• 23 Chamelibagh, Dhaka-1217
  • +88-02-9333543
  • bfdrms@gmail.com

Category Page: Recent News

১০ জানুয়ারি ’৭২ : স্বর্ণাক্ষরে লেখা ঐতিহাসিক দিন

লন্ডনের হোটেল ‘ক্ল্যারিজস’। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ঐ দিনই লন্ডনে পৌঁছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিুবর রহমান। হোটেল লবিতে জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি যতদ্রুত দেশে ফিরতে চাই। আমার জনগণকে ছেড়ে আমি এক মুহূর্ত শান্তি পাচ্ছি না।’ মহান নেতার এ কথায় অভিভূত হয়ে পড়েন ব্রিটেনের সাংবাদিকরা। প্রায় দশ মাস পাকিস্তানের কারাগারে একাধিকবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা মহান পুরুষ মুক্তি লাভ করে আগে ভাবছেন তার দেশের জনগণের কথা। স্মরণ করেছেন মুক্তিযুদ্ধে বাংলার জনগণের আত্মত্যাগের কথা। বিশ্বের সাংবাদিকদের জন্যে অভিভূত হবার মতো বিশাল ঘটনা তখনো অপেক্ষা করছিলো সামনে। দিল্লী হয়ে ঢাকা ফেরার পথে ভারতের জনগণ যে রাজকীয় সংবর্ধনা দিয়েছিলো বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে, তাতে মুগ্ধ হয়েছিলো সারা বিশ্বের মানুষ। চমৎকৃত হয়েছিলো ১০ জানুয়ারি ঢাকার চিত্র দেখে। মুক্তিকামী একটি জাতির হৃদয়জ আশা-আকাক্সক্ষার কতটা ধারণা করতে পারলে বঙ্গবন্ধুর মতো বিশাল ব্যক্তিত্ব হওয়া যায়, সারা বিশ্ব তা উপলব্ধি করেছিলো।
২৫ মার্চ রাতে পাক বাহিনীর হাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হলেন। দীর্ঘ ন’মাসের যুদ্ধ শেষে বিজয় অর্জন করলো বাঙালি। কিন্তু বিজয়ের সে আনন্দ যেন অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছিলো। যে মহামানবকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে মুক্ত করে আনতে ’৬৯ এ বাংলার মানুষ সেনাবাহিনীর ব্যারিকেড ভাঙার জন্যে উন্মুক্ত হয়ে উঠেছিলো, যে মহানায়ক ’৭১-এর ৭ মার্চ চূড়ান্ত সংগ্রামের প্রস্তুতি নেবার নির্দেশ দিয়ে জনতাকে উজ্জীবিত করলেন তাঁর অনুপস্থিতিতে বাংলার মানুষ বিজয়ের পূর্ণাঙ্গ আনন্দ পাচ্ছিলো না। যুদ্ধকালীন নয় মাস বাংলার ঘরে ঘরে নির্যাতিত মানুষ প্রার্থনা করেছে বঙ্গবন্ধুর জন্যে। বিজয় অর্জনের পর ২৫ দিন আশঙ্কার দোলাচলে দুলেছে মানুষ। অবশেষে জানা গেলো বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন। দেশে আসছেন। সে সংবাদ পাবার পর গোটা দেশে কি পরিমাণ আনন্দের জোয়ার বয়ে গিয়েছিলো তা প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়া আর কেউ অনুভব করতে পারবে না।
জানুয়ারির ৮ তারিখে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। রাওয়ালপিন্ডি বিমানবন্দর থেকে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজের ৬৩৫ নং ফ্লাইটটি লন্ডনে পৌঁছালে ব্রিটেনের পররাষ্ট্র এবং কমনওয়েলথ অফিসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিমান বন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান। এ সময় ব্রিটেন প্রবাসী বাঙালিদের গগণবিদারী ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে বিমানবন্দর।
লন্ডনে বঙ্গবন্ধু হোটেল ‘ক্ল্যারিজস’এ ওঠেন। এখানে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি কথা বলেন। তাঁর প্রতি সাংবাদিকদের প্রথম প্রশ্ন ছিলো, তিনি কেন ঢাকা না গিয়ে প্রথমে ব্রিটেনে এসেছেন। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি স্বেচ্ছায় আসিনি। আমাকে লন্ডন পাঠানোর সিদ্ধান্ত পাকিস্তান সরকারের। আমি তাদের বন্দি ছিলাম।’
লন্ডনে অবস্থানকাল সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি সুনির্দিষ্ট সময় জানতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে তিনি জানান, লন্ডন ত্যাগের আগে তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। বঙ্গবন্ধু’র এ কথা প্রচারের কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্রিটেনের সরকারি কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেন, প্রধানমন্ত্রী এ্যাডওয়ার্ড হীথ এর সঙ্গে সন্ধ্যায় তার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু তার বন্দি জীবনের কথা তুলে ধরেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা প্রসঙ্গে মতামত ব্যক্ত করতে অনুরোধ জানানো হলে তিনি বলেন, ‘আমি বন্দি ছিলাম। অনেক কিছুই আমার জানার উপায় ছিলো না। আমি ঢাকায় ফিরে আমার দেশবাসীর কাছে সব জানবো।’
ব্রিটিশ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতকি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত এ সংবাদ সম্মেলন সম্পর্কে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ৫১ বছর বয়সী সুঠামদেহী শেখ মুজিবুর রহমানকে বেশ কৃশকায় দেখাচ্ছিলো। দীর্ঘ দিনের বন্দি জীবনের ছাপ পড়েছিলো তার চেহারায়। তা সত্ত্বেও তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিটি কথা উচ্চারণ করেছেন। যত দ্রুত দেশে ফেরার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমি আমার জনগণকে ছেড়ে আর এক মুহূর্ত শান্তি পাচ্ছি না। তারা প্রত্যেকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে চরম মূল্য দিয়েছে।’ ২০ মিনিট সংবাদ সম্মেলন শেষে বঙ্গবন্ধু জানান তিনি খুব ক্লান্ত। দৃঢ় কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করে তিনি তার বক্তব্য শেষ করেন। এ সময় হোটেলের বাইরে সমবেত প্রবাসী বাঙালিরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে পুরো এলাকা প্রকম্পিত করে তোলে।
এদিকে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তান সরকার বেশ কিছু সময় নীরবতা অবলম্বন করে। রাত তিনটায় রেডিও পাকিস্তান থেকে ঘোষণা দেয় হয়, ‘শেখ মুজিব’ বর্তমানে লন্ডনে রয়েছেন। তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো বিমানবন্দরে ‘শেখ মুজিব’কে বিদায় জানিয়েছেন।
এ ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত বাংলার আপামর জনগণের মধ্যে উৎকণ্ঠা বিরাজ করছিলো। ৮ তারিখেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়ার দাবি জানিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভুট্টো যদি পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষা এবং ভারতীয় উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চান, তাহলে অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে দিন।’ তাজউদ্দিন বলেন, ‘আমরা আমাদের প্রিয় নেতাকে মুক্ত করতে যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ভয় পাই না।’ তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আমেরিকা ও চীনের ন্যাক্কারজনক ভূমিকার তীব্র নিন্দা জানান।
ঐদিন সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের সঙ্গে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিট-এ সাক্ষাৎ করেন। এ সাক্ষাতের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা হয়ে থাকবে। বাংলাদেশ তখন সদ্য স্বাধীন একটি দেশ। রাষ্ট্র হিসেবে ব্রিটেনের তুলনায় কিছুই নয়। অথচ মহাপরাক্রমশালী ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী সে সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর বাসার সামনে। বৈঠকে শেখ মুজিবুর রহমান ব্রিটেন কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টি উত্থাপন করেন। এডওয়ার্ড হীথ যথাসম্ভব স্বল্পতম সময়ে স্বীকৃতিদানের আশ্বাস দেন। প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের পর কমনওয়েলথ এর সেক্রেটারি জেনারেল আর্নল্ড স্মিথ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার হোটেল কক্ষে গিয়ে সাক্ষাৎ করেন। পরদিন ৯ জানুয়ারি ভোরে বঙ্গবন্ধু দিল্লির উদ্দেশ্যে লন্ডন ত্যাগ করেন।
১০ জানুয়ারি দিল্লি পৌঁছেন বঙ্গবন্ধু। ব্রিটেনের রয়েল এয়ার ফোর্স কমেটে দিল্লি বিমানবন্দরে অবতরণ করে। উজ্জ্বল সূর্যালোকে দৃপ্ত পায়ে বিমান থেকে নেমে আসেন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনতার নয়নের মণি। এই সময় তার পরণে ছিলো গাঢ় ধূসর রঙের স্যুট এবং কালো ওভারকোর্ট। তিনি বিমান থেকে নামার আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ বিমানে প্রবেশ করেন। সেখানে তিনি কয়েক মিনিট তীব্র আবেগে জড়িয়ে ধরেন প্রিয় নেতাকে। ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচরের আলিঙ্গনমুক্ত হয়ে কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধু নেমে আসেন। ২১ বার তোপধ্বনি করে ভারত অভিবাদন জানায় বাংলাদেশের মহান নেতাকে। ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি স্বাগত জানান বঙ্গবন্ধুকে। বিশ্বের ২০টির বেশি রাষ্ট্রের কূটনীতিকরা উপস্থিত ছিলেন। তিন বাহিনীর একটি চৌকষ দল তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। পুরো এলাকা বাংলাদেশ ও ভারতের পতাকায় সজ্জিত ছিলো। আমাদের প্রিয় জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ এবং ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ‘জনগণমন অধিনায়ক’ বাজছিলো যখন বঙ্গবন্ধু তিন বাহিনীর স্যালুট গ্রহণ করছিলেন। দিল্লি সেনানিবাসে বঙ্গবন্ধু একটি জনসভায় ভাষণ দেন। এ সময় এক মাইলের বেশি এলাকা জুড়ে মানুষ গিজ গিজ করছিলো, সবাই শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে একনজর দেখার প্রত্যাশা নিয়ে ছুটে এসেছিলো। এরপর বঙ্গবন্ধু একটি মার্সিডিজ বেঞ্চ গাড়িতে চড়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে যান। পুরোটা পথের দুধারে সুসজ্জিত ব্যানার ছিলো। যাতে লেখা ছিলো, ‘বাংলাদেশের ¯্রষ্টা দীর্ঘজীবী হোক’, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার নায়ক দীর্ঘজীবী হোক।’ শত শত মোটর গাড়ি অনুসরণ করছিলো রাষ্ট্রীয় অতিথির গাড়ি বহরকে। সেদিনই বঙ্গবন্ধু ঢাকার উদ্দেশ্যে দিল্লি ত্যাগ করেন।
সকাল থেকেই বাংলাদেশের মানুষ অপেক্ষা করছিলো। ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণের পূর্বে ব্রিটিশ এয়ার ফোর্স এর কমেট বিমানের পাইলটরা বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে প্রায় পৌনে একঘণ্টা বিমানটিকে নিয়ে ঢাকার আকাশে চক্কর দেন। বঙ্গবন্ধু বিমান থেকে প্রাণভরে দেখেন তাঁর সোনার বাংলাকে।
অবশেষে এলো সেই বহু প্রতীক্ষিত ক্ষণ। পাকিস্তানের কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে একাধিকবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা মহান নেতা এসে দাঁড়ালেন তার প্রিয় জনগণের মধ্যে। বাংলার মানুষ আন্দাশ্রু আর ফুলের মালায় বরণ করে নিলো প্রিয় নেতাকে। পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের ইজেলে আঁকা স্বাধীনতা নামক অমর চিত্রে তুলির শেষ আঁচড় পড়লো। পূর্ণ হলো স্বাধীনতার আনন্দ। যার বহিঃপ্রকাশ হৃদয়ের গভীরতম অনুভবে চোখের জল হয়ে ঝরে পড়েছিলো বাংলার পবিত্র মাটিতে। ৩১ বার তোপধ্বনি হয় তেজগাঁ বিমানবন্দরে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এবং মন্ত্রী পরিষদ সদস্যরা স্বাগত জানান প্রিয় নেতাকে। অগণিত ফুলের মালা আর লাখো জনতার ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানের মধ্যে অশ্রুসিক্ত বঙ্গবন্ধু জড়িয়ে ধরেন প্রিয় জনগণকে। তাকে বহনকারী গাড়িটি জনতার ভিড়ে অত্যন্ত ধীরগতিতে এগুতে থাকে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের দিকে।
তেজগাঁও পুরানো বিমানবন্দর থেকে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীদের বহনকারী ট্রাকটি লক্ষ লক্ষ জনতার মধ্য দিয়ে পিঁপড়ার মতো হেঁটে প্রায় দু’ঘণ্টায় ঐতিহাসিক সেই রমনার ময়দানে পৌঁছে। বঙ্গবন্ধু আবার এসে দাঁড়ালেন, যেখান থেকে তিনি শেষ আহ্বান বাঙালি জাতিকে জানিয়েছিলেন : ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’
ইয়াহিয়ার বন্দিশালার দুর্বিসহ নিঃসঙ্গতা আর চিন্তায় শুকিয়ে যাওয়া দীর্ঘদেহী বঙ্গবন্ধু লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ মুছতে মুছতে যখন বললেন : ‘আমি আবার আপনাদের কাছে এসেছি। লক্ষ লক্ষ ভাই, মা আর বোন নিজেদের জীবনের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন, আমাকে মুক্ত করেছেন। আমার প্রতি ভালোবাসার কোনো পরিমাপ নেই। এর কোনো প্রতিদান আমি দিতে পারিনে…” তখন এমন কোন বাঙালি মাঠে ছিল না, যার নিজের চোখেও পানি জমেনি এবং আবেগে গলাটা রুদ্ধ হয়ে আসেনি।
কান্না ছিলো সেদিনের একমাত্র কণ্ঠস্বর। তিনি কাঁদছিলেন। কাঁদছিলো লাখো মানুষ। যুগে যুগে অনেক কেঁদেছে বাঙালি, অনেক কান্না বুকের রক্ত হয়ে ঝরেছে। কিন্তু সেদিনের প্রেক্ষপট ছিলো ভিন্ন। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির জন্যে অসীম মমতার আবাস যে মহামানবের বুকে, তাঁকে ফিরে পাবার আনন্দে উদ্বেল বাঙালি অঝোরে কেঁদেছে ১৯৭১-এর ১০ জানুয়ারি। আর তিনি কাঁদছিলেন তার প্রিয় মাতৃভূমিতে প্রাণাধিক প্রিয় জনতার মাঝে আসতে পেরে।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে বাঙালি অনুভব করেছিলো জাতি হিসেবে আবহমান যে সংস্কৃতির গৌরবোজ্জ্বল উত্তরাধিকার তার রয়েছে পাকিস্তান কাঠামোয় সে ঐতিহ্য এবং গৌরবের লালন ও বিকাশ অসম্ভব। আর তাই সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। মহান ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত অধ্যায় সে সংঘাতের প্রথম স্মারক। এরপর থেকে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ এগিয়ে নিয়েছেন বাঙালিকে জাতি হিসেবে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের পথে। কিন্তু তাদের কেউই চেতনার ভিত্তিমূলে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার বিদ্রোহী অনুভবে উদ্দীপ্ত করতে পারেননি বাংলার মানুষকে। যা সম্ভব ছিলো একমাত্র বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই। আর তাই ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে বাঙালি স্বাধীনতার পূর্ণ-আলোকে উদ্ভাসিত হয়েছিলো।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ২১টি বছর শাসকগোষ্ঠী নানানভাবে চেষ্টা করেছে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার। কিন্তু সত্যকে অস্বীকার করে মিথ্যার রাজত্ব কতদিন চলে? আকাশে যখন সূর্য ওঠে, আঁধার পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সন্ধ্যা নেমে এলে নিঃশব্দ আততায়ীর মতো আবারো আঁধার হানা দেয়। ’৭৫-এর পনেরো আগস্ট আঁধার হানা দিয়েছিলো বাংলার জনপদে। ২১ বছর বছর পর আবারো মাথা উঁচু করে বাংলাদেশ অভিষিক্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শানিত সূর্যালোকে। সূর্যের ন্যায় উদিত হয়েছে জাতির জনক তাঁর স্ব-মহিমায়। এ সূর্য, এ আলোকিত দিন কখনো হারাবার নয়। ঝোপ-ঝাড়ের আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকা আঁধাররূপী দানবীয় শক্তির উত্থান যাতে আর কখনো ঘটতে না পারে, সে দায়িত্ব নিতে হবে নতুন প্রজন্মকে। বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশকে জানতে হবে। জাতির জনকের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ৪৭তম বার্ষিকীতে সে দায়িত্ব পালনে অবিচল থাকার অঙ্গীকারই করতে হবে নতুন প্রজন্মকে। বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানার জন্যে এ প্রজন্মের প্রতি অনুরোধ থাকবে সত্যের সন্ধ্যানে ব্রতী হবার। শিকড়ের সন্ধান করার। শতাব্দীর মহানায়ক বঙ্গবন্ধু বাঙালির বিবেককে কিভাবে জাগ্রত করেছেন, বাঙালিকে আত্মপরিচয়ে সম্মানিত করেছেন সে প্রেক্ষাপট জানতে হলে ইতিহাসের চর্চা করতে হবে।
৩০ ডিসেম্বর, ২০১৭

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ইন্দিরা গান্ধি

১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্টে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃত দিয়ে তিনি যে ঔদার্য প্রদর্শন করেছেন, এ জন্য বাংলার মানুষ চিরদিন তাঁকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির রক্ত আর ভারতবাসীর রক্ত মিশে এক পবিত্র বন্ধন রচনা করেছে। আমরা দুই দেশ রক্তের বাঁধনে বাঁধা। শুধু তাই নয়Ñ মুক্তিযুদ্ধকালীন আটানব্বই লক্ষ নিরানব্বই হাজার তিনশত পাঁচজন শরণার্থীকে আশ্রয় ও খাদ্য দিয়ে যেভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাঙালি জাতির জীবনে তা অমলিন হয়ে থাকবে। আমি বাংলাদেশের ষোলো কোটি মানুষের পক্ষ থেকে আজ জন্মশতবর্ষে ইন্দিরা গান্ধিকে শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। বাঙালির প্রতি তার যে অসীম ভালোবাসাÑ সেই অসীম ভালোবাসার প্রতি ঋণ স্বীকার করছি। ১৯৭৫ সালের পরে আমি তিনবার ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ তাদের ১৬৯ জন প্রতিনিধির মধ্যে ১৬৭ জন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীকে নির্বাচিত করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক আমলাতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠী জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বানের পরিবর্তে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) লক্ষ লক্ষ মানুষের বিশাল সমাবেশে বলেনÑ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ইউনোস্কর বিশ্ব ঐতিহ্যে তালিকায়, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে পরিণত হয়েছে। এই দুই অর্জনই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বকালেই অর্জিত।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়ার নির্দেশে ঢাকাসহ সাবেক পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান মিলিটারি নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে। তারা অগ্নিসংযোগ লুণ্ঠন ও মানুষের ক্ষতি সাধন করে। সে-রাতেই বঙ্গবন্ধু ইপিআর-এর ওয়্যারলেসের ডিকোডেড মেসেজের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। তার আহ্বানে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে পশ্চিম পাকিস্তানি কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও বাঙালি সেনারা ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়াসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করে সশস্ত্র লড়াই শুরু করে। ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে শেখ মুজিবুর রহমান প্রেরিত নির্দেশকে ভিত্তি করে ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথমে আওয়ামী লীগের আবদুল হান্নান কালুরঘাটে স্থাপিত বেতার কেন্দ্রের বেলাল মোহাম্মদ, আবুল কাশেম সন্দীপ এবং ২৭ মার্চ তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে সাক্ষাতের পর ১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ গণপরিষদের নির্বাচিত সদস্যগণের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি (ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি), তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমদ, এম. মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানকে মন্ত্রী করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করা হয়। অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এমএজি ওসমানী এমএনএ-কে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। ঘোষণার এক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী মুজিবনগরে (তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার পরিবর্তিত নাম) ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ শেষে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে মন্ত্রিসভার সদস্যদেরকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।
১৯৭১-এর মে মাসে কলকাতার ৮নম্বর থিয়েটার রোডে প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান দপ্তর স্থাপন করা হয় এবং ৫৭/৮ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে এমএনএ আবদুল মান্নানের পরিচালনায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয়।
১৯৭১-এর ৭-১২ জুলাই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের অধিনায়কত্বে যুদ্ধ পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ১৯৭১-এর ১০ আগস্ট সামরিক শাসক ইয়াহিয়া (ঈগখঅ) কর্তৃক বিশেষ সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রহসনমূলক বিচারের ঘোষণা দেওয়া হয়।
১০ আগস্ট সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিচারের প্রহসনের বিরুদ্ধে ভারত ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিশ্বের অন্যান্য স্থানে প্রতিবাদ ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবি উত্থাপিত হয়। ১৫ আগস্ট চট্টগ্রাম, মংলা ও চাঁদপুর বন্দরে বাংলাদেশের নৌ-কমান্ডোদের গেরিলা আক্রমণে ৯টি পাকিস্তানি জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ১৯৭১-এর ২৩ নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর সাফল্যে ভীত হয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা জারি করে। বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে যেমন : কমলপুর, নকশী, ধলই, জয়মনিরহাট, পটিয়া বাজার, সালদা নদী, বিলোনিয়া, রৌমারী ইত্যাদি এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান বাহিনীকে ক্রমাগত আক্রমণ ও পর্যুদস্ত করতে থাকে।
পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নৃশংস অত্যাচারে অবরুদ্ধ বাংলাদেশ থেকে নভেম্বরের শেষে ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় এক কোটি। মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গণহত্যা, নারী নির্যাতনসহ অন্যান্য ধ্বংসাত্মক কর্মকা- বেড়ে যায়।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সারা পৃথিবীর অনেক দেশ এবং মানুষ সক্রিয় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। সর্বোচ্চ সহায়তা প্রদান করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির নেতৃত্বে ভারত এবং পদগর্নির নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন।
১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর (বৈদ্যনাথতলায়) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ করে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (Proclamation of Independence) পাঠ করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী এমএনএ (মেম্বার অব ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি)। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ, অর্থ-বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী ক্যাপটেন (অব.) এম. মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্র, কৃষি-ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামান-কে নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। এছাড়া সংবাদপত্র, তথ্য ও বেতার চলচ্চিত্র বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয় এমএনএ আবদুল মান্নানকে।
১৯৭১-এর মে মাসে কলকাতার ৮নং থিয়েটার রোডে মুজিবনগর সরকারের প্রধান দপ্তর স্থাপন করা হয়। ৫৭/৮, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে এমএনএ আবদুল মান্নানের পরিচালনায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয়। ১২ জুলাই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জনসংযোগ ও দেশের প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ১১ জন নির্বাচিত সংসদ সদস্যকে আঞ্চলিক প্রশাসক নিযুক্ত করে।
১৯৭১-এর ২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সারাদেশে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচারে নিরাপরাধ মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে, গ্রাম ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে সীমানা পেরিয়ে ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিতে শুরু করে।
৩১ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান ও প্রতিরোধ তথা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন ও সহমর্মিতা ঘোষণা করেন।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দুর্গত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আবেদন জানান। ১৫-১৬ মে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধি পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামরাজ্যে আশ্রয়প্রার্থী লক্ষ লক্ষ বাঙালি শরণার্থীর দুঃখ-দুর্দশা সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। ভারতে ও বিশ্ববাসীর কাছে নিরাপরাধ মানুষের উপর পাকিস্তানি সামরিক জান্তার হত্যাযজ্ঞের চিত্র তুলে ধরেন।
১৩ আগস্ট মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সফর করেন এবং শরণার্থী-জনগণের দুর্দশা দেখে বলেন,
ÒIt is the greatest human tragedy of our time.Ó
পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নৃশংস অত্যাচারে অবরুদ্ধ বাংলাদেশ থেকে নভেম্বর মাসের শেষে ভারতে আশ্রিত শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১ কোটি। ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়। শরণার্থীরাও স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ফিরতে শুরু করেন।

ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ও জেলাভিত্তিক শরণার্থী পরিসংখ্যান
১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত


ক্রমিক রাজ্যের শিবির ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত শরণার্থী
নম্বর নাম সংখ্যা শিবিরের মধ্যে শিবিরের বাইরে মোট
১. পশ্চিমবঙ্গ ৪৯২ ৪৮,৪৯,৭৮৬ ২৩,৮৬,১৩০ ৭২,৩৫,৯১৬
২. ত্রিপুরা ২৭৬ ৮,৩৪,০৯৮ ৫,৪৭,০৯৮ ১৩,৮১,৬৪৯
৩. মেঘালয় ১৭ ৫,৯১,৫২০ ৭৬,৪৬৬ ৬,৬৭,৯৮৬
৪. আসাম ২৮ ২,৫৫,৬৪২ ৯১,৯১৩ ৩,৪৭,৫৫৫
৫. বিহার ৮ ৩৬,৭৩২ – ৩৬,৭৩২
৬. মধ্যপ্রদেশ ৩ ২,১৯,২৯৮ – ২,১৯,২৯৮
৭. উত্তরপ্রদেশ ১ ১০,১৬৯ – ১০,১৬৯
মোট : ৮২৫ ৬৭,৯৭,২৪৫ ৩১,০২,০৬০ ৯৮,৯৯,৩০৫

কেন ইন্দিরা গান্ধি আপামর বাঙালির ব্যথায় সাড়া দিলেন, কেন তিনি ঝুঁকি নিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সেই বিষযে কথা বলার আগে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে ইন্দিরা গান্ধির মানসগঠনের দিকে। তার পিতা প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ জওয়াহেরলাল নেহেরু, তিনি সাহচার্য পেয়েছেন কবি-দার্শনিক রবীন্দ্রনাথের, তাঁর রুচিবোধ তৈরি করেছিল ইউরোপীয় মানবিক উদারতা। প্রাচীন ভারতবর্ষের আরণ্যক ঋষিরা যেমন তার কাছে প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় ছিলেন, তেমনি তার মুগ্ধতা জাগিয়ে ছিল ইউরোপ। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের এই মেলবন্ধন ইন্দিরা গান্ধির মধ্যে এক অতুলনীয় সেতুবন্ধন তৈরি করেছিল বলেই তিনি মানুষের ব্যথায় ব্যথা অনুভব করতেন। ক্ষমাপ্রার্থীকে ক্ষমা করতে পারতেন এবং পীড়নকারীকে দিতে পারতেন কঠিন শাস্তি।
পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশ যখন যুদ্ধের মাঠে লড়ছে তখন নতুন করে হিসাব-নিকাশ কষতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও পাকিস্তান। এই ত্রিদেশীয় বিরোধিতা মোকাবিলা করতে ইন্দিরা গান্ধি হাত বাড়ান সোভিয়েট রাশিয়ার দিকে। কিভাবে সেদিন ইন্দো-সোভিয়েট চুক্তি করে ইন্দিরা বাংলাদেশকে স্বাধীনার পথে এগিয়ে দিয়েছিলেন এবং ভারতকেও ভয়ঙ্কর যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচিয়ে ছিলেন তার বিবরণ দিয়েছেন পুপুল জয়কর।
আসন্ন চীন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক কাতারে শামিল হওয়া এবং দু’জাতির মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে পাকিস্তানের ভূমিকা সম্বন্ধে ঝা’র প্রতিবেদনে ভারতের জন্য বিপদের ঝুঁকিগুলো তীব্রতর হয়ে ওঠে। যুধ্যমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, চীন ত্রয়ী ভারতের অখ-তার জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে দেখা দেয়। ত্বরিতগতিতে ইন্দিরা গান্ধি প্রয়োজন সিদ্ধ করেন। সোভিয়েতদের কাছে দূত পাঠানো হয় এবং শান্তি, বন্ধুত্ব আর সহযোগিতার ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তি যা আলোচনাধীন তবে স্থগিতাবস্থায় রাখা হয়েছে তা, আগস্ট মাসের মাঝামাঝি নাগাদ স্বাক্ষরিত হয়।
ইতিহাস যেমন নেতৃত্বের সৃষ্টি করে, নেতৃত্বও তেমনি ইতিহাস সৃষ্টি করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারা যেমন শেখ মুজিবুর রহমানকে ইতিহাসের মূলস্রোতে নিয়ে তাঁকে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা করেছে, ঠিক তেমনিভাবে শেখ মুজিবও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে তাঁর রাজনৈতিক সাধনা-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিয়ে গেছেন একটা পরিণতরূপে স্বাধীন বাঙালি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা পূরণ করে। তাই বাংলাদেশ ও বাঙালির অপর নামÑ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধুর মহিমা এখন বাংলাদেশ ছেড়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। সমগ্র পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে তার নাম।
একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো যেখানে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে যখন মহান ভারতের ঔদার্যে দেশের বির্ধ্বস্ত সেতু, সড়কপথ পুনরায় ব্যবহারের উপযোগী করা হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় কোষাগার যখন আক্ষরিক অর্থেই কপর্দকশূন্য, সেই সর্বশূন্য অবস্থা থেকে সংক্ষিপ্ততম সময়ের মধ্যে তিনি জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে উন্নীত করেছিলেন। এটি সম্ভব হয়েছিল তার প্রজ্ঞা, কঠোর পরিশ্রম এবং অকৃত্রিম ভালোবাসার জন্য। এই প্রবৃদ্ধির হার আজও বাংলাদেশের জন্য একটি ইপ্সিত লক্ষ্য।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন :
‘‘‘‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’
মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে বাংলার মাটি ও মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই সংশপ্তক, শত্রুর নিশ্চিত ফাঁসির মঞ্চ থেকেও বেরিয়ে এসেছিলেন, দেশ ও বিশ্ববাসীর দাবির মুখে বীরের বেশে। কিন্তু এই ভালোবাসার কাঙ্গাল মানুষটিকে, শেষ পর্যন্ত বুকের রক্ত দিতে হলো, বাংলার মাটিতে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায়, কতিপয় অবিমৃষ্যকারী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রের ষড়যন্ত্রে।
বঙ্গবন্ধুর ভাষায় :
‘সাত কোটি বাঙালির ভালোবাসার কাঙ্গাল আমি। আমি সব হারাতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারবো না। বাঙালির ভালোবাসার ঋণ বুকের রক্ত দিয়ে শোধ করবো ইন্শাল্লাহ।’
বঙ্গবন্ধু তার কথা রেখেছেন। এখন আমাদের ঋণ পরিশোধ করার পালা। বাঙালিশ্রেষ্ঠ বঙ্গবন্ধুর নামে ইতিহাসের নতুন অধ্যায় সৃষ্টি হয়েছে। আবহমান কালের প্রবহমান মানুষ তার নামে উদ্দীপ্ত হবে, অনুপ্রাণিত হবে, অনুরণিত হবে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে।
তদ্রƒপ ইন্দিরা গান্ধির নামও উচ্চারিত হবে সসম্মানে। তিনি শুধু দুনিয়ার বৃহদাকার গণতান্ত্রিক দেশের পার্লামেন্ট সরকার প্রধান ছিলেন না, মতিলাল নেহেরু ও জওয়াহেরলাল নেহেরুর মতো দুজন মহান নেতার গুণাবলির উত্তরাধিকারিণীও ছিলেন। আর এ জন্যই তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল দ্রুততম সময়ের মধ্যে যুদ্ধজয়ী ভারতীয় সেনাবাহিনীর বাংলাদেশ ত্যাগ। বঙ্গবন্ধু যেমন বাংলাদেশ ও বাঙালিকে বুকের রক্ত দিয়ে ভালোবেসে ছিলেন, ইন্দিরা গান্ধিও সেই একই কথা ব্যক্ত করছিলেন তার জীবনের শেষ ভাষণে।
আমি বেঁচে থাকব কি নাÑ পরোয়া করি না। আমি দীর্ঘজীবন লাভ করেছি এবং যদি আমি কোনোকিছু নিয়ে গর্বিত হই, তবে সেটা হল এই যে, আমি আমার জীবনের সবটুকু সেবাকর্মে কাটিয়েছি। আমি শুধু এটা নিয়েই গৌরব বোধ করি এবং অন্য কিছুতেই নয়। অধিকন্তু যতদিন পর্যন্ত আমার দম আছে ততদিন পর্যন্ত আমি সেবাকর্ম চালিয়ে যাব এবং যখন আমার জীবন চলে যাবে তখন আমি বলতে পারব যে, আমার প্রতিটি রক্তবিন্দু ভারতকে প্রাণসঞ্চার করবে, আর তাকে আরও শক্তিশালী করে তুলবে।
বাংলাদেশ এখন স্বাধীন দেশ। স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশকে ত্বরান্বিত করে ৬৭ বছর বয়সী ইন্দিরা গান্ধি বাঙালি জাতিকে চিরঋণে আবদ্ধ করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশ চিরজীবী হোক। চিরজীবী হোক আধুনিক ভারতের রূপকার প্রিয়দর্শিনী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধি।
১৯ নভেম্বর, ২০১৭

এককভাবে সরকার গঠন করতে মুজিব-আদর্শের সৈনিকদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের দুই বছর পরেই ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে একঝাঁক লড়াকু নেতার অংশগ্রহণে এই দলটির জন্ম হয়। দেখতে দেখতে বৃহৎ এই রাজনৈতিক দল ৬৮ বছর অতিক্রম করল। এই ৬৮ বছরে দলটির নেতৃত্ব দিয়েছেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো অনন্য নেতৃবৃন্দ। এখন এই দলের হাল ধরে আছেন মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা। যারা বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস করে তাদের একমাত্র ভরসা আওয়ামী লীগই। বাংলাদেশের ইতিহাস মানে আওয়ামী লীগেরই ইতিহাস। আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা শুধু অকল্পনীয় বিষয়ই নয়, অযৌক্তিকও। দারুণ এক ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশের হাল ধরেছিলেন শেখ হাসিনা। সেই ভগ্নদশা থেকে দল ও দেশকে টেনে তুলেছেন তিনি। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে মডেল। বিগত আট বছরে বাংলাদেশে যে অসম্ভব উন্নয়ন হয়েছে আগামী দিনের ইতিহাসে তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে থাকবে।
শুরুর দিকে আওয়ামী লীগ ছিল একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম। এই রাজনৈতিক প্লাটফর্ম পরে রূপ নেয় সাহসী রাজনৈতিক পার্টিতে। সূচনালগ্নে নেতা ও নীতিই ছিল এই দলের অমূল্য সম্পদ। এখন নেতা আছেন কিন্তু নীতির প্রশ্নে নানারকম কথা শোনা যাচ্ছে। নীতির প্রশ্নে দলটি যদি অনড় ও অবিচল না থাকে, তাহলে এই পার্টি জনগণের কাছ থেকে শ্রদ্ধা ও সমর্থন পেতে ব্যর্থতার পরিচয় দেবে। আগামী নির্বাচনে অবশ্যই আওয়ামী লীগকে ৫১ শতাংশ ভোট ও ৫১ শতাংশ আসন পেয়ে নিরঙ্কুশভাবে সরকার গঠন করতে হবে। অতীতে আওয়ামী লীগ যতবার সরকার গঠন করেছে, ততবারই কোনো না কোনো দলের কাঁধে তাকে ভর দিয়ে দাঁড়াতে হয়েছে। অন্য দলের কাঁধে ভর দিয়ে নয়, নিজের পায়েই আওয়ামী লীগকে দাঁড়ানো শিখতে হবে। মুজিব আদর্শে বিশ্বাসী সকল নেতাকর্মীকে এই জন্যে যার যার জায়গা থেকে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে।
আগামী নির্বাচন হবে এমন এক মুহূর্তে যখন আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বর্ণযুগ পার করছে। এই যুগকে আরও দীর্ঘ করতে হলে তাকে আগামী নির্বাচনে কৌশলগত অনেক পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। নির্বাচনপূর্ব সেই বার্তাও পেয়েছে দলীয় নেতাকর্মীরা ও দেশের সাধারণ মানুষ। যারা দুর্নীতিবাজ, লোভী, সুযোগসন্ধানী (হাইব্রিড) ও চিহ্নিত সন্ত্রাসী এই নির্বাচনে তারা ঝরে পড়বে। অপরদিকে যারা বিনয়ী, ভদ্র, পরিশ্রমী তরুণ ও প্রগতিশীল, তাদের বেশি বেশি প্রাধান্য দেওয়া উচিত। দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা পর্যালোচনা এবং দলটিকে জঞ্জালমুক্ত করে একটি গণতান্ত্রিক বাতাবরণ তৈরি করাও এই নির্বাচনের অন্যতম লক্ষ্য বলেই আমরা মনে করি। আওয়ামী লীগ থেকে এবার যারা মনোনয়ন পেতে বঞ্চিত হবেন, এটা তাদের কর্মফলের কারণে হবেন। এমনকি যারা নতুন করে মনোনয়ন পাবেন, তারা তা কর্মফলের কারণেই পাবেন।
বর্তমান বাংলাদেশকে শেখ হাসিনা তার দূরদর্শী নেতৃত্বের মাধ্যমে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন তা কল্পনারও বাইরে। এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কোনো রাজনৈতিক শক্তি দেশে নেই। তাছাড়া দলটি গত আট বছরে বেশকিছু দৃশ্যমান উন্নয়ন কর্মকা- করেছে। দারিদ্র্য বিমোচনের আপেক্ষিক হার হ্রাস, আট বছর ধরে অব্যাহতভাবে ছয় ভাগের বেশি প্রবৃদ্ধির হার ধরে রাখা (বর্তমানে যা ৭.১১ শতাংশ), বিশ্বব্যাংকের বিরোধিতার মুখেও নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জন, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি প্রতিপালন তথা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যকর প্রভৃতি সাফল্য আওয়ামী লীগকে দিয়েছে ব্যাপক গণভিত্তি। এর পাশাপাশি কূটনৈতিকভাবেও বর্তমান সরকারের সাফল্য শুধু বাংলাদেশের মানুষের নয়, বিশ্ববাসীরও দৃষ্টি কেড়েছে। ভারত-চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র হলেও এই চারটি শক্তিধর রাষ্ট্রের সঙ্গেই আওয়ামী লীগ সরকারের সুসম্পর্ক রয়েছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বিশ্বের শীর্ষ ৫টি দেশের একটি এখন বাংলাদেশ। এই কথাগুলো সাধারণ মানুষকে বারবার বোঝাতে হবে।
বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বর্তমানে ১ হাজার ৪৬৬ মার্কিন ডলার। দারিদ্র্যের হার এখন ৪১.৫ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২২.৪ শতাংশ। বর্তমানে দেশে রিজার্ভের পরিমাণ ৩১.৩২ বিলিয়ন ডলার। এই সরকারের আমলে দেশে-বিদেশে প্রায় দেড় কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। বাংলা নববর্ষে উৎসব ভাতা, আশ্রয়ণ, একটি বাড়ি একটি খামার, দুস্থ ভাতা, বিধবা ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ অসংখ্য সেবা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। দেশে বর্তমানে শিক্ষার হার ৭১ শতাংশ, উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার মেগাওয়াট। সড়ক, নৌ, রেল, বিমানসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন বাংলাদেশে এখন দৃশ্যমান সত্য।
পূর্ববর্তী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বাংলাদেশকে বানিয়েছিল মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের কারখানা। সে সময় যেখানে-সেখানে বোমা হামলা হতো, এমনকি ৬৩টি জেলায়ও একসঙ্গে বোমা হামলার নজির রয়েছে। সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হয়েছে। মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ দমনে সরকারের অনমনীয় দৃঢ়তা জনগণের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের এ কথা মনে রাখা দরকার।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এবং আওয়ামী লীগের ভাগ্য একসূত্রে গাঁথা। যখনই বাংলাদেশের মাটিতে ঘাতকচক্র ও বিরোধী শিবিরের ষড়যন্ত্রে আওয়ামী লীগ বিপর্যস্ত হয়েছে তখনই বাংলাদেশের ভাগ্যে নেমে এসেছে চরম
অশান্তি কিংবা সামরিক থাবা। বাংলাদেশের জন্য লড়েছে আওয়ামী লীগ, বর্তমানে দেশও গড়ছে আওয়ামী লীগ। উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত রাখতে হলে অবশ্যই আওয়ামী লীগকে স্বচ্ছ, সুন্দর ও আত্মসমীক্ষার মুখোমুখি হওয়া দরকার। দল এখন ক্ষমতায় আছে। ক্ষমতায় থাকলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে কিন্তু পর্যবেক্ষণ শক্তি কমে। আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনা বর্তমান বিশ্বে অতুলনীয় নেত্রী। আন্তর্জাতিক বহু সম্মাননা ও পদবি তাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তিনি একাই আওয়ামী লীগের ভার বহন করতে সক্ষম। কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, শেখ হাসিনা যতই ক্লিন ইমেজ তৈরি করুন না কেন যদি তার দলীয় লোকজন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, দলীয় নীতি বিসর্জন দিয়ে অবৈধভাবে মানুষকে হয়রানি করে, তাহলে সামনে ভরাডুবি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। অনেক নেতারই মাঠে জনপ্রিয়তা নেই, অনেকেই এলাকায় তেমন কোনো কাজ করছেন না, অনেকেই শুধু ধান্ধায় আছেন কীভাবে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা বানাবেন ও বিত্ত-বৈভবের মালিক হবেন। আওয়ামী লীগের অনেক নেতার বিরুদ্ধেই সীমাহীন দুর্নীতি ও ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগ আছে। কেউ কেউ শুধু নিজে নয়, পুত্র ও জামাতাকেও ব্যবহার করেছে দুর্নীতি করতে। এগুলো জনগণের কাছে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে ভুল বার্তা পৌঁছায়। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এমনকি পৌরসভার নির্বাচনেও কোনো কোনো নেতা দলীয় প্রতীক নৌকা টাকার বিনিময়ে বিএনপি ও জামায়াতের লোকের হাতে তুলে দিয়েছে। এসব নির্বাচন বাণিজ্যে তারা লক্ষ লক্ষ নয়, কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। উপজেলায় আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দাপট লক্ষণীয়। তাদের ঘুষ-দুর্নীতির কথাও মাঝে মাঝে প্রকাশ হচ্ছে পত্রিকায়।
এসব ব্যাপারে এখনই সচেতন হওয়া দরকার। তা না হলে আগামী নির্বাচনে দলের ভাগ্যে কী হবে, কেউ বলতে পারে না। ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগকে আরও কন্ট্রোল করা দরকার। এদের বিরুদ্ধে মানুষের অনেক অভিযোগ রয়েছে। গত আট বছরে এই তিন সংগঠনের আটটি ভালো কাজের দৃষ্টান্ত আছে কিনা সন্দেহ। তবে তাদের বিরুদ্ধে শত শত অভিযোগ তৈরি হয়েছে জনমনে। দলীয় শৃঙ্খলা যারা ভঙ্গ করবে, যারা দলের সুনাম-সুখ্যাতি নষ্ট করবে, তাদের দলে না রাখাই সমীচীন হবে। নির্বাচনের আগে মনোনয়ন দেওয়ার মুহূর্তে তাদেরই মনোনয়ন দিতে হবে, যাদের বিজয়ে বিন্দু পরিমাণ সন্দেহ থাকবে না। এজন্য অবশ্য দলীয় প্রধানকে কঠোর হতে হবে। আমরা জানি তিনি অতটুকু কঠোর হওয়ার মানসিকতা পোষণ করেন।
ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। বিশ্বের সেরা ৪৪টি বক্তৃতা নিয়ে জেকব এফ ফিল্ড যে বক্তৃতা সংকলন বের করেছেন, যার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতা স্থান পেয়েছে। যা ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। জেকব তাঁর সংকলনের নাম দিয়েছিলেন চার্চিলের বক্তৃতার অংশ থেকে We shall fight on the Beaches (The speeches that inspired History)। সেই চার্চিলও পরবর্তী নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন। আমাদের দেশেও বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামী লীগ কোনো প্রতিবাদ, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে ১৯৯১ সালের নির্বাচনের কথাও দলীয় নেতা-কর্মীদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। ১৯৯৬ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়েছিল। সে কথা মনে রেখে আওয়ামী লীগ নেত্রীকে দল ও সরকার পরিচালনা করতে হবে। দীর্ঘ তেইশ বছর সংগ্রাম করে বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যেভাবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিলেন এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠন হিসাবে আওয়ামী লীগকে দাঁড় করিয়েছিলেন ঠিক সেই জায়গায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে নিয়ে যেতে হবে। মৌলবাদী ও পাকিস্তানি ভাবধারা থেকে মানুষের ‘মাইন্ডসেট’ পরিবর্তন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক ভাবধারায় বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে হবে। দেশের উন্নয়নের পাশাপাশি এটাও অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগের জন্য।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে উচ্চতম স্থানে নিয়ে গেছেন। এখন মানুষের মাঝে অনেক আশা তৈরি হচ্ছে। মানুষ বুঝতে পারছে আসলেই দেশের উন্নতি হচ্ছে। এজন্যই রাজপথে বিরোধী দলের মিছিল-মিটিং জনশূন্য। কেউ আর অকারণে রাজনীতি নিয়ে ভাবছে না। এটা আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত শুভ লক্ষণ। কিন্তু আগামী নির্বাচনে যদি কোনো কারণে বা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়, তাহলে বাংলাদেশ তার সব উন্নয়ন সূচক হারাবে ঠিকই, কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই হবেন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। সব দিক সামাল দিয়ে এখন ঠান্ডা মাথায় সরকার ও দল পরিচালনা করতে হবে। মন্ত্রিপরিষদকেও স্বচ্ছতা ও দুর্নীতিমুক্ত করার প্রয়োজনে পরিবর্তন করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেখানে বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে চান সেখানে নিতে গেলে অবশ্যই আওয়ামী লীগ ও সরকারের ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতি সঠিক ও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে।
সবার মতো আমিও চাই, সৎ, যোগ্য, শিক্ষিত, জনপ্রিয় ও ত্যাগী নেতাদের নির্বাচনী প্রার্থী হিসেবে স্থান দিতে হবে, সেই সাথে দলছুট, হাইব্রিড নেতাদের যথাসম্ভব পরীক্ষার ভেতর দিয়ে গ্রহণ-বর্জন করতে হবে। এ প্রসঙ্গে ২০০১ সালের নির্বাচনের কথা মনে রাখা দরকার। সেই নির্বাচনে কতিপয় দুর্বৃত্তের কারণে ও বিএনপি-জামায়াতের আসন ভাগাভাগির চক্রান্তে আওয়ামী লীগ সর্বাধিক ভোট পেয়েও আসন সংখ্যায় হেরে ক্ষমতায় যেতে পারেনি।
এক সময় আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলাম। দলের অনেক নীতিনির্ধারণেরও অংশীদার ছিলাম। দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় রাজনীতির বাইরে থাকলেও এটা ভুলে যাইনি, আওয়ামী লীগই বাংলাদেশের নির্মাতা। আওয়ামী লীগের হাতেই বাংলাদেশ সবচেয়ে নিরাপদ ও নির্ভার। আজ বঙ্গবন্ধুর পরে বিশ্বব্যাপী যে নাম উচ্চারিত হচ্ছে, তার নাম ‘শেখ হাসিনা’। এ কথা আজ বললে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না যে, দেশনায়ক বঙ্গবন্ধু ও দেশনায়ক শেখ হাসিনা দু-জনই আজ বিশ্ববরেণ্য। শুধু তা-ই নয়, দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা বঙ্গবন্ধুর চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। বঙ্গবন্ধুর পা ধরলেই সব অপরাধ ক্ষমা পেয়ে যেত, কিন্তু শেখ হাসিনা ক্ষমা করেন বিচার-বিশ্লেষণ করে। কারণ বঙ্গবন্ধু ‘Was too good and gracious. It is dangerous to be for good.’
আওয়ামী লীগ ছাড়া বাংলাদেশের বিএনপি ও জাতীয় পার্টি আঙুল ফুলে কলা গাছের মতো। প্রতি পার্টিই জন্ম হয়েছে বিশেষ উদ্দেশ্যে ও অন্ধকারে। তাদের পেছনে ছিল ক্ষমতার লোভ, নয়তো ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থতা। যার ফলে দেখা গেছে, সেসব পার্টি কিছুদিন ঢাকঢোল পেটালেও এক সময় ঠিকই নিস্তেজ হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ থেকে ছুটে গিয়েও কেউ কেউ নতুন নতুন দল তৈরি করেছেন; নতুন পার্টির নেতা হয়ে পত্রপত্রিকার শিরোনাম হয়েছেন। কিন্তু আশ্চর্য হলো, যেসব নেতা আওয়ামী লীগে থেকে এমপি-মন্ত্রী হতেন, রাষ্ট্রপতি বা উপরাষ্ট্রপতি হওয়ার যোগ্য ছিলেন, তারা যখন নিজ নিজ দল গঠন করে নির্বাচন করতে লাগলেন, তখন তারা শুধু হারলেনই না, নির্বাচনে তাদের জামানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হয়ে গেল।
এ থেকেই প্রমাণ হয়, আওয়ামী লীগ হলো বহতা নদীর মতো। এই বিশাল-বিপুল নদী থেকে দুই-এক ফোঁটা জল এদিক-সেদিক হলে নদীর অবয়বগত যেমন পরিবর্তন হয় না, তেমনি নদীর গতিপথও বদলায় না। বরং যে দুই-একটা ফোঁটা পানি এদিক-সেদিক হয়, তারাই কিছুদিন পরে শূন্যে মিলিয়ে যায়। উদাহরণ দিলে এমন দৃষ্টান্তের চারপাশে অভাব নেই।
আমরা জানি, বঙ্গীয় ভূখ-ে রাজনৈতিক দুরবস্থার অবসান ঘটাতে প্রথম যে দল জনগণের আশা-আকাক্সক্ষাকে বাস্তবায়ন করতে বুক ফুলিয়ে দাঁড়ায়, তার নাম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আজকের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আর দল গঠিত হওয়ার মুহূর্তের আওয়ামী লীগ কোনোভাবেই এক নয়। সময়ের ব্যবধানের সঙ্গে সঙ্গে দলের অনেক কিছুই বদলেছে অথবা বদলাতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ যখন পূর্ববঙ্গে গঠিত হয়, গঠনকালীন সময়েই তা বৃহৎ দল হিসাবে পরিচিত ছিল। আজকের বাংলাদেশেও আওয়ামী লীগ সর্ববৃহৎ দল। কিন্তু এই সর্ববৃহৎ দলের ট্র্যাজেডিও অনেক বড়, অনেক বেশি নির্মম। ইতিহাসের অসংখ্য রক্তাক্ত পথ পাড়ি দিয়ে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করেছে ঠিকই, তবে এজন্য আওয়ামী লীগের শরীর থেকেও কম রক্ত ঝরেনি। পৃথিবীর কোনো দেশের একটি রাজনৈতিক দল এত ভাঙাগড়া-দলন-নিপীড়নের মধ্য দিয়ে টিকে আছে কি না, তা আমার জানা নেই। আওয়ামী লীগের টিকে থাকার কারণ তার আদর্শবাদ, সাংগঠনিক শক্তি ও তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীবৃন্দ।
পরিশেষে মুজিব আদর্শে বিশ্বাসী নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলতে চাইÑ আত্মকলহ ভুলে জননেত্রী শেখ হাসিনার মনোনীত প্রার্থীকে বিজয়ী করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করুন। দল ক্ষমতায় থাকলে একদিন না একদিন আপনার মূল্যায়ন হবেইÑ সেদিন আপনি সুযোগ-সুবিধাও পাবেন। কিন্তু ব্যক্তিগত স্বার্থ বা বিদ্বেষবশত দলীয় প্রার্থীর ভরাডুবি করে দলের সর্বনাশ করবেন না। মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের অবস্থা দেখে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সচেতন হওয়ার সময় এখনই। উল্লেখ্য ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ন্যাপকে ২০টি আসন দিতে প্রস্তাব দিয়েছিলেন কিন্তু ন্যাপ ৪০টি আসন চেয়েছিল। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন নির্বাচনের পর দেখা যাবে। বর্তমানেও বামপন্থী ও প্রগতিশীল দলগুলি তাদের ভোটের সংখ্যা বুঝতে বার বার ভুল করছে। আপনারা সবাই মিলে ১৯৭০ সালের মতো নির্বাচনী জোয়ার তুলুন। তাহলে নৌকা যেমন বাঁচবেÑ বাঁচবে নৌকার মাঝি-মাল্লা ও বাংলাদেশ। এর ব্যত্যয় হলেই নেমে আসবে ভয়ঙ্কর বিপদ। আগাম বিপদের কথা ভেবে এখনই নৌকার পক্ষে কাজ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হোন।
১১ নভেম্বর, ২০১৭

মান্যবর গুড সিস্টার, সুবর্ণ সত্তরে স্বাগত

মাত্র আটাশ বছর বয়সে পিতৃ-মাতৃ-ভ্রাতৃহীন হন শেখ হাসিনা। একজন সাধারণ গৃহবধূ আর মুজিব কন্যা ছাড়া তখন তার অন্য কোনো পরিচয় ছিল না। তার জীবন ছিল খুবই সাধারণÑ এ কথা অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণের বিচারে যেমন সত্য সামাজিকতার বিচারেও তাই। আমি শেখ হাসিনার জীবনের অনেক করুণ মুহূর্তের সাক্ষী। সেই কথাগুলো এখন হয়তো গল্পের মতো শোনাবেÑ কিš‘ ১৯৭৫ সালের পরে যে বিপর্যপ্ত, দিকভ্রান্ত, ক্লান্ত, আশ্রয়হীন, অসহায়, শেখ হাসিনাকে আমি দেখেছি তার সাথে আজকের দিনের শেখ হাসিনার আকাশ-পাতাল প্রভেদ। একজন সাধারণ গৃহবধূ আজ অসাধারণ রাষ্ট্রনায়ক। দারিদ্রের শৃঙ্খল ভেঙে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন স্বচ্ছলতার দিকে। এই মুহূর্তে তিনি যা কিছু স্পর্শ করছেনÑ তা-ই তার হাতের ছোঁয়ায় সোনা হয়ে যাচ্ছে।
ত্যাগে, দয়ায়, ক্ষমায় ও সাহসের মহিমায় শেখ হাসিনা আজ বিশ্বের বিস্ময়। মাত্র ৩৬ বছরের প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক জীবনের তিনি অনেক কিছু উপহার দিয়েছেন বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে। আজ আমি এই মাহেন্দ্রক্ষণে তার অর্জনের দুই-একটি বিষয় অবতারণা করতে চাই। শেখ হাসিনাকে আমি ‘গুড সিস্টার’ বলে ডাকি। তিনি আজ সুবর্ণ সত্তরের পদার্পণ করেছেনÑ সত্তরে তাঁকে সানন্দে স্বাগত জানাই।
বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে যারা একটু সময় ব্যয় করেন তারা নিশ্চয়ই জানেনÑ শেখ হাসিনা নিজের ই”ছায় রাজনীতির মঞ্চে আবির্ভূত হননি, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পরে বাংলাদেশ চলে যায় পাকিস্তানি ধারায় ক্ষমতালোভী সামরিক চক্রের হাতে। সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করার পরে আওয়ামী লীগের নেতাদের উপর নেমে আসে ভয়াবহ অত্যাচার ও নির্যাতন। এ সময় চলতে থাকে হত্যাকা-, গুম ও অকারণ জেল-জুলুম। সামরিক চক্রের ই”ছায় হতে থাকে ক্যু। যেই বঙ্গবন্ধু বর্ণনাতীত লড়াই-সংগ্রাম করে বাঙালি জাতিকে এনে দেন বহু কাক্সিক্ষত স্বাধীনতাÑ তার নাম উ”চারণ করা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এমনই এক ভয়াল মুহূর্তে দল ও জাতির স্বার্থে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন শেখ হাসিনা। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ কোথায় গিয়ে পৌঁছেছেÑ সে কথা দেশবাসী আজ সম্পূর্ণভাবে অবগত।
আওয়ামী লীগে রক্তক্ষরণ বঙ্গবন্ধুর আমল থেকেই শুরু হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকতেই অনেক প্রবীণ নেতা দল থেকে সরে গিয়ে নতুন দল গঠন করে যদিও সে সব দলের অস্তিত্ব আজ অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও দেখা কষ্টকর। তবু ভাঙনের বিপর্যয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ একটু হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান, মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, আমেনা বেগম প্রমুখ নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর সময়েই আওয়ামী লীগ ছেড়ে চলে যায়। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরেও এ ধারা অব্যাহত থাকে। অধ্যাপক ইউসুফ আলী, সোহরাব হোসেন, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, কে. এম. ওবায়দুর রহমান, কুরবান আলীসহ বহু নেতাকর্মী বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার পর দলত্যাগ করেছেন। কিš‘ শেখ হাসিনা অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে আওয়ামী লীগের হাল ধরার মুহূর্ত থেকে একাই দলকে টেনে নিয়ে গেছেন। শেখ হাসিনাও যে দলের ভাঙনের মুখে পড়েননি এ কথা বলা যাবে না। ড. কামাল হোসেন ও আবদুর রাজ্জাকের মতো নেতারাও তাকে কম আঘাত করেননি। কলঙ্কিত ওয়ান-ইলাভেনের সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও জেল খেটেছেন,¬ তিনি উপলব্ধি করেছেন সুবিধাবাদীদের বিষদাঁতের কামড়। তবু তিনি সবকিছু সামলে নিয়েছেন অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে। এখনো তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গেই সব বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যা”েছন।
শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় গুণ তিনি প্রতিহিংসাপরায়ণ নন। যে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার তাকে নানাভাবে নির্যাতন করেছেন, হয়রানি করেছেন, আজ তাকেই তিনি দিয়েছেন উপদেষ্টার মর্যাদা। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদীয় জোট সরকারের আমলে যেভাবে তাকে একের পর এক হত্যার চেষ্টা করা হয়েছেÑ সেই বিএনপিকেও তিনি আক্রোশবশত আঘাত করেননি, বিশ্বের ইতিহাসে উদারতার এমন নজির খুব একটা আছে বলে মনে হয় না।
শেখ হাসিনা আজ শুধু আওয়ামী লীগেরই নেতা নন, তিনি আজ দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে স্টেটসম্যান বা রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হয়েছেন। ইতিহাস যদি বাংলাদেশের রাজনীতিকদের নাম বুকে ধারণ করতে চায়, তাহলে শেখ হাসিনার নামটি স্বর্ণাক্ষরেই লেখা হয়ে থাকবে। তার নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত কর্তব্য সম্পন্ন হতে চলেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে। ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। আজ জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের কর্মযজ্ঞ বাঙালি জাতির ইতিহাসে গৌরবোজ্জল নতুন অধ্যায় হিসেবে স্বীকৃতি পা”েছ। অকুতোভয় সাহসী শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ আজ সারা বিশ্বে উন্নয়নের মডেল হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার কারণেই বাংলাদেশ বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে আসীন হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানদ-ে ও উন্নয়নের সকল ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে।
জননেত্রী শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশের জনগণের আ¯’ার প্রতীক। তিনি দেশে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ যেভাবে বাংলাদেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রভাব বিস্তার করেছিলÑ তিনি দৃঢ় মনোবলে সে সব কিছু বাংলার মাটি থেকে উপড়ে ফেলতে সমর্থ হয়েছেন। বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনাও তিনি সামাল দিয়েছেন দক্ষ হাতে। দুর্নীতি দমনে তার অর্জন মোটেই খাটো করে দেখার মতো নয়। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রাদর্শ যেমন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিলÑ শেখ হাসিনার স্বপ্নও তা-ই। সেই লক্ষ্যেই তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে যা”েছন। পিছিয়ে পড়া বাংলার জনপদে আজ তিনি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ আন্দোলনের স্লে¬াগান তুলে দেশের চেহারা বদলে দিয়েছেন। দেশের মানুষ প্রথম দিকে ডিজিটাল বাংলাদেশের মমার্থ বুঝতে দেরি করলেও আজ সকলেই স্বীকার করছে বাংলাদেশে তথ্য প্রযুক্তির এক নীরব বিপ্ল¬ব ঘটে গেছে। আজ বাংলাদেশের ঘরে ঘরে মোবাইল ফোন, কম্পিউটার ও ল্যাপটপ জরুরি কাজ সমাধা করতে ব্যবহৃত হ”েছ।
দুর্বলের উপর সবলের খবরদারি এক ঐতিহাসিক সত্য। এই কথা দুর্বল দেশের বেলায়ও সমানভাবে প্রযুক্ত। বাংলাদেশের উপর অনেকেই অযৌক্তিক অভিভাবকত্ব প্রদর্শন করেছে এবং এখনো করতে চা”েছ। এদেশে নির্বাচন হলে আমেরিকা পর্যবেক্ষণ করতে আসে, আসে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। কিš‘ তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে আজ আমরা সকলেই জানিÑ আমেরিকাতেও নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তারাও খামখেয়ালের বশে এবং নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্য অন্য দেশের উপর চাপিয়ে দেয় অন্যায় যুদ্ধ। ইউরোপিয়ন ইউনিয়ন গরিব দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন নাÑ তারা ধনীদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন এতটাই মেরুদ- সোজা করে দাঁড়িয়েছে যে, আমেরিকা বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের রক্তচক্ষুকেও আর ভয় পায় না। বিগত কয়েক বছরে শেখ হাসিনা এ কথার প্রমাণ বহুবার বাংলাদেশের মানুষের সামনে রেখেছেন।
কারও কাছে নতজানু হয়ে নয়, আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েই এখন দেশ শাসন করছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। যারা ভারতবিদ্বেষী আছেÑ তারা বহুবার বলার চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে দেশ ভারতের হাতে চলে যাবে। তাদের এমন অর্বাচীন প্রলাপের মোক্ষম জবাব দিয়েছেন তিনি। শেখ হাসিনার পক্ষেই সম্ভব হয়েছে ২৫ বছর মেয়াদি ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি বাতিল করা। তার সময়েই বাস্তবায়িত হলো ৬৮ বছরের কষ্ট আর ৪১ বছরের প্রতীক্ষিত সীমান্ত চুক্তি। ভারতের মতো দেশের কাছ থেকে সীমান্ত চুক্তির বিল পাস করানো কতটা কূটনীতিক দূরদর্শিতার ফলÑ তা আজ আর কারও বুঝতে কষ্ট হ”েছ না। এমনকি মায়ানমার ও ভারতের কাছ থেকে সমুদ্রসীমা বিজয়ও বাংলাদেশের ভৌগোলিক ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে।
ছাত্র জীবনেও তিনি রাজনীতি করেছেন এবং ইডেন কলেজের ভিপি ছিলেন। তবু বলবো, শেখ হাসিনার সক্রিয় রাজনীতির বয়স মাত্র ৩৬ বছর। এই ৩৬ বছরে তিনি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ ১৯ বার মৃত্যু ঝুঁকিতে পতিত হয়েছেনÑ এতবার মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসা রাজনীতিক পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কমই আছে। এ বিষয়ে কেবল কিউবার বিপ্ল¬বী রাজনীতিক ফিডেল ক্যাস্ত্রোর সঙ্গেই তার তুলনা চলে। রাজনীতিতে পা দিয়েই তিনি গৃহে অন্তরীণ, কারানির্যাতন ভোগ, মিথ্যা মামলায় হয়রানিসহ বিচিত্র জুলুমের মুখোমুখি হন। তবু তার অপ্রতিরোধ্য গতি কেউ থামাতে পারেনি। বরং যারা তার গতিরোধ করতে চেয়েছে তারাই নিক্ষেপিত হয়েছে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে।
গণতন্ত্রের মানসকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষকে তিনি সাধ্যের চেয়েও বেশি কিছু দিয়েছেনÑ সীমাহীন প্রতিকূলতার মুখে পদ্মাসেতু নির্মাণ কাজ শুরু যোগাযোগ ব্যব¯’ার যুগান্তকারী উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি তারই সুযোগ্য নেতৃত্বের ফসল। উন্নয়নশীল বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এবং প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ধারায় পরিচালনার জন্য শেখ হাসিনা আজ সংবর্ধিত হওয়ার যোগ্য। বাংলাদেশকে শেখ হাসিনা দিয়েছেন অনেক কিছুইÑ কিš‘ বাংলাদেশ তাকে রক্তাক্ত-ক্ষত-বিক্ষত করা ছাড়া আর কিছুই দেয়নি। আজ বাংলাদেশের সামনে সময় এসেছে নির্ভীক এই দেশপ্রেমীকে যথার্থ মর্যাদায় শুভে”ছা জানানো।
সম্প্রতি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উত্তাল জন¯্রােত এসে আছড়ে পড়েছে বাংলাদেশে। লক্ষ লক্ষ নিরাশ্রয় রোহিঙ্গাদের মানবিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে নিরলসভাবে তিনি কাজ করে যা”েছন। রোহিঙ্গাদের পক্ষে বৈশ্বিক জনমত সৃষ্টির জন্য ছুটে যা”েছন একপ্রান্ত থেকে পৃথিবীর আরেক প্রান্তে। আজ আমরা তাকে চিনতে পারছি ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ বলে। তার নাম নোবেল শান্তি কমিটির কাছে প্রস্তাব করেছেন বিশ্ববিখ্যাত অধ্যাপক ও বিশেষজ্ঞগণ। মাদার অব হিউম্যানিটি শেখ হাসিনা এবার শান্তিতে নোবেল পেয়ে বাংলাদেশ ও বাঙালির মুখ উজ্জ্বল করবেনÑ এই উ”চাকাক্সক্ষা মনে-প্রাণে লালন করি। তার সত্তরতম জন্মদিনে দীর্ঘায়ু, সু¯’-স্বাভাবিক জীবন প্রত্যাশা করছি।
২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

শেখ মুজিব : মৃত্যুঞ্জয় ছায়াবৃক্ষ

বাংলার উর্বর মাটিতে যুগে যুগে অসংখ্য কীর্তিমানের আবির্ভাব ঘটেছে। এই সব প্রাতঃস্মরণীয় কীর্তিমানদের নিয়ে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন কবি, কথাশিল্পী ও গবেষক রচনা করেছেন বিষয় বৈচিত্র্যে ভরপুর অসংখ্য গ্রন্থ। বাংলার আপসহীন নেতা, বাঙালিশ্রেষ্ঠ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যত কবিতা, গল্প, গান, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও গবেষণাগ্রন্থ রচিত হয়েছে, অন্য কোনো বাঙালি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে এত কবিতা, গল্প, গান ও গবেষণাগ্রন্থ রচিত হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। আজও পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গ্রন্থ রচিত ও অনূদিত হচ্ছে। একজন বাঙালি হিসেবে এমন সংবাদ আমাদের জন্য অত্যন্ত অহংকারের বিষয়। ২০১২ সালে প্রকাশিত শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ২০১৭ সালে প্রকাশিত ‘কারাগারের রোজনামচা’ বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনের কিছু বলিষ্ঠ প্রতিচ্ছবি দীর্ঘকাল পর পাওয়া গেল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। তিনি কিংবদন্তি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। বাঙালির হাজার বছরের আশা-আকাক্সক্ষা, বেদনা, বিক্ষোভ ও আবহমান বাংলার ঐতিহ্যকে তিনি নিজের চেতনায় আত্মস্থ করেছেন। তাঁর কণ্ঠে বাঙালি জাতির সার্বিক মুক্তির আকাক্সক্ষা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সা¤্রাজ্যবাদ-বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূর্ত প্রতীক। তিনি বিশ্বশান্তি আন্দোলনের অন্যতম সেনানী এবং নিবেদিতপ্রাণ বঙ্গসন্তান। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। বাঙালির বিস্মৃতি জাতিসত্তাকে তিনি জাগ্রত করেছেন।
বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই পাকিস্তানের রাজনীতি অপেক্ষা পূর্ববাংলার মানুষের ঐতিহ্য ও অধিকার নিয়ে বেশি সচেতন ছিলেন। স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর মূল লক্ষ্য ছিল পূর্ব বাংলার মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্য তাদের ঐক্যবদ্ধ করা। তিনি এদেশের মানুষকে তাদের জাতিগত পরিচয় আমলে নিয়ে আসার কাজে অনুপ্রাণিত করেছেন। তার সমস্ত চিন্তা-ভাবনা ছিল এই বাংলার কৃষক, শ্রমিক, নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষ। বাঙালির স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে তিনি কখনো ক্ষমতায় যেতে চাননি। তিনি বারবার বলেছেন, এদেশের মানুষের মুক্তির জন্য তিনি রাজনীতি করেছেন, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয়, কিভাবে বঙ্গবন্ধু নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন, কিভাবে তিনি দীর্ঘ ২৩ বছর আন্দোলন সংগ্রাম করে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেনÑ সেই ইতিহাসই মূলত বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাস।
মানব সভ্যতা বিকাশের ধাপে ধাপে বিভিন্ন দার্শনিক ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব অসংখ্য মতবাদ প্রচার করেছেন। সেই সব মতবাদ কোনো কোনো যুগে প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়। অভিজাততন্ত্র, ধনতন্ত্র, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রÑ এমন অসংখ্য রাজনৈতিক মতবাদ পৃথিবীতে দাপটের সঙ্গে টিকে ছিল। আজ এগুলোর বেশিরভাগই মৃত। মার্কসবাদ, লেলিনবাদ, মাওবাদও আজ ক্ষয়িষ্ণুতার পথে। বঙ্গবন্ধু এসব মতবাদে না জড়িয়ে এক অভিনব শাসন পদ্ধতির পক্ষে ছিলেন, তার পছন্দের রাজনেতিক পদ্ধতির নাম হলোÑ ‘শোষিতের গণতন্ত্র’। এ জন্য তিনি বলেছিলেনÑ ‘আজ দুনিয়া দু’ভাগে বিভক্তÑ শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের দলে।’
বঙ্গবন্ধুর ভাবনা জুড়ে ছিল হাজার বছরের বাংলাদেশ। তার সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখার ইতিহাস কেবল পাকিস্তান আমলে অন্যায়-অবিচারের আন্দোলনের যুগের নয়, তারও আগের। আশৈশব সংগ্রামী ভূমিকায় বাংলার স্বার্থের প্রশ্নে তিনি কোথাও কখনো আপস করেননি। কোনো চাপের কাছে মাথা নত করেননি। এ কারণেই তাকে বারবার কারাবন্দি হতে হয়। এ কারণেই তাকে ৬-দফা আন্দোলন পরবর্তীকালে দেশের মাটিতে আগরতলা মামলার আসামি হিসেবে এবং ১৯৭১ সালের মুক্তি সংগ্রামকালে পাকিস্তানে দুঃসহ বন্দি জীবনযাপন করতে হয়।
পৃথিবীর অনেক জাতির ইতিহাসের সঙ্গেই যুক্ত হয়ে আছে কিছু ঐতিহাসিক ভাষণের স্মৃতি। এই ভাষণগুলো সেই সব দেশের নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষকে শুনিয়েছিল মুক্তির বাণী। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণও তেমনি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। জ্যাকব এফ. ফিল্ড সম্পদিত ‘The Speeches that inspired history’ গ্রন্থে খ্রিস্টপুর্ব ৪৩১ অব্দ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর ৪১টি ঐতিহাসিক ভাষণ সংকলন করেন। এই গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সারের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণও সংকলন করা হয়। যার শিরোনাম হলোÑ ‘The struggle this time is the struggle for independence’, যা বাঙালি জাতির জন্যও অত্যন্ত গৌরবের বিষয়।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে অনেকগুলো নির্দেশনা ছিল, যেগুলো মুক্তিযুদ্ধের সময় দারুন প্রভাব বিস্তার করেছিল গণমানুষের চেতনায়। এই ভাষণে উজ্জীবিত হয়েই বাংলার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়, একদিকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী হাজার হাজার নিরীহ মানুষ গুলি করে হত্যা করেছে, অপরদিকে বাঙারির মৃত্যুঞ্জয় নেতা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে শান্তিপূর্ণভাবে অসম সাহসে গুলির মুখে বুক পেতে দিয়েছে এবং আন্দোলন করেছে। পাকিস্তানি সরকারের নির্দেশ অমান্য করে কারফিউ ভেঙেছে বাংলার জনগণ। মরণকে উপেক্ষা করতে বঙ্গবন্ধুর যে বাণী তাদের সাহস যুগিয়ে ছিল তাহলো এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বিশাল বটবৃক্ষের মতো। একটি বটবৃক্ষের অনেক শাখা-প্রশাখা থাকে। সেই শাখা-প্রশাখার ভেতর থেকে জন্ম নেয় শত শত ঝুরি। সেই ঝুরিগুলো মাটির সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করে বটবৃক্ষকে শক্তিদান করে। বটবৃক্ষের শাখায় এসে নানারকম পশুপাখি আশ্রয় নেয়, তারা বটবৃক্ষের ফুল-ফল খায়। বিষ্টা ত্যাগ করে। আবার বৃষ্টি হলে সবকিছু ধুয়ে সাফ হয়ে যায়। বিরাট বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা কেটে নিলে কিছু সময়ের জন্য হয়তো সেই বৃক্ষের কিছুটা ক্ষতি হয়, কিন্তু আবার ঠিকই সেই বৃক্ষ আকাশে মাথা তুলে দাঁড়ায়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ঘাতকরা ভেবেছিল বঙ্গবন্ধুর নাম পৃথিবীর বুক থেকে মুছে দিবে। কিন্তু ঘাতকদের সবচক্রান্ত ব্যর্থ করে দেয় শেখ মুজিবের মানবতাবাদী আদর্শ। বঙ্গবন্ধুকে শারীরিকভাবে হত্যা করা গেলেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে হত্যা করা যায় না। বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে যারা চিরতরে মুছে দিতে চেয়েছে তারাই বাংলার বুক থেকে মুছে গেছে অথবা ঘৃণ্য ব্যক্তি হয়ে ইতিহাসে কোনোভাবে টিকে আছে।
বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ভাষণে বাংলার মানুষকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তা ঘাট, যা যা আছে সবকিছুইÑ আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর এই অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন। আজ দেশ এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। অনুন্নত জীবন ব্যবস্থা থেকে বাংলার জনগণ শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে উন্নত জীবন ব্যবস্থার দিকে। আজ আবার আওয়ামী লীগের বিজয়রথ সচল রাখার জন্য পাড়ায়, মহল্লায়, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ার সময় এসেছে। যদি বাংলার মানুষ তাদের জীবনে সুখ চায়, স্বস্তি চায়, সার্বিক নিরাপত্তা চায়, তাহলে অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া আওয়ামী লীগের পক্ষেই তাঁদের অবস্থান নিতে হবে।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শচ্যুত হলে এদেশ আবার চলে যাবে পাকিস্তানি ভাবধারায়। পাকিস্তান আমলে এবং বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে দীর্ঘ ২১ বছর এদেশে যারা ক্ষমতায় ছিল তারা কেউই বাংলাদেশের মঙ্গল চায়নি। তারা বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে, তারা বাংলাদেশে জন্ম দিতে চেয়েছে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা। খুনিদের তারা পুরস্কৃত করে ন্যায় বিচারকে দেখিয়েছে বৃদ্ধাঙ্গলি।
বাঙালির জন্য বঙ্গবন্ধুর অন্তরে কত ভালোবাসা ছিল তা পরিমাপ করা অসম্ভব। বঙ্গবন্ধু যখন বাংলার জনগণকে যা যা বলেছেন, বাংলার জনগণ তাই অকপটে মেনে নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে এদেশের মানুষ বিশ্বাস করেছেন। আজ এদেশের মানুষের উচিত বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে মনে প্রাণে আঁকড়ে ধরা। বাংলার মানুষ যদি শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শকে ভুলে গিয়ে অন্য কোনো মত ও পথকে আলিঙ্গন করতে চায়Ñ তাহলে তারা শুধু প্রতারিতই হবে না, নিজেরাই নিজেদের কবর রচনা করবে।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেনÑ ‘সাত কোটি বাঙালির ভালোবাসার কাঙাল আমি। আমি সব হারাতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারবো না। বাঙালির ভালোবাসার ঋণ বুকের রক্ত দিয়ে শোধ করবো ইনশাল্লাহ।’ বঙ্গবন্ধু তার কথা রেখেছেন। এখন বাংলাদেশের মানুষের ঋণ শোধ করার পালা, যারা বাংলাদেশকে পিছনে নিয়ে যেতে চায়, যারা বাংলাদেশে হত্যার রাজনীতি কায়েম করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে অবিরাম লড়াই করে সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ের মাধ্যমেই সম্ভব বঙ্গবন্ধুর বুকের রক্তের ঋণ শোধ করা।
বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়ার সীমাহীন স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন তিনি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। পঁচাত্তরের ঘাতকচক্র তার সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে খান খান করে দেয়। তবুও পিতার স্বপ্ন সফল করার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে অপরাজেয় নেত্রী শেখ হাসিনা।
১৯৭১ সালের ১১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু তার এক ভাষণে বলেছিলেনÑ ‘এটা প্রমাণিত হয়েছে যে আমি এবং আমার দলই বাংলাদেশের একমাত্র মুখপাত্র।’ বঙ্গবন্ধুর এই কথা আজো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সত্য। মুজিব আদর্শ এবং আওয়ামী লীগÑ এ দুটোই বাংলাদেশের দিশাহীন মানুষকে বারবার দিশা দিয়েছে। এ দুটোর কারণেই এখনো এগিয়ে যাচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ দ্বিমুখী শত্রু কবলিত দেশ। এদেশের ভেতরে যেমন এদেশের শত্রু আছে, তেমনি বহির্বিশ্বেও আছে বাংলাদেশের অগণিত শত্রু। ঘরের ও বাইরের শত্রুদের মোকাবিলা করা নিশ্চয়ই কোনো সহজ কাজ নয়। এসব শত্রুকে উপেক্ষা করেই এগিয়ে যেতে হবে বাংলাদেশের মানুষকে।
ধ্রুবতারা যেমন কূলহীন সমুদ্রে দিকভ্রান্ত নাবিককে পথের সন্ধান দেয়, তেমনি মুজিব আদর্শও বাঙালির জন্য ধ্রুবতারাতুল্য। যতদিন পর্যন্ত বাঙালির হৃদয়ে শেখ মুজিব ও মুজিব আদর্শ অটুট থাকবে, ততদিন পথভ্রষ্ট হবে না বাংলাদেশ।
বাংলার আকাশে বারবার কালো মেঘের ঘনঘটা হয়েছে। ঝড়ো হাওয়ায় অসংখ্যবার ছিন্নভিন্ন হয়েছে নৌকার পাল, সকল কালে, সকল ঝড়ের আঘাত সহ্য করে তরতর করে এগিয়ে গেছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নতরী। আগামী দিনেও বাংলার সংগ্রামী জনতা বঙ্গবন্ধু নামক ছায়াবৃক্ষের তলে আশ্রয় নিবেÑ এমনটাই প্রত্যাশা।
১২ আগস্ট, ২০১৭

পুঁজিবাদ ক্যান্সার-আক্রান্ত হয়ে পড়েছে

বর্তমান পৃথিবী হিংসা, দ্বন্দ্ব, যুদ্ধ ও স্বার্থপরতায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। তাই দেশে-দেশে ও মানুষে-মানুষে মারামারি, কাটাকাটি, রক্তপাত লেগেই আছে। মানুষের জন্য যা ক্ষতিকর সেসব করা মানুষের উচিত নয়। তবু মানুষ অর্থের মোহে অন্ধ হয়ে বা ক্ষমতার অপব্যবহার করতে এমন কিছু আবেগী সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে, যা সভ্যতার জন্য কলঙ্ক তিলক হয়ে থাকে। যুদ্ধ পৃথিবীতে কেউ চায় না, তবু আজ পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আছে। এই ভয়াবহ যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে আজ মানুষ মুক্তি চায়, চায় সার্বিক শান্তি। কিন্তু শান্তির পথে না হেঁটে মানুষ যদি অস্ত্রের পথে হাটে ও অস্ত্রের ভাষায় কথা বলে, তাহলে রক্ত¯্রােত বন্ধ হবে না, বন্ধ হবে না ঘরে ঘরে নর-নারী ও শিশুর ক্রন্দন।
পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যত রকমের শোষণ দেখা গেছে তার মূলে ছিল অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তার। অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করতে না পারলে পৃথিবীতে মোড়লগিরি করা যায় না, দাপটের সঙ্গে চলাফেরা করা যায় না, তাই নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর বারবার জোর দিয়েছে মানুষ। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য যা কিছু করার দরকার, কোনো কোনো রাষ্ট্র এখন সেসব কিছুই করছে।
বলতে দ্বিধা নেইÑ পুঁজিবাদ পৃথিবীকে এখন মরণ কামড় বসিয়ে চলছে। যারা বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছেন বা বিশ্ব রাজনীতি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করছেন, তারা নিশ্চয়ই টের পাচ্ছেন পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে এখন ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে। এই ক্যান্সার পরিস্থিতি চিকিৎসার বাইরে চলে গেছে। এখন যত দিন যাবে ততই পুঁজিবাদ দুর্বল হয়ে পড়বে, শক্তি কমে আসবে তার অসুর শরীরে। এক তরফা দাপট দেখিয়ে পৃথিবীকে বহুদিন শাসন করেছে পুঁজিবাদী প্রভুরা। পুঁজিবাদ যেভাবে পৃথিবীতে অনাচার-অত্যাচার ও মানবিকতার পতন ঘটিয়ে যাচ্ছে তাতে তার মৃত্যু ঘণ্টা বাজতে আর বেশি দেরি নেই।
দুর্নীতি সারা বিশ্বে এখন মহামারীর আকার ধারণ করেছে। এমন কোনো দেশ নেই, এমন কোনো সমাজ নেই সেই দেশে যেই সমাজে দুর্নীতি নেই। দুর্নীতির পেছনে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি ক্রিয়াশীল থাকে তার নাম ‘অর্থ’। অর্থ বানানোর জন্যই মানুষ দুর্নীতির খাতায় নাম লেখায়। আজ সুযোগ পেলেই মানুষ দুর্নীতি করার জন্য তৎপর হয়ে উঠছে। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে সবাই দু’হাতে টাকা কামানোর ফিকিরে ব্যস্ত। নির্বিচারে টাকা কামানোর বা সম্পদের পাহাড় গড়ার প্রবণতা সামাজিক সাম্য রক্ষার জন্য হুমকি স্বরূপ। পুঁজিবাদী বিশ্বে দুর্নীতি যত সীমাহীন হবে, পুঁজিবাদের মৃত্যু ততই নিকটে আসবে, এটাই পুঁজিবাদের নিয়তি।
গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বায়ন থিউরি পুঁজি বিকাশের জন্য উন্নত দেশের এক বিরাট ধাপ্পা। বিশ্বায়নের নামে এখন চলছে ছদ্ম-উপনিবেশবাদ। বলতে গেলে বিশ্বে এখন দুই রকম উপনিবেশবাদ কার্যকর আছেÑ এক. জোরপূর্বক ভূমি দখল, দুই. ভূমি দখল না করেও বাজার দখল। বিশ্বায়ন হলো সেই তত্ত্ব যেই তত্ত্বের বলে ভূমি দখল না করেও বাজার দখল করতে সক্ষম হয়েছে ধনী ও শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো। বিশ্বায়নকে পজেটিভ অর্থেই প্রথম সারাবিশ্বে প্রচার করা হয়। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই মোহভঙ্গ হয় সাধারণ মানুষের। তারা বুঝতে পারে বিশ্বায়ন মূলত গরিব দেশগুলোকে শোষণ করারই একটি অভিনব পদ্ধতি। এখন বিশ্বায়ন তত্ত্বের কুফল মানুষ বুঝতে পারছে, কিন্তু ততদিনে অনেক বেশি ফুলে-ফেঁপে উঠেছে সর্বনাশী পুঁজিবাদ।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো এখনও পৃথিবীতে অনেক কোম্পানি আছে, যারা ভিন্ন নামে ভিন্নভাবে দেশে দেশে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এদের নতুন নাম হয়েছে ‘মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি’। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির প্রধান কাজ কমিশন দিয়ে কাজ নেওয়া। এই কমিশনকে সহজ ভাষায় ‘ঘুষ’ও বলা যেতে পারে। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো এক টাকার পণ্য একশ টাকায় বেঁচতে চায়। এই জন্য যা যা করার দরকার পড়ে তারা তাই করে।
এই কোম্পানিগুলো এত পরিমাণ অবৈধ অর্থের মালিক যে ছোটোখাটো দেশের রাজনীতিতেও এরা প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা রাখে। এদের দৌরাত্ম্য দিনে দিনে বেড়েই চলছে। এভাবে যদি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির আধিপত্য বৃদ্ধি পায়Ñ তাহলে আবার ফিরে আসবে উপনিবেশের কাল। যেটা এখন আফ্রিকায় সূচনা হয়েছে। খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ আফ্রিকার উপরে পৃথিবীর শক্তিশালী দেশগুলো তাদের বিষদাঁত ফুটিয়ে কামড়ে ধরেছে। সম্প্রতি চীনও সেখানে ভাগ বসানোর জন্য সদলবলে ছুটে গেছে। আফ্রিকা যে নব্য উপনিবেশ হতে যাচ্ছে এটা মোটামুটি পরিষ্কার।
বিশ্ব আজ একটি মারাত্মক সংকটের ভিতর দিয়ে অতিক্রম করছে। এই সংকটের নাম আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদ। জঙ্গিবাদ জনজীবনে হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। গভীরভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে, জঙ্গিবাদের পেছনে রয়েছে পুঁজিবাদের গোপন অভিপ্রায়। কি সেই অভিপ্রায়? জঙ্গিবাদ সৃষ্টির পেছনে আছে রমরমা অস্ত্র ব্যবসা। মারণাস্ত্র ব্যবসা এখন সবচেয়ে লাভজনক খাত। এই খাতে ধনী দেশগুলো কোটি কোটি বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। দেশে দেশে সৃষ্টি করছে জঙ্গিগোষ্ঠী। আমরা যদি পেছনের ইতিহাস খেয়াল করি, তাহলে দেখবো পৃথিবীর বৃহৎ জঙ্গি সংগঠন ‘আল-কায়েদা’কে সৃষ্টি করেছিলো মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি।
আল-কায়েদার কাঁধে বন্দুক রেখে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদীরা আফগানিস্থানকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আফগানিস্থানের সমস্ত সম্পদ লুট করে নেয় মার্কিনিরা। এমন কি ইরাকে যে মার্কিন হামলা হলো টুইন টাওয়ার ধ্বংসের অজুহাত্ েসেই হামলার সঙ্গে আল-কয়েদার সংযোগ স্থাপন করে ইরাক দখল করে পুঁজিবাদী গোষ্ঠী। ‘আল-কায়েদার’ পতন হতে না হতেই পুঁজিবাদী মার্কিন গোষ্ঠী সৃষ্টি করে আরেক নতুন জঙ্গি গোষ্ঠী যারা ‘আইএস’ নামে খ্যাত। বিভিন্ন অনুসন্ধানে বের হয়ে আসছে ‘আইএস’ সৃষ্টির পেছনে মার্কিনিদের হাত রয়েছে। আইএস বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনেছে আমেরিকার নিকট থেকে, ইরাক-সিরিয়া-মিশরসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আইএস একটি শক্তিশালী জঙ্গি সংগঠন। আইএস এখন কিছুটা দুর্বল হয়ে গেছে। তাদেরকে দুর্বল করার ক্ষেত্রে আমেরিকার ভূমিকার পাশাপাশি রাশিয়ারও হাত রয়েছে।
সা¤্রাজ্যবাদী আমেরিকা বুঝে ফেলেছে আইএস দিয়ে তারা যা করতে চেয়েছিল তাদের সেই উদ্দেশ্য সফল হয়ে গেছে। এখন আর আইএস দরকার নেই। তাই যেই আইএস দানব তারা নিজের হাতে সৃষ্টি করেছিল সেই আইএসকে এখন তারা নিজেরাই ধ্বংস করে ফেলছে। আইএস’র পতন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আইএস’র পর এখন আবার কোন্ জঙ্গিগোষ্ঠী তৈরি হয় সেটাই দেখার বিষয়। অনেকেই আশঙ্কা করছেনÑ পৃথিবীতে খুব শীঘ্রই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধবে। এমনটি ভাবার কোনো কারণ আপাতত আছে বলে মনে হয় না। তবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয় দেখিয়ে ছোট ছোট দেশগুলোকে অস্ত্র-শস্ত্র কিনতে বাধ্য করবে অস্ত্র উৎপাদনকারী দেশগুলো। ইতোমধ্যে বেশকিছু দেশে অস্ত্র বিক্রি করার জন্য তোড়জোর শুরু করেছে আমেরিকা। আমেরিকার অর্থনীতি এখন ধুকতে শুরু করেছে, অস্ত্র ব্যবসা ও যুদ্ধ ব্যয় সামলাতে গিয়েই তাদের অর্থনীতি সংকটের মুখে পড়েছে। আমেরিকা এখন অর্থের জন্য পাগল হয়ে গেছে। তাদের এই পাগলামি পৃথিবীকে কোথায় নিয়ে যায় তা বলা মুশকিল।
মানুষের মধ্যে একটা প্রবণতা আছে যেটা হলো কেউই ঠকতে চায় না। সবাই জিততে চায়, নিজেকে অন্য মানুষের চেয়ে শক্তিশালী দেখতে চায়। আজ যদি আমরা উত্তর কোরিয়ার দিকে তাকাই, তাহলেই এই কথাটার সত্যতা বুঝতে পারি। গরিব দেশ উত্তর কোরিয়া বুঝে ফেলেছে পুঁজিপতি হতে হলে শক্তি প্রদর্শনের বিকল্প আর কিছু নেইÑ তারা এখন আমেরিকাকে হুমকি দিচ্ছে। উত্তর কোরিয়ার হুমকিতে আমেরিকা যে মোটেই ভয় পাচ্ছে না এ কথা বলার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।
আমার এক বন্ধু একটা কথা বলতোÑ ‘জব্বারের মাথায় বল দুইদিকে গোলকিপার সাবধান।’ পৃথিবীর দেশে দেশে এখন পাগল ধনীপতিরা রাষ্ট্রনায়ক হয়ে বসে আছে। এরা কখন কোন অঘটন ঘটায় তা কেউ বলতে পারে না। উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জন থেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্র্যাম্প প্রত্যেকেই শক্তি প্রদর্শনে ব্যস্ত। এই শক্তি প্রদর্শন পুঁজিবাদের কবর খুড়ছে বলেই আপাতত মনে হচ্ছে।
বিশ্ববাসী বিগত দিনে অনেক যুদ্ধ দেখেছে। মানুষ আর যুদ্ধ দেখতে চায় না। মানুষকে যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য পৃথিবীর সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, এই জন্য গণবিধ্বংসী মরণাস্ত্র উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। যেসব দেশের হাতে মারণাস্ত্র আছে সেসব দেশকেও বাধ্য করতে হবে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র ধ্বংস করার জন্য। পৃথিবীতে অস্ত্র ব্যবসা ও মাদক ব্যবসা সবচেয়ে লাভজনক হলেও এ দুটোকে বন্ধ করতে হবে। কেননা অস্ত্র ও মাদক বিক্রির জন্য দেশে দেশে ইচ্ছাকৃত সংকট সৃষ্টি করা হয়Ñ বাঁধিয়ে দেওয়া হয় যুদ্ধের মতো জীবন বিপন্ন পরিস্থিতি।
পুঁজিবাদীর সব ফন্দিই মানুষ এখন বুঝে ফেলেছে। মানুষকে বোকা বানিয়ে আর তাদের শোষণ করা যাবে না। পুঁজিবাদ এখন যদি সাবধান ও সংযমের পরিচয় না দেয়, তাহলে তার ধ্বংস অনিবার্য। মানুষের জীবন নিয়ে রক্তের হোলি খেলা বন্ধ না হলে মানুষই পুঁজিবাদের কবর রচনা করবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে যেই অস্ত্র বিক্রির জন্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো উন্মাদ হয়ে উঠেছে, সেই অস্ত্র আর কিছুদিন পরে তাদের দিকেই তাক করে ধরা হবে।
৩১ জুলাই, ২০১৭

  • 1
  • 2