পৃথিবী এখন নানা কারণেই উত্তপ্ত। দেশে দেশে হানাহানি, রক্তপাত, মৌলবাদী-গোষ্ঠীর নির্বিচার নরহত্যা-পৃথিবীকে নিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসের দিকে। একবিংশ শতাব্দীর এই উৎকর্ষের মুহূর্তে পৃথিবীর এই রক্তাক্ত অবয়ব আমরা কেউই দেখতে চাই না। অথচ আজ আমাদের এই রক্তঝরা দৃশ্যই বার বার দেখতে হচ্ছে। কেন মানুষ পৃথিবীকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, কি কারণে পৃথিবীকে স্বর্গ না বানিয়ে আমরা নরক বানানোর প্রচেষ্টায় লিপ্ত সেই বিষয়গুলো আজ আমাদের খতিয়ে দেখা দরকার।
বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকালে দেখতে পাই পৃথিবী আজ ক্রান্তিকালে এসে দাঁড়িয়েছে। ‘ক্রান্তিকাল’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলোÑ ‘অবস্থা পরিবর্তনের সময়’। পৃথিবী এখন যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থা বিন্দু থেকে বাঁক পরিবর্তনের সময় এসেছে। পৃথিবীর এই বাঁকবদল এখন বিশ্ববাসীর জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে নাকি পৃথিবীকে বিনষ্ট করবেÑ সেই শঙ্কা আজ পৃথিবীর সকল শান্তিকামী মানুষকেই ভাবিয়ে তুলছে। যারা শান্তির সপক্ষে দ-ায়মান, তারা জোর দাবি তুলছে কল্যাণকর চিন্তাই হোক পৃথিবীবাসীর লক্ষ্যবিন্দু, কিন্তু যারা পুঁজির পূজারী তারা চাচ্ছে ঠিক এর উল্টোটা। কল্যাণ এবং অকল্যাণের এই দ্বন্দ্বই আজ পৃথিবীকে উত্তপ্ত করে তুলেছে। মানুষের মনে যদি শুভভাবের উদয় না হয়, মানুষ যদি মানুষের জন্য আন্তরিক না হয়, তাহলে মানুষের পৃথিবী আর বাসযোগ্য থাকবে না। এই পৃথিবী দ্রুতই ধ্বংস হবে। ছারখার হয়ে যাবে মানুষের সকল আশা-ভরসা। আজ পৃথিবীর সকল মানুষকেই এই বিষয়টি গভীর মনোযোগ দিয়ে ভাবতে হবে। আজ একমাত্র মানবপ্রেমী ভাবনাই মানুষকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে পারে। এ ছাড়া আর কোনো কিছুই অনাগত বিনাশ থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারবে না।
পৃথিবীর বৃহৎ পরিবর্তন একদিনে বা এক মুহূর্তেই লক্ষ্য করা যায় না। যেকোনো দৃশ্যমান পরিবর্তনই সময় সাপেক্ষ ও শ্রমসাধ্য বিষয়। দৃশ্যমান পরিবর্তনের জন্য কখনো কখনো শতাব্দীকাল পর্যন্তও অপেক্ষা করতে হয়। আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা পৃথিবীর যে চেহারা দেখতে পাচ্ছি এই রূপে পৃথিবীকে সাজাতে অনেক কিছুই বিসর্জন দিয়েছে মানুষ। বিসর্জন না দিলে অর্জনের গৌরব অনুভব করা যায় না। আজ আমরা পৃথিবীবাসী এমন এক মুহূর্তের মুখোমুখি হয়েছি যে মুহূর্তে এসে চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছি আমাদের ভবিষ্যৎ কী? কোন পথে যাত্রা করছি সমগ্র মানবসমাজ? নিশ্চয় এই সময়ে এই নেতিবাচক শঙ্কা আমাদের মধ্যে থাকার কথা ছিল নাÑ অথচ কি আশ্চর্য আজ দুনিয়ার সব মানুষকেই এই নেতিবাচক ভাবনা দারুণ এক সংকটের মধ্যে নিপতিত করেছে।
গত শতাব্দীগুলোতে মানুষ যেসব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে সেগুলোর মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় মনুষ্যসমাজের সামাজিক স্তরবিন্যাসের আমূল পরিবর্তন। দাসপ্রথা থেকে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় আসতে দীর্ঘদিন সংগ্রাম করতে হয়েছে মানুষকে। আবার এর মধ্যেই চলেছে গোত্রযুদ্ধ, ধর্মযুদ্ধ। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত অসংখ্যবার ধর্মযুদ্ধ লেগেছে। সেসব যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে কোটি কোটি নিরপরাধ মানুষ। এরপরে দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীকে করেছে রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত। এছাড়া স্বাধীনতাকামী মানুষের স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘদিনের সংগ্রাম তো ছিলই। অতীত দিনের যেসব রক্তক্ষয়ী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মানুষ এগিয়েছে সেসবই আজ আবার ভয়াল রূপ নিয়ে মানুষের সামনে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে।
পৃথিবীর মানুষ আজ ধনের কাছে, ক্ষমতার কাছে, লোভের কাছে এতটাই নতজানু হয়ে পড়েছে যে এসব থেকে কিছুতেই নিজেকে দূরে সরাতে পারছে না। কথায় আছে ‘লোভের ফলে পাপ হয়, পাপের ফলে মৃত্যু হয়।’ আজ পৃথিবীর মানুষ যেন বহু শতাব্দী ধরে চলমান এই মহৎ সত্যবাণীকে স্বেচ্ছায় অস্বীকার করে মৃত্যুর দিকে যাত্রা শুরু করেছে। এখন আবার দাস যুগে, ক্রসেডের যুগে ফিরে গেলে পৃথিবীর কি মঙ্গল হবে? আবার যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত হয়, তাহলে কি সুখে থাকবে পৃথিবীর মানুষ?
যে পরিস্থিতিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ লেগেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সে পরিস্থিতি ছিল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যুগে পৃথিবীতে তেমন কোনো আধুনিক মারণাস্ত্র ব্যবহৃত হয়নি। তাই অল্প ক্ষতিতেই শেষ হয়েছে সেই মহারণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রথম পারমাণবিক বোমার ব্যবহার করা হয়। ‘লিটল বয়’ আর ‘ফ্যাট ম্যান’ নামে জাপানের হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে যে দুটি বোমা আকাশ থেকে নিক্ষেপ করা হয়েছিল, সে দুটি বোমা সেদিন জীবন ও পরিবেশের যে ক্ষতি সাধন করেছিল ইতিহাস তার স্বাক্ষী আছে।
১৯৪৫ সালের মারণাস্ত্রের চেয়ে আজ পৃথিবীর ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো আরো অনেক উন্নত ও শক্তিশালী মারণাস্ত্র আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। এমন মুহূর্তে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে পৃথিবী যে তার অস্তিত্ব হারাবে এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। পৃথিবীতে অস্ত্রব্যবসা আজ পুঁজিবৃদ্ধির প্রধান উৎসে পরিণত হয়েছে। এই অস্ত্র ব্যবসা রমরমা রাখার জন্য দেশে দেশে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখার পাঁয়তারা করছে অস্ত্র-উৎপাদনকারী দেশগুলো। এর ফলে সাম্প্রদায়িকতা যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি বৃদ্ধি পাচ্ছে ধর্মীয় সন্ত্রাস। আজ মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই বোকো হারাম, আলকায়েদা, আইএস, হিজবুল্লাহদের নরঘাতী তা-ব। যে তা-বে জ্বলে পুড়ে মরছে ইরাক, সিরায়া, মিশর, লেবানন, ইয়েমেনের মতো রাষ্ট্র। ধ্বংস হচ্ছে প্রাচীন সভ্যতার সব মূল্যবান নির্দশন। ইহুদিরা যেমন উড়ে এসে ফিলিস্তিনের উপর জুড়ে বসে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে, তদ্রƒপ ভারতের হিন্দু ও মিয়ানমারের বৌদ্ধরাও লিপ্ত হচ্ছে ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতায়। যখন পুরো পৃথিবীর যাত্রা শুরু করার কথা ছিল একটি সুন্দর আগামীর দিকে, যখন পৃথিবীর সবমানুষেরই আসা দরকার ঐক্য ও শান্তির এক পতাকাতলে, তখনি আমরা জড়িয়ে পড়ছি বিভেদের বৈরিতায়। ‘একতায় উত্থান বিভেদে পতন’ জেনেও কেন পৃথিবীর মানুষ আজ এত আত্মকলহে লিপ্ত এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা আজ সময়ের দাবি। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে না পারলে কিছুতেই ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানো যাবে না পৃথিবী ও মানবসভ্যতা।
হিংসা দিয়ে হিংসাকে ধ্বংস করা যায় না। আজ হিংসার পরিবর্তে প্রেম বিলাবার সময় এসেছে। ধনী রাষ্ট্রগুলোর উপর নৈতিক দায় বর্তেছে গরিব রাষ্ট্রগুলোকে সার্বিক নিরাপত্তা দেওয়া। বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে খেতে পারে, বৃহৎ হিং¯্র বন্য পশু নির্বিচারে হত্যা করতে পারে বনের অন্য নিরীহ পশুকে। কিন্তু মানব সমাজে এই পশুনীতি একেবারেই অচল। মানুষ মানুষকে ভালোবাসবে, সেবাশুশ্রƒষা দিয়ে নিরাপদ রাখবে এটাই মানুষের ধর্ম। শক্তিমান রাষ্ট্রগুলোর আজ একান্ত উচিত গরিব রাষ্ট্রগুলোর পাশে মানবিক সাহায্য নিয়ে নিঃশর্তে দাঁড়ানো। শাসন-শোষণ যুদ্ধ পরিহার করে উন্নত রাষ্ট্রগুলোর উচিত মানবসেবার চিন্তা লালন করা। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে সব মানুষকেই তার মানবিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। ধনবৈষম্য নয়, ধনসাম্য রক্ষা করতে হবে। অস্ত্রনির্ভর বাণিজ্য ও ভূ-রাজনীতির আধিপত্য থেকে মুক্ত হতে হবে।
জড় পৃথিবীর সাধ্য নেই জীবন ও পরিবেশের জন্য কল্যাণকর কোনো সমাধান দেওয়া যদি পৃথিবীর মানুষ কল্যাণের দিকে এগিয়ে না যায়। আমরা মানুষেরা আবার কি আদিম অসভ্য সমাজে ফিরে যেতে চাই? আমরা কি জড়িয়ে পড়তে চাই অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয় ধর্মযুদ্ধে? আমরা কি ঠুনকো কোনো বিষয় নিয়ে বাঁধিয়ে দিতে চাই সর্বগ্রাসী তৃতীয় মহাযুদ্ধ? এসব আজ ঠা-া মাথায় ভেবে দেখা দরকার। আমাদের পূর্বপুুরুষেরা যে সীমাহীন ত্যাগ ও সংগ্রাম করে আজ আমাদের এইখানে পৌঁছে দিয়েছে সে ত্যাগ ও সংগ্রামকে আমরা বিফলে যেতে দিতে পারি না। আজ ধ্বংসের জন্য নয়, সৃষ্টির জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। লোভ ও লাভের চিন্তা বলি দিতে হবে। শুধু মুনাফা নয়, মানুষের কল্যাণের দিকেই এখন সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে যাত্রা করতে হবে। ধ্বংস নয়, সৃষ্টির দিকে যাত্রা করুক আমাদের প্রিয় পৃথিবী। আজ আমাদের অঙ্গীকার হোকÑ
‘যখন প্রশ্ন উঠবে যুদ্ধ না শান্তি?
আমরা জবাব দেবো শান্তি, শান্তি, শান্তি।’
০৩ এপ্রিল, ২০১৮
পৃথিবী এখন নানা কারণেই উত্তপ্ত। দেশে দেশে হানাহানি, রক্তপাত, মৌলবাদী-গোষ্ঠীর নির্বিচার নরহত্যা-পৃথিবীকে নিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসের দিকে। একবিংশ শতাব্দীর এই উৎকর্ষের মুহূর্তে পৃথিবীর এই রক্তাক্ত অবয়ব আমরা কেউই দেখতে চাই না। অথচ আজ আমাদের এই রক্তঝরা দৃশ্যই বার বার দেখতে হচ্ছে। কেন মানুষ পৃথিবীকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, কি কারণে পৃথিবীকে স্বর্গ না বানিয়ে আমরা নরক বানানোর প্রচেষ্টায় লিপ্ত সেই বিষয়গুলো আজ আমাদের খতিয়ে দেখা দরকার।
বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকালে দেখতে পাই পৃথিবী আজ ক্রান্তিকালে এসে দাঁড়িয়েছে। ‘ক্রান্তিকাল’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলোÑ ‘অবস্থা পরিবর্তনের সময়’। পৃথিবী এখন যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থা বিন্দু থেকে বাঁক পরিবর্তনের সময় এসেছে। পৃথিবীর এই বাঁকবদল এখন বিশ্ববাসীর জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে নাকি পৃথিবীকে বিনষ্ট করবেÑ সেই শঙ্কা আজ পৃথিবীর সকল শান্তিকামী মানুষকেই ভাবিয়ে তুলছে। যারা শান্তির সপক্ষে দ-ায়মান, তারা জোর দাবি তুলছে কল্যাণকর চিন্তাই হোক পৃথিবীবাসীর লক্ষ্যবিন্দু, কিন্তু যারা পুঁজির পূজারী তারা চাচ্ছে ঠিক এর উল্টোটা। কল্যাণ এবং অকল্যাণের এই দ্বন্দ্বই আজ পৃথিবীকে উত্তপ্ত করে তুলেছে। মানুষের মনে যদি শুভভাবের উদয় না হয়, মানুষ যদি মানুষের জন্য আন্তরিক না হয়, তাহলে মানুষের পৃথিবী আর বাসযোগ্য থাকবে না। এই পৃথিবী দ্রুতই ধ্বংস হবে। ছারখার হয়ে যাবে মানুষের সকল আশা-ভরসা। আজ পৃথিবীর সকল মানুষকেই এই বিষয়টি গভীর মনোযোগ দিয়ে ভাবতে হবে। আজ একমাত্র মানবপ্রেমী ভাবনাই মানুষকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে পারে। এ ছাড়া আর কোনো কিছুই অনাগত বিনাশ থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারবে না।
পৃথিবীর বৃহৎ পরিবর্তন একদিনে বা এক মুহূর্তেই লক্ষ্য করা যায় না। যেকোনো দৃশ্যমান পরিবর্তনই সময় সাপেক্ষ ও শ্রমসাধ্য বিষয়। দৃশ্যমান পরিবর্তনের জন্য কখনো কখনো শতাব্দীকাল পর্যন্তও অপেক্ষা করতে হয়। আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা পৃথিবীর যে চেহারা দেখতে পাচ্ছি এই রূপে পৃথিবীকে সাজাতে অনেক কিছুই বিসর্জন দিয়েছে মানুষ। বিসর্জন না দিলে অর্জনের গৌরব অনুভব করা যায় না। আজ আমরা পৃথিবীবাসী এমন এক মুহূর্তের মুখোমুখি হয়েছি যে মুহূর্তে এসে চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছি আমাদের ভবিষ্যৎ কী? কোন পথে যাত্রা করছি সমগ্র মানবসমাজ? নিশ্চয় এই সময়ে এই নেতিবাচক শঙ্কা আমাদের মধ্যে থাকার কথা ছিল নাÑ অথচ কি আশ্চর্য আজ দুনিয়ার সব মানুষকেই এই নেতিবাচক ভাবনা দারুণ এক সংকটের মধ্যে নিপতিত করেছে।
গত শতাব্দীগুলোতে মানুষ যেসব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে সেগুলোর মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় মনুষ্যসমাজের সামাজিক স্তরবিন্যাসের আমূল পরিবর্তন। দাসপ্রথা থেকে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় আসতে দীর্ঘদিন সংগ্রাম করতে হয়েছে মানুষকে। আবার এর মধ্যেই চলেছে গোত্রযুদ্ধ, ধর্মযুদ্ধ। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত অসংখ্যবার ধর্মযুদ্ধ লেগেছে। সেসব যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে কোটি কোটি নিরপরাধ মানুষ। এরপরে দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীকে করেছে রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত। এছাড়া স্বাধীনতাকামী মানুষের স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘদিনের সংগ্রাম তো ছিলই। অতীত দিনের যেসব রক্তক্ষয়ী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মানুষ এগিয়েছে সেসবই আজ আবার ভয়াল রূপ নিয়ে মানুষের সামনে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে।
পৃথিবীর মানুষ আজ ধনের কাছে, ক্ষমতার কাছে, লোভের কাছে এতটাই নতজানু হয়ে পড়েছে যে এসব থেকে কিছুতেই নিজেকে দূরে সরাতে পারছে না। কথায় আছে ‘লোভের ফলে পাপ হয়, পাপের ফলে মৃত্যু হয়।’ আজ পৃথিবীর মানুষ যেন বহু শতাব্দী ধরে চলমান এই মহৎ সত্যবাণীকে স্বেচ্ছায় অস্বীকার করে মৃত্যুর দিকে যাত্রা শুরু করেছে। এখন আবার দাস যুগে, ক্রসেডের যুগে ফিরে গেলে পৃথিবীর কি মঙ্গল হবে? আবার যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত হয়, তাহলে কি সুখে থাকবে পৃথিবীর মানুষ?
যে পরিস্থিতিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ লেগেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সে পরিস্থিতি ছিল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যুগে পৃথিবীতে তেমন কোনো আধুনিক মারণাস্ত্র ব্যবহৃত হয়নি। তাই অল্প ক্ষতিতেই শেষ হয়েছে সেই মহারণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রথম পারমাণবিক বোমার ব্যবহার করা হয়। ‘লিটল বয়’ আর ‘ফ্যাট ম্যান’ নামে জাপানের হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে যে দুটি বোমা আকাশ থেকে নিক্ষেপ করা হয়েছিল, সে দুটি বোমা সেদিন জীবন ও পরিবেশের যে ক্ষতি সাধন করেছিল ইতিহাস তার স্বাক্ষী আছে।
১৯৪৫ সালের মারণাস্ত্রের চেয়ে আজ পৃথিবীর ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো আরো অনেক উন্নত ও শক্তিশালী মারণাস্ত্র আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। এমন মুহূর্তে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে পৃথিবী যে তার অস্তিত্ব হারাবে এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। পৃথিবীতে অস্ত্রব্যবসা আজ পুঁজিবৃদ্ধির প্রধান উৎসে পরিণত হয়েছে। এই অস্ত্র ব্যবসা রমরমা রাখার জন্য দেশে দেশে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখার পাঁয়তারা করছে অস্ত্র-উৎপাদনকারী দেশগুলো। এর ফলে সাম্প্রদায়িকতা যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি বৃদ্ধি পাচ্ছে ধর্মীয় সন্ত্রাস। আজ মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই বোকো হারাম, আলকায়েদা, আইএস, হিজবুল্লাহদের নরঘাতী তা-ব। যে তা-বে জ্বলে পুড়ে মরছে ইরাক, সিরায়া, মিশর, লেবানন, ইয়েমেনের মতো রাষ্ট্র। ধ্বংস হচ্ছে প্রাচীন সভ্যতার সব মূল্যবান নির্দশন। ইহুদিরা যেমন উড়ে এসে ফিলিস্তিনের উপর জুড়ে বসে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে, তদ্রƒপ ভারতের হিন্দু ও মিয়ানমারের বৌদ্ধরাও লিপ্ত হচ্ছে ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতায়। যখন পুরো পৃথিবীর যাত্রা শুরু করার কথা ছিল একটি সুন্দর আগামীর দিকে, যখন পৃথিবীর সবমানুষেরই আসা দরকার ঐক্য ও শান্তির এক পতাকাতলে, তখনি আমরা জড়িয়ে পড়ছি বিভেদের বৈরিতায়। ‘একতায় উত্থান বিভেদে পতন’ জেনেও কেন পৃথিবীর মানুষ আজ এত আত্মকলহে লিপ্ত এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা আজ সময়ের দাবি। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে না পারলে কিছুতেই ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানো যাবে না পৃথিবী ও মানবসভ্যতা।
হিংসা দিয়ে হিংসাকে ধ্বংস করা যায় না। আজ হিংসার পরিবর্তে প্রেম বিলাবার সময় এসেছে। ধনী রাষ্ট্রগুলোর উপর নৈতিক দায় বর্তেছে গরিব রাষ্ট্রগুলোকে সার্বিক নিরাপত্তা দেওয়া। বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে খেতে পারে, বৃহৎ হিং¯্র বন্য পশু নির্বিচারে হত্যা করতে পারে বনের অন্য নিরীহ পশুকে। কিন্তু মানব সমাজে এই পশুনীতি একেবারেই অচল। মানুষ মানুষকে ভালোবাসবে, সেবাশুশ্রƒষা দিয়ে নিরাপদ রাখবে এটাই মানুষের ধর্ম। শক্তিমান রাষ্ট্রগুলোর আজ একান্ত উচিত গরিব রাষ্ট্রগুলোর পাশে মানবিক সাহায্য নিয়ে নিঃশর্তে দাঁড়ানো। শাসন-শোষণ যুদ্ধ পরিহার করে উন্নত রাষ্ট্রগুলোর উচিত মানবসেবার চিন্তা লালন করা। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে সব মানুষকেই তার মানবিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। ধনবৈষম্য নয়, ধনসাম্য রক্ষা করতে হবে। অস্ত্রনির্ভর বাণিজ্য ও ভূ-রাজনীতির আধিপত্য থেকে মুক্ত হতে হবে।
জড় পৃথিবীর সাধ্য নেই জীবন ও পরিবেশের জন্য কল্যাণকর কোনো সমাধান দেওয়া যদি পৃথিবীর মানুষ কল্যাণের দিকে এগিয়ে না যায়। আমরা মানুষেরা আবার কি আদিম অসভ্য সমাজে ফিরে যেতে চাই? আমরা কি জড়িয়ে পড়তে চাই অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয় ধর্মযুদ্ধে? আমরা কি ঠুনকো কোনো বিষয় নিয়ে বাঁধিয়ে দিতে চাই সর্বগ্রাসী তৃতীয় মহাযুদ্ধ? এসব আজ ঠা-া মাথায় ভেবে দেখা দরকার। আমাদের পূর্বপুুরুষেরা যে সীমাহীন ত্যাগ ও সংগ্রাম করে আজ আমাদের এইখানে পৌঁছে দিয়েছে সে ত্যাগ ও সংগ্রামকে আমরা বিফলে যেতে দিতে পারি না। আজ ধ্বংসের জন্য নয়, সৃষ্টির জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। লোভ ও লাভের চিন্তা বলি দিতে হবে। শুধু মুনাফা নয়, মানুষের কল্যাণের দিকেই এখন সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে যাত্রা করতে হবে। ধ্বংস নয়, সৃষ্টির দিকে যাত্রা করুক আমাদের প্রিয় পৃথিবী। আজ আমাদের অঙ্গীকার হোকÑ
‘যখন প্রশ্ন উঠবে যুদ্ধ না শান্তি?
আমরা জবাব দেবো শান্তি, শান্তি, শান্তি।’
০৩ এপ্রিল, ২০১৮
পৃথিবী প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। মানুষ তার একমাত্র বাসস্থল পৃথিবীকে নিজের প্রয়োজনেই বদলাতে বাধ্য হচ্ছে। আমরা যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখবো বিশ শতক উনিশ শতকের রেপ্লিকা নয়, তদ্রƒপ একবিংশ শতাব্দীকেও আমরা বিশ শতকের রেপ্লিকা বলতে পারি না। একবিংশ শতকের বিজ্ঞানচর্চা ও বিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান অগ্রগতি পূর্বের সমস্ত ধ্যান-ধারণা ভেঙে খান খান করে দিচ্ছে। আগামীতে আরো কত পরিবর্তন দেখতে হবে এই মুহূর্তে তা অনুমান করা কঠিন।
আমরা যারা এক সময় বামপন্থী ছিলাম, যারা মার্কসবাদ, লেলিনবাদে বিশ্বাসস্থাপন করে সোনালি যৌবন বাজি রেখেছিলাম তারা মনে করতাম বিশ শতকের শেষ দিকে অর্থাৎ একবিংশ শতকের গোড়ার দিকে পৃথিবীব্যাপী সমাজতন্ত্র কায়েম হবে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসে দেখছি আমাদের সেই ধারণা ভুল ছিল, কেন ভুল ছিল সেই ব্যাখ্যা এই লেখায় করবো না, শুধু বলবোÑ ধনসাম্যের পরিবর্তে এখন ধনবৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। একদিন আমরা হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিতাম ‘কেউ খাবে তো কেউ খাবে না তা হবে না, তা হবে না।’ যারা ভাবেন এই স্লোগানের দিন শেষ হয়ে গেছে আজ তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, এই স্লোগানের দিন শেষ হয়ে যায়নি। আজ পৃথিবীর এক শতাংশ লোকের হাতে যে পরিমাণ অর্থ-সম্পদ গচ্ছিত আছে, বাকি নিরানব্বই শতাংশ মানুষের হাতেও সেই পরিমাণ সম্পদ নেই। তাহলে অঙ্কটা দাঁড়াচ্ছে এক শতাংশ সমান নিরানব্বই শতাংশ। এক শতাংশ মানুষের হাতে পৃথিবীর সব সম্পদ, সব সুখ বন্ধক রেখে নিরানব্বই শতাংশ মানুষ কি সুখে থাকতে পারে নাকি সুখে থাকা সম্ভব?
মানবসভ্যতার ধারাবাহিক ইতিহাস বলে আমরা বারবার মানুষ হতে চেয়েছি কিন্তু আমরা আসলেই কি মানুষ হতে পারছি? আমরা সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ জীব বলে নিজেদের পরিচয় দেই কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ জীব হওয়ার জন্য নয়, প্রতিযোগিতায় নেমেছে সর্বনিকৃষ্ট জীব হওয়ার জন্য। আজ পৃথিবীর দিকে তাকালে ব্যথায় বুক কুকড়ে ওঠে, দেশে দেশে বেড়ে যাচ্ছে ছিন্নমূল, দেশহারা মানুষের সংখ্যা। নির্বিচারে তথাকথিত মোড়ল রাষ্ট্ররা অত্যাচার চালাচ্ছে গরিব রাষ্ট্রগুলোর উপর। অস্ত্র বিক্রির জন্য আজ প্রত্যেকটি শক্তিশালী রাষ্ট্রই চাপ প্রয়োগ করে গরিব রাষ্ট্রগুলোকে অস্ত্র কিনতে বাধ্য করছে। যে সময় অস্ত্র পরিহার করে শান্তির পথে, সাম্যের পথে আমাদের যাত্রা করার কথা ছিল সেই সময় আমরা যুদ্ধের দিকে, রক্তপাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিÑ এটা কি আদৌ আমাদের স্বপ্ন ছিল? আমরা কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছিÑ সব মানুষকেই আজ এই বিষয়টা ভেবে দেখা দরকার। উদ্দেশ্যহীনভাবে পাগলের মতো ছুটে চললে আমরা শুধু ক্লান্ত হবো, কখনো শান্তি পাবো না। আমাদের উচিত পৃথিবীতে আজ শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একযোগে কাজ করা।
একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আমাদের আরাম-আয়াশের ব্যবস্থা যেমন করেছেÑ তেমনি ব্যারামের জন্যও কোনো কিছু বাকি রাখেনি। বিজ্ঞান মানুষকে সীমাহীন ক্ষমতা হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। আজ উত্তর কোরিয়াকে শায়েস্তা করার জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সামনে থাকা টেবিলের বোতামের ভয় দেখাচ্ছেন অর্থাৎ ট্রাম্পের টেবিলে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন যে বোতাম আছে সেটিতে চাপ দিলেই উত্তর কোরিয়া ধ্বংস হতে বাধ্য। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বিজ্ঞান মানুষকে যেমন অপরিসীম সৃষ্টিক্ষমতা দিয়েছে, তেমনি দিয়েছে ব্যাপক ধ্বংসাত্মক ক্ষমতাও। আমরা ধ্বংস চাই না, সৃষ্টি চাই। সৃষ্টির পথে থেকেই আমরা রচনা করতে চাই সাম্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। সাম্যের পক্ষে, মুক্তির লক্ষ্যে আজ আমাদের এগুতেই হবে। একমাত্র পৃথিবীকে পাগলামি করে ধ্বংসের হাতে ঠেলে দেওয়া সিদ্ধান্ত কিছুতেই বিবেকবান মানুষ সমর্থন করতে পারেন না।
পৃথিবীর চারদিকে আজ দেখছি মানবসৃষ্ট পাপ মহামারীর আকার ধারণ করেছে। দেশে দেশে যুদ্ধ-গৃহযুদ্ধ নিরপরাধ মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো পুঁজির লোভে উন্মাদ হয়ে গেছে, মানুষকে যে কাজে মানায় না, যে কাজ করলে মানবতার চরম অমর্যাদা হয়, আজ তারা পৃথিবীব্যাপী সেই কাজগুলোই নির্লজ্জের মতো করে যাচ্ছে। তাদের লালসার রাশ টেনে ধরতে না পারলে এই পৃথিবী আর বাসযোগ্য থাকবে না, শ্মশানে পরিণত হবে। আমরা যারা শান্তির সপক্ষে দ-ায়মান তাদের উচিত সংঘাতের পথ, ধ্বংসের পথ পরিহার করে কল্যাণের দিকে যাত্রা করা। এই যাত্রা যতদ্রুত শুরু হবে ততই মানুষের জন্য মঙ্গল বার্তা বয়ে নিয়ে আসবে।
পত্র-পত্রিকার পাতা খুললেই, সোশ্যাল মিডিয়ায় দৃষ্টি দিলেই চারপাশের নৃশংস ঘটনা দেখতে পাই। আদিম যুগেও মানুষ যা করতে দ্বিধা করতো, আধুনিকতার প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেও সেই বর্বর কাজগুলো করেই মানুষ এখন এক ধরনের বিকৃত সুখ অনুভব করার চেষ্টা করছে। মানুষ এত বিকৃত হচ্ছে কেন? কি কারণে উল্টো দিকে চলতে শুরু করেছে লোভে অন্ধ ক্ষণজীবী মানবসন্তান?
আজ ইউরোপ জুড়ে অশান্তি। এশিয়া দাউ দাউ করে জ্বলছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিধন ও নির্যাতন বিশ্ববাসীর আবেগকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে কোনো রকমে রক্ষা পেলেও বাংলাদেশ পড়েছে তীব্র সংকটে। সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়ে মিয়ানমার বাংলাদেশ ও পৃথিবীকে যে বার্তা দিতে চায় সেটা যে শুভ বার্তা নয় এটা মোটামুটি নিশ্চিত। শুধু মিয়ানমার নয় সিরিয়ায় সাম্প্রতিককালে যে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ববাসী তার বিবরণ দেওয়া অসম্ভব। মিসর-ইয়েমেন-প্যালেস্টাইনে প্রতিদিন যে রক্ত ঝরছে সেই হিসাব আর কত কষতে হবে আমাদের? এর কি কোনোই সমাধান নেই? এই সংঘাতের বৃত্ত থেকে কি কখনোই মুক্তি সম্ভব নয়?
সমগ্র পৃথিবী এর আগে দুই দুটি বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে। দেখেছে আরও অসংখ্য ছোট-বড় গৃহযুদ্ধ। ঔপনিবেশিক শাসনের কবলে পড়েও অসংখ্য দেশ সর্বস্বান্ত হয়েছে। এত যুদ্ধ-বিগ্রহ, শোষণের অভিজ্ঞতা থাকতেও মানুষ কেন আজ আবার যুদ্ধের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে সেটাই সবচেয়ে বেদনাদায়ক। একবিংশ শতাব্দীর এই উৎকর্ষের যুগে এসেও কেন আমরা দিন দিন অমানবিক হয়ে উঠছি, হিং¯্র থেকে হিং¯্রতম হচ্ছি আমাদের আজ এই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া দরকার।
বর্তমান পৃথিবী এখন একটি মানবিক সমাজব্যবস্থা প্রত্যাশা করছে। এই মানবিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে আমাদের সবাইকে আজ লোভ পরিহার করতে হবে। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির ঊর্ধ্বে ওঠে অসাম্প্রদায়িক আচরণ করতে হবে। গণতন্ত্রের চর্চা দেশে দেশে আরও ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, মারণাস্ত্র উৎপাদন সর্বাংশে পরিহার করতে হবে। যে নিরন্ন মানুষের মুখে আমরা একমুঠো অন্ন তুলে দিতে পারি না, সেই অনাহারী মানুষকে হত্যা করার অধিকার কি আমাদের আছে? নাকি সেই অধিকার থাকতে পারে? আমরা যদি কারো মঙ্গল করতে না পারি, তাহলে তার অমঙ্গল কামনা করি কেন?
আমরা এখন এমন এক সময়ে বসবাস করছি যে সময় সত্যিকার অর্থেই চরম অস্থির। অস্থির সময়ের সন্তান হিসেবে আমরাও গা ভাসিয়ে দিচ্ছি ব্যক্তিগত ভোগ-বিলাস আর স্বার্থপরতায়। কিন্তু আমরা যদি দাসপ্রথাবিরোধী নেতা আব্রাহাম লিংকনের দিকে তাকাই, তাহলে মানবতাবাদী শিক্ষা নিতে পারি। আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন একটি অসচ্ছল পরিবার থেকে নিজের শ্রম ও প্রজ্ঞা দিয়ে বরেণ্য হয়েছিলেন, হৃদয় জয় করেছিলেন কোটি কোটি মানুষের। ভারতবর্ষের মহাত্মা গান্ধিও আদর্শ ও প্রেরণার বাতিঘর হয়ে আছেন বিশ্ববাসীর কাছে। বাঙালিশ্রেষ্ঠ বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করে, নির্লোভ জীবনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে শুধু বাঙালির সামনেই নয়, বিশ্ববাসীর সামনে সততার ও মহানুভবতার যে কীর্তি সৃষ্টি করেছেন তার কোনো তুলনা নেই। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের কথাও আমরা ভুলে যাই কেন? দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমের যে উদাহরণ বঙ্গের এই নির্ভীক সন্তান সৃষ্টি করেছেন তা এক বিরল ইতিহাস। আমরা নৃশংস রাষ্ট্রনায়ক হিটলারকে দেখেছি, দেখেছি হিটলারের দোসর ইটালির মুসোলিনি ও জাপানের তোজোকে। কুখ্যাত একনায়কেরা যুগে যুগে পৃথিবীব্যাপী যে তা-ব চালিয়েছে, নির্বিচারে যে পরিমাণ মানুষ হত্যা করেছে তার পরিসংখ্যান ইতিহাসের পাতায় পাতায় লিপিবদ্ধ আছে।
আমরা একটি গল্প জানি, যে গল্পটি একজন ভূমিলোভী মানুষের। তাকে বলা হয়েছিলÑ তুমি দৌড়াও। তুমি যতদূর দৌড়াতে পারবে, ততদূর পর্যন্ত জমিই তোমাকে দেওয়া হবে। জমির লোভে দৌড়াতে দৌড়াতে লোকটি একসময় মারা গেলেন, সেই সঙ্গে মারা গেল তার সম্পদ-আকাক্সক্ষাও।
বিশ্ববিখ্যাত লেখক টলস্টয় জমিদার ছিলেন। লেখালেখি করেও তিনি প্রভুত সম্পদ অর্জন করেছিলেন। তিনি এক পর্যায়ে ঘর থেকে শূন্য হাতে বের হয়ে যান। মৃত্যুবরণ করেন নিঃসঙ্গ-সামান্য মানুষের মতো। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, সাড়ে তিন হাত ভূমিই মানুষের শেষ সম্বল। তাই যদি হয়, তাহলে পৃথিবীতে আমরা এত সম্পদের পাহাড় কার জন্য, কিসের জন্য রেখে যাচ্ছি?
আমাদের যৌবনে একটা গান শুনেছিলামÑ ‘পৃথিবী বদলে গেছেÑ যা দেখি নতুন লাগে’, আসলেই তাই। পৃথিবী প্রতিদিন একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে। এই বদলানোতে আমরা আশাবাদী হতে পারতাম যদি বদলানো শুভ হতো, কিন্তু আমাদের এই মুহূর্তে আশাহত হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না। পৃথিবী বদলাচ্ছে বটে, তবে এই বদলকে অবশ্যই কল্যাণমুখী করতে হবে, মানবিক করতে হবে। অন্যকে কষ্ট দিয়ে, মৃত্যু যন্ত্রণার ভেতর ঠেলে দিয়ে পৃথিবীকে যারা বদলাতে চায় সেই বদলানোকে আমাদের প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
মানুষই মানুষের ভরসার জায়গা। মানুষই মানুষের সুখ-দুঃখের একমাত্র আশ্রয়স্থল। মানুষকে অকারণে কিংবা অর্থের লোভে হত্যা করে যারা আনন্দ পায়, ধন-সম্পদের পাহাড় গড়তে চায়Ñ আমাদের সবার উচিত হবে তাদের ঘৃণা করতে শেখা। পৃথিবীর সবকিছুই সুন্দর, মূল্যবান, সম্মানীয় এই কথাটি আমাদের মনে রাখতে হবে। পরিশেষে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে চাইÑ “যাহা-কিছু হেরি চোখে কিছু তুচ্ছ নয়/ সকলই দুর্লভ বলে আজি মনে হয়।/ দুর্লভ এ ধরণীর লেশতম স্থান,/ দুর্লভ এ জগতের ব্যর্থতম প্রাণ।” পৃথিবীতে সকলেই সুখে থাকুক। নির্বিঘœ হোক আমাদের সবার জীবন। জয় হোক মানবতার, জয় হোক ভ্রাতৃত্ববোধের।
০২ মার্চ, ২০১৮
বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি। রাজপথে বলি দিয়েছি অনেক তাজা প্রাণ। বুকের রক্ত ঢেলে পৃথিবীর আর কোনো দেশ আমাদের মতো মাতৃভাষাকে রক্ষা করতে পারেনি। ভাষা আন্দোলনের লড়াই আমাদের বাঁচতে শিখিয়েছে। এই লড়াইয়েরই চূড়ান্ত ফসল আমাদের বহুল আকাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা মূলত বাংলা ভাষা রক্ষার আন্দোলনের সোনালি ফসল। বাংলার কবি অতুল প্রসাদ সেন বলেছিলেনÑ ‘মোদের গরব মোদের আশা/আ মরি বাংলা ভাষা’। বাংলা ভাষা যে বাঙালির গৌরব বৃদ্ধি করে চলেছে, তার প্রমাণ ইত:পূর্বে আমরা বহুবার পেয়েছি। সম্প্রতিও পেলাম বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতির মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাংলা ভাষার গৌরবকে আরো মর্যাদাপূর্ণ করেছে। বাংলা ভাষাভাষী হিসেবে আমাদের করেছে সম্মানিত।
বাংলা ভাষা এক সহ¯্রাব্দ অতিক্রম করে আরেকটি নতুন সহ¯্রাব্দের দিকে যাত্রা শুরু করেছে। শুরু থেকেই বাংলা ভাষার যাত্রাপথ নানা সংকটে আকীর্ণ ছিলÑ এখনও বাংলা ভাষার আকাশ থেকে সংকটের কালো মেঘ পুরোপুরি সরে যায়নি। প্রতিনিয়তই বাংলা ভাষা নানামুখী চক্রান্তের মুখোমুখি হচ্ছে। সে সব চক্রান্ত ছিন্ন করে বাংলা ভাষা এগিয়ে যাচ্ছে তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে। পৃথিবীতে যত ভাষা আছে সেসব ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষাই সবচেয়ে সংগ্রামী আর প্রতিবাদী। বারবার বাংলা ভাষার উপর আক্রমণ এসেছে বারবারই বাংলা ভাষা সেসব আক্রমণ প্রতিহত করে আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। এখনো বাংলা ভাষা তার আত্মমর্যাদা রক্ষার্থে অবিরাম লড়াই করে যাচ্ছে। যতদিন না বাঙালি জাতি বাংলা ভাষাকে মনে প্রাণে ধারণ করবে, ততদিন বাংলা ভাষাকে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে যেতেই হবে। আত্মপ্রতিষ্ঠার এই অবিরাম লড়াই থেকে যেদিন বাংলা ভাষা ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে সরে দাঁড়াবে সেদিনই তার পতন অনিবার্য হয়ে উঠবে। তবে আশার কথা হলো বাংলা ভাষা মৃতুঞ্জয়। এ ভাষার কোনো লয় নেই, ক্ষয় নেই, ধ্বংস নেই। মাঝে মাঝে ভিনদেশি রাক্ষুসে ভাষা এসে বাংলা ভাষাকে গ্রাস করতে চায় বটে কিন্তু বাংলা ভাষা এমনই এক মৃত্যুহীন ভাষা যে একে কিছু সময়ের জন্য বন্দী করা যায় কিন্তু চিরতরে ধ্বংস করা যায় না। অবিনশ্বর বাঙালি জাতি সত্তার মতো বাংলা ভাষাও অমর, অজর, মৃত্যুহীন।
মুঘল আমলে ফারাসি যখন রাজভাষা হিসেবে প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন বাংলা ভাষা তার নিজস্ব ভূখ-েই কোণঠাসা হয়ে পড়ে। রাজার অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য এবং সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার জন্য এই ভূখ-েরই একদল লোক ফারসি ভাষা চর্চা করতে উঠে পড়ে লাগে। আরেকটি দল থেকে যায় দরিদ্র বাংলা ভাষার কাছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ফারসি ভাষা বাংলা ভাষার উপর চাবুক মারতে থাকে, ফারসি ভাষা বাংলাকে গ্রাস করতে চায় কিন্তু পারে না। মরতে মরতে বেঁচে যায় বাংলা ভাষা। মুঘলদের পরে ইংরেজরা এলে বাংলা ভাষার উপর শুরু হয় নতুন অত্যাচার। তখনও বাংলা ভাষার বন্ধনকে উপেক্ষা করে, ভুলে গিয়ে বাংলা ভাষার মহিমা একদল সুবিধাভোগী ইংরেজি ভাষাকে সাদরে গ্রহণ করে। তারা হয়ে ওঠে কালো সাহেব। তাদের ভাবখানা এমন যেন বাংলা তাদের বৈমাত্রেয় বোন। তারা এড়িয়ে চলতে থাকে বাংলা ভাষার সংস্পর্শ। বাংলাকে তারা শুধু অনাদর আর অবহেলা করেই ক্ষান্ত হলেন না তারা বাংলাকে ‘ল্যাংগয়েজ অব ফিসারম্যান’ বলতে শুরু করেন। এদের মধ্যে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩ খ্রি.)-ও ছিলেন। কিন্তু যখন তার মোহ ভঙ্গ হয় তখন তিনি ঠিকই এসে মুখ লুকান বাংলা ভাষার আঁচলতলে। বঙ্কিমচন্দ্রও প্রথম প্রথম ইংরেজি ভাষা চর্চা শুরু করেছিলেন। কিন্তু তিনিও অবশেষে আশ্রয় নিয়েছেন বাংলার কুঁড়েঘরে।
বাংলা ভূখ- যখন ব্রিটিশ মুক্ত হলো তখন আশায় বুক বাঁধে বাংলা ভাষা। বাংলা ভাষা ভাবতে শুরু করে তার দুঃখের রাত বুঝি শেষ হয়ে গেল। কিন্তু না, নতুন করে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় উর্দু নামের এক অদ্ভুত ভাষা। উর্দু বাংলার বিরুদ্ধে এমনই ষড়যন্ত্র শুরু করে যে, বাংলা ভাষার তখন নাভিশ্বাস উঠে যায়। ফারসি, ইংরেজি ভাষার উৎপাত বাঙালিরা মেনে নিলেও উর্দুর বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। বলতে গেলে উর্দুর হাত থেকে বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার আন্দোলনই বাঙালির প্রথম ভাষা রক্ষা বিষয়ক আন্দোলন। এর আগে বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার জন্য কোনো সংঘবদ্ধ আন্দোলন আর গড়ে ওঠেনি। উর্দুর বিরুদ্ধে চার বছর বাঙালি রক্তঝরা ভাষা আন্দোলন করে। ১৯৪৮ সালে যে আন্দোলন শুরু হয় তার সমাপ্তি ঘটে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে। এর মাঝে ঘটে যায় অনেক ঘটনা। অনেক প্রাণ বিসর্জিত হয় রাজপথে। জেল-জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেন অনেক ভাষা সৈনিক। অসংখ্য মানুষের প্রাণদান আর নির্যাতনের বিনিময়ে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পায় বাংলা ভাষা। ১৯৫২ সালই সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত যে মুহূর্তে বাংলা ভূখ-ে বাংলা ভাষা প্রথম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পায়।
বাংলা সাহিত্যের একমাত্র প্রাচীন গ্রন্থ ‘চর্যাপদ’। চর্যাপদের ভাষা বাংলা ভাষা বলেই আজ স্বীকৃত। চর্যাপদের ভাষা দিয়েই বাংলা ভাষার বয়স যদি হিসাব করা হয়, তাহলে দেখবো যে যুগে চর্যাপদ রচিত হয়েছে সে যুগে অভিজাত কেউ বাংলা ভাষার চর্চা করেননি। চর্যাপদ যারা রচনা করেছিলেন তারা প্রায় প্রত্যেকেই ছিলেন পলাতক মানুষ। তারা স্থির হয়ে কেউই বাংলা ভাষা চর্চা করার সুযোগ পাননি। যদি পেতেনই তাহলে শুধু একখানা গ্রন্থ রচনা করেই তারা ক্ষান্ত হতেন না, তাদের হাত দিয়ে আমরা আরো অসংখ্য গ্রন্থ পেতাম। তাছাড়া চর্যাপদ আবিষ্কারের মধ্যেও আছে চমৎকার বিস্ময। বাংলা ভাষার গ্রন্থ বাংলা ভূখ- পাওয়া গেল না, এটা পাওয়া গেল নেপালে। কেন বাংলা ভাষার গ্রন্থ নেপালে আবিষ্কৃত হলোÑ এ সম্পর্কেও নতুন করে গবেষণা হওয়া দরকার।
মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম তাঁর ‘নুরনামা’ গ্রন্থে বলেছিলেনÑ
“যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি।”
কেন আবদুল হাকিম এ কথা বলেছিলেন তা আজ অনেকেরই জানা। কেননা তখনও একদল বাংলা ভাষা বিদ্বেষী মানুষ ছিলেন যারা বাংলা ভাষাকে মোটেই সুনজরে দেখতেন না। বাংলা ভূখ-ে এক শ্রেণির মানুষ বাস করে যারা এদেশের খায়, এদেশের পরে কিন্তু স্বপ্ন দেখে ইরান, তুরান, ইউরোপের, পাকিস্তানের। এরা পরগাছার মতো। এদের ভাষাপ্রেম তো নেই-ই, দেশপ্রেমও নেই। দেশপ্রেম আর ভাষাপ্রেম পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যার দেশপ্রেম থাকে তার ভাষাপ্রেমও থাকে। যার দেশপ্রেম থাকে না, তার ভাষাপ্রেমও লোপ পায়।
যুগে যুগে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে যে কত রকম ষড়যন্ত্র হয়েছে তার দুই-একটি নমুনা তুলে ধরতে চাই। ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে ‘রওশন হেদায়েত’ নামে একটি পত্রিকা তার ‘লেখক-লেখিকাগণের প্রতি’ নিবেদন করে বলেÑ “হিন্দুয়ানী বাঙালি না হইয়া দোভাষী অর্থাৎ বাঙ্গালা ভাষার মধ্যে আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষা প্রয়োগ বাঞ্ছনীয়। অ-ইসলামিক শব্দ যেরূপ স্বর্গ, নরক, যুগ, ত্রিভুবন, ঈশ্বর, ভগবান, নিরঞ্জন, বিধাতা ইত্যাদি প্রবন্ধে থাকিলে, সে প্রবন্ধ বাহির হইবে না। লেখকগণের খেয়াল করা দরকার, বোজর্গানে দীনে যখন এদেশে ইসলাম প্রচার করেছিলেন তখন তাঁহারা এদেশের ভাষার মধ্যে ইসলামিক ভাষা প্রবেশ করাইয়া সর্বসাধারণকে ইসলাম শিক্ষা দিয়াছিলেন। ‘রওশন হেদায়েতে’রও প্রধান উদ্দেশ্য ইসলাম শিক্ষা দেওয়া; কাজেই কালামে কুফর প্রকাশ হওয়া উচিত নয়।” অর্থাৎ যারা মনে করে আরবি, ফারসি, উর্দু ছাড়া অন্য ভাষা গ্রহণ করলেই বাংলা ভাষার চরিত্র নষ্ট হয় তারা প্রকারান্তরে বাংলা ভাষার শত্রুই। পৃথিবীতে হাতেগোনা কয়েকটি ভাষা ছাড়া সব ভাষার মধ্যই প্রচুর ঋণ শব্দ আছে। বাংলা ভাষার মধ্যেও প্রচুর ঋণ শব্দ ঢুকে পড়েছে কিংবা বলা যায়Ñ নিজের প্রয়োজনেই বাংলা ভাষা বিদেশি শব্দ ঋণ নিয়েছে। ধর্ম বিচার করে যারা শব্দ বিচার করে তাদের উদ্দেশ্যে বলতেই হয়Ñ আল্লাহ, খোদা, নামাজ, রোজা, এবাদত, রাসুল, আদমÑ এগুলো বাংলা শব্দ নয় এবং আমাদের ভূখ-ের শব্দও নয়। জেনে শুনেই আমরা এই শব্দগুলো আত্মীকৃত করেছি।
অধ্যাপক যতীন সরকার তার একটি প্রবন্ধে (বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার সম্পর্ক নিয়ে হিন্দু-মুসলমানি কা-) বলেছেনÑ ‘বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা বাংলা না উর্দু?’Ñ এই অদ্ভুত প্রশ্নটি তো উনিশ শতকেই উঠেছিল। সে সময়েই তো নবাব আবদুল লতিফ মুসলমানের মাতৃভাষা যে উর্দু সে বিষয়ে স্থির নিশ্চিত ছিলেন। তবে, নি¤œশ্রেণির যে সব মুসলমান উর্দুকে ঠিক মতো রপ্ত করে উঠতে পারেনি, তাদের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য তিনি ‘মুসলমানি বাংলা’র সুপারিশ করেছিলেন। সেই মুসলমানি বাংলা হবে প্রচলিত বাংলা থেকে আলাদা, সংস্কৃতের বদলে এতে থাকবে সেইসব আরবি-ফারসি শব্দ যেগুলো উর্দু ভাষায় বহু ব্যবহৃত। নবাব আবদুল লতিফরা হয়তো বিশ্বাস করতেন যে এরকম মুসলমানি বাংলার পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ‘আতরাফ’ মুসলমানরা এক সময় উর্দুর মঞ্জিলে পৌঁছে ‘আশরাফ’দের কাতারে শামিল হয়ে যেতে পারবে।”
নবাব আবদুল লতিফগংদের মতো এরকম আরো অসংখ্য ষড়যন্ত্র ও নীলনকশা একদিন বাংলা ভাষাকে ঘিরে ধরে ছিল। দুর্মর বাংলা ভাষা সেসব অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে আজ গৌরবের মর্যাদায় আসীন। এখানে অবশ্য একটি কথা না বললেই নয় যে, বাংলা ভাষাই এশিয়া মহাদেশে প্রথম ভাষা যে ভাষার কবি (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) নোবেল পুরস্কার ঘোষিত হওয়ার মাত্র তেরো বছরের মাথায় এই দুর্লভ পুরস্কারে ভূষিত হন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যে লড়াই শুরু হয়েছিল ও রক্ত ঝরেছিল, ১৯৯৯ সালে তা মর্যাদা পায় ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এর। সারা পৃথিবীর মানুষ আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে জানতে ও বুঝতে শিখছে। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটা খবর। যে ভাষাকে একদিন গলাটিপে হত্যা করার চক্রান্ত হয়েছিল সেই ভাষার সম্মানার্থেই আজ পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। এর চেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার আর কি হতে পারে। তবু দুশ্চিন্তার ব্যাপার হচ্ছে, এখনো বাংলা ভাষা সর্বস্তরে সমানভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া ক্রীতদাসেরা এখনও বাংলার বদলে ইংরেজি আওড়াতে বেশি সম্মানিত বোধ করে। প্রতিক্রিয়াশীল, মৌলবাদীরা এখনও স্বপ্ন দেখে এদেশে আবার ফিরে আসবে আরবি, ফারসি, উর্দু মিশেল খিচুড়ি ভাষা, বাংলা বিদ্বেষী এই কুলাঙ্গারেরা শুধু বাংলা ভাষারই শত্রু নয়, এরা বাংলাদেশেরও শত্রু। এদের যথাযথভাবে প্রতিহত করতে হলে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন করা এখন সময়ের দাবি। যদিও এই দাবি অনেক আগে থেকেই উঠেছে।
বর্তমান সরকার বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ বান্ধব সরকার। বঙ্গবন্ধুর হাতেই নির্মিত হয়েছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উপাখ্যান। বাংলা ভাষার বৈশ্বিক মর্যাদাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার হাতে। যদি আমরা সত্যি সত্যিই বাংলা ভাষাকে দেশের মাটিতে এবং বিদেশিদের কাছে মূল্যবান করে তুলতে চাই, তাহলে এখনই সুযোগ সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন ঘটানোÑ কেননা এমন সুযোগ অতীতে কখনো আসেনি। ভবিষ্যতেও আসবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। বাংলা ভাষা দীর্ঘজীবী হোক, আত্মমর্যাদায় বলিয়ান হোক আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষা।
১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮
বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি। রাজপথে বলি দিয়েছি অনেক তাজা প্রাণ। বুকের রক্ত ঢেলে পৃথিবীর আর কোনো দেশ আমাদের মতো মাতৃভাষাকে রক্ষা করতে পারেনি। ভাষা আন্দোলনের লড়াই আমাদের বাঁচতে শিখিয়েছে। এই লড়াইয়েরই চূড়ান্ত ফসল আমাদের বহুল আকাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা মূলত বাংলা ভাষা রক্ষার আন্দোলনের সোনালি ফসল। বাংলার কবি অতুল প্রসাদ সেন বলেছিলেনÑ ‘মোদের গরব মোদের আশা/আ মরি বাংলা ভাষা’। বাংলা ভাষা যে বাঙালির গৌরব বৃদ্ধি করে চলেছে, তার প্রমাণ ইত:পূর্বে আমরা বহুবার পেয়েছি। সম্প্রতিও পেলাম বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতির মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাংলা ভাষার গৌরবকে আরো মর্যাদাপূর্ণ করেছে। বাংলা ভাষাভাষী হিসেবে আমাদের করেছে সম্মানিত।
বাংলা ভাষা এক সহ¯্রাব্দ অতিক্রম করে আরেকটি নতুন সহ¯্রাব্দের দিকে যাত্রা শুরু করেছে। শুরু থেকেই বাংলা ভাষার যাত্রাপথ নানা সংকটে আকীর্ণ ছিলÑ এখনও বাংলা ভাষার আকাশ থেকে সংকটের কালো মেঘ পুরোপুরি সরে যায়নি। প্রতিনিয়তই বাংলা ভাষা নানামুখী চক্রান্তের মুখোমুখি হচ্ছে। সে সব চক্রান্ত ছিন্ন করে বাংলা ভাষা এগিয়ে যাচ্ছে তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে। পৃথিবীতে যত ভাষা আছে সেসব ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষাই সবচেয়ে সংগ্রামী আর প্রতিবাদী। বারবার বাংলা ভাষার উপর আক্রমণ এসেছে বারবারই বাংলা ভাষা সেসব আক্রমণ প্রতিহত করে আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। এখনো বাংলা ভাষা তার আত্মমর্যাদা রক্ষার্থে অবিরাম লড়াই করে যাচ্ছে। যতদিন না বাঙালি জাতি বাংলা ভাষাকে মনে প্রাণে ধারণ করবে, ততদিন বাংলা ভাষাকে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে যেতেই হবে। আত্মপ্রতিষ্ঠার এই অবিরাম লড়াই থেকে যেদিন বাংলা ভাষা ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে সরে দাঁড়াবে সেদিনই তার পতন অনিবার্য হয়ে উঠবে। তবে আশার কথা হলো বাংলা ভাষা মৃতুঞ্জয়। এ ভাষার কোনো লয় নেই, ক্ষয় নেই, ধ্বংস নেই। মাঝে মাঝে ভিনদেশি রাক্ষুসে ভাষা এসে বাংলা ভাষাকে গ্রাস করতে চায় বটে কিন্তু বাংলা ভাষা এমনই এক মৃত্যুহীন ভাষা যে একে কিছু সময়ের জন্য বন্দী করা যায় কিন্তু চিরতরে ধ্বংস করা যায় না। অবিনশ্বর বাঙালি জাতি সত্তার মতো বাংলা ভাষাও অমর, অজর, মৃত্যুহীন।
মুঘল আমলে ফারাসি যখন রাজভাষা হিসেবে প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন বাংলা ভাষা তার নিজস্ব ভূখ-েই কোণঠাসা হয়ে পড়ে। রাজার অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য এবং সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার জন্য এই ভূখ-েরই একদল লোক ফারসি ভাষা চর্চা করতে উঠে পড়ে লাগে। আরেকটি দল থেকে যায় দরিদ্র বাংলা ভাষার কাছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ফারসি ভাষা বাংলা ভাষার উপর চাবুক মারতে থাকে, ফারসি ভাষা বাংলাকে গ্রাস করতে চায় কিন্তু পারে না। মরতে মরতে বেঁচে যায় বাংলা ভাষা। মুঘলদের পরে ইংরেজরা এলে বাংলা ভাষার উপর শুরু হয় নতুন অত্যাচার। তখনও বাংলা ভাষার বন্ধনকে উপেক্ষা করে, ভুলে গিয়ে বাংলা ভাষার মহিমা একদল সুবিধাভোগী ইংরেজি ভাষাকে সাদরে গ্রহণ করে। তারা হয়ে ওঠে কালো সাহেব। তাদের ভাবখানা এমন যেন বাংলা তাদের বৈমাত্রেয় বোন। তারা এড়িয়ে চলতে থাকে বাংলা ভাষার সংস্পর্শ। বাংলাকে তারা শুধু অনাদর আর অবহেলা করেই ক্ষান্ত হলেন না তারা বাংলাকে ‘ল্যাংগয়েজ অব ফিসারম্যান’ বলতে শুরু করেন। এদের মধ্যে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩ খ্রি.)-ও ছিলেন। কিন্তু যখন তার মোহ ভঙ্গ হয় তখন তিনি ঠিকই এসে মুখ লুকান বাংলা ভাষার আঁচলতলে। বঙ্কিমচন্দ্রও প্রথম প্রথম ইংরেজি ভাষা চর্চা শুরু করেছিলেন। কিন্তু তিনিও অবশেষে আশ্রয় নিয়েছেন বাংলার কুঁড়েঘরে।
বাংলা ভূখ- যখন ব্রিটিশ মুক্ত হলো তখন আশায় বুক বাঁধে বাংলা ভাষা। বাংলা ভাষা ভাবতে শুরু করে তার দুঃখের রাত বুঝি শেষ হয়ে গেল। কিন্তু না, নতুন করে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় উর্দু নামের এক অদ্ভুত ভাষা। উর্দু বাংলার বিরুদ্ধে এমনই ষড়যন্ত্র শুরু করে যে, বাংলা ভাষার তখন নাভিশ্বাস উঠে যায়। ফারসি, ইংরেজি ভাষার উৎপাত বাঙালিরা মেনে নিলেও উর্দুর বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। বলতে গেলে উর্দুর হাত থেকে বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার আন্দোলনই বাঙালির প্রথম ভাষা রক্ষা বিষয়ক আন্দোলন। এর আগে বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার জন্য কোনো সংঘবদ্ধ আন্দোলন আর গড়ে ওঠেনি। উর্দুর বিরুদ্ধে চার বছর বাঙালি রক্তঝরা ভাষা আন্দোলন করে। ১৯৪৮ সালে যে আন্দোলন শুরু হয় তার সমাপ্তি ঘটে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে। এর মাঝে ঘটে যায় অনেক ঘটনা। অনেক প্রাণ বিসর্জিত হয় রাজপথে। জেল-জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেন অনেক ভাষা সৈনিক। অসংখ্য মানুষের প্রাণদান আর নির্যাতনের বিনিময়ে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পায় বাংলা ভাষা। ১৯৫২ সালই সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত যে মুহূর্তে বাংলা ভূখ-ে বাংলা ভাষা প্রথম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পায়।
বাংলা সাহিত্যের একমাত্র প্রাচীন গ্রন্থ ‘চর্যাপদ’। চর্যাপদের ভাষা বাংলা ভাষা বলেই আজ স্বীকৃত। চর্যাপদের ভাষা দিয়েই বাংলা ভাষার বয়স যদি হিসাব করা হয়, তাহলে দেখবো যে যুগে চর্যাপদ রচিত হয়েছে সে যুগে অভিজাত কেউ বাংলা ভাষার চর্চা করেননি। চর্যাপদ যারা রচনা করেছিলেন তারা প্রায় প্রত্যেকেই ছিলেন পলাতক মানুষ। তারা স্থির হয়ে কেউই বাংলা ভাষা চর্চা করার সুযোগ পাননি। যদি পেতেনই তাহলে শুধু একখানা গ্রন্থ রচনা করেই তারা ক্ষান্ত হতেন না, তাদের হাত দিয়ে আমরা আরো অসংখ্য গ্রন্থ পেতাম। তাছাড়া চর্যাপদ আবিষ্কারের মধ্যেও আছে চমৎকার বিস্ময। বাংলা ভাষার গ্রন্থ বাংলা ভূখ- পাওয়া গেল না, এটা পাওয়া গেল নেপালে। কেন বাংলা ভাষার গ্রন্থ নেপালে আবিষ্কৃত হলোÑ এ সম্পর্কেও নতুন করে গবেষণা হওয়া দরকার।
মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম তাঁর ‘নুরনামা’ গ্রন্থে বলেছিলেনÑ
“যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি।”
কেন আবদুল হাকিম এ কথা বলেছিলেন তা আজ অনেকেরই জানা। কেননা তখনও একদল বাংলা ভাষা বিদ্বেষী মানুষ ছিলেন যারা বাংলা ভাষাকে মোটেই সুনজরে দেখতেন না। বাংলা ভূখ-ে এক শ্রেণির মানুষ বাস করে যারা এদেশের খায়, এদেশের পরে কিন্তু স্বপ্ন দেখে ইরান, তুরান, ইউরোপের, পাকিস্তানের। এরা পরগাছার মতো। এদের ভাষাপ্রেম তো নেই-ই, দেশপ্রেমও নেই। দেশপ্রেম আর ভাষাপ্রেম পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যার দেশপ্রেম থাকে তার ভাষাপ্রেমও থাকে। যার দেশপ্রেম থাকে না, তার ভাষাপ্রেমও লোপ পায়।
যুগে যুগে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে যে কত রকম ষড়যন্ত্র হয়েছে তার দুই-একটি নমুনা তুলে ধরতে চাই। ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে ‘রওশন হেদায়েত’ নামে একটি পত্রিকা তার ‘লেখক-লেখিকাগণের প্রতি’ নিবেদন করে বলেÑ “হিন্দুয়ানী বাঙালি না হইয়া দোভাষী অর্থাৎ বাঙ্গালা ভাষার মধ্যে আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষা প্রয়োগ বাঞ্ছনীয়। অ-ইসলামিক শব্দ যেরূপ স্বর্গ, নরক, যুগ, ত্রিভুবন, ঈশ্বর, ভগবান, নিরঞ্জন, বিধাতা ইত্যাদি প্রবন্ধে থাকিলে, সে প্রবন্ধ বাহির হইবে না। লেখকগণের খেয়াল করা দরকার, বোজর্গানে দীনে যখন এদেশে ইসলাম প্রচার করেছিলেন তখন তাঁহারা এদেশের ভাষার মধ্যে ইসলামিক ভাষা প্রবেশ করাইয়া সর্বসাধারণকে ইসলাম শিক্ষা দিয়াছিলেন। ‘রওশন হেদায়েতে’রও প্রধান উদ্দেশ্য ইসলাম শিক্ষা দেওয়া; কাজেই কালামে কুফর প্রকাশ হওয়া উচিত নয়।” অর্থাৎ যারা মনে করে আরবি, ফারসি, উর্দু ছাড়া অন্য ভাষা গ্রহণ করলেই বাংলা ভাষার চরিত্র নষ্ট হয় তারা প্রকারান্তরে বাংলা ভাষার শত্রুই। পৃথিবীতে হাতেগোনা কয়েকটি ভাষা ছাড়া সব ভাষার মধ্যই প্রচুর ঋণ শব্দ আছে। বাংলা ভাষার মধ্যেও প্রচুর ঋণ শব্দ ঢুকে পড়েছে কিংবা বলা যায়Ñ নিজের প্রয়োজনেই বাংলা ভাষা বিদেশি শব্দ ঋণ নিয়েছে। ধর্ম বিচার করে যারা শব্দ বিচার করে তাদের উদ্দেশ্যে বলতেই হয়Ñ আল্লাহ, খোদা, নামাজ, রোজা, এবাদত, রাসুল, আদমÑ এগুলো বাংলা শব্দ নয় এবং আমাদের ভূখ-ের শব্দও নয়। জেনে শুনেই আমরা এই শব্দগুলো আত্মীকৃত করেছি।
অধ্যাপক যতীন সরকার তার একটি প্রবন্ধে (বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার সম্পর্ক নিয়ে হিন্দু-মুসলমানি কা-) বলেছেনÑ ‘বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা বাংলা না উর্দু?’Ñ এই অদ্ভুত প্রশ্নটি তো উনিশ শতকেই উঠেছিল। সে সময়েই তো নবাব আবদুল লতিফ মুসলমানের মাতৃভাষা যে উর্দু সে বিষয়ে স্থির নিশ্চিত ছিলেন। তবে, নি¤œশ্রেণির যে সব মুসলমান উর্দুকে ঠিক মতো রপ্ত করে উঠতে পারেনি, তাদের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য তিনি ‘মুসলমানি বাংলা’র সুপারিশ করেছিলেন। সেই মুসলমানি বাংলা হবে প্রচলিত বাংলা থেকে আলাদা, সংস্কৃতের বদলে এতে থাকবে সেইসব আরবি-ফারসি শব্দ যেগুলো উর্দু ভাষায় বহু ব্যবহৃত। নবাব আবদুল লতিফরা হয়তো বিশ্বাস করতেন যে এরকম মুসলমানি বাংলার পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ‘আতরাফ’ মুসলমানরা এক সময় উর্দুর মঞ্জিলে পৌঁছে ‘আশরাফ’দের কাতারে শামিল হয়ে যেতে পারবে।”
নবাব আবদুল লতিফগংদের মতো এরকম আরো অসংখ্য ষড়যন্ত্র ও নীলনকশা একদিন বাংলা ভাষাকে ঘিরে ধরে ছিল। দুর্মর বাংলা ভাষা সেসব অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে আজ গৌরবের মর্যাদায় আসীন। এখানে অবশ্য একটি কথা না বললেই নয় যে, বাংলা ভাষাই এশিয়া মহাদেশে প্রথম ভাষা যে ভাষার কবি (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) নোবেল পুরস্কার ঘোষিত হওয়ার মাত্র তেরো বছরের মাথায় এই দুর্লভ পুরস্কারে ভূষিত হন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যে লড়াই শুরু হয়েছিল ও রক্ত ঝরেছিল, ১৯৯৯ সালে তা মর্যাদা পায় ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এর। সারা পৃথিবীর মানুষ আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে জানতে ও বুঝতে শিখছে। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটা খবর। যে ভাষাকে একদিন গলাটিপে হত্যা করার চক্রান্ত হয়েছিল সেই ভাষার সম্মানার্থেই আজ পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। এর চেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার আর কি হতে পারে। তবু দুশ্চিন্তার ব্যাপার হচ্ছে, এখনো বাংলা ভাষা সর্বস্তরে সমানভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া ক্রীতদাসেরা এখনও বাংলার বদলে ইংরেজি আওড়াতে বেশি সম্মানিত বোধ করে। প্রতিক্রিয়াশীল, মৌলবাদীরা এখনও স্বপ্ন দেখে এদেশে আবার ফিরে আসবে আরবি, ফারসি, উর্দু মিশেল খিচুড়ি ভাষা, বাংলা বিদ্বেষী এই কুলাঙ্গারেরা শুধু বাংলা ভাষারই শত্রু নয়, এরা বাংলাদেশেরও শত্রু। এদের যথাযথভাবে প্রতিহত করতে হলে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন করা এখন সময়ের দাবি। যদিও এই দাবি অনেক আগে থেকেই উঠেছে।
বর্তমান সরকার বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ বান্ধব সরকার। বঙ্গবন্ধুর হাতেই নির্মিত হয়েছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উপাখ্যান। বাংলা ভাষার বৈশ্বিক মর্যাদাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার হাতে। যদি আমরা সত্যি সত্যিই বাংলা ভাষাকে দেশের মাটিতে এবং বিদেশিদের কাছে মূল্যবান করে তুলতে চাই, তাহলে এখনই সুযোগ সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন ঘটানোÑ কেননা এমন সুযোগ অতীতে কখনো আসেনি। ভবিষ্যতেও আসবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। বাংলা ভাষা দীর্ঘজীবী হোক, আত্মমর্যাদায় বলিয়ান হোক আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষা।
৩১ ডিসেম্বর, ২০১৭
Nuclear power plans
Building a nuclear power plant in Bangladesh was proposed in 1961. Since then a number of reports have affirmed the technical and economic feasibility. The Rooppur site in Pabna district about 160 km northwest of Dhaka was selected in 1963 and land was acquired. The government gave formal approval for a succession of plant proposals, then after independence a 125 MWe nuclear power plant proposal was approved in 1980 but not built.
With growth in demand and grid capacity since then, a much larger plant looked feasible, and the Awami League government in 1999 expressed its firm commitment to build this Rooppur plant. In 2001 it adopted a national Nuclear Power Action.
Russia, China and South Korea had earlier offered financial and technical help to establish nuclear power, and in March 2009 Russia made a formal proposal to build a nuclear power plant in the country. In May 2009 a bilateral nuclear cooperation agreement was signed with Russia. In April 2009 the government approved the Russian proposal to build a 1000 MWe AES-92 nuclear plant at Rooppur for about $2 billion, and a year later this had become two such reactors by 2017. A nuclear energy bill was introduced into parliament in May 2012, with work to begin in 2013, and setting up a Bangladesh Atomic Energy Regulatory Authority. Parliament was told that 5000 MWe of nuclear capacity was envisaged by 2030, and a second plant would be built in the south once Rooppur is operating.
In May 2010 an intergovernmental agreement was signed with Russia, providing a legal basis for nuclear cooperation in areas such as siting, design, construction and operation of power and research nuclear reactors, water desalination plants, and elementary particle accelerators. Other areas covered included fuel supply and wastes– Russia will manage wastes and decommissioning.
An agreement with ROSATOM was signed in February 2011 for two 1000 MWe-class reactors to be built at Rooppur for the Bangladesh Atomic Energy Commission (BAEC). Rooppur is close to a HVDC link with India and on the route of a planned 600 kV HVDC link running up the western side of the country. Another intergovernmental agreement was signed in November 2011 for the project to be built by AtomStroyExport. In 2014 Moscow AEP said that the plant would be an AES-2006 with a version of its V-392M reactors, with Novovoronezh II being the reference plant. Turbine generators (high speed) are expected to be from Power Machines.
Planned nuclear power reactors
Type Capacity Construction start Commercial operation
Rooppur 1 VVER-1200/V-523 1200 MWe Oct 2017 2023 or 2024
Rooppur 2 VVER-1200/V-523 1200 MWe 2018 2024 or 2025
An intergovernmental agreement for provision of a $500 million Russian loan to finance engineering surveys on the site, project development and personnel training was signed in January 2013. The $500 million loan will be repaid in 12 years with five years’ grace period. In June and October 2013, AtomStroyExport signed contracts with BAEC to prepare documentation related to the construction and environmental impact assessment for the Rooppur plant, as well as providing for necessary engineering studies, including site preparation and detailed design documentation. AtomStroyExport said that this represented a transition to long-term cooperation. A $190 million agreement for major site works to prepare for first concrete was signed in June 2014, and BAEC authorized this in September, to be completed by 2016.
All we need to know about Rooppur Nuclear Power Programme
Design of the containment building to be used at Rooppur Nuclear Power Plant.
source: Rooppur Nuclear Power Plant Project Brochure
Bangladesh has been maintaining robust growth over the last two decades. The present government is committed to elevate the country to the status of a middle income country by 2021 and a developed country by 2041. For this vision to be materialised a huge supply of energy in the form of electricity will be required in a secured and affordable manner. Our indigenous resource of primary energy would be inadequate to meet the entire demand.
Globally, nuclear power is considered to be one of the cheapest and reliable sources of electricity. Virtually, it emits no greenhouse gases. Considering international experience, Bangladesh has decided to develop its own nuclear power programme. The government has plans to generate at least 4000MW electricity from nuclear sources by 2030.
Over the last several years, Bangladesh has made a significant progress in development of the power sector. Presently, Bangladesh is implementing a master plan to produce 24,000 MW, 40,000 MW and 60,000 MW in the year 2021. 2030 and 2041, respectively. The Power System Master Plan (PSMP), 2016 aims to ensure supply of electricity to all citizen and economic sectors at affordable costs at all times through a well-balanced power generation environment that maximizes the respective advantages of different types of power generation methods, including nuclear power, thermal power, hydropower generation and will be covered by coal and gas and the remaining 30% will be by nuclear power, hydropower generation, renewables and power imports from neighboring countries. Nuclear power is considered as the base load energy and the share of nuclear electricity generation beyond 2030 will be about 10% of the total power generation.
On November 30, the ceremony of first concrete pouring by Prime Minister Sheikh Hasina into the reactor building foundation has taken place at Rooppur NPP. This event marks the start of construction of the country’s first nuclear power plant under Sheikh Hasina’s govt.
Bangladesh will have the safest and most environmentally friendly nuclear power plant, which will provide a quality solution to country’s ever increasing power demand boost scientific and technological growth, create new job opportunities and facilitate socio-economic development.
Rooppur Nuclear Power Plant will be equipped with two units, each of 1200 MW capacity. In project construction, will be used the most advanced 3+ generation technology, which complies with the latest safety requirements of the International Atomic Energy Agency (IAEA). This type of reactor with the unique combination of active and passive safety systems was first commissioned in Russia’s Novovoronezh Nuclear Power Plant in March 2016. The power unit made the list of top three awardees of Power Awards 2017 in the Best Power Plant category according to POWER Magazine (USA). The Russian WER 1200 brought home the award in the Top Plant nomination.
Today, ROSATOM is the global leader in terms of the number of simultaneously implemented nuclear reactor construction projects at various stages, 8 in Russia and 34 in 12 other countries. ROSATOM offering all-encompassing solutions for Bangladesh and other partners, which include support at every stage of national nuclear power program. ROSATOM, other than implementing the Rooppur Nuclear Power Plan project is extending its support and cooperation to Bangladesh in development of national nuclear infrastructure and human resources, management of spent nuclear fuel as well as developing of local industry among many others. There will encouraging and trying to ensure maximum participation of local companies in the process.
The IAEA has been supporting Bangladesh from its early phase of nuclear power programme. The Agency (IAEA) has been organizing training courses, workshops, fellowship and scientific visit programmes, educational seminars and with access to accumulated expertise in nuclear power to develop human resources of our country. The Agency’s Integrated Nuclear Infrastructure Review (INIR) mission, conducted in 2011 recognized that Bangladesh is on progress in building its first NPP. The INIR mission team concluded that Bangladesh reached Milestone 1, having ‘made a knowledgeable decision’ regarding its nuclear power program and the country has stepped into Phase-2, in the stage of preparation to negotiate the agreement(s)/contract(s) with the selected NPP vendor. The INIR mission provided recommendations and suggestions on how to make further improvements. An Integrated Work Plan (IWP) for Bangladesh infrastructure development was developed through collaboration of the IAEA for the period 2012-2015 that provided a framework for the IAEA assistance to Bangladesh. Bangladesh had initiated its actions responding to all recommendations and suggestions provided by the 2011 INIR mission.
The construction of this NPP is going to enhance the development of social and economic, scientific and technological potential of the country and promoting Bangladesh to become a member of the elite ‘Nuclear Club’ of countries, which have nuclear technologies for power generation. The Rooppur NPP project is the largest infrastructure project in Bangladesh. Bangladesh started preparatory construction activities in 2013. Now the nation is celebrating the first concrete pouring of the unit 1 of Rooppur NPP on 30 November. Hopefully, the two units of Rooppur NPP will go into operation by 2023 and in 2024 respectively. Rooppur NPP will play an important role in providing a stable base load and ensuring energy security of our nation. For 60 years, our country has had a dream of building its own NPP. We all are happy that we are proceeding steadily towards fulfilling our dream. I have the pleasure to mentioned here that I was the First Secretary of Science & Technology department of Awami League Central Committee in 1990. There was no such post in Awami League before. In technology & Research also Bangladesh has developed, we have built NOVO THEATRE, SATELLITE will be placed in Space in near future. Due to Research in different sectors Rice, Jute, Fishery, Poultry & different vegetable items we have achieved grand success.
05 December, 2017