজনীতি শুরু করে। ফলে স্বাধীনতার পর বাস্তব কারণেই কমিউনিস্ট পার্টির তেমন গণভিত্তি ছিল না।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকার যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি খুব ভালোভাবে সামাল দিতে পেরেছেÑ এটা বলা যাবে না। একদিকে যেমন বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলা-বারুদ বাইরে রয়ে গেল, অন্যদিকে জাসদ সৃষ্টি হওয়ার পর সরকার দ্রুত রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে থাকে। জাসদ ছাড়াও অন্যান্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চীনপন্থী গোপন দলগুলো চাঙ্গা হয়ে ওঠে। স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের পরিস্থিতিতে বামপন্থী খোলসে বাংলাদেশের বিরোধিতা করা খুব সহজ ব্যাপার হয়ে ওঠে। গোপন সন্ত্রাসী তৎপরতা বাড়তে থাকে। অসংখ্য থানা ও পুলিশ ফাঁড়িতে সশস্ত্র হামলা ও লুট করা হয়। বেশ কয়েকটি পাটের গুদামে আগুন ধরানো হয়।
আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, রাজনৈতিক সহিংসতা, অর্থনৈতিক স্থবিরতার সাথে ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালের উপর্যুপরি বন্যা এবং আমেরিকার ষড়যন্ত্রের কারণে ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার ১৯৭৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা জারি করে। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ তারিখে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি জাতীয় দলের নাম ঘোষণা করেনÑ বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ Ñ সংক্ষেপে ‘বাকশাল’। জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার পর আইন-শৃঙ্খলার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়। থানা লুটের সংখ্যাও কমে আসে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ইতিবাচক উন্নয়ন ঘটতে থাকে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মাধ্যমে যবনিকাপাত ঘটে বাকশালের এবং সাথে সাথে পরিসমাপ্তি ঘটে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনাধারণকারী রাজনৈতিক ধারার।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিদের মধ্যে অনৈক্যের সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ’৭১-এর পরাজিত শক্তিরা। ’৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করা হয় তার শিরোমণি ছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি পর্যায়ক্রমে সামরিক ফরমান বলে সংবিধান পরিবর্তন করে ধর্মীয় রাজনীতি পুনঃপ্রবর্তন করে জামায়াতসহ নিষিদ্ধ দলগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করেন। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতাকারী, চীনপন্থী রাজনৈতিক দল, মুসলিম লীগসহ অন্যান্য ছোট-বড় সাম্প্রদায়িক দল ও ব্যক্তিদের নিয়ে গড়ে তোলেন প্রথমে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট, পরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।
এটা ঠিক যে, প্রবণতার দিক থেকে ভাবতে গেলে এই প্রবণতা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকেই শুরু হয়। রাষ্ট্রপতি হিসেবে খোন্দকার মোস্তাক আহমেদ প্রথম ভাষণ শেষ করেন ‘জয় বাংলার’ পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ দিয়ে। এ ছাড়াও ‘বাংলাদেশ বেতার’-এর নাম ‘রেডিও পাকিস্তানের’ আদলে ‘রেডিও বাংলাদেশ’ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মাধ্যমে সেনাবাহিনী ও তার প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান যখন স্ব-মূর্তিতে আবির্ভূত হন, তখন নতুন উত্থিত রাজনৈতিক সরকারের রাজনীতি ও আদর্শ আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি এতই প্রতিক্রিয়াশীল ও নেতিবাচক হয়ে ওঠে যে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধকে ‘ভারতীয় ষড়যন্ত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিদের ভারতীয়দের এজেন্ট হিসেবে আখ্যায়িত করা শুরু হয়। দেশপ্রেমের নতুন সংজ্ঞা আমদানি করা হয়। যারা যত সাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তারাই তত দেশপ্রেমিক। জাতীয়তাবাদ বলতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর রইলো না; জাতীয়তাবাদ হয়ে উঠলো ‘বাংলাদেশী’ যা ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’-এর নামান্তর। সমন্বয় ও সমঝোতার রাজনীতির নামে জিয়াউর রহমান দেশের প্রধানমন্ত্রী বানালেন একজন কুখ্যাত ‘রাজাকার’ শাহ আজিজুর রহমানকে ও পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আজমকে দেশে নিয়ে আসা হয়। পরবর্তীকালে ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান নিহত হন।
জিয়াউর রহমানের হত্যার ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক ধারার সমাপ্তি না হয়ে বরং সেটাকে পুঁজি করে আজও তথাকথিত ‘জাতীয়তাবাদী’ শক্তি বেঁচে আছে। আর জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর প্রায় ৮ বছর দেশ শাসন করেন আরেক সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনিও ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’-কেই আদর্শ করে পথ চলেছেন। তবে এটা বলতে হয় যে, জিয়ার মতো তিনি ‘রাজাকার-পুনর্বাসন’ কর্মসূচি গ্রহণ না করলেও তাদের প্রতিপালনের কর্মসূচি তারও ছিল। নিজের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য তিনি ১৯৮৫ সালে সামরিক ফরমান বলে ‘ইসলাম’কে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির মাথায় কুঠারাঘাত করেন এবং স্থায়ী ক্ষত তৈরি করে রেখে যান। এরশাদ তার শাসনামলে জনভিত্তি বাড়ানোর জন্য বার বারই ধর্মকে ব্যবহার করেছেন। এমনকি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনকে বিভক্ত করার জন্য ১৯৯০ সালের নভেম্বরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও বাঁধিয়েছেন।
১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি পুনরায় ক্ষমতায় আসে উগ্র-সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় দল জামায়াতে ইসলামীর হাত ধরে। সেটা হয়তো খানিকটা স্বাভাবিক ছিল, কেননা আদর্শিক দিক দিয়ে তারা একে অপরের অনেক কাছাকাছি। বিএনপি-জামায়াতের যৌথ রাজনীতি দেশে সাম্প্রদায়িক ও উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোকে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়। অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারাকে দুর্বল করার জন্য রাষ্ট্রীয় মদদে নানা উগ্রবাদী গোষ্ঠী তৎপরতা শুরু করে।
২০০১ সালে এই দুই অপশক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রথমেই ঝাঁপিয়ে পড়ে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় বসার পর পরই পরোক্ষ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মাঠে নামে ‘বাংলা ভাই’। তারা রাজশাহীর বাগমারায় তা-ব সৃষ্টি করে এবং পরে তাদের ‘আন্দোলন’ দেশের তেষট্টিটি জেলায় পাঁচশত বোমা ফাটিয়ে আতঙ্ক ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করে। আন্তর্জাতিক চাপের কারণে শেষ পর্যন্ত চারদলীয় সরকার ‘বাংলা ভাই’ ও তার কথিত আধ্যাত্মিক গুরু শায়খ আবদুর রহমানকে গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়। এক-এগারোর পর ফখরুদ্দিনের ‘বিশেষ’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পর বাংলা ভাই ও তার গুরুর মৃত্যুদ- কার্যকর হয়।
সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে গড়া পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্য থেকেই বাংলাদেশের অভ্যুদয়। তাই এখানে সাম্প্রদায়িকতার শেকড় গজানোর সহায়ক পরিবেশ থাকাটাই স্বাভাবিক। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা যে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করলাম সেই দেশে অসাম্প্রদায়িক চেতনার আরো বিকাশ ঘটবে বলে স্বাভাবিকভাবেই আশা করা হয়েছিল। কারণ সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেয়া পাকিস্তানের রাষ্ট্র-দর্শনকে প্রত্যাখ্যান করেই বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল এই ভূখ-ের জনগোষ্ঠী। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে বাংলাদেশের প্রায় সকল নাগরিক। বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় অন্যতম আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। অবশ্য এটাও ঠিক যে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ দেশের সব মানুষ রাতারাতি গ্রহণ করে ফেলার মতো বিষয় নয়। তাছাড়া দীর্ঘদিন দেশের মানুষ একটি ধর্মীয় আবহে বেড়ে উঠেছে, মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি বঞ্চনাবোধ কাজ করায় তাদের মধ্যে ধর্ম নিয়ে এক ধরনের ‘মাইন্ডসেট’ তৈরি হয়েছিল। হিন্দু ও ভারত বিরোধিতা ছিল যার বহিঃপ্রকাশ। সেখানে পরিবর্তন আনার জন্য যে ধরনের উদ্যোগ-প্রচেষ্টা রাজনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে গ্রহণ করা দরকার ছিল সেটা সরকারি-বেসরকারি কোনো পর্যায়েই করা হয়নি। দেশের সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী যখন ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির বিরোধিতা করেছে তখন বরং ধর্মের পক্ষেই অবস্থান নিয়ে নানা যুক্তি উপস্থাপনের চেষ্টা হয়েছে। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা করার যে সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, দূরদর্শী পরিকল্পনা এবং দৃঢ় রাজনৈতিক অবস্থানের অভাবে তা কার্যকর হয়নি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে রাজনীতির গতিমুখ পরিবর্তন করা না হলে দেশে উগ্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জয়যাত্রা শুরু হতো না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চরিত্র আমূল পরিবর্তন করে একটি তালেবানি রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্র এগিয়ে যেতে পারতো না। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা যদি স্বাধীনতা অর্জন করতে ব্যর্থ হতাম তাহলে আমাদের আজও পাকিস্তানের সঙ্গেই থাকতে হতো সেই পাঞ্জাবি সামরিক শাসকদের দ্বারা শোষণ-বঞ্চনা-অত্যাচার-নিপীড়নের মধ্যে। আর পাকিস্তান রাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থা কি তা-ও আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছি। পাকিস্তান এখন একটি ল-ভ- দেশ। ধর্মের নাম করে মসজিদের ঢুকে নামাজরত মুসল্লিদেরও হত্যা করছে জঙ্গিরা। মানুষের জীবন সেখানে নিরাপদ নয়। ধর্মভিত্তিক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি যে কোনো রাষ্ট্রের জন্য একেবারেই কল্যাণকর হতে পারে না, পাকিস্তান তার বড় উদাহরণ।
অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বার বার বাংলাদেশের উন্নয়নের গতি দেশি-বিদেশি অপশক্তি রোধ করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু বাঙালির লড়াকু মনোভাবের কারণে তারা তা পারেনি। বাঙালি ঐক্যবদ্ধ থাকলে কেউ কোনোদিনই বাঙালির অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে পারবে না। সামনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, এই নির্বাচনকে ঘিরে আওয়ামী লীগের পরিত্যক্ত নেতাকর্মী ও দেশবিরোধী শক্তি যত কথাই বলুক না কেন, যত জোট-ফ্রন্ট তৈরি করুক না কেন, এই নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনালালনকারী দল আওয়ামী লীগকে এককভাবে বিজয়ী করে বাংলাদেশের অগ্রগতির ধারা অটুট রাখতে আজ আমাদের সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
১০ নভেম্বর, ২০১৮
আওয়ামী লীগকে কেন ভোট দিতে হবে
মোনায়েম সরকার
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এ বছরের শেষে অনুষ্ঠিত হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে নানান রকম হিসাব-নিকাশ। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে জোট করে ভোট করার প্রবণতা বাংলাদেশেও চালু হয়েছে। সমমনা দলের সঙ্গে জোট গঠন খারাপ কিছু নয়, নির্বাচনী কৌশল হিসেবে এটাকে বাঁকা চোখেও দেখার কিছু নেই। গণতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন মেনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা এটা ব্যক্তি বা দলের নাগরিক অধিকার।
সরকার গঠন ও সরকার পরিবর্তনে ভোটের গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা যদি সবাই নিজেদের বুদ্ধি-বিবেচনা খাটিয়ে সৎ-যোগ্য ও দেশপ্রেমিক জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করি, উন্নয়নমুখী রাজনৈতিক দলকে দেশ-পরিচালনার দায়িত্ব দিই, তাহলে দেশ সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যায়। এর অন্যথা হলেই দেশে দেখা দেয়া রাজনৈতিক সংকট জনজীবনে নেমে আসে দুর্ভোগ ও দুর্দশা। এ কথার প্রমাণ বিগত দিনের সামরিক সরকার (জিয়া-এরশাদ সরকার) প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদ শাসন (বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার) ও সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনকাল উল্লেখ করা যেতে পারে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে আমরা দেশের স্বাধীনতা পেয়েছি। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর দেশে যে অগণতান্ত্রিক শাসনের ধারা সূচিত হয়, তার অবসান ঘটানোর জন্য, জনগণের ভোটের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশের গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল শক্তিকে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম করতে হয়েছে। বাঙালিশ্রেষ্ঠ বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হলেও আওয়ামী লীগ শাসনক্ষমতায় থাকার সুযোগ পেয়েছে খুব কম সময়ই। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মাত্র সাড়ে তিন বছর ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। ওই সময় যুদ্ধ-বিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশ পুনর্গঠনের জটিল কাজটি অত্যন্ত সফলভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিল। সে অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে রাজনীতির গতিমুখ পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছিল। তারপর দীর্ঘ ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সুযোগ পায়। সেবার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও সাহসী কাজ করেছিল। বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচার কাজ শুরু করে বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছিল। এ ছাড়াও পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর, গঙ্গার পানিবন্টন চুক্তিসহ দীর্ঘদিনের জিইয়ে থাকা বেশ কিছু সমস্যা সমাধানের যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তারপরও ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পুনরায় নির্বাচিত হতে পারেনি। তুলনামূলকভাবে ভালো শাসন উপহার দিয়েও সেবার নির্বাচনে জয়ী না হওয়া অপ্রত্যাশিতই ছিল। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের অপশাসন-কুশাসনে অতিষ্ট দেশবাসী পরের নির্বাচনে আবার সঠিক রায় দিতে ভুল করেনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ার সুযোগ পায়। দেশ গড়ার কাজে মন দেয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। ধীরে ধীরে দেশ এগিয়ে যেতে থাকে। এক দশকেই উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে সারা বিশ্বে স্বীকৃতি পায় বাংলাদেশ।
২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোটের সেই বিভীষিকাময় শাসনামলের কথা চিন্তা করলে সত্যিই শরীরে শিউরে ওঠে! বিএনপি-জামায়াতকে সঙ্গে নিয়েই ‘সোনার বাংলা’ ধ্বংসের মিশনে নেমেছিল। ক্ষমতা হারানোর পরও জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধই আছে বিএনপি। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষ নেতার দ- হওয়ায় দেশের ভেতর জামায়াত-শিবির যে তা-ব চালায়, সেই নারকীয় তা-বের সঙ্গে কেবল একাত্তরের দুঃসময়েরই তুলনা করা চলে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির কাছ থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পাওয়া যায়নি। বরং জামায়াতের রাজনীতি ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার অবস্থান অত্যন্ত পীড়াদায়ক।
রাজাকার-আল-বদর ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে অনেকের মুখে অনেক রকম সমালোচনা শোনা যায়। বলা হয়, এটা নাকি মতলবের বিচার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে ব্যবসা ইত্যাদি। এসব কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলা কথা এটাই যে, গত ৪৭ বছরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দল কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কি? ৪৭ বছরের অধিকাংশ সময় যারা বাংলাদেশের ক্ষমতায় থেকেছে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কোনো উদ্যোগ নেয়নি কেন? কারণ একটাই। আওয়ামী লীগই একমাত্র দল যে কিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে। সেই জন্যই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নানা প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে এতদিন পর ক্ষমতায় এসে একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে এবং তাদের শাস্তি কার্যকর করে ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি রয়েছি, যারা মনে করি বাংলাদেশের জন্ম না হলে আমরা আজকের এই অবস্থায় পৌঁছাতে পারতাম না। তারা নৌকা ছাড়া আর কোন প্রতীকে ভোট দেব? আওয়ামী লীগ ছাড়া কাকে দেব দেশ শাসনের ভার? যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলাদেশের মানুষের জীবনে নিঃসন্দেহে একটি শ্রেষ্ঠ ঘটনা। শ্রেষ্ঠ পাওয়া।
’৭৫-পরবর্তী প্রজন্মকে ভুল ইতিহাস শিক্ষা দিয়ে পাকিস্তানি ভাবধারায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। নতুন প্রজন্মকে বোঝানো হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যা ঘটেছিল তা সব সত্য নয়। এমনকি আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে মনগড়া ইতিহাস রচনা করে এ যুগের নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার হীন প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। আর এটা সম্ভব হয়েছে দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে ছিল বলে। নির্বাচনকে সামনে রেখে এখনই কেউ কেউ আমাদের অতীত ভুলে সামনে তাকাতে বলছেন। বলছেন, নতুন ধারার রাজনীতির কথা ভাবতে। কিন্তু আমরা কি করে ভুলব মুক্তিযুদ্ধের কথা, কীভাবে ভুলব ত্রিশ লক্ষ শহীদের কথা? কি করে ভুলব রাজাকার-আলবদরদের নৃশংসার কথা, জাতির শ্রেষ্ঠসম্পদ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা। আমাদের পক্ষে বিএনপি-জামায়াতের অপশাসন ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর পাকিস্তানি স্টাইলে সংখ্যালঘুদের উপর জুলুম-নির্যাতন, তাদেরকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইউনুস, আওয়ামী লীগ নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টার, মঞ্জুরুল ইমাম, সাবেক অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শাহ এ এম এস কিবরিয়া, চট্টগ্রামের গোপাল কৃষ্ণ মুহুরিকে নির্মমভাবে হত্যা এবং প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদের উপর হামলা ঘটনা কি ভুলে যাওয়া যায়? বানিয়ার চর গির্জায় হামলা, যশোরের উদীচীর অনুষ্ঠান, ময়মনসিংহের সিনেমা হল, সিপিবির জনসভা, পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলের অনুষ্ঠানসহ ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বোমা-গ্রেনেড হামলা করে আমাদের প্রিয় স্বদেশকে এক অন্ধকার মৃত্যু-উপত্যকা বানানোর স্মৃতি কী এত সহজেই ভোলা যায়?
২০০১-এ ক্ষমতায় এসেই বিএনপি-জামায়াত তিন মাসে পাঁচশ’র কাছাকাছি মন্দির ধ্বংস করে। শ’য়ে শ’য়ে নারীকে ধর্ষণ করে, জেএমবি, হরকাতুল জিহাদের মতো জঙ্গি দলের উত্থান ঘটায়, এক যোগে বোমা হামলা চালায় ৬৩টি জেলায়। বাংলার মানুষ ইচ্ছে করলেও সেই ভয়াবহ দুঃসময়ের স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলতে পারবে না। ভুলে যেতে পারবে না হাওয়া ভবন, খোয়াব ভবনের লুটেরা তথা তারেক-কোকো-মামুনের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের ঘটনা। এদেশের মানুষ বিএনপির শাসনামলে জঙ্গি সংগঠন জেএমবি’র পৃষ্ঠপোষক এসপি মাসুদ মিয়া ও বাংলা ভাইয়ের তা-ব বিস্মৃত হয়নি। ভুলে যায়নি এসপি কোহিনূরের আইনবহির্ভূত আচরণের কথাÑ যে কিনা রাজপথে জাতীয় নেতাদের পিটিয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল।
বাংলাদেশ এক সময় ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে বিশ্বে পরিচিত ছিল। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে পাঁচ-পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে ব্যর্থ রাষ্ট্রের খ্যাতি পেয়েছিল। জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে দুর্বার বেগে এগিয়ে যাচ্ছে। কৃষিতে, যোগাযোগ ব্যবস্থাপনায়, শিল্পে, শিক্ষায়, তথ্য-প্রযুক্তিতে, নারীর ক্ষমতায়নে, রক্তাক্ত সবুজ পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায়, আইনের শাসন বাস্তবায়নে, মানবতা-বিরোধী অপরাধীদের বিচার ও জঙ্গি দমনে বিশ্বের দরবারে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। বিগত এক দশকে সারাদেশে নজিরবিহীন যে উন্নয়নমূলক কর্মকা- হয়েছে তা কেবল খাতা-কলমের উন্নয়ন নয়, বাস্তবেও তা দৃশ্যমান।
ষোলো কোটি মানুষের এই ছোট্ট দেশে উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা দিতে যে জাদুর কাঠির প্রয়োজন তা কেবল আওয়ামী লীগের হাতেই আছে। তাই চলমান উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে আওয়ামী
লীগকেই আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনা দ্বিধায় বিজয়ী করতে হবে। তাই আসুন, সকল রকম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, মান-অভিমান পরিহার করে ’৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনের মতো জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান তুলে আগামী নির্বাচনে নিজে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ তথা নৌকা মার্কায় ভোট দিই এবং অন্যকেও একই সিদ্ধান্ত নিতে অনুপ্রাণিত করি।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
০১ নভেম্বর, ২০১৮
ঐতিহাসিক রায়ে স্পষ্ট হলো বিএনপি একটি সন্ত্রাসী দল
মোনায়েম সরকার
কয়েকদিন আগে আমি একটি কলাম লিখেছিলাম ‘নিজেকে প্রশ্ন করুন কোন পক্ষে যাবেন’Ñ শিরোনামে। যেখানে আমি নানা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেছিলাম জন্মলগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত বিএনপি কিভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। আমার সে লেখায় এটাও বলার চেষ্টা করেছিলাম যে, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার মাটিতে বিএনপি নামক ঘাতক দলের রাজনীতি করার কোনো অধিকার থাকতে পারে না। যে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়া ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পেছনে কলকাঠি নেড়েছে এবং কারা প্রকোষ্ঠে জাতীয় চার নেতাÑ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান এবং এম. মনসুর আলীকে হত্যা করেছে, যে বিএনপি ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে নৃশংস গ্রেনেড হামলায় প্রত্যক্ষ মদদ জুগিয়েছে, সেই বিএনপির আসলেই কি কোনো অধিকার থাকতে পারে বাংলাদেশে রাজনীতি করার? জন্মলগ্ন থেকেই বিএনপি বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় নিয়ে যাওয়ার জন্য নানামুখী চক্রান্ত করে যাচ্ছে। পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে মৌলবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে। জিয়াউর রহমান দল গঠন করে দেশদ্রোহী-রাজাকারদের বাংলাদেশে পুনর্বাসিত করেছিলেন, তার স্ত্রী খালেদা জিয়া ও পুত্র তারেক রহমান জিয়া নির্দেশিত পথেই এগিয়ে গেছেন।
জিয়া পরিবারের জন্য বঙ্গবন্ধু অনেক কিছুই করেছেন। খালেদা জিয়াকে বঙ্গবন্ধু আপন কন্যার মতোই ¯েœহ করতেন। খালেদা জিয়ার ভাঙ্গা সংসার বঙ্গবন্ধুই জোড়া লাগিয়ে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এত আদর-¯েœহের মূল্য জিয়া দিয়েছেন ‘বুলেট’ দিয়ে, আর তার স্ত্রী-পুত্র দিয়েছেন ‘গ্রেনেড’ দিয়ে। মানুষ একটা অকৃতজ্ঞ হতে পারে, ক্ষমতা ও স্বার্থের জন্য কতটা নিচে নামতে পারে, জিয়া পরিবারকে না দেখলে বাংলাদেশের মানুষ কিছুতেই তা বুঝতে পারতেন না।
কথায় বলেÑ ‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’। আসলেই ধর্মের কল বাতাসে নড়েছে। ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির রায়ের কল নড়েছিল ২৩ বছর ২ মাস পরে আর ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষিত হয় ১৪ বছর ২ মাস ১৯ দিনের মাথায়। দীর্ঘ সময় পরে হলেও আদালতের রায়ে সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মুখোশ খুলে গেছে ষড়যন্ত্রকারীদের। আজ শুধু বাংলাদেশের মানুষই নয়, পৃথিবীর নানান দেশের মানুষই বুঝতে পারছে বিএনপি স্বচ্ছ রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয়, বিএনপির বিশ্বাস হত্যা ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে, বিএনপি একটি সন্ত্রাসী দল, তাই জামায়াত তাদের বন্ধু।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সন্ত্রাসবিরোধী শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বিকেল ৫.৪০ মিনিটে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে নারকীয় গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। সেই হামলায় ঘটনাস্থলেই মারা যান আওয়ামী লীগের ২৪ জন নিরপরাধ নেতাকর্মী। এর মধ্যে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানও আছেন। আহত হন পাঁচশ’র অধিক নেতাকর্মী। বাংলাদেশের ইতিহাসে দিবালোকে এমন নৃশংস ঘটনার আর কোনো নজির নেই। সবশেষে শেখ হাসিনাকে বহন করা গাড়িতেও কয়েকটি গুলি করেছিল তাকে হত্যার জন্য। সেদিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। মূলত শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে এই হামলা চালানো হলেও, এর পেছনে ছিল আরও গভীর চক্রান্ত। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বাংলাদেশকে মৌলবাদীদের অভয়ারণ্য বানাতে চেয়েছিল, বিপথে নিয়ে যেতে চেয়েছিল ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তমূল্যে কেনা সমস্ত অর্জন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চায়নি বিএনপি ও তার দোসররা। এই হামলাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য সমস্ত আলামত নষ্ট করা হয়। আওয়ামী লীগের উপর দোষ চাপানো হয়, সাজানো হয় জজ মিয়া নাটক। নোয়াখালীর সেনবাগের শ্রমজীবী যুবক মোহাম্মদ জামাল উদ্দীন ওরফে জজ মিয়া নিরপরাধ হওয়া সত্ত্বেও তাকে ৪ বছর ২৬ দিন জেলখানায় কাটাতে হয়। রিমান্ডে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন করা হয় জজ মিয়ার উপর। ক্রসফায়ারের হুমকি ও জজ মিয়ার পরিবারকে টাকা দেওয়ার শর্তে শেখানো জবানবন্দি রেকর্ড করা হয় জজ মিয়ার। তবু শেষ রক্ষা হয় না। একে একে বের হতে থাকে আসল ঘটনা। তারপর অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১০ অক্টোবর, ২০১৮ সালে ঘোষিত হয় আদালতের রায়। ৪৯ জন আসামির মধ্যে ১৯ জন মৃত্যুদ-ে দ-িত হয়, যাবজ্জীবন সাজা হয় ১৯ জনের, বাকি এগারো জন পায় বিভিন্ন মেয়াদের দ-।
আদালতের রায় ঘোষিত হওয়ার পরে নানাজন নানাভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ছাড়াও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ভুক্তভোগী ও সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গ। এখানে আমি রায়ের প্রতিক্রিয়া নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না, আমি শুধু বলতে চাইÑ এই ঐতিহাসিক রায়ে একটি জিনিস স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সেটা হলোÑ বিএনপি একটি সন্ত্রাসী ও ঘাতক দল। হত্যা, খুন, লুটপাট ও জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতা দান করাই বিএনপির মূল লক্ষ্য। এরা চায় না বাংলাদেশ সুখে-শান্তিতে থাকুক, নিরাপদে বসবাস করুক বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ। এরা ষড়যন্ত্র করে কিংবা মৌলবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সহায়তা যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় তখন দেশে দুর্নীতি বেড়ে যায়, বোমাবাজি বেড়ে যায়, রাষ্ট্র খেতাব পায় অকার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে। বিএনপি স্পষ্টত রাষ্ট্র চালনায় ব্যর্থ এবং রাজনৈতিক কর্মকা-ের আড়ালে এরা গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এরা মুখোশ পরে থাকে, কিন্তু মুখোশের আড়ালে এদের যে মুখটা আছে সেটা খুবই ভয়ঙ্কর।
একটি রাজনৈতিক দলের চেয়ারপার্সন দুর্নীতির মামলায় দ-িত হয়ে জেলবন্দী, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন পূর্বে দশ বছর সাজাপ্রাপ্ত বর্তমানে হত্যা চেষ্টার দায়ে যাবজ্জীবনের সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি। এদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনীতি কোনো দিনই সুস্থ ধারায় প্রবাহিত হবে না। আজ সময় এসেছে এদের প্রত্যাখ্যান করার। বাংলাদেশের জনগণ যত তাড়াতাড়ি বিএনপি ও তার জোটভুক্ত দলগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে ততই তা বাংলাদেশের জন্য মঙ্গল। বিএনপি পদে পদে ব্যর্থতা, অযোগ্যতা ও নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছে। যারা নৃশংস, সন্ত্রাসী, ব্যর্থ এবং অযোগ্য তাদের হাতে দেশ ও দেশের মানুষ কিছুতেই নিরাপদ থাকতে পারে না।
আমি প্রথমেই বলেছিলাম আমার পূর্ববর্তী একটি নিবন্ধের কথাÑ ‘নিজেকে প্রশ্ন করুন কোন্ পক্ষে যাবেন।’ আজ আবার এই প্রশ্ন উত্থাপন করে বলতে চাইÑ বাংলাদেশের মানুষ কোন্ পক্ষে যেতে চায়? তারা কি হত্যায় বিশ্বাসী, মৌলবাদে উস্কানিদাতা, দুর্নীতিবাজ বিএনপির সঙ্গে যাবে? বিএনপি পন্থী বুদ্ধিজীবী, দল এবং যারা জোট করতে চান তাদেরও নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। নাকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও উন্নয়নে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের পক্ষে থাকবে? বাংলাদেশের মানুষ খুবই আবেগপ্রবণ, তাদের মনও অত্যন্ত কোমল। বাঙালি আবেগপ্রবণ আর কোমল মনের বলে অনেক সহজেই এরা ক্ষমাশীল। ক্ষমা মহৎ গুণ বটে। তবে ঘাতককে, দেশদ্রোহীকে ক্ষমা করার কোনো মানে নেই। এদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে বয়কট করে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। এ জন্য যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি তাদের হাত শক্তিশালী করতে হবে। নির্দ্বিধায় গণরায় দিতে হবে দেশপ্রেমিক, উন্নয়নমুখী, পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক দলকে। বিগত দশ বছরে বাংলাদেশ অনেক দূরে এগিয়ে গেছে, বিদেশেও মর্যাদা বাড়ছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বিএনপি নয়Ñ আওয়ামী লীগই এখন আমাদের একমাত্র ভরসা।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
১৩ অক্টোবর, ২০১৮
দৃষ্টি আকর্ষণ : মহত্মা গান্ধীর জন্মদিন উপলক্ষে [২ অক্টোবর,২০১৮]
মহাত্মা গান্ধী : শান্তিকামী মানুষের পথপ্রদর্শক
মোনায়েম সরকার
পৃথিবী ক্রমে ক্রমেই অশান্ত হয়ে উঠছে। মানুষের মানবিক মূল্যবোধ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, পশুত্ব প্রদর্শনেই আজ যেন সবাই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবী এমন নিষ্ঠুর হৃদয়হীন হওয়ার কথা ছিল না, এই শতাব্দীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে উল্লম্ফন হয়েছে, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমাদের সকলেরই মানবকল্যাণে আত্মনিয়োগ করার কথা ছিল, কিন্তু আমরা কল্যাণের পথ পরিহার করে হিংসার পথ, যুদ্ধের পথ বেছে নিয়েছি। মানুষের রক্তে, মানুষের চোখের জলে পৃথিবীর মাটি ভিজিয়ে দিচ্ছি। বিদ্বেষ বিষ ভুলে গিয়ে আজ আমাদের শান্তিসঙ্গীত রচনা করতে হবে। মানুষের কাছে ফিরে যেতে হবে ভালোবাসার, শান্তির, কল্যাণের অঙ্গীকার নিয়ে। এ ক্ষেত্রে আমরা অহিংস আন্দোলনের নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে পথপ্রদর্শক মানতে পারি। অনুসরণ করতে পারি তার মহিমান্বিত, শান্তিবাদী, সহজ-জীবন। শান্তির স্বপক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেনÑ তা শুধু ভারতবর্ষে নয়, সমগ্র পৃথিবীতেই দুর্লভ। এই দুর্লভ পুণ্যাত্মাকেই আজ আমাদের নত মস্তকে মেনে নিতে হবে, গান্ধীর শিক্ষা ছাড়া পৃথিবীব্যাপী প্রজ্জ্বলিত অশান্তির আগুন নেভানো আজ অনেকটাই সম্ভব।
যার কাছ থেকে মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কে আমি প্রথম জানতে পারি তিনি হলেন কুমিল্লার গর্বিত সন্তান ভাষাসংগ্রামী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। আমি তখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। কুমিল্লার ইউসুফ স্কুলে লেখাপড়া করি। থাকি ধর্মসাগরের কাছে। ওখানেই পরিচয় হয় দেশবরেণ্য রাজনীতিক ও ভাষাসংগ্রামী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে। তিনি সকালবেলা প্রাতঃভ্রমণ করতেন। একদিন সকালে আমি তার প্রাতঃভ্রমণের সঙ্গী হই। তিনি আমাকে প্রাতঃভ্রমণ শেষে তার বাড়ি নিয়ে যান। ইংরেজিতে লেখা একটি বই শিরোনাম সম্ভবত Tagore’s Letter’s to Mahatma Gandhi তিনি আমাকে পড়তে দেন। আমার মতো বালকের পক্ষে সেই বই পড়ে তাকে শোনানো কঠিন হলেও আমি সাধ্যমতো বইটি পড়তে চেষ্টা করি। আমার পাঠ শুনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত খুশি হন। তিনি বইটি বাসায় নিয়ে পড়ার অনুমতি দিয়ে আমার মাঝে পাঠ্যাভাস গড়ে তুলতে প্রথম প্রেরণাদাতা হিসেবে কাজ করেন। এটা অবশ্য ১৯৫৬ সালের কথা। সবকিছু যে এতদিন পর আমার হুবহু মনে আছে বিষয়টি এমন নয়, তবে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের কাছ থেকে আমি প্রথম মহাত্মা গান্ধীর নাম শুনেছিলাম এবং বিস্মিত হয়েছিলামÑ ভারতবর্ষের একজন হালকা-পাতলা-ধুতিপরা মানুষ কিভাবে সম্মানের শীর্ষ আসন দখল করেছিলেন? কিভাবে তিনি সত্যাগ্রহ ও অহিংসনীতি দ্বারা নিপীড়িত ভারতবাসীকে জাগিয়ে তুলে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে অবিস্মরণীয় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন? পৃথিবীর যেখানেই নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের কান্না শুনেছেন, সেখানেই ছুটে গেছেন গান্ধীজি। যেখানেই বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা রক্তপিপাসু রূপ নিয়েছে, সেখানেই তিনি প্রসারিত করেছেন শান্তির বাহু। কি আফ্রিকা, কি কলকাতা, নোয়াখালি, বিহারÑ সর্বত্রই তিনি শান্তির পথ-প্রদর্শক।
মহাত্মা গান্ধীর আসল নাম মোহনদাস করমদাঁদ গান্ধী। তিনি ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর ব্রিটিশ ভারতের গুজরাটে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা করমচাঁদ গান্ধী ছিলেন পোরবন্দরের দেওয়ান। মহাত্মা গান্ধীর মা পুতলিবা-করমচাঁদের চতুর্থ স্ত্রী ছিলেন। পুতলিবা পরম ধার্মিক মহিলা ছিলেন। মায়ের আদর্শ এবং গুজরাটের জৈন প্রভাবিত পরিবেশ থেকে গান্ধী তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষা লাভ করেন। সর্বজীবে দয়া, অহিংসা, নিরামিষ ভোজন, আত্মশুদ্ধির জন্য উপবাস, সর্বোপরি অসাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গী মহাত্মা গান্ধী শৈশবেই আত্মস্থ করেছিলেন। ছাত্র হিসেবে মহাত্মা খুব মেধাবী না হলেও ১৮ বছর বয়সে তিনি ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন ভর্তি হন। বিলেতে পড়তে পাওয়ার পাঁচ বছর পূর্বেই তিনি পারিবারিক সিদ্ধান্তে বাবা-মায়ের মনোনীত পাত্রী ১৪ বছর বয়স্কা কুস্তুরবা মাখাঞ্জীকে বিয়ে করেন। গান্ধী যখন দাম্পত্য-জীবন শুরু করেন তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর।
মহাত্মা গান্ধীর জীবনী যারা মনোযোগ দিয়ে পাঠ করেছেন তারা নিশ্চয়ই জানেন, একরাশ অনুপম গুণের অধিকারী ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। তিনি যখন ইংল্যান্ড গমন করেন ব্যারিস্টারি পড়তে, তখন তার মা পুতলিবা এক জৈন সন্ন্যাসীর মাধ্যমে তাকে কয়েকটি প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন। এগুলোর মধ্যে ছিলÑ মদ ও মাংস না খাওয়া এবং নারী সংসর্গ থেকে বিরত থাকা। মহাত্মা গান্ধী যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন এ কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। কৃচ্ছ্রসাধনার প্রতি গান্ধী ভীষণ অনুরাগী ছিলেন। যতটুকু না হলেই নয়Ñ তিনি কেবল ততটুকু নিয়েই জীবনধারণ করার অভ্যাস গড়ে তুলেছিলেন। এজন্যই তার পক্ষে স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও ৩৬ বছর বয়সে ব্রহ্মচর্য করা সম্ভব হয়েছিলো, সম্ভব হয়েছিল লবণ কর আন্দোলনের ২৪১ কিলোমিটার লম্বা লং মার্চ পরিচালনা করা। ভারতের স্বাধীনতা ও ভারতবাসীর মুক্তির জন্য মহাত্মা গান্ধী জীবনভর সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি চরকা কেটে ভারতের স্বরাজ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বিদেশি পণ্য বর্জন করে কেন তিনি চরকা কেটে স্বরাজ আন্দোলন শুরু করেছিলেনÑ তার ব্যাখ্যাও উপস্থাপন করেছিলেন মহাত্মাজি। রক্তপাতে কখনো বিশ্বাস ছিল না মহাত্মার। বিদ্বেষ বা হানাহানিতেও বরাবর তার অনাস্থা ছিল। ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে ইংরেজ কর্তৃক তিনি বর্ণবাদের শিকার হযেছিলেন। ফার্স্ট ক্লাসে ট্রেন ভ্রমণ করার জন্য এক ইংরেজ তাকে ট্রেন থেকে ছুড়ে ফেলেদিয়েছিল, তবু তিনি কখনো ইংরেজদের প্রতি সশস্ত্র-সংগ্রামে আগ্রহবোধ করেননি। প্রতিশোধ নিতে চাননি শক্তি প্রদর্শন করে। শোষক ও বর্ণবাদী ইংরেজদের প্রতি মহাত্মার মনোভাব কখনোই নমনীয় ছিল না, কিন্তু মানবতাবোধের কারণে ইংরেজকে আক্রমণ করতেও অন্তরে তিনি বেদনা অনুভব করতেন।
মহাত্মা গান্ধীর জীবন ছিল একেবারেই সাদামাটা। আহারে-বিহারেই শুধু নয়Ñ পোশাকেও তিনি খুবই সাধারণ ছিলেন। ব্যারিস্টারি পড়ার সময় পুরোদস্তুর সাহেবি পোশাক পরিধান করলেও ভারতে এসে মহাত্মা ‘লেংটি আর চাদর’ ধরেছিলেন। তার অর্ধনগ্ন পোশাক নিয়ে পৃথিবীর অনেক বড় বড় মানুষই টিটকারি কেটেছেন। এদের মধ্যে প্রেসিডেন্ট চার্টিলের নাম বলতেই হয়। চার্চিল বিশ্বাসই করতে পারেন নাই অর্ধনগ্ন এই ফকিরই (Naked Fakir of India) ভারতবাসীর স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ইউরোপীয় সভ্যতার অনেক ভুল মহাত্মা গান্ধী নিজের কর্ম ও জীবন দিয়ে নির্দেশ করে গেছেন। মহাত্মাজি জানতেন বিলাসী জীবনযাপন মানুষকে কখনোই সুখী করতে পারে না। মানুষ মহৎ হয় তার কর্মে ও সৃজনী প্রতিভায়। কর্মগুণে যে নমস্য নয়, শ্রদ্ধাস্পদ নয়, তাকে ভয় করার কোনো মানেই থাকতে পারে না। অসাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি এবং নিখাদ মানবপ্রেম মহাত্মা গান্ধীর চরিত্রভূষণ ছিল। তবুও এই মানুষটিকে আফ্রিকা ও ভারত মিলিয়ে মোট ১৩ বার কারাবরণ করতে হয়েছে। তার সবচেয়ে বড় সাজা হয়েছিল ১৯২২ সালে। একটি পত্রিকায় ব্রিটিশবিরোধী জালাময়ী আর্টিকেল লেখার কারণে তার ৬ বছর কারাদ- হয়। যদিও শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাকে দুই বছর পরেই মুক্তি দেওয়া হয়।
মহাত্মা গান্ধী জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই মহাত্মা হননি। এজন্য তাকে নিরন্তর সাধনা করতে হয়েছে। সেই সাধনায় কোনো ফাঁক ছিল না, লোক দেখানোর কোনো হীনমানসিকতাও ছিল না। যদিও অগ্রজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনুজ গান্ধীর সকল কাজ সমর্থন করেননি, তবু তিনিই তাকে ভালোবেসে দিয়েছিলেন ‘মহাত্মা’ উপাধি। মহাত্মাও রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। মহাত্মাজি শুধু ভারত বর্ষেরই প্রিয় মহাত্মা নন, আজ তিনি সমগ্র বিশ্বে নিজগুণে সম্মানিত ও সমাদৃত। অনেকেই মনে করতে পারেন, গান্ধীর অহিংস-নীতি এমন কী কঠিন কাজ। এটা তো সকলেই পারে। আসলেই কি সকলের পক্ষে সম্ভব অহিংস হয়ে ওঠা? একবার সাবারকর নামের এক ডাক্তার গান্ধীর সঙ্গে তার হিংসা-অহিংসা নীতি নিয়ে তর্ক শুরু করলেন। সারারকর বলেন, ‘গান্ধী, মনে করুন একটা বিরাট বিষধর সাপ আপনার দিকে তেড়ে আসছে। আর আপনার হাতে আছে একগাছা লাঠি। আপনি কী করবেন? মারবেন না মরবেন? গান্ধী উত্তর দেন, ‘লাঠিখানা আমি ছুড়ে ফেলে দেব। পাছে ওকে মারবার প্রলোভন জাগে।’ এই হলো মহাত্মার অহিংসাদর্শন, জীবন সংকটাপন্ন জেনেও যিনি আদর্শে অটল থাকতে পারেন তিনিই তো সত্যিকারের আদর্শবান মানুষ।
শুরুতেই বলেছিলাম মানুষের উন্মত্ততার কথা, রক্তের আর সীমাহীন অশ্রুপাতের কথা। আজকের দিনে মানবসৃষ্ট মৃত্যুর হাত থেকে মানুষকে বাঁচানোই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে মানুষকে আজ যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য পৃথিবীর সব মানুষকে শান্তির স্বপক্ষে এক কাতারে দাঁড়াতে হবে। মানুষকে আজ স্বেচ্ছায় প্রতিজ্ঞা করতে হবে, কোনো দেশ অন্য কোনো দেশকে আর শোষণ করতে পারবে না, পারবে না গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র উৎপাদন করতে। যেসব দেশের হাতে মারণাস্ত্র আছে সেসব দেশকে বাধ্য করা হবে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র ধ্বংস করার জন্য। মানুষের সদিচ্ছা আর শান্তিমুখী প্রচেষ্টাই পারে পৃথিবীকে শান্তির স্বর্গে রূপান্তর করতে। সমগ্র পৃথিবী আজ একটি মানবিক বিশ্বব্যবস্থা প্রত্যাশা করছে। এই মানবিক পৃথিবী গড়তে হলে মার্টিন লুথার কিং, নেলসন ম্যান্ডেলা, আব্রাহাম লিংকন, কিংবা মহাত্মা গান্ধীর কাছেই আমাদের ফিরে যেতে হবে। অনুসরণ করতে হবে এদের মহান জীবনাদর্শ ও কর্ম। কেননা মানবিক পৃথিবী কেবল মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষের পক্ষেই গড়ে তোলা সম্ভব। মহাত্মা গান্ধীর সার্ধশত জন্মবার্ষিকীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েও মনে হয় বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় গান্ধিজির নীতি ও আদর্শ প্রাসঙ্গিক। শুভ জন্মদিনÑ শান্তিকামী মহাত্মাজি।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮
ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে কেন?
মোনায়েম সরকার
সম্প্রতি লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘ওয়েলথ এক্স’ একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে অতি ধনীর সংখ্যা সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে বাংলাদেশে। ‘ওয়েলথ এক্স’-এর রিপোর্টে তাদেরকেই অতি ধনী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে যাদের সম্পদের পরিমাণ তিন কোটি ডলার বা তারচেয়ে বেশি। অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় যাদের সম্পদ আড়াইশ কোটি টাকার বেশি, তারাই ‘অতি ধনী’ বলে গণ্য হবেন। অতি ধনী মানুষের দেশ বলে যে দশটি দেশ তালিকার শীর্ষে আছে তার মধ্যে বাংলাদেশ নেই। কিন্তু বাংলাদেশ সংবাদের শিরোনাম হয়েছে এ কারণে যে, বাংলাদেশে অতি ধনীর সংখ্যা পৃথিবীর মধ্যে দ্রুত হারে (১৭.৩ শতাংশ) বাড়ছে।
অতি ধনী মূলত কারা হচ্ছেÑ এমন প্রশ্ন উত্থাপিত হলে দেখা যাবে যারা ক্ষমতার খুব কাছাকাছি আছে তারাই দ্রুত ধনী হচ্ছে। ক্ষমতাইÑ ‘অর্থ’। তাই সবাই অর্থের লোভে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে চায়। আগে যারা রাজনীতি করতেন তাদের মধ্যে অর্থের লালসা খুব একটা ছিল না, কিন্তু পৃথিবীর সবদেশেই আজ ব্যবসায়ী রাজনীতিকের ভিড়। ব্যবসায়ীরা ব্যবসার চেয়ে আজ রাজনীতি বেশি পছন্দ করেন। কেন একজন শিল্পপতি বা ব্যবসায়ী তার ব্যবসায় মনোযোগ না গিয়ে রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকেনÑ তা একটু খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, এর পেছনে রয়েছে টাকা কামানোর গোপন অভিলাষ।
রাজনীতি হলো একটি দেশের চালিকাশক্তি। একটি দেশকে নির্মাণ করা এবং সেই দেশের মানুষকে সার্বিক নিরাপত্তা দেওয়া রাজনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য। বর্তমান বিশ্বে কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা বা তত্ত্ব রাজনীতিকে আরো বেশি সংবেদনশীল ও দায়িত্ববান করে তুলেছে। কল্যাণ রাষ্ট্রে নাগরিকের অধিকার পূরণ করা রাষ্ট্রের অপরিহার্য কর্তব্য। এই কর্তব্যকে কিছুতেই রাষ্ট্র অস্বীকার করতে পারে না। তাই আধুনিক রাষ্ট্র ও রাজনীতি দুটোই এখন আমজনতার সেবা দিতে বাধ্য। কেননা জনতা যদি রাষ্ট্র ও রাজনীতি সম্পর্কে অনাস্থা প্রকাশ করে, তাহলে অবস্থা কতটা ভয়াবহ হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
সারা পৃথিবীর মতো আমাদের বাংলাদেশেও রাজনীতিতে বর্তমানে ব্যবসায়ী অনুপ্রবেশ প্রবণতা সাংঘাতিক আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি মনে করি, এটা আমাদের রাজনীতির জন্য অশনিসংকেত। এই অশনিসংকেত বুঝেও যদি আমরা না বোঝার ভান করি, তাহলে আমাদের তৈরি বিপদ আমাদেরকে গ্রাস করবে। বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদের চেয়ে ব্যবসায়ীদের আনাগোনা অনেক বেশি দৃশ্যমান। ব্যবসায়ীরা যেভাবে রাজনীতিতে বেনোজলের মতো ঢুকে পড়ছে তাতে দেশের সৎ, যোগ্য ও মেধাবী রাজনীতিবিদরা তো কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছেই, সঙ্গে সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষও বঞ্চিত হচ্ছে যথার্থ সেবা থেকে। এভাবে চলতে থাকলে রাজনীতি এক সময় মুখ থুবড়ে পড়বে। অরাজকতা সৃষ্টি হবে রাজনীতির অঙ্গনে। যা আমাদের জন্যই মোটেই শুভকর হবে না।
প্লেটো তার ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে আদর্শ রাষ্ট্রের যে চিত্র তুলে ধরেছেন, সেখানে ব্যবসায়ীদের রাজনীতি করার অধিকার রাখেন নি। কারণ তিনি জানতেন, যার যে কাজÑ তাকে সে কাজ করাই উচিত। ব্যবসায়ীরা যেখানে হাত দেন সেখান থেকেই তারা টাকা উপার্জন করার কথা ভাবেন। তারা হাসপাতাল তৈরি করেন টাকার জন্য, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় করেন টাকার জন্য, পত্রিকার মালিকানা বলি আর টিভি চ্যানেলের মালিকানা বলিÑ সবখানেই আছে টাকা বানানোর মনোবৃত্তি। টাকা কামানোর এত এত পথ থাকতে রাজনীতিতে আসার উদ্দেশ্য কিÑ ডিউটি ফ্রি গাড়ি, বিলাস বহুল বাড়ি, কম দামে প্লট, বদলি ও নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিনা পুঁজিতে কাড়ি কাড়ি টাকা কামানোর জন্য? আগে ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে টাকা লগ্নি করতেন কিন্তু সরাসরি রাজনীতি করতেন না, আজকের চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। এখন দলের জন্য টাকা ব্যয় না করে নিজেই নেমে পড়ছেন রাজনীতিতে, এর ফলে বদলে যাচ্ছে রাজনীতির ব্যাকরণ। টাটা বিড়লা, বিল গেটস্, ওয়ারেন বাফেটরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মালিক হয়েও রাজনীতিতে পা রাখেননিÑ ব্যবসার দিকে মনোযোগী হওয়াই তাদের প্রধান কাজ ছিল। ব্যবসাতেই তারা সফলতা পেয়েছিলেন। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদেরও অনুরোধ করবÑ রাজনীতিকে টাকা বানানোর যন্ত্র না বানিয়ে নিজের ব্যবসায় মন দিন। তাতে দেশের অর্থনীতি সবল হবেÑ প্রকৃত রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করার সুযোগ পাবে।
যারা আমাদের প্রবীণ রাজনীতিক বা রাজনৈতিক কর্মী তারা জানেন ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকারে যারা মন্ত্রিসভার সভ্য ছিলেন তারা বেশির ভাগই ছিলেন সার্বক্ষণিক রাজনীতিবিদ, উকিল ও ডাক্তার। যেমনÑ খয়রাত হোসেন, শেখ মুজিবুর রহমান, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, আতাউর রহমান খান, শরৎ চন্দ্র মজুমদার, মাহমুদ আলী, হাসিম উদ্দিন আহমদ, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মনোরঞ্জন ধর, মসিউর রহমান প্রমুখ। অধ্যাপকরাও সে সময়ের রাজনীতিতে বেশ সক্রিয় ছিলেন। অতীত দিনের রাজনীতির অঙ্গনে আমরা সেই মানুষগুলোকেই দেখেছি যারা দেশের জন্য ও দেশের মানুষের জন্য নিবেদিতপ্রাণ নেতা ছিলেন। আজ যারা ব্যবসায়ী নেতাÑ যারা টাকার জোরে রাজনীতির মঞ্চে এসে প্রবেশ করেছেন, তাদের কাছে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা সবকিছুই ভূ-লণ্ঠিত হচ্ছে। টাকাওয়ালা ব্যবসায়ীরা টাকা ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। এরা রাজনীতিকে টাকা কামানোর অন্যতম শক্তিশালী উৎস বলেই মনে করে। বঙ্গবন্ধুর সময়েও এই নষ্ট প্রবণতা আমরা দেখি নাই। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরে জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিকে একেবারে নষ্ট করে দেন। তিনি বলেন- I shall make politics dificult for politicians.. তিনি আরো বলেন, ‘Money is no problem.’ এই যে জিয়ার ‘রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে তোলা’ এবং ‘টাকা কোনো সমস্যা নয়’ বক্তব্য বাংলাদেশের রাজনীতিকে হিংস্র এবং দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলে। আমরা দেখি ওরস্যালাইন পার্টি বিএনপি গঠন করার জন্য জিয়াউর রহমান দেশ রক্ষার মহান কাজে নিয়োজিত সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেন এবং কতিপয় সেনা কর্মকর্তাকে মন্ত্রির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন। তিনি এমন এমন ব্যক্তিকে রাজনীতির মাঠে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেনÑ যারা দেশের চিহ্নিত অপরাধী ও অবৈধ টাকার মালিক, তাছাড়া দেশদ্রোহী রাজাকারদের তো জিয়াই রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেন। এর ফলে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের রাজনীতিতে প্রবেশের সুযোগ তৈরি হয়।
এরপর আসেন আরেক জেনারেল হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ। তিনিও জিয়ার মতো জাতীয় পার্টি গঠন করেন সেনা সদস্য, অস্ত্র ও টাকার উপর ভিত্তি করে। ছাত্রদের হাতে অর্থ ও অস্ত্র তুলে দিয়ে ছাত্ররাজনীতিকে হত্যার জন্য জিয়া ও এরশাদের কুটিল ভূমিকা চিরদিন বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ মনে রাখবে। এরশাদের জাতীয় পার্টিতেও একে একে এসে যোগ দেয় সুযোগ সন্ধানী আমলা, সেনা কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীগণ। এরশাদের পরে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হলে সেই নতুন সরকারের মধ্যেও দেখা যায় ব্যবসায়ী নেতা, সামরিক ও আমলাতান্ত্রিক আধিপত্য। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারে শুধু ব্যবসায়ী রাজনৈতিক নেতাই ননÑ সেখানে ধীরে ধীরে জঙ্গিরাও অনুপ্রবেশ করে।
আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরাতন রাজনৈতিক দল। সঙ্গত কারণেই আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী দলের কাছে দেশের সাধারণ মানুষ গঠনমূলক রাজনীতি প্রত্যাশা করে, কিন্তু আওয়ামী লীগও ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করেছে। আওয়ামী লীগের মধ্যেও এখন ব্যবসায়ী নেতাদের আনাগোনা একেবারে কম নয়। যেহেতু সব দলেই এখন ব্যবসায়ীদের জয়জয়কার এবং টাকা ছাড়া যেহেতু নির্বাচনে জয়লাভ করা বর্তমান সময়ে কঠিন; তাই আওয়ামী লীগও অন্যান্য দলের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের রাজনীতি করার সুযোগ করে দিচ্ছে। এ ছাড়া যে আর কোনো উপায় নেই!
যদি আমরা বাংলাদেশের রাজনীতির দিকে একটু ভালো করে তাকাই তাহলে দেখবোÑ তৃণমূল পর্যায় থেকেই শুধু হয়েছে রাজনীতিতে টাকাওয়ালা বা ব্যবসায়ীদের যোগাযোগ। যার টাকা আছে তার পিছেই লোক আছে, যে কোনো জায়গায় টাকাওয়ালার জন্য চেয়ার আছে। ফলে টাকা ইনভেস্ট করতে টাকাওয়ালারা মোটেই দ্বিধা করে না। আজকের দিনে সমাজে একজন সৎ মানুষের চেয়ে টাকাওয়ালা মানুষের দাম বেশি। যেহেতু টাকার দাম বেশি, তাই টাকা যাদের আছে তারাই তো সমাজপতি হবে। আগে জ্ঞানীরা সমাজপতি হতো এখন ধনীরা সমাজপতি হয়। এই চিন্তা চেতনা অত্যন্ত খারাপ মানসিকতার পরিচয় বহন করে। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে সমাজ কিছুদিন পরেই নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়বে। পৃথিবীতে রাজনীতি কোনো সহজ কাজ নয়। যে কোনো লোকের পক্ষেই রাজনীতি করা সম্ভব নয়। এর সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত। ব্যবসায়ীরাই যদি রাজনীতি করতে পারতোÑ তাহলে মহাত্মা গান্ধী, জওহর লাল নেহেরু, কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী, শেরে বাংলা, এ জে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানরা রাজনীতি করে মানুষের এত কাছে যেত পারতেন না, জনগণকে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ উপহার দিতে পারতেন না।
ব্যবসায়ীদের কাজ হলো মুনাফা তৈরি করা, মানুষের দাবি-দাওয়া পূরণ করা নয়। তাদের কাছে মানুষের চেয়ে টাকার দাম বেশি। পক্ষান্তরে প্রকৃত রাজনীতিবিদদের কাছে টাকার চেয়ে মানুষের দাম বেশি। দুটি বিপরীত বিশ্বাস নিয়ে দুই মেরুতে দাঁড়িয়ে আছে প্রকৃত রাজনীতিবিদ আর ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদগণ। আমরা যদি এখনি রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদের পার্থক্য বুঝতে না পারি, তাহলে ভবিষ্যতে দুঃখ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। ভবিষ্যতের কথা ভেবে আসুন আজ থেকেই প্রকৃত রাজনীতিবিদদের হাতে রাজনীতি তুলে দেই। বিদায় জানাই ব্যবসায়ী রাজনৈতিক নেতাদের। রাজনীতিকে ব্যবসায়ীদের হাত থেকে বাঁচাতে হলে জনতার সচেতনতা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। কেননা জনতাই পারে রাজনীতি না-জানা টাকাওয়ালা ব্যবসায়ীদের রাজনীতির ব্যাকরণ শিক্ষা দিতে।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮
জোট-ভোট ও আন্দোলনের আস্ফালন
মোনায়েম সরকার
বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে শক্তি থাকুক আর না থাকুক সবগুলো দলই জোট গঠনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বড় দলগুলোর পাশাপাশি নাম সর্বস্ব দলও এবার জোট করে ক্ষমতায় যাওয়ার রঙিন স্বপ্ন দেখছে। ব্যাপারটা হাস্যকর কিনা জানি না, তবে আমার কাছে জোটভুক্ত কোনো কোনো দলের কর্মকা- তামাশা বলেই মনে হচ্ছে।
রাজনীতি কোনো সহজ কাজ নয়। এমন কী ভীরুর জন্যও রাজনীতি নয়, কিন্তু বাংলাদেশের কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা মনে করেনÑ শক্তি থাকুক আর না থাকুক জোট করেই ক্ষমতাসীন সরকারের পতন ঘটিয়ে ফেলবেন। যাদের এক শতাংশ ভোট নেই, যারা নির্বাচনে দাঁড়ালে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়, যারা প্রেস কনফারেন্স ছাড়া খোলা আকাশের নিচে জনসভা করার লোক সংকটে ভুগে, তাদের নির্বাচনকালীন জোট-তৎপরতা দেখে আমার অনেক প্রবীণ রাজনীতিক বন্ধুই হাসিতে ফেটে পড়ছেন। শূন্যের সঙ্গে শূন্য যোগ করলে যোগফল শুধু শূন্যই হয়, কখনো তা পূর্ণ সংখ্যায় রূপ নেয় না। যেসব দলের কোনো আসন পাওয়ার যোগ্যতা নেই, যেসব দলের কোনো ভোট ব্যাংক বা কর্মীই খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, তারা যদি নির্বাচনকালীন জোটের জন্য লম্ফ-ঝম্প করেনÑ তাহলে তাদের এসব কর্মকা- ‘সিজনাল উপদ্রব’ ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে।
জোট নিয়ে কিংবা রাজনীতির নতুন মেরুকরণ নিয়ে আমি আজ কথা বলতে চাই না, আমি কথা বলতে চাই আগামী দিনে বিএনপি-র আন্দোলন পরিকল্পনা নিয়ে। পত্র-পত্রিকায় দেখা যাচ্ছে সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কি জানি কি হয়ে যাবে। বিশেষ করে বিএনপির এক-দফা আন্দোলন হিং¯্র রূপ নিবে এবং আইন-আদালত করে নয়, গণআন্দোলন করেই বিএনপির নেতাকর্মীরা দলীয় চেয়ারপারসনকে জেল থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসবে। আমার প্রশ্ন হলোÑ খালেদা জিয়ার জন্য কেন মানুষ রাস্তায় নামবে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার মতো মানুষ কি আসলেই খুব গুরুত্বপূর্ণ? খালেদা জিয়া এদেশের মানুষের জন্য এমন কি করেছেন যে তার জন্য মানুষ রাস্তায় নেমে যাবে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর দমন-পীড়ন উপেক্ষা করে? বিএনপি এ পর্যন্ত বহু হুঙ্কার দিয়েছে, বহুভাবে সরকারকে হটাতে চেয়েছে, কিন্তু সরকার হটানো তো দূরের কথা নিজেরাই এখন হটতে হটতে এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে, সেখানে কোমর সোজা করে দাঁড়ানোই এখন তাদের জন্য বিরাট বড় চ্যালেঞ্জ। বিএনপি জন্মলগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত এককভাবে কোনো আন্দোলনের ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারেনি। তারা বড় জোর ‘যুগপৎ’ আন্দোলন করতে পারে, অন্যের ঘাড়ে চড়ে আন্দোলনের সুফল ভোগ করতে পারে কিন্তু নিজেরা কখনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি, ভবিষ্যতে পারবে বলেও কেউ তা বিশ্বাস করে না। বাংলাদেশের মানুষ অনেক আগে থেকেই বিএনপির উপর থেকে বিশ্বাস হারাতে শুরু করেছে, এখন তা তলানিতে এসে ঠেকেছে।
যে দলের সাথে গণমানুষের কোনোই সম্পৃক্ততা নেই, জনগণের কল্যাণের জন্য যে দল মোটেই মনোযোগী নয়, বরং জঙ্গিবাদ, ষড়যন্ত্র আর হত্যার রাজনীতিই যাদের মূল উদ্দেশ্য, সে দলের পক্ষে গণআন্দোলন গড়ে তোলা আকাশ-কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কি হতে পারে? বিএনপির আন্দোলন মানেই তো আগুন, সন্ত্রাস, বিদেশি নাগরিক হত্যা, বিদেশি শক্তির যোগসাজশে ষড়যন্ত্র করে গণতান্ত্রিক ধারা থেকে বাংলাদেশকে মৌলবাদী ভাবধারায় নিয়ে যাওয়া। আন্দোলন-সংগ্রামের পথে নয়Ñ
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) জন্মের শুরু থেকেই বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্রের খেলায় মেতে আছে। বিএনপি ক্যান্টনমেন্টের ছত্রছায়ায় জন্ম নেওয়া একটি দল। ক্যান্টনমেন্টের শক্তিই এই দলের ভরসা। ক্যান্টনমেন্টের বাইরে এলে আর শক্তি দেখাতে পারে না। ক্যান্টনমেন্টের যে বাড়িতে খালেদা জিয়া থাকতেন, এখন সেখানে ৪৫টি সেনা পরিবার থাকেন। এটা রাষ্ট্রের জন্য দারুণ এক সুখবর। এরা চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র করে বহু বছর দেশের ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে ছিল। এর ফলে এরা বাঙালির মাইন্ডসেট পরিবর্তন করে পাকিস্তানি ভাবধারা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। এই দলটি বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা বোঝেনি। কখনোই এই দলটি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করার উপায় খোঁজা ছাড়া উত্তরণের পথ দেখাতে পারেনিÑ এ কথা যখন ভাবি তখনই বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে গোপন ব্যথায় ব্যথিত হই।
আজ বাংলাদেশকে নিয়ে বিএনপি যে ষড়যন্ত্রের খেলা শুরু করেছে তা এদেশের মানুষ স্পষ্ট বুঝে গেছে। আর এটা বুঝেছে বলেই বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে বাংলাদেশের মানুষ এখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আমি বহুবার, বহু লেখায় বলেছিÑ ‘বিএনপি, বেগম খালেদা জিয়া এবং তার দ-প্রাপ্ত অর্বাচীনপুত্র রাজনীতির ব্যাকরণ বুঝেন না’Ñ কথাটা যে মিথ্যা নয়, তা বিএনপির আবোল-তাবোল বিবৃতি বা আন্দোলনের পরিকল্পনা দেখেই বুঝা যায়।
বিএনপি ভেবেছিল বিডিআর বিদ্রোহ ঘটিয়ে, নিরীহ মানুষ পুড়িয়ে মেরে, ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের দিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করে, জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে বোমাবাজি করিয়ে দেশের নির্বাচিত সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারবে, কিন্তু তাদের এই অপ-কৌশল বারবার ব্যর্থ হওয়ার পরেও কেন তারা আন্দোলনের স্বপ্ন দেখা থেকে বিরত হচ্ছে না তা বোধগম্য নয়। ২৯ আগস্ট, ২০১৮ তারিখে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পত্রিকায় দেখলাম সিঙ্গাপুরে ষড়যন্ত্র করছে বিএনপি ও পাকিস্তানি আইএসআই। ওই ষড়যন্ত্রে সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীকে হত্যা করার নীল-নকশাও আছে। বিএনপি যদি আন্দোলন করেই সরকার পতন করার শক্তি রাখেÑ তাহলে তারা একের পর এক ষড়যন্ত্র করছে কেন, কেন তারা হত্যার রাজনীতির পথ পরিহার করতে পারছে না।
চক্রান্তের রাজনীতিতে বিএনপি জন্মলগ্ন থেকেই পটু। কেননা এই দলটির জন্মই হয়েছে চক্রান্তের ভেতর দিয়ে। বিএনপির যখন জন্ম হয় জেনারেল জিয়াউর রহমানের হাত দিয়ে, তখন বেগম জিয়াও সেই বিষয়ে কমবেশি অবগত ছিলেন। কারণ তখন তিনি জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী ছিলেন। জিয়া কিভাবে ষড়যন্ত্র করতেন সেই শিক্ষা খালেদা জিয়া-জিয়াউর রহমানের কাছ থেকেই রপ্ত করেছেন। সুতরাং খালেদা জিয়া দেশের উন্নতি করতে না পারলেও, দেশের মানুষকে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন দিতে ব্যর্থ হলেও দেশকে রসাতলে নিতে তার অসুবিধা হবে না। আজ বাংলাদেশের মানুষ ষড়যন্ত্রের রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বলেই বেগম জিয়া সুবিধা করতে পারছেন না। এ জন্য এ দেশের মানুষের উপর তার ক্ষোভ থাকা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। আর সেই ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটবে আগামী আন্দোলন তথা হত্যা, খুন, পেট্রোল বোমা, অগ্নিসংযোগে।
১৯৭১ সাল থেকেই আমরা বাংলাদেশের ভেতরের ও বাইরের শত্রুদের বিভৎস চেহারা দেখে আসছি। বঙ্গবন্ধুর দ-িত হত্যাকারী মেজর ডালিম, রশিদরা বিদেশে ইঁদুরের মতো পালিয়ে এখনো চক্রান্ত করে যাচ্ছে। ফাঁসির দ-াদেশ মাথায় নিয়ে চক্রান্ত করছে ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীরা। বারবার বাংলাদেশ ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হয়েছে, বারবারই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আজ বাংলাদেশ বিশ্ববাসীর চোখে শুধু উন্নয়নের মডেলই নয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের মর্যাদাকেও বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমরা বিশ্ববাসীর কাছ থেকে সব সময় এমন মর্যাদাই প্রত্যাশা করি। দেশ এখন এগিয়ে যাচ্ছে উন্নতির ঊর্ধ্বমুখী সূচক ধরে, দেশের এই অগ্রগতিকে বাধা না দিয়ে সংহতি প্রকাশ করাই সকলের কর্তব্য হওয়া উচিত। যদি বিএনপি এই কাজটি করতে ভুল করে তাহলে তাদের বোকামির ফল হবে আরো ভয়ঙ্কর।
আসলে বিএনপি আন্দোলন করতে চায় না বাংলাদেশের উন্নয়নকে বিঘিœত করতে চায়। শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগ রাজনীতিকে চিরতরে বন্ধ করতে চায়। আন্দোলন করে ক্ষমতায় গেলে আবার সেই পুরনো পথেই দেশ চালাবে বিএনপি। জন্ম দিবে নতুন নতুন হাওয়া ভবন, বাংলা ভাই ও মৌলবাদ।
বিএনপির শাসনামলে আমরা একযোগে বাংলাদেশের সকল জেলায় বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি। এই বোমাবাজির চূড়ান্ত নৃশংসতা ছিল ২১ আগস্টের হামলা। বিএনপি মন্ত্রী-এমপিদের যোগসাজশে দশ ট্রাক অবৈধ অস্ত্রের চালান ধরা পড়ার দৃশ্য দেখেছি, দেশের সর্বত্র অবলোকন করেছি জঙ্গিদের অপতৎপরতা। আজ বাংলাদেশে ওসব কিছু নেই। মানুষ যেখানে সেখানে নির্ভয়ে চলাচল করছেÑ এটা কি বিএনপির গাত্রদাহের কারণ? বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ঘাতকদের বিচার করে যথাযোগ্য শাস্তির ব্যবস্থা করেছে। সেই শাস্তি ভোগ করছে জামায়াত ও বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা। বিএনপি ও বিএনপির জোটভুক্ত দলগুলো জানে এই সরকার ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশে তারা কোনো জঙ্গি তৎপরতা চালাতে পারবে না, দুঃশাসন করতে পারবে না, তাই এমন কোনো কৌশল নেই তারা প্রয়োগ না করছেন সরকারের পতন ঘটানোর জন্য। কিন্তু কথায় বলেÑ ‘রাখে আল্লায় মারে কে’।
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাদের কর্ম দিয়ে, প্রচেষ্টা দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হতে বদ্ধপরিকর। এখানে আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে এখন আর ফায়দা লোটা যাবে না। জনগণের সমর্থন পেতে হলে এখন জনগণের ‘সেন্টিমেন্ট’কে মূল্য দিতে হবে। যারা জনগণের আবেগ-অনুভূতিকে সম্মান প্রদর্শন করবে না, জনগণের সুখ-শান্তিতে বিঘœ ঘটাবে জনগণ কখনোই তাদের সমর্থন জানাবে না। আজ যারা বাংলাদেশের ক্ষমতায় আছেন এবং যারা ক্ষমতার বাইরে অবস্থান করছেন, তাদের মনে রাখা দরকার, দেশের চরিত্র হনন করলে প্রকারান্তরে দেশের মানুষকেই অমর্যাদা করা হয়, ছোট করা হয়। দেশের বাইরে গিয়ে যারা দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে কিংবা দেশে থেকেও যারা জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের উস্কানি দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে অরাজকতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করবে, মানুষ তাদের শনাক্ত করে উচিত জবাব দিবে। জনতার সম্মিলিত শক্তি দিনদিন বেগবান হচ্ছে। আজ আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস সৃষ্টি করলে সঙ্গত কারণেই সরকার জনগণের জানমালের নিশ্চয়তা দিতে হার্ডলাইনে যাবে। দেশের স্বার্থে, দেশের মানুষের স্বার্থে তাকে হার্ডলাইনে যেতেই হবে। বিএনপি মানুষ পুড়িয়ে মারবে, জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করবে এটা সরকার চেয়ে চেয়ে দেখবেÑ এমনটি কখনোই হবে না। আকাশ-কুসুম কল্পনা বাদ দিয়েÑ মানুষের মূল্যবোধকে সম্মান করতে শিখুন। পরের জন্য পুকুর কেটে লাভ নেই, পারলে গণতন্ত্রের পথ প্রশস্ত করুন। স্মরণ করুন পঁচাত্তর পরবর্তী নির্বাচনগুলোর কথা। সেই সব নির্বাচন কখনোই সুষ্ঠু হয়নি। শুধু ‘হ্যাঁ’, ‘না’ ভোটের কথাই নয়, হঠাৎ গজিয়ে উঠা পার্টিও ২০০ বেশির আসন পেয়েছে বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। বিএনপিকে অনুরোধ করবো, অযৌক্তিক আন্দোলন নয়, সাংবিধানিক আইন মেনে নিয়ে গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রাখুন।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
৩১ আগস্ট, ২০১৮